নির্বাসন: আটলান্টিক মহাসাগরে কেপটাউন থেকে সাড়ে এগারো কিমি দূরে রবেন দ্বীপ। এখানেই কারারুদ্ধ ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা
দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়েস্টার্ন কেপের ছোট্ট এক দ্বীপ রবেন আইল্যান্ড। রাজধানী কেপটাউন থেকে সাড়ে এগারো কিলোমিটার দূরে এই দ্বীপেই নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্ঘ বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। এক-আধ বছর নয়, টানা আঠেরো বছর! তাঁর সাতাশ বছরের কারাবাসের মধ্যে আঠেরো বছরই কেটেছে এই রবেন আইল্যান্ডের কুখ্যাত কারাগারে।
সামুদ্রিক প্রাণী সিল প্রচুর পাওয়া যেত বলে, ‘সিল আইল্যান্ড’ নামেও পরিচিত এই দ্বীপ। কিন্তু রবেন-এর খ্যাতি তার কারাগারের জন্যই। আমাদের আন্দামান যেমন বিখ্যাত তার সেলুলার জেলের জন্য।
নামমাত্র জনবসতি। থাকার মধ্যে পরিত্যক্ত চুনাপাথরের খনি আর জেলখানা, সঙ্গে গির্জা, গোরস্থান! কেপটাউন থেকে দিনে তিন বার জাহাজ যাতায়াত করে পর্যটক নিয়ে। সাড়ে তিন ঘণ্টার সফর। পর্যটকদের বাসে করে দ্বীপ ঘুরিয়ে দেখিয়ে ফিরে যায় কেপটাউনে।
রবেন আইল্যান্ড আয়তনে ছোটই। লম্বায় সাড়ে তিন কিমি এবং চওড়ায় দু’কিমি। মোট ছ’কিমি ব্যাসার্ধ। আকৃতি ডিমের মতো। ভাঙনের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে খুব একটা উঁচু নয়। রাতে এই দ্বীপ যেন প্রেতভূমি! চার দিক শুনশান, জনমানবহীন, সাগরের ঢেউ ছুঁয়ে শনশন বাতাসের শব্দ। জ্যোৎস্নার আলোয় রাতে আটলান্টিকের ঘন নীল জলে চাঁদের আলোর মায়া মনকে উদাসী করে দেয়। কিন্তু অমাবস্যার রাতে এই দ্বীপ যেন আঁধারপুরী!
এখানেই বন্দি ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। বর্ণবিদ্বেষের অবসান এবং মানবাধিকার অর্জনের অক্লান্ত যোদ্ধা! ১৯৬৪ থেকে ১৯৮২, আঠেরো বছর ধরে রবেন আইল্যান্ড কারাগারের আট বাই সাত-এর সঙ্কীর্ণ কুঠুরিই ছিল ম্যান্ডেলার স্থায়ী ঠিকানা। ১৯৬৪ সালে ম্যান্ডেলা ছিলেন ৪৬৬ নম্বর বন্দি। আঠেরো বছর ধরে তাঁর কোড ছিল ৪৬৬/৬৪। আজও ‘প্রিজ়নার ৪৬৬৬৪’ সংখ্যাটি গভীর শ্র্দ্ধায় তাঁর সঙ্গে জুড়ে আছে। বাকি ন’বছরে কখনও তিনি ছিলেন কুখ্যাত পলসমুর জেলে, কখনও বা ভিক্টর ভারস্টার কারাগারে।
ছোট্ট কুঠুরিতে শয্যা বলতে ছিল খড়ের মাদুর। সারা দিন চলত হাড়ভাঙা পরিশ্রম। দিনে তেরো ঘণ্টা শ্রম দিতে হত। কখনও পাথর ভেঙে, জঙ্গল সাফ করে রাস্তা নির্মাণে, কখনও চুনাপাথরের খনিতে। খনিতে কাজ করতে করতে ম্যান্ডেলার দৃষ্টিশক্তি খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ কর্তৃপক্ষ তাঁকে রোদচশমা ব্যবহার করতে দেয়নি।
প্রথম দিকে ম্যান্ডেলাকে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ‘ডি’-শ্রেণির বন্দির তকমা দিয়েছিল। ছ’মাসে একটা চিঠি আর এক জন মাত্র ভিজ়িটরের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি ছিল। কারণ ১৯৬২ সালে রিভোনিয়া ট্রায়ালের রায়ে, নেলসন ম্যান্ডেলাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। বহু লড়াইয়ের পর তাঁকে ‘এ’-শ্রেণির বন্দির মর্যাদা দেওয়া হয়।
এমনকি ১৯৬৮ সালে তাঁর মায়ের মৃত্যু এবং বড় ছেলের গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর তাঁকে তাঁদের শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়নি।
নেলসন ম্যান্ডেলা জেল থেকে মুক্তি পান ১৯৯০ সালে। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৯ সালে গ্রহণ করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। পরবর্তী সময়ে ম্যান্ডেলা দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। মানবাধিকার আর নেলসন ম্যান্ডেলার নাম ক্রমশ সমার্থক হয়ে ওঠে।
জেলে থাকাকালীন ম্যান্ডেলা স্থানীয় আফ্রিকান ভাষা শেখেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে আইনের উচ্চতর পাঠ নেন, বই লেখেন— ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’। কারাবাসে লেখা এই আত্মজীবনী প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। প্রকাশ করে লিটল ব্রাউন অ্যান্ড কোম্পানি। এই বইতেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর কৈশোর, যৌবন, শিক্ষাপর্ব এবং সাতাশ বছরের বন্দিজীবনের কথা।
২০১৩ সালে ম্যান্ডেলা বিবিসি-র অনুরোধে রবেনে তাঁর কারাকক্ষটি পরিদর্শনে যান। সেখানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ম্যান্ডেলা বলেন, রবেন আইল্যান্ডের কারাজীবন তাঁকে অন্য এক মানুষে রূপান্তরিত করেছে, নিজেকে তিনি পুনরাবিষ্কার করেছেন।
রবেন আইল্যান্ডে নির্বাসনের ইতিহাস নতুন নয়। চারশো বছরের পুরনো। সপ্তদশ শতকের ধারা বজায় রেখে বিভিন্ন সময়ে রবেন দ্বীপকে নির্বাসনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। সব সময় অপরাধীও নয়, কখনও কুষ্ঠরোগীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য ব্যবহৃত হত রবেন দ্বীপ। রাষ্ট্রদ্রোহীদের নির্বাসিত করে কঠোরতম শাস্তি দেওয়ার জন্য রবেন আইল্যান্ড ছিল শাসকের চোখে আদর্শ। ১৯৬১ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার রাজনৈতিক বন্দি এবং সাজাপ্রাপ্তদের নির্বাসনের জন্য রবেনকে নির্দিষ্ট করে।
নামিবিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও এখানে পাঠানো হত। নামিবিয়ার পিপলস লিবারেশন আর্মির কম্যান্ডার ছিলেন জন ইয়া ওটো নানকুধু। তিনি ইজিপ্ট আর তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তানজ়ানিয়াতে গেরিলা প্রশিক্ষণ শিবিরও শুরু করেন। ধরা পড়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়ে িনর্বাসিত করেছিল এই রবেনে। ১৯৮৫ সালে তিনি মুক্তি পান।
নামিবিয়ার আর এক নামী বিপ্লবী ইয়া টোইভো ১৯৬৬ সালে ধরা পড়েন। সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় তাঁর ঠিকানা হয় এই রবেন। তাঁর স্বাধীনতার স্পৃহা ছিল অদম্য। ১৯৮৪ সালে মুক্তি পেয়ে পরবর্তী কালে তিনি স্বাধীন নামিবিয়ার খনি, শক্তি ও কারা দফতরের মন্ত্রী হন।
কেপটাউনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালফ্রেড ওয়াটারফ্রন্ট থেকে পর্যটকদের নিয়ে জাহাজ ছাড়ে দিনে তিন বার। সফরে ঘুরিয়ে দেখানো হয় গোটা দ্বীপ— জেলখানা, নেলসন ম্যান্ডেলার সেল, পরিত্যক্ত চুনাপাথরের খনি, গোরস্থান, গির্জা, স্কুল, নৌ-ঘাঁটি, বাঙ্কার। সঙ্গে থাকেন গাইডও।
তবে কারাগার দেখানোর গাইড স্বতন্ত্র। এঁরা বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন। এই গাইডেরা এক সময় রাজনৈতিক বন্দি ছিলেন। আমাদের সঙ্গে ছিলেন মি. সিফো। ষাটের কিছু বেশি বয়স। বেশ শক্তপোক্ত গড়ন। সব দেখার পর সবার সঙ্গে পরিচয় করলেন। আমাদের বললেন, ‘‘আপনারা মহাত্মা গাঁধীর দেশের!’’ দু’হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন। আমরাও তাঁর উদ্দেশে প্রতিনমস্কার জানালাম।
নেলসন ম্যান্ডেলা যে সেলে বন্দি ছিলেন, সেই সেল দেখলাম। খুবই ছোট। দেশ-বিদেশের লোক ছুটে আসেন এই দ্বীপ আর কারাগার দেখার টানে। এখানে এলে, ম্যান্ডেলার আপসহীন সংগ্রামের ইতিহাস জানলে শ্রদ্ধায় মাথা আপনিই নত হয়ে আসে!
তবে যারা আন্দামানের সেলুলার জেল দেখেছেন, তাঁদের মনে হতে পারে, রবেন কারাগার সেলুলার জেলের চেয়ে অনেক কম ভয়াবহ। কিন্তু রবেনের তাৎপর্য অন্যত্র। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা-সহ দেশ-বিদেশের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি মানবাধিকার সংগ্রামের এই তীর্থস্থান পরিদর্শন করে গিয়েছেন। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এবং দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার রবেন দ্বীপকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের শিরোপা দিয়েছে।
রবেন দ্বীপ নির্জন হলেও প্রাণিশূন্য নয়। মানুষ সে ভাবে না থাকলেও এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা বেশ কয়েকটি প্রাচীন কচ্ছপ আর পেঙ্গুইন। যে সময়ই যান না কেন, ওরা আপনাকে স্বাগত জানাবেই! আর আছে ঝাঁকে ঝাঁকে সিগাল। তারা মানুষকে ভয় পায় না, বরং খাবারের প্রত্যাশায় কাছে-কাছে ঘোরে। মনের আনন্দে ভয়ডরহীন হয়ে উড়ে বেড়ায় ওরা! তাদের অবাধ সমুদ্র, উন্মুক্ত আকাশ আর বিস্তীর্ণ বালুতটের কোথাও কারাগার নেই যে!