জেমস বন্ড-রূপী শন কোনরি
দিন কয়েক আগের কথা। ২০ মার্চ। বসন্তের রোদে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। লন্ডনের রুশ দূতাবাস থেকে কয়েকটা গাড়ি রওনা দিল স্টানস্টেড বিমানবন্দরের দিকে। সঙ্গে একটা বাস, জানলাগুলো কালো কাচের। ভিতরে ৮০ জন রুশ নাগরিক। তাঁদের মধ্যে ২৩ জন আবার কূটনীতিক। সঙ্গে তাঁদের পরিবার— স্ত্রী, ছেলেমেয়ে। ব্রিটেন এঁদের সবাইকে বহিষ্কার করেছে। আনা হয়েছে ভয়ংকর অভিযোগ— প্রাক্তন রুশ এজেন্ট, বছর ছেষট্টির সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ে, তেত্রিশ বছর বয়সি উলিয়াকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছেন তাঁরা। ২৩ জন কূটনীতিকই নাকি গুপ্তচর বিভাগের আধিকারিক! এক সপ্তাহ আগে থেকেই নাকি ওঁরা কাগজপত্র ছিঁড়ে কুটিকুটি করছিলেন, বাক্সপ্যাঁটরা গোছাচ্ছিলেন। কেনসিংটন প্যালেস গার্ডেনস-এর ছায়া-ঘেরা দূতাবাস-চত্বর থেকে ঝটিতি উধাও হয়ে যাওয়ার ফন্দি।
অতঃপর? লন্ডন থেকে ২৩ জন রুশ আধিকারিককে বহিষ্কারের বদলা নিতে দেরি করেনি মস্কোও। সমসংখ্যক ব্রিটিশ আধিকারিককে সপরিবার দেশে ফেরত পাঠায় রুশ সরকার। দু’দেশের মধ্যে ফিরে আসে ঠান্ডা যুদ্ধের স্মৃতি।
ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার গুপ্তচরদের কাহিনি পাঠকদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছে দীর্ঘ কয়েক দশক। ১৯৭৪ সালে জন ল্য কারে লিখেছিলেন ‘টিংকার টেলর সোলজার স্পাই’। কেমব্রিজের চার গুপ্তচর— কিম ফিলবি, ডোনাল্ড ডুয়ার্ট ম্যাকলিন, গাই বার্জেস আর অ্যান্টনি ব্লান্ট— ছিলেন সেই উপন্যাসের চার রোমাঞ্চকর নায়ক। এঁরা সোভিয়েট ইউনিয়নকে তথ্য পাচার করতেন, সক্রিয় ছিলেন পঞ্চাশের দশক অবধি। একই বই থেকে বিবিসি মিনি সিরিজ বানিয়েছিল ১৯৭৯ সালে, আর মাত্র ক’বছর আগে, ২০১১-তে হলিউডে ওই কাহিনি নিয়েই তৈরি হয়েছে সিনেমা। ছিলেন গ্যারি ওল্ডম্যান, কলিন ফার্থ, টম হার্ডি, টোবি জোন্স, বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচের মতো বাঘা অভিনেতারা। চর-চক্রের অন্যতম মাথা কিম ফিলবি ছিলেন ডাবল এজেন্ট। কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে ব্রিটেন এবং সোভিয়েট ইউনিয়ন দুই দেশের হয়েই চরবৃত্তি করতেন। বিয়ে করেছিলেন এক রুশ মহিলাকে, জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন মস্কোর একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে। অনেক বই লেখা হয়েছে ওঁকে নিয়ে। গবেষকই হোন কি চিত্রনাট্য-লিখিয়ে, সবাই আজও ওঁর জীবন নিয়ে আবিষ্ট।
স্টিভেন স্পিলবার্গের ২০১৫-র হলিউড-ছবি ‘ব্রিজ অব স্পাইজ’ মনে আছে? ’৬২-র ১০ ফেব্রুয়ারির সকালে বার্লিনের গ্লিনিক ব্রিজে সোভিয়েট গুপ্তচর আর মার্কিন গুপ্তচর বদল হচ্ছে, দেখানো হয়েছিল সেখানে। সত্য ঘটনা। ১৯৬০-এ মার্কিন বায়ুসেনার পাইলট ফ্রান্সিস গ্যারি পাওয়ার্স-এর ‘ইউ-টু’ গুপ্তচর বিমানকে সোভিয়েট ইউনিয়নের আকাশে গুলি করে নামিয়ে দেওয়া হয়। ও দিকে মার্কিন মুলুকে বন্দি হয়ে ছিল এক রুশ কেজিবি চর, রুডল্ফ অ্যাবেল। ফ্রান্সিসকে বদল করা হয় রুডল্ফ-এর সঙ্গে। ‘দ্য ডে অব দ্য জ্যাকল’, ‘দি ওডেসা ফাইল’-এর মতো থ্রিলারের স্রষ্টা ফ্রেডেরিক ফরসাইথ এক বার বলেছিলেন, পাওয়ার্স ও অ্যাবেলের বদলের অল্প ক’দিন আগেই বার্লিনে আর এক গুপ্তচর-পালটাপালটির কাণ্ডে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। পূর্ব বার্লিনে তিনি তখন এক ছোকরা রিপোর্টার। সাংবাদিকতার সূত্রে চেনাজানাও কম নয়। ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা তাঁকে অল্প কিছু দিনের জন্য কাজেও লাগিয়েছিল।
বহুগামী ‘ডবল এজেন্ট’ নয়, জন ল্য কারে-এর ‘টিংকার টেলর সোলজার স্পাই’ বা ‘আ লিগ্যাসি অব স্পাইজ’-এর মোটাসোটা, টেকো এবং ভীমরতিগ্রস্ত বউয়ের হাতে নাস্তানাবুদ জর্জ স্মাইলিকে কে ভুলতে পারে? এগুলি সবই তার বহিরঙ্গ, ভিতরে ভিতরে সে ক্ষিপ্র ও তীক্ষ্ণধী। স্যর অ্যালেক গিনেস-এর অভিনয়ে সেই চরিত্র আজও উজ্জ্বল। কিংবা ল্য কারে-এর প্রথম সাড়া-জাগানো উপন্যাস অবলম্বনে, ঠান্ডা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রিচার্ড বার্টন অভিনীত ‘দ্য স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড’! রিচার্ড সেখানে ব্রিটিশ গুপ্তচর অ্যালেক রেমাস-এর চরিত্রে। জনসংস্কৃতিতে, স্মৃতিতে সাহিত্য, সিনেমার এই সব চরিত্র আজও উজ্জ্বল!
গুপ্তচর শুধু এ কালের সৃষ্টি নয়। রাজারাজড়ারা যত দিন আছেন এই দুনিয়ায়, তত দিন আছেন গুপ্তচরেরাও। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর নামকরা সব চরদের সৌজন্যে। ভগতরাম তলওয়ার— আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে নেতাজিকে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন ইতালির দূতাবাসে। পরে জানা যায়, এই ভগতরাম ছিলেন পাঁচ-পাঁচটা দেশের গুপ্তচর— ইতালি, জার্মানি, রাশিয়া, জাপান আর ব্রিটেনেরও। জেমস বন্ড-এর স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিং-এর দাদা পিটার ফ্লেমিং ১৯৪২-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ভারতে ব্রিটিশ গুপ্তচর দফতরের প্রধান ছিলেন। আর মাতা হারিকে কে না চেনে, দুনিয়া-কাঁপানো এক নারী গুপ্তচর! জন্মসূত্রে ডাচ, পেশায় নর্তকী, তাঁর আসল নাম মার্গারেটা ম্যাকলিয়ড। নাম নিয়েছিলেন মাতাহারি, যার অর্থ ‘ভোরের চোখ’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত মাতা হারিকে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল ফরাসি ফায়ারিং স্কোয়াড। কে-ই বা ভুলতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি-অধিকৃত প্যারিসে গোপনে চরবৃত্তি করা নুর ইনায়েত খানকে! কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। সাহসিকতার পুরস্কারস্বরূপ মরণোত্তর ‘জর্জ ক্রস’ পেয়েছিলেন।
সেও তো কবেকার কথা! তা বলে আজকের ইংল্যান্ডে, উইল্টশায়ারের ছোট্ট ছিমছাম শান্তির শহর সালিসবেরি-তে গুপ্তচর! সে ঘটনাই ঘটল গত মাসে। মার্চের প্রথম রবিবার। বিকেল চারটের খানিক পরেই দেখা গেল, শপিং সেন্টারের বাইরে পার্কের বেঞ্চিতে এলিয়ে পড়ে আছেন এক বৃদ্ধ ও এক তরুণী। দুজনেরই শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক। আধ ঘণ্টার মধ্যেই ঘটনাস্থলে এসে হাজির স্বাস্থ্যকর্মীরা। কেউই জানতেন না মুমূর্ষু দুজনের পরিচয়: বৃদ্ধ মানুষটি এক প্রাক্তন রুশ গুপ্তচর, তরুণীটি তাঁরই মেয়ে, আগের দিনই মস্কো থেকে এসেছেন বাবার কাছে। দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ল বেড়াল। দু’জনকেই প্রাণঘাতী কোনও নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে!
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ছবির মতো সুন্দর শহর সালিসবেরিকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন হলিউডের কোনও ছবির সেট। চারদিকে থিকথিক করছে পুলিশ আর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের দল। প্রথমেই তাঁরা পার্কের সেই বেঞ্চিটাকে একটা তাঁবুর মতো করে ঘিরে দিলেন। কাছেই ইতালিয়ান রেস্তরাঁ ‘জিজি’— স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ে সে দিন যেখানে দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন— সিল করে দিলেন। বেঞ্চিতে এলিয়ে পড়ার আগে ‘বিশপ’স মিল পাব’-এ গিয়েছিলেন বাবা আর মেয়ে, ঝাঁপ নামল সেখানেও। সালিসবেরিতে সের্গেই স্ক্রিপাল-এর চার-কামরার বাড়িও ফরেনসিক তাঁবু দিয়ে ঘিরে দেওয়া হল। স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ের উপর এমন সাংঘাতিক নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করা হয়েছিল যে জিজি রেস্তরাঁয় ওঁরা যে টেবিলে বসে খেয়েছিলেন সেটাকে নষ্ট করে ফেলা হল। যে এয়ার-অ্যাম্বুল্যান্সে করে ওঁদের হাসপাতালে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ধ্বংস করে ফেলা হল সেটাও। স্ক্রিপালদের সাহায্য করতে, বা ওঁদের এমনিই ওঁদের আশেপাশে গিয়েছিলেন, এমন প্রায় ৪০ জন মানুষকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠাতে হল। নিক বেইলি নামের যে পুলিশ অফিসারটি ৯৯৯ ইমার্জেন্সি নম্বরে আসা কলটা ধরেছিলেন আর পরে স্ক্রিপালদের সঙ্গে ছিলেন, গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকেও। কয়েক দিনের মধ্যেই জায়গাটা দখলে নিয়ে নেন প্রায় ১৮০ জন রয়্যাল মেরিন আর র্যাফ রেজিমেন্টের সেনা। স্ক্রিপালরা জিজি-তে বসে বা পরে পাব-এ খাওয়ার সময় আর যাঁরা সেখানে ছিলেন, তাঁদেরও প্রশাসন হরেক নির্দেশ দিল। বলা হল, সে দিন যে সব জামাকাপড় পরেছিলেন, সেগুলি যেন ভাল ভাবে ধুয়ে দেওয়া হয়। মুখবন্ধ ব্যাগে ভরে ড্রাইক্লিনিংয়ে পাঠানো হয়। গোটা সালিসবেরির মানুষ আতঙ্কে সিঁটিয়ে ছিলেন। পরের ক’দিন শপিং সেন্টারগুলো শুনশান, রেস্তরাঁগুলোকে লোক ডেকে ডেকে বলতে হচ্ছিল, খেতে আসুন, সব ঠিক আছে। যেন শুধু স্ক্রিপালদের নয়, বিষ দিয়ে হত্যার চেষ্টা হয়েছে শহরের সব বাসিন্দাদের!
প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে পার্লামেন্টে ঘোষণা করলেন, স্ক্রিপালদের উপরে নোভোচক নামের নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করা হয়েছে। মস্কোকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দেওয়া হল এই ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার, সঙ্গে হুঁশিয়ারি: নইলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এও বলা হল, ব্রিটিশ আধিকারিকরা মস্কোয় হতে-চলা বিশ্বকাপ বয়কট করবেন।
এত সব ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে আস্তে আস্তে স্ক্রিপাল-রহস্যের জটও খুলছিল। জানা গেল, ইনি এক জন প্রাক্তন সেনা অফিসার। আফগানিস্তানে ছিলেন, পরে রুশ সেনার গুপ্তচর সংস্থা জিআরইউ-তে যোগ দেন। কর্মসূত্রে মাদ্রিদে থাকার সময়ে স্পেনের গুপ্তচর আধিকারিকদের নজরে আসেন তিনি। তাঁদের মনে হয়েছিল, স্ক্রিপালকে ভাল সামলাতে পারবে বরং ব্রিটিশ গুপ্তচররা। তাঁরা ব্রিটিশ আধিকারিকদের সতর্ক করলেন এই রুশ গুপ্তচর সম্পর্কে। ১৯৯৫ সালের জুলাইয়ে ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা ‘এমআই-সিক্স’এর এক এজেন্ট যোগাযোগ করলেন স্ক্রিপাল-এর সঙ্গে। তখন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বরিস ইয়েলৎসিন। রুশ সরকারের অবস্থা বিশেষ ভাল না, সরকারের টাকাপয়সা বিশেষ নেই, যেটুকু আছে তাও সময়ে হাতে আসে না। ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী সেই সময়ে বহু রুশ গুপ্তচর অফিসার কিছু উপরি আয়ের সন্ধান করছিলেন। এমনকী পশ্চিমি গুপ্তচর সংস্থাগুলির হয়ে কাজ করতেও তাঁদের আপত্তি ছিল না। স্ক্রিপালও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর নয়া কোড নেম হল ‘ফোর্থউইথ’। অচিরেই পশ্চিমি এজেন্ট হিসেবে খুব নামও হল তাঁর। দশ বছর ধরে নগদ টাকা কামাচ্ছিলেন ভালই। পরিবর্তে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য। জিআরইউ-এর আস্ত টেলিফোন ডিরেক্টরিটাই নাকি তুলে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ আধিকারিকদের হাতে!
২০০০ সালে স্ক্রিপাল মস্কোয় ফিরে আসেন। কিন্তু স্পেনের মালাগায় যাতায়াত অব্যাহতই ছিল। এমআই-সিক্স সেখানে তাঁকে সম্পত্তি-টম্পত্তিও কিনে দিয়েছিল। এমআই-সিক্স’এর ‘হ্যান্ডলার’-এর সঙ্গে তাঁর দেখা হত এখানেই। প্রতি ট্রিপ-পিছু পাঁচ থেকে ছ’হাজার ডলারও জুটত। স্পেনেরই একটা ব্যাংকে সেই টাকা রাখতেন স্ক্রিপাল। ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা তাঁকে ব্রিটেনে নিয়ে আসেনি, দেখাসাক্ষাৎ, আলাপ-আলোচনা— সবই হত স্পেনে। ২০০৪ সালে তাঁর ডাবল এজেন্ট পরিচয় জানাজানি হয়ে যায়। স্ক্রিপাল গ্রেফতার হন। সে বছর স্পেনে একটা মিটিঙে আসতে ব্যর্থ হওয়ায় এমআই-সিক্স বুঝতে পারে যে ‘ফোর্থউইথ’-এর পরদা ফাঁস হয়ে গিয়েছে। স্ক্রিপালের ঠাঁই হয়েছিল রাশিয়ার এক কারাগারে।
কয়েক বছর পরেই ২০১০ সালে— সেই নাটকীয় ঘটনা! আমেরিকা আর রাশিয়া ঠিক করল, গুপ্তচর পালটাপালটি করবে। আমেরিকা দশ জন রুশ গুপ্তচরকে মুক্তি দিতে রাজি হল, বদলে রাশিয়ার হাতে বন্দি মার্কিন গুপ্তচরদেরও মুক্তি দিতে হবে। অতঃপর ভিয়েনা বিমানবন্দরের এক রানওয়েতে দুটো বিমান পাশাপাশি এসে দাঁড়াল। একটি রুশ, অন্যটি আমেরিকান। ওখানেই হল গুপ্তচর অদলবদল। মার্কিন বিমানটা ওয়াশিংটন উড়ে যাওয়ার পথে থামল ইংল্যান্ডের এক র্যাফ বেস-এ, সেখানে দু’জন গুপ্তচরকে নামানো হল। তাঁদেরই এক জন সের্গেই স্ক্রিপাল। অন্য জন, ইগর সুতিয়াগিন— অস্ত্রসুরক্ষায় সুদক্ষ, ভিতরে ভিতরে পশ্চিমি দেশগুলির হয়ে হয়ে কাজ করতেন।
অন্য দিকে যে দু’জন রুশ গুপ্তচর আমেরিকা উড়ে গেলেন, তাঁরা হলেন আলেকজান্দার জাপোরোঝ্স্কি আর জেনাদি ভাসিলেঙ্কো। প্রথম জন কেজিবি-র এক কর্নেল, ওঁর দেওয়া তথ্যে সিআইএ আর এফবিআই-এর ভেতরকার জনা কয়েক ‘গদ্দার’ ধরা পড়েছিল। জেনাদিও ছিলেন এক প্রাক্তন কেজিবি অফিসার। বিমানবন্দরে কিন্তু সবার নজর কেড়ে নিয়েছিলেন এক রুশ সুন্দরী। তিনিও এক গুপ্তচর, আনা চ্যাপম্যান। আমেরিকা মুক্তি দিয়েছিল তাঁকেও। আসল নাম আনা ভাসিলিয়েভনা কুশচেঙ্কো, রুশ কূটনীতিকের মেয়ে। বিয়ে করেছিলেন এক ব্রিটিশকে, সেই সূত্রেই জুটেছিল ব্রিটেনের নাগরিকত্বও। আমেরিকায় এফবিআই তাঁর পরিচয় ফাঁস করে দেয়, ম্যানহাটানের একটা কফি-শপে বসে রুশ সরকারের এক আধিকারিককে তথ্য পাচারের সময় গ্রেফতার হন আনা। অদলবদল-হওয়া দশ গুপ্তচরের মধ্যে সে দিন ছিলেন তিনিও। লোকে তাঁকে একটু বেশি জানত, প্রাক্তন স্বামী তাঁর বেশ কিছু ছবি মিডিয়ার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
দেশে ফেরার পর এই রুশ গুপ্তচরদের নায়কোচিত সম্মান দেওয়া হয়েছিল। ভ্লাদিমির পুতিন তাঁদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, সেই বৈঠকে দেশাত্মবোধক গানও হয়েছিল। আনা অচিরেই মস্কোর এক বিখ্যাত মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। পুতিনের বিবৃতিও খুব সাড়া ফেলেছিল: পশ্চিমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে যারা, তাদের খুঁজে বের করা হবে। ‘‘এই লোকগুলো তাদের বন্ধু, সহকর্মীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যে ক’টা পয়সার জন্য করেছে, ওই পয়সাই ওদের কাল হবে!’’
একই সময়ে ইংল্যান্ডে ঘটছিল অন্য ঘটনা। এমআই-ফাইভ আর এমআই-সিক্স’এর অফিসাররা স্ক্রিপালকে অনেক জেরা-টেরা করলেন। স্ক্রিপালকে একটা বাড়ি দেওয়া হল, পেনশনের ব্যবস্থা করা হল। সেই থেকেই তাঁর ঠিকানা সালিসবেরির নিরিবিলি এক গলি। বিএমডব্লিউ চেপে ঘুরতেন। সবাই জানত, বুড়ো লোকটা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে, এখন বসে বসে কম্পিউটারে গেম খেলে। কেউ যা জানত না, মাসে এক বার নিয়ম করে এই মানুষটাই একটা রেস্তরাঁয় তাঁর এমআই-সিক্স হ্যান্ডলারের কাছে হাজিরা দিতেন। স্ক্রিপাল তাঁর রুশ নামও পালটাননি। পড়শিদের বলতেন, তিনি রাশিয়ান আর্মিতে চাকরি করতেন। ইংল্যান্ডে তাঁর জীবন কিন্তু খুব নিশ্চিন্ত ছিল না। বছর ছয়েক আগে তাঁর স্ত্রী ক্যানসারে মারা যান। দু’বছর আগে মারা যান স্ক্রিপালের দাদা ভ্যালেরি, যিনি নিজেও এক সেনা আধিকারিক ছিলেন। এতেই শেষ নয়। লিভারের রোগে কাবু হয়ে গত বছর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে মারা যান ছেলে আলেকজান্দারও, মাত্র ৪৪ বছর বয়সে। ছেলের মৃতদেহ উড়িয়ে আনা হয়েছিল সালিসবেরিতে, মায়ের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। এই মৃত্যু নিয়েও জল্পনা চলছে। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর সমাধি ঘিরে রেখেছে ফরেনসিক টেন্ট দিয়ে। শোনা যাচ্ছে, প্রয়োজনে সমাধি খুঁড়ে মৃতদেহ বার করা হতে পারে।
বিষপ্রয়োগ, খুন— রুশদের কাছে নতুন কিছু নয়। ঠান্ডা যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, হাড়-হিম একটা ঘটনায় তোলপাড় হয়েছিল চারদিক। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডনের ওয়াটারলু ব্রিজে পাওয়া যায় বুলগেরিয়ার তদানীন্তন শাসকের প্রতি বিক্ষুব্ধ গিয়র্গি মার্কোভকে। বিষ দিয়ে খুন করা হয়েছিল তাঁকে। বিষাক্ত উপকরণটি অদ্ভুত, একটা ছাতা! বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় মার্কোভ তাঁর পায়ে তীক্ষ্ম কোনও জিনিসের খোঁচা টের পান। তিন দিন পর মৃত্যু হয় তাঁর। মার্কোভের চামড়ায় ১.৭ মিলিমিটার আকারের ছোট্ট একটা জিনিস বিঁধে ছিল, তার মধ্যে ছিল ‘রিসিন’ বিষ। মনে করা হয়, আততায়ী ছিল বুলগেরিয়ার সিক্রেট সার্ভিস-এর লোক। সে কাল বা এ কাল, মস্কো কোনও দিনই বিদ্রোহীদের ভাল চোখে দেখেনি। পুতিন বা তাঁর নীতির সমালোচক অন্তত ১৪ জন রুশ নাগরিক ও তাঁদের ব্রিটিশ সহযোগীদের সম্প্রতি মৃত্যু হয়েছে লন্ডনে। এই মৃত্যু নিয়েও সন্দেহ আছে।
বরিস বেরেজভস্কি-র কথাই ধরা যাক। নব্বইয়ের দশকে এই রুশ মানুষটি প্রভূত বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন। তীব্র সমালোচক ছিলেন পুতিনের, যিনি তখন কেজিবি-র প্রধান। ইয়েলৎসিন-এর সঙ্গে বেরেজভস্কি-র সুসম্পর্ক ছিল, শেষ দিকে ইয়েলৎসিন যখন অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রকোপে অসুস্থ, বেরেজভস্কি তাঁকে সামলে রাখতেন। ২০০৩-এ ব্রিটেন বেরেজভস্কিকে রাজনৈতির আশ্রয় দেয়। তাঁর অক্লান্ত পুতিন-বিরোধী প্রচার চলছিলই। লন্ডনে বসে তিনি ও তাঁর বন্ধু, প্রাক্তন কেজিবি আধিকারিক আলোকজান্দর লিতভিনেঙ্কো পুতিনকে একেবারে ধুইয়ে দিতেন।
‘স্মাইলি’স পিপল’ ছবিতে স্যর অ্যালেক গিনেস
২০০৬-এর নভেম্বর। লন্ডনের এক হোটেলের ঘরে লিতভিনেঙ্কোকে পাওয়া গেল মৃতপ্রায় অবস্থায়। জানা গেল, ওঁর চায়ের কাপে তেজস্ক্রিয় পোলোনিয়াম মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল! লন্ডনের মিলেনিয়াম হোটেলের নীচের তলায় এক বার-এ লিতভিনেঙ্কো তাঁর আততায়ী দু’জনকে দেখেওছিলেন। তাঁদেরই এক জন আন্দ্রেই লুগোভোই— কেজিবি-র অফিসার থেকে যিনি পরে ব্যবসায়ী হয়েছিলেন— এখন রাশিয়ার ‘স্টেট দুমা’-র (পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ) ডেপুটি। অন্য জন— দ্মিত্রি কোভতুন— লুগোভোইয়ের বন্ধু, সোভিয়েট সেনাপরিবারের ছেলে। প্রায় দশ বছর পর লিতভিনেঙ্কোর মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিটি গড়া হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল, এই হত্যার পিছনে সম্ভবত পুতিনের ব্যক্তিগত সম্মতি ছিল। লুগোভোই আর কোভতুনের গাড়ির সিটে, সুটকেসে, এমনকী প্লেনের মধ্যেও যে রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল, তাতে সন্দেহের তির সরাসরি ক্রেমলিনের দিকেই যায়। পুতিন অবশ্য সব অস্বীকার করেন। তদন্ত ও বিচারের জন্য দুই খুনিকে লন্ডনের হাতে তুলে দেননি, বলা বাহুল্য।
লিতভিনেঙ্কো-কাণ্ডের পরেও পেরিয়ে গিয়েছে সাত সাতটা বছর। ২০১৩-র মার্চে নির্বাসিত বিলিয়নেয়ার বরিস বেরেজভস্কি-কে পাওয়া গেল ঘরে, ঝুলন্ত অবস্থায়। দেখে মনে হয়েছিল আত্মহত্যা। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষটা একটা হাই-প্রোফাইল পুতিন-বিরোধী মিডিয়াযুদ্ধ চালাচ্ছিলেন। বেরেজভস্কির মৃত্যুও সন্দেহের ঊর্ধ্বে ছিল না। বেরেজভস্কির মৃতদেহের ময়নাতদন্ত যিনি করেছিলেন, হত্যার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি।
দ্য স্পাই হু কেম ইন ফ্রম দ্য কোল্ড’ ছবিতে রিচার্ড বার্টন
নাটকের শেষ নয় এখানেও। তেজস্ক্রিয়তা-বিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ পাঞ্চনার— লিতভিনেঙ্কোর শরীরে পোলোনিয়ামের মাত্রা মেপেছিলেন যিনি— ২০১৬ সালে ছুরির আঘাতে খুন হন। কী একটা কাজে রাশিয়া থেকে ফেরার মাস পাঁচেক পরেই!
মৃত্যু-তালিকা দীর্ঘ। সোভিয়েট-উত্তর রাশিয়ায় সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানির অন্যতম প্রধান ইউরি গোলুবেভ ছিলেন মিখাইল খোদোরকভস্কি-র উপদেষ্টা। মিখাইল পুতিনের কড়া সমালোচক, পুতিন-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে অর্থসাহায্যও করতেন। ২০০৭ সালে লন্ডনের ফ্ল্যাটে পাওয়া যায় গোলুবেভকে। আর্মচেয়ারে শায়িত, মৃত। ২০১২-র মার্চে নির্বাসিত রুশ ব্যাংকার জার্মান গর্বানৎসভ লন্ডনে একটা ট্যাক্সি থেকে নামার সময় কোনওক্রমে প্রাণে বাঁচেন। সাইলেন্সার লাগানো একটা পিস্তল থেকে চারটে গুলি করা হয়েছিল তাঁকে। আলেকজান্দর পেরেপিলিচনি নামের মস্ত রুশ ব্যবসায়ীটি ক্রেমলিনের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে ব্রিটেনে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ২০১২-র নভেম্বরে সারে-র ওয়েব্রিজে নিজের বাড়ির কাছেই সকালে জগিংয়ের সময় রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান আলেকজান্দর। মনে করা হয়, ওঁর মৃত্যুর কারণও নার্ভ এজেন্ট। জেলসেমিয়াম নামের বিষাক্ত গাছে যে রাসায়নিক থাকে, সেটিই পাওয়া গিয়েছিল ভদ্রলোকের পেটে! জগিং করতে করতে এলিয়ে পড়ার আগে বমি করেছিলেন, অদ্ভুত সবুজ-হলুদ রঙের বমি। সেই যে কোমায় চলে যান, আর ফেরেননি! তদন্তে জানা যায়, মৃত্যুর দিন তিনি জনপ্রিয় এক রুশ খাবার খেয়েছিলেন, যাতে সোরেল নামের একটা পাতা ছিল। মনে হয়, বিষ ছিল সেই খাবারে। তদন্ত এখনও চলছে।
কী করেছিলেন পেরেপিলিচনি? কিছু রুশ কেষ্টবিষ্টু ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড কর ফাঁকি দিয়েছে, সে কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। পুতিন-বিরোধী মিখাইল খোদরকভস্কির সঙ্গে যুক্ত আরো কয়েক জন মারা গিয়েছেন সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে। কারও প্লেন ভেঙে পড়েছে, কেউ পাঁচতলার ফ্ল্যাট, বা ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছেন।
ব্রিটিশ সাংসদ বব সিলি গবেষণা করেছেন রাশিয়ার যুদ্ধপ্রণালী নিয়ে। তাঁর মতে, বিষপ্রয়োগে হত্যা ক্রেমলিনের খুব প্রিয়। বব চার বছর সোভিয়েট ইউনিয়নে ছিলেন। জোর দিয়ে বলেছেন, প্রমাণ আছে যে রুশরা নতুন নতুন ‘টক্সিন’ তৈরি করে। এফএসবি-র (কেজিবি-র পরে এখন যেটি রুশ গুপ্তচর সংস্থা) একটি বিশেষ বিভাগই আছে যা এই নিয়ে কাজ করে থাকে। সের্গেই স্ক্রিপালের ক্ষেত্রে যে ‘নোভোচক’ প্রয়োগ করা হয়েছিল, রুশ ভাষায় তার অর্থ ‘নবাগত’। সত্তর, আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে বেশ কতকগুলো নার্ভ এজেন্ট তৈরি করা হয়, এ তারই একটি। ‘এ-২৩০’ নামের একটা রাসায়নিক আছে, যার প্রয়োগে আক্রান্ত মানুষটির মৃত্যু হবে কয়েক মিনিটেই!
মাতা হারি
স্ক্রিপাল আর তাঁর মেয়ে সালিসবেরি হাসপাতালে শুয়ে। ও দিকে ব্রিটেন আর রাশিয়ার মধ্যে যেন শৈত্যপ্রবাহ চলছে। ব্রিটেনে বসবাসকারী বিদ্রোহী রুশরা প্রাণভয়ে কাঁপছেন। অনেকেই খুনের হুমকিও পেয়েছেন। কারও কাছে বেনামা চিঠি এসেছে: ‘ওরা সের্গেইকেও মারতে এসেছিল, এ বার তোমার পালা।’ ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী বরিস জনসন পুতিনের আসন্ন ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের সঙ্গে তুলনা করেছেন হিটলারের ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক্স-এর। ব্রিটেনের রুশ দূতাবাস আবার সেই মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছে। যে রাশিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এত বড় ত্যাগ স্বীকার করল, নাৎসি সেনার বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়ে তাদের পরাস্ত করল, সেই রাশিয়ার নামে এই সব বলা! বাগ্যুদ্ধ চলছে। বাড়ছে স্নায়ুর চাপ। পুরোটাই ‘নার্ভ’-এর খেলা যে!
শিরোনাম নামাঙ্কন: প্রত্যয়ভাস্বর জানা