সেই ট্রাডিশন এখনও চলছে

নতুন বছরে প্রকাশকের ঘরে লেখকদের এন্তার খাওয়াদাওয়া আর এলাহি আড্ডা। ব্যবসার হিসেবনিকেশে নয়, বাঙালির বইপাড়া এ দিন ধরা দেয় আত্মীয়তার বাঁধনে। অময় দেব রায়নতুন বছরে প্রকাশকের ঘরে লেখকদের এন্তার খাওয়াদাওয়া আর এলাহি আড্ডা। ব্যবসার হিসেবনিকেশে নয়, বাঙালির বইপাড়া এ দিন ধরা দেয় আত্মীয়তার বাঁধনে। অময় দেব রায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

নক্ষত্রপুঞ্জ: আনন্দ পাবলিশার্স-এ নববর্ষে লেখকদের আড্ডা

সন ১৩৬৫। পয়লা বৈশাখ। ভোলানাথ পেপার হাউসে যুবক ভানুর সঙ্গে দাদাঠাকুরের হঠাৎ দেখা। দাদাঠাকুর বললেন, ‘টাকাপয়সা যা পাওনা আছে আজই উসুল করে দে।’

Advertisement

‘তবে চলুন আমাদের অফিসে।’

‘কোথায়? গজেনের ওখানে?’

Advertisement

‘হ্যাঁ, কলেজ স্ট্রিট।’

‘চল তবে।’

‘একটা ট্যাক্সি ডাকি দাদাঠাকুর?’

‘আবার ট্যাক্সি কেন!’

‘ও মা! এতটা পথ যাবেন ট্যাক্সি লাগবে না!’

‘আমি দুটো দা একটা কুড়ুল নিয়ে চলি রে হতভাগা। ওতেই যথেষ্ট। ট্যাক্সির দরকার পড়ে না।’

শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের তখন বিপুল জনপ্রিয়তা। কলকাতা শহরে সবাই এক ডাকে চেনে। পাশ থেকে এক জন বললেন, দুটো দা, একটা কুড়ুলের মানেটা ঠিক বুঝলাম না দাদাঠাকুর!

‘ডাকছিস তো দাদাঠাকুর, মানে বুঝতে পারলি না! ‘দাদা’তেই দুটো ‘দা’ আছে। আর ‘ঠাকুর’-এর মধ্যে লুকিয়ে আছে একখানা আস্ত ‘কুঠার’। বলে পা চালিয়ে হাঁটা লাগালেন। খালি গা, চটি-জুতো কিচ্ছু নেই। একখানি সাদা ন্যাতা ধুতির মতো করে জড়ানো। চোখে মোটা ফ্রেমের গোল চশমা। দাদাঠাকুর ছুটছেন।

‘মিত্র ও ঘোষ’ পাবলিকেশনে তখন চাঁদের হাট বসেছে। সজনীকান্ত দাস, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, কে নেই? দাদাঠাকুরকে দেখতেই সকলে উঠে দাঁড়ালেন। দরাজ গলায় গান ধরলেন শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। ‘কলকাতা কেবল ভুলে ভরা/ হেথায় বুদ্ধিমানে চুরি করে/ বোকায় পড়ে ধরা/ হায় রে! কলকাতা কেবল ভুলে ভরা...’

দাদাঠাকুর আসতেই আড্ডা যেন দ্বিগুণ জমে উঠল। গানে, গল্পে, কথায় সন্ধে গড়িয়ে তখন রাত ন’টা। সজনীকান্ত দাস বললেন, ‘আমার সঙ্গে গাড়ি আছে দাদাঠাকুর, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

‘এত করে বলছিস যখন চল। তুই তো অনেক পাপ করেছিস! নাহয় খানিক খণ্ডাবি।’

‘আমি আবার কী পাপ করলাম দাদাঠাকুর?’

‘ওই যে তোর পত্রিকায় সবাইকে ধরে-ধরে বধ করিস!’

কথা শুনে উল্লাসে ফেটে পড়লেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ‘আপনি ঠিক বলেছেন দাদাঠাকুর। ও ব্যাটা আমাকে একুশ বার বধ করেছে!’

সে দিনের আড্ডার একমাত্র জীবিত সাক্ষী যুবক ভানু এখন তিরাশির প্রবীণ সবিতেন্দ্রনাথ রায়। সরকারি চাকরির সুযোগ পেয়েও সাহিত্যের আড্ডার টানে প্রকাশনা ছাড়তে পারেননি। কলেজ স্ট্রিটের অনেক বদল হয়েছে। ধীরে-ধীরে কৌলীন্য হারিয়েছে নববর্ষের আড্ডা। চোখের সামনে ইস্টার্ন পাবলিশার্স, এ মুখার্জি, বাণীমন্দিরের মতো তাবড় পাবলিকেশন হাউসের ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে। তবু বদলাননি ভানুবাবু। আজও প্রকাশনাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। বলছিলেন, তখন নববর্ষ মানেই ফুলের গন্ধে ম-ম করত কলেজ স্ট্রিট। দিন পনেরো আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত তোড়জোড়। আর ছিল পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়া। রীতিমত ঠাকুর আনিয়ে রান্না হত পাবলিকেশন হাউসগুলিতে। অনেকে মিষ্টিটাও কারিগর ডেকে তৈরি করে নিতেন। লেখকেরা রকমারি স্বাদের লেখা নিয়ে দফতরে-দফতরে ঘুরে বেড়াতেন। কপিরাইটের বালাই ছিল না। যার যেটা পছন্দ সরাসরি
কিনে নিতেন। কোনও-কোনও লেখকের সঙ্গে এই দিন বার্ষিক চুক্তি হত। সারা বছর লেখা দেওয়ার বিনিময়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।

১৩৮৫-র পয়লা বৈশাখ। সে আরএক হুলুস্থুল কাণ্ড! কিছু দিন আগে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। নববর্ষে ‘মিত্র ও ঘোষ’ থেকে ‘পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস’ বইটির চারটি খণ্ড একত্রে প্রকাশিত হবে। ভোরবেলা কালীঘাটে পুজো দিয়ে সবে দোকানে ঢুকেছেন সবিতেন্দ্রনাথ রায়। তখনও এগারোটা বাজতে অনেক দেরি। কাউন্টারে এসে ধূপধুনো জ্বালাতে গিয়ে দেখেন, জনা পনেরো-কুড়ি লোক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখনও তো এগারোটা বাজেনি! এত সকাল-সকাল লাইন দিয়েছেন কেন?’ সকলের এক উত্তর, পরে যদি ঠাকুরের বই না পাই! তাই আগেভাগেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। ‘পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস’ তাঁদের চাই-ই চাই। এগারোটার মধ্যে লাইন সংস্কৃত কলেজ ছাড়িয়ে গেল। এত ভিড় ভানুবাবু কল্পনাও করেননি। এ দিকে ঘরে মাত্র তিন হাজার কপি! ঠিক হল, প্রত্যেকে এক কপি করে বই পাবে। অমনি পুস্তকবিক্রেতারা গোল বাধালেন। তাঁদের অন্তত দশ কপি বই চাই। শেষমেশ রফা হল, পুস্তকবিক্রেতারা ৫ কপি, সাধারণ ক্রেতারা পাবেন ১ কপি করে। দুপুর একটার মধ্যে তিন হাজার কপি শেষ। কিছু ক্ষণ বাদে আরও তিন হাজার বই এল। বিকেল পাঁচটাতেও লাইন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ক্রেতাদের হইচই কিছুতেই থামে না। এ দিকে কাউন্টার ফাঁকা। আর একটিও বই নেই! বিপদ বুঝে কোলাপসিব্‌ল গেট বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন সবিতেন্দ্রনাথ। বাধ্য হয়েই সে বার আমহার্স্ট স্ট্রিট থানায় খবর দিতে হয়েছিল। পুলিশ এসে লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয়। নইলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। নববর্ষে বইয়ের জন্য থানাপুলিশ রূপকথার গল্পের মতো শোনালেও তখন সেটাই ছিল ঘোর বাস্তব।

গল্পে-গল্পে ‘খেয়ালখুশির খাতা’ মেলে ধরলেন সবিতেন্দ্রনাথ রায়। ১৩৭০ সনে এই খাতা লেখার সূচনা করেন প্রমথনাথ বিশী। তার পর ‘মিত্র ও ঘোষ’-এর নববর্ষের আড্ডায় যাঁরাই এসেছেন, প্রত্যেকেই কিছু না কিছু লিখে গিয়েছেন। প্রমথনাথ বিশী প্রথম পাতায় দু’লাইনের কবিতা লিখেছিলেন, ‘আজি যার জীবনের কথা তুচ্ছতম/ সেদিন শোনাবে তাহা কবিত্বের সম।’ খাতাটি বহু অমূল্য স্মৃতির ভাণ্ডার। বনফুল, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, মহাশ্বেতা দেবী, বিমল মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ ১৪০ জন লেখকের কলমের আঁচড় ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়।

এ রকমই এক পাতায় ১৩৮৪-র নববর্ষে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় লিখলেন, ‘খুব জমিয়ে কিছু লিখব ভাবছিলাম। গত একটা বছরের হিসেবনিকেশ নেব। এমন সময় সহাস্যে শংকর হাজির। হিংসেয় আমার কলম থেমে গেল।’ শংকরের জবাব, ‘যিনি আশুতোষ তিনিই শংকর! সুতরাং নিজেকে নিজেই থামিয়ে রাখার প্রচেষ্টা কেন?’ তার ঠিক নীচেই গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের উত্তর, ‘আশুতোষের হিসেব নিকেশ করে নিয়েছেন শংকর। এক্ষেত্রে গৌরীশঙ্করের জন্য বাকী আর কি থাকে।’ তবে লেখকেরা সকলেই একটি বিষয়ে একমত, ‘মিত্র ও ঘোষ’-এর নববর্ষের আড্ডায় চন্দ্রপুলি সন্দেশের স্বাদ এক বার যার জিভে লেগেছে, তিনি আজীবন মনে রাখবেন।

চাঁদের হাট: মিত্র ও ঘোষ-এ সাহিত্যের মহারথীরা

১৩৮৮-র ৩ বৈশাখ। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম: ‘শংকর: প্রকাশকের লক্ষ্মী’। সঙ্গে সাহিত্যিক মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ের হাফ পেজ ছবি। দে’জ প্রকাশিত শংকরের ট্রিলজি ‘স্বর্গ-মর্ত-পাতাল’ সে বার শততম সংস্করণে পৌঁছয়। প্রকাশক সুধাংশুশেখর দে বলছিলেন, সে বার নববর্ষে সকাল থেকে রাত অবধি দফতরে হাজির ছিলেন শংকর। উপচে পড়া ভিড়। সবাই বই কিনে বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন শংকরের হাতে। হাসিমুখে সকলের আবদার মিটিয়ে বইয়ে সই দিয়েছিলেন লেখক। সেলফি-যুগ আসেনি, লেখকের সই-ই তখন নববর্ষে পাঠকের সেরা প্রাপ্তি।

‘মিত্র ও ঘোষ’-এর যেমন ‘খেয়ালখুশির খাতা’, দে’জ-এর তেমন লাল খাতা। একটা-দুটো নয়, সাত সাতটা লাল মলাটের খাতা। একের পর এক তাক থেকে বেরোচ্ছিল সেই সব যখের ধন। এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা। কিন্তু কিছুতেই অর্থোদ্ধার করা যাচ্ছে না। কাহিনি খোলসা করলেন বড় ছেলে শুভঙ্কর দে: ‘বোঝা যাবে কী করে! বাবার মুখে শুনেছি, সে বার শক্তি দফতরে এলেন টলমল পায়ে। বললেন, ‘মাথাটা ঝিমঝিম করছে, দাও দেখি তোমাদের খাতাখানি।’ কী সব হিজিবিজি দাগ কাটলেন। কেউ আর পড়তে পারে না! শেষমেশ গম্ভীর গলায় নিজেই পড়েছিলেন— ‘সারা জীবন ধরে কে ছাপাবে, কে ছাপবে বলে এই চিৎকার, ভালোবাসা মন্দবাসা কে জানে? কে শক্তি!
১ বৈশাখ। ১৩৮৮।’ এই না হলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়!

নববর্ষের কলেজ স্ট্রিট মানে আনন্দ পাবলিশার্সকে বাদ দিয়ে ভাবাই যায় না। পবিত্র সরকার বলছিলেন, ‘এক বার বছরকার দিন এলোমেলো ভাবে কলেজ স্ট্রিট ঘুরে বেড়াচ্ছি। এক জন জানতে চাইলেন, আনন্দ পাবলিশার্সটা কোথায়? উত্তর দিলাম, সোজা এগিয়ে যান, যেখানে দেখবেন প্রচুর ডাবের খোলা ছড়িয়ে আছে, বুঝবেন আপনি পৌঁছে গেছেন।’ সে দিন আনন্দতে যে-ই আসুন, ডাবের জল বাঁধা। সঙ্গে এক বাক্স নকুড়ের সন্দেশ। প্রকাশক সুবীর মিত্র জানাচ্ছিলেন, তখন এক একটা নববর্ষ মানেই রথী-মহারথীতে ঠাসা আড্ডা। শক্তি, সুনীল, শীর্ষেন্দু সব গোল হয়ে বসতেন। কথার ফাঁকে-ফাঁকে খালি গলায় গান ধরতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। হাবেভাবেই বোঝা যেত তিনি তখন বাংলা সাহিত্যের রাজা।

আর এক নববর্ষ। প্রকাশ পেল ‘রাগ অনুরাগ’। রবিশঙ্কর তখন খ্যাতির শীর্ষে। কিন্তু দফতরে যে লোকটি এলেন তিনি একেবারে মাটির মানুষ। সারা দিন ধরে ঘুরিয়ে দেখানো হল গোটা কলেজ স্ট্রিট। অলিগলি খুঁটিয়ে দেখলেন। বললেন, ‘নতুন বইয়ের গন্ধ আর একরাশ আনন্দ নিয়ে ফিরছি। আবার আসব।’

শুধু লেখক? প্রচ্ছদশিল্পী, প্রুফরিডার, বাইন্ডার, প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত সকলের দেখা মেলে নববর্ষের দিন। কলেজ স্ট্রিট হয়তো বদলেছে। কিন্তু নববর্ষে আড্ডার ট্রাডিশন বদলায়নি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement