হিরণ্ময় ঘোষাল।
খবরের কাগজে যুদ্ধের খবর পড়ে কিংবা টিভির পর্দায় যুদ্ধের ঝলক দেখে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁদের পক্ষে ধারণা করা মুশকিল, যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা কতখানি ভয়াবহ। যাঁরা যুদ্ধ স্বচক্ষে দেখেন, আশ্চর্য এক বিহ্বলতা তাঁদের গ্রাস করে। যুদ্ধের বীভৎস রূপটি সম্পর্কে নৈর্ব্যক্তিক তথ্য লিপিবদ্ধ করা তাই খুব সহজ নয়। বিদেশের মাটিতে যুদ্ধকে খুব কাছ থেকে দেখতে দেখতে হিরণ্ময় ঘোষাল (১৯০৮-১৯৬৯) এটাই করতে পেরেছিলেন। ‘কুলটুরকাম্প্ফ’ বইয়ে তিনি লিখছেন: “বিশাল ধ্বংস-প্রান্তরের মাঝে দগ্ধপ্রায় বাড়ীখানার চারতলার ঐ ছোট্ট ফ্ল্যাটে ওরা দুজনে আবার সংসার পেতে বসেছে। পালিশ-করা নখের চন্দ্রকণা, চাহনির চোখ-ঠারা নিষ্পাপতা এবং নাচের ঐন্দ্রিয়ক, সাবলীল আত্মসমর্পণ ছাড়া এদের জীবনে আর কোনো সমস্যা ছিল না। এরাই আজ পথে পথে রুটি আর বাঁধা কোপির সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।... ভাবি, প্রত্যঙ্গের ক্ষুধার চেয়ে জঠরের বুভুক্ষা যে কত শক্তিমান, শুধু এই নিতান্ত সহজ সত্যকে উপলব্ধি করার জন্যেই কি এরা বেঁচে রইলো?”
হিরণ্ময় ঘোষাল কলকাতায় বেড়ে ওঠা এক আন্তর্জাতিক বাঙালি। তিনি ভাষাশিক্ষাবিদ, অনুবাদক, কূটনীতিক, বিবিধ পরিচয়ে যুদ্ধধ্বস্ত ইউরোপের বুকে নিজের কর্মক্ষমতা যাচাই করেছেন। পাকেচক্রে জড়িয়ে পড়েছেন বিশ্ব-রাজনীতির সঙ্গেও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক। ১৯২৯-এ পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে, আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে। উচ্চাভিলাষী এই ব্যক্তি ১৯৩৯-৪০-এ যুদ্ধের অভিঘাত দেখছেন পোল্যান্ডের মাটিতে। ২৬টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন।
১৯৩৫-এ হিরণ্ময় ওয়ারশ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট বিভাগে শিক্ষক পদে যোগ দেন। পড়াতেন ইংরেজি ও হিন্দি। ১৯৩৯-এ যুদ্ধে প্রাথমিক ভাবে আটকে পড়ার পরে তিনি ১৯৪০-এ ভারতে ফিরতে পারেন। পরে বাংলা রেডিয়োতে নিজের ডায়েরি থেকে বিশ্ব-রাজনীতি ও বিশ্বযুদ্ধের বোঝাপড়া পাঠ করতে-করতেই ১৯৪২-এ তা একটি সম্পূর্ণ বই রূপে, ‘মহত্তর যুদ্ধের প্রথম অধ্যায়’ নামে বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করল।
তাঁর ‘মহত্তর যুদ্ধের প্রথম অধ্যায়’ ও ‘কুলটুরকাম্প্ফ’ বই দু’টি কঠিন বিদ্বেষ-ব্যাখ্যার পাশাপাশি পোল্যান্ডের নিসর্গকে পাঠকের সামনে তুলে ধরে। একই সঙ্গে বহুভাষিকতাকে দেয় নতুনতর মাত্রা। বাংলায় লেখা, কিন্তু লেখক জার্মান ও পোলিশ শব্দচয়নেও সঙ্কোচ বোধ করেননি। কখনও রোমান হরফে রুশ ভাষার অবতারণা করে, কখনও বা ফুটনোটের ব্যবহারে তিনি স্বতন্ত্র।
“মানুষ একেবারে নিরাশ্রয় না হয়ে পড়লে আশ্রয়ের মর্ম বোঝে না”— পোল্যান্ডে থাকাকালীন হিরণ্ময় এটা বুঝেছিলেন। নিকোলাই গোগোলকে বাংলায় অনুবাদ করে ও আন্তন চেকভের লেখা নিয়ে গবেষণা করে নিজের সাহিত্যপথকে উন্মুক্ত করেছেন যখন, সেই সময়ে নিছক ভ্রমণকাহিনি লিখতে চাননি তিনি। আবার, যুদ্ধের বীভৎসতা দেখিয়ে পাঠকের মেকি সহানুভবের আড়াল খোঁজাটাও তাঁর উপজীব্য নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে, জার্মানরা যখন পশ্চিম পোল্যান্ড ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে, তখন ওয়ারশ’ (লেখকের স্লাভ উচ্চারণে ভারশৌ) শহরে এসে অনেকে মাথার উপরে ছাদ খোঁজেন।
আশ্রয় ক্ষণিকের। তবু মানুষের জীবনরস শুকিয়ে না যাওয়া অবধি আশালতা আঁকড়ে থাকার অভিব্যক্তিকে লেখক ‘কুলটুরকাম্পফ’-এ জায়গা দিচ্ছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে একক মানুষের কাহিনি মানবগোষ্ঠীর কাছে বার বার হেরেছে সম্মিলিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির কাছে যুদ্ধ ক্রমশ নৈমিত্তিক। প্রাণরক্ষাও প্রতিদিনের জন্য। আগামী কাল খাবার জুটবে কি না, বাঁচা যাবে কি না, কিচ্ছু ঠিক নেই। সৈনিক আর উদ্বাস্তু মানুষের ভিড় দেখে হিরণ্ময়ের মনে হয়, “তবে এরা যে মরণ দিয়ে মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্করকে প্রতিরোধ করতেই এসে হাজির হয়েছে, তা এদের মুখ দেখলেই বোঝা যায়।”
১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বর। হিটলার নিজে ওয়ারশ’ এসেছিলেন, ‘ভারশাভা’-কে ঠিকমতো শিক্ষা দেওয়া হয়েছে কি না তা দেখতে। নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো। প্রায় চারতলা উঁচু ধ্বংসস্তূপের ভিতরেও তখন জার্মানদের অস্ত্রের খোঁচা এসে লাগছে। কেউ বেঁচে নেই তো? যে বাড়ির ছাদ বা বারান্দা উপর থেকে ঝুলছে, সেগুলিকে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তার ধারের যে গুটিকতক ফ্ল্যাট তখনও টিকে, সেগুলিকেও পুরোপুরি খালি করে দেওয়া হয়েছিল— “পাছে কেউ জানালা থেকে কিছু ছুঁড়ে-টুঁড়ে দেয়।”
সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ, হিরণ্ময় দুই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি বোঝার চেষ্টা করেছেন। দেখছেন, মানুষ মাত্রেই দ্বিচারিতার প্রতিমূর্তি; হিটলারকে তুলোধোনা করা মানুষই “হেন লাইন নামক হিট্লারের একটি শিষ্যের পাল্লায় পড়ে দলে দলে ‘হাইল হিট্লার’ মন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছে আর গুণ্ডামি করে বেড়াচ্ছে।”
ভাষা-সংস্কৃতি সম্বন্ধে নৈর্ব্যক্তিক ধারণার কারণে হিরণ্ময় স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতে এক জন কূটনীতিক হয়ে উঠলেন। জটিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে তাঁর ঐকান্তিক মুক্তিপথ ছিল সাহিত্য-নির্মাণ। যে সাহিত্যের উপাদান আপন জীবন থেকেই উঠে আসে: “অধিকৃত ভারশৌএ দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণ এমন আকস্মিক যে তা দু-একদিন পরেই অসহনীয় হয়ে ওঠে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গতি ও বিরতির মাঝে পরস্পর-সংসক্ত মুহূর্তগুলি আমাদের রাত্রির শান্তি ও দিনের সংগ্রামের পক্ষে কতটা প্রয়োজনীয় তা এর পূর্বে অনুভব করা যেত না।”
সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯-এ পৌঁছে এক বার লেখক কেবল নিজের কথা বলেন, ব্যাপকতর সংঘর্ষের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অবস্থাকে ভাষা দেন। আবার পরক্ষণেই রাজনৈতিক চেতনা তাঁর একার পরিস্থিতিকে তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর করে তোলে। সেসময়ে ‘ভারশৌএর’ পুরুষেরা প্রায় সবাই যুদ্ধে শামিল। শিক্ষা মন্ত্রক থেকে নির্দেশ এসেছে, যুদ্ধের সময় শিক্ষকদের কর্তব্য হল, এমন ভাবে জীবনযাপন করা যাতে যুদ্ধ একেবারেই হচ্ছে না বলে মনে হয়।
তেমনটা সম্ভব? লেখক বলেন, “বাড়ীতে বসে আছি কি চোরবাজারে বসে আছি, তা দস্তুরমত ভেবে উপলব্ধি করতে হয়। শোবার ঘরের জানলায় বিছানার গদি আর তোষক ঝুলছে, যাতে বোমার আওয়াজে ভাঙ্গা কাচের টুকরো এসে এই অধমকে ঘুমন্ত অবস্থায় জখম করতে না পারে।” তার পরেও যে ঘুম আসে চোখে, এ বড় অবাক করে তাঁকে: “দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি ও যুদ্ধের কুৎসিত, নৃশংস ঘটনাস্তূপের মাঝখানে মন এক অদ্ভুত উপায়ে সামঞ্জস্যের সেতু বাঁধতে বসলো। বুঝলাম, অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছি।”
এই সামঞ্জস্যের সেতুবন্ধনের আগ্রহকে সম্বল করেই হিরণ্ময় ১৯৫৭-তে আবার পোল্যান্ডে যান। তাঁর ‘শাকান্ন’ বা ‘হাতের কাজ’-এর মতো গল্প সংগ্রহেও দেখা যায় এই সাংস্কৃতিক মিশ্রণের ছায়া। নিভৃতে পড়াশোনায় মগ্ন থাকতে গিয়ে যাঁর বাড়ি বিমান হামলায় কেঁপে উঠেছিল। বেশ কয়েক বার যাঁর মনে হয়েছিল, এই বুঝি জীবনের শেষ দিন: “বোমার প্রতিক্রিয়ায় আমাদের ছোট দোতলা বাড়ীখানা থর থর করে’ কাঁপছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, বাড়ীটার ছাদের একদিকে চিড় খাচ্ছে আস্তে আস্তে।” তাঁর বইয়ের তাকে রয়েছে মুন্সী প্রেমচন্দের লেখা ‘কাফন’। মনে করছেন বুঝি এই বাড়িটাই হবে তাঁর জীবন্ত কবর। সেই কারণেই সব কিছু ছেড়ে ‘কাফন’-এর মলাটটাই চোখে পড়েছে।
পৃথিবী আজও যুদ্ধ ভালবাসে। যেন গণহত্যা খুব স্বাভাবিক। গণহত্যাকারী মানুষ মারলে সৃষ্টিময়তায় চির দিনের দাগ লেগে যায়; “প্রকৃতির কোলে স্রষ্টার সৃষ্টির আবেগে এই যে জীবলোকের উৎপত্তি, তা যদি সত্যিই এই মহত্তর বা মহত্তম যুদ্ধে সম্পূর্ণ রূপে বিধ্বস্ত হয়ে যায়, তা হ’লে বিধাতার কাছে নতমস্তকে শাস্তির প্রতীক্ষায় দাঁড়াবে একটি মানুষ এবং একটি জাতি— হিট্লার এবং “হাইল-হিট্লার” মন্ত্রে দীক্ষিত জার্মানী”— লিখে যান পোল্যান্ডবাসীদের এক জন হয়ে যাওয়া ‘হিরণ’।
রাতের গভীরে ওয়ারশ’র শুনশান রাস্তার দিকে চেয়ে রেডিয়োর পরবর্তী সাবধানবার্তার অপেক্ষা করতে করতে হিরণ্ময় ভেবে চলেন: “মানুষ কখন রবত (রোবট) হয়ে যায়?— যখন তার সঙ্কল্পচ্যুতি ঘটে।”