গাগারিনের মৃত্যু

পঞ্চাশ বছর আগে এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন প্রথম নভশ্চর। মহাকাশ থেকে ফিরে অজস্র সম্মান, বিপুল খ্যাতি। তার পর ১৯৬৮ সালে মস্কো থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে আছড়ে পড়ল তাঁর মিগ বিমান। পঞ্চাশ বছর আগে এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন প্রথম নভশ্চর। মহাকাশ থেকে ফিরে অজস্র সম্মান, বিপুল খ্যাতি। তার পর ১৯৬৮ সালে মস্কো থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে আছড়ে পড়ল তাঁর মিগ বিমান।

Advertisement

দীপাঞ্জন মাহাত

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share:

মস্কো থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে সারাটোভ এলাকায় সে দিন আকাশে চক্কর কাটছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনা হেলিকপ্টার। দিনটা ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল। সে দিন সকালে তারা খোঁজ করছিল এক সোভিয়েত পাইলটের। যে পাইলট কিছু ক্ষণ আগেই প্রথম মানুষ হিসাবে মহাকাশ সফর সেরে পৃথিবীর বুকে ফিরেছেন।

Advertisement

ঠিক সাত বছর পরে, ১৯৬৮ সালের ২৭ মার্চের বিকেলেও একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। মস্কো থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে এক জঙ্গুলে এলাকায় ওই দিনও সেনার উদ্ধারকারী বিমান খোঁজ করেছিল ওই পাইলটের। তবে তফাতটা একটাই— প্রথম বার খোঁজ শেষে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল পাইলটকে। আর দ্বিতীয় অনুসন্ধানে সামনে এসেছিল তাঁর মৃত্যুর খবর।

পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ চলার সময় মহাকাশ গবেষণায় দুই রাষ্ট্রই নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে কার্যত উঠেপড়ে লেগেছিল। সেই লড়াইয়ে ১৯৬১ সালে এক ধাপে অনেকটা এগিয়ে যায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন— ইউরি আলেক্সিভিচ গাগারিনকে মহাকাশে পাঠিয়ে। প্রথম মহাকাশচারীর মৃত্যুর ৫০ বছর পেরোল এ বছরই, গত মার্চে।

Advertisement

১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়েনের ছোট্ট গ্রাম ক্লুসিনোতে জন্মেছিলেন গাগারিন। চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় গাগারিন গ্র্যাজুয়েশনের পরে নরওয়ে সীমান্তের কাছে লুওস্তারি সেনা বিমানঘাঁটিতে পাইলট হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। পরে তিনি এবং মোট ২০ জন পাইলট সোভিয়েত মহাকাশ গবেষণার অংশ হয়েছিলেন। যদিও ওই ২০ জনের মধ্যে ‘ভস্তক-১’ মহাকাশযানে শেষ অবধি জায়গা করে নিয়েছিলেন গাগারিনই।

১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৫টা থেকে শুরু হয়েছিল গাগারিনের মহাকাশ যাত্রার তোড়জোড়। সকাল ন’টার কিছু পরেই ‘ভস্তক-১’ ক্যাপসুলে বসে পড়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে অভিযানের রূপকার সের্গেই পাবলোভিচ কারালোভের শুভেচ্ছাবার্তার জবাব দিয়েছিলেন মাত্র একটি শব্দে— ‘পইয়োখালে’! ইংরাজিতে যার মানে ‘লেটস গো!’

রকেটের উৎক্ষেপণ থেকে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসা অবধি মোট ১০৮ মিনিটের সফর ছিল গাগারিনের। ওই সময়ের মধ্যেই তিনি মহাকাশ থেকে চক্কর কেটেছেন অতলান্তিক, প্রশান্ত মহাসাগরের উপরে। অতিক্রম করেছেন প্রায় ৪১ হাজার কিলোমিটার, যা পরবর্তীকালে গোটা বিশ্বে গাগারিনকে জনপ্রিয় করেছে। তাঁর সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসার খবর মস্কো থেকে রেডিয়োয় ঘোষণার পরেই উৎসবে মেতেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন-সহ গোটা বিশ্ব। পরের বেশ কয়েক বছরও সেই রেশ ছিল একই রকম। বিশ্বের যে প্রান্তেই গিয়েছেন গাগারিন, সেখানেই তাঁকে নিয়ে মেতে উঠেছেন সকলে।

বিশ্ববাসীর সেই উৎসবে ছন্দপতন ঘটে ১৯৬৮ সালের ২৭ মার্চ। সে দিন মস্কো থেকে রেডিয়োয় গাগারিনের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয়। জানানো হয়, যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কী কারণে সেই বিমান ভেঙে পড়েছিল, তা নিয়ে তদন্তে উঠে এসেছে বিভিন্ন তত্ত্ব। দুর্ঘটনার দিন সকালে প্রশিক্ষণের জন্য রুশ বায়ুসেনার চিকালোভস্কি ঘাঁটি থেকে মিগ-১৫ বিমান নিয়ে আকাশে উড়েছিলেন গাগারিন (পরবর্তী সময়ে মিগ সিরিজের বিমান ভারতের সেনাবাহিনীতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। ভেঙেও পড়েছে অন্য যুদ্ধবিমানের থেকে অনেক বেশি সংখ্যায়)। গাগারিনের সঙ্গে ছিলেন ফ্লাইট ইনস্ট্রাক্টর ভ্লাদিমির সিরিয়োগান। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের ওই প্রশিক্ষণ পর্বে তাঁদের বিভিন্ন কসরত করার কথা ছিল। ওই দিন চিকালোভস্কি ঘাঁটির ফ্লাইট কন্ট্রোলার হিসাবে থাকা ভেলরি এসিকোভ পরে এক সাক্ষাৎকারে জানান, চার মিনিট পরেই গাগারিন বলেছিলেন, ‘‘ডান, হেডিং ফর বেস।’’ সে সময় তাঁর গলা অদ্ভুত রকম শান্ত ছিল।

পরে গাগারিনের মিগ বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। বিকেল তিনটে নাগাদ মস্কো থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে বার্চ গাছের জঙ্গলে ওই বিমানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। ওই দিন গাগারিনের মোট তিন বার আকাশে ওড়ার কথা ছিল। এক বার ইনস্ট্রাক্টরের সঙ্গে, বাকি দু’বার একা।

১৯৬১ সালে সফল মহাকাশ অভিযানের পর থেকে গাগারিনকে দেশে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসাবেই গণ্য করা হত। তাই রুশ-মার্কিন ঠান্ডা যুদ্ধের আমলে তাঁর মৃত্যু নিয়ে প্রচুর ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ও চালু হয়েছিল। কিন্তু পনেরো বছর আগেই, ২০০৩ সালে বর্তমান রাশিয়ার গুপ্তচর সংস্থা কেজিবি ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব কার্যত খারিজ করে দেয়। তারা যে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল, তাতে জানানো হয়, বিমানঘাঁটি থেকে গাগারিনকে আবহাওয়া সম্পর্কে পুরনো তথ্য দেওয়া হয়েছিল। গাগারিনের উড়ানের সময় আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়। ওই রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, গাগারিনের বিমানের যে ধরনের কসরত করার কথা ছিল, তার জন্য পরিষ্কার আকাশের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় তা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। দুর্ঘটনার সময় গাগারিনের বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘুরতে শুরু করেছিল। যাকে বলে, টেল স্পিন! তদন্তকারী দলের এক পাইলট জানিয়েছিলেন, খারাপ আবহাওয়া এবং ঘন মেঘ থাকলে ওই ঘূর্ণন থেকে বেরিয়ে আসা কষ্টকর। হয়তো তেমনই কোনও পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন গাগারিন।

প্রথম নভশ্চরের মৃত্যু নিয়ে কত যে রিপোর্ট আর তথ্যের ছড়াছড়ি! আসলে ১৯৬৮ সালে ককপিটে পাইলটের কথোপকথন রেকর্ড করা হত না। তবে এটুকু জানা যায়, খুব দ্রুত গতিতেই আছড়ে পড়েছিল গাগারিনের বিমান। তাতে বোঝা গিয়েছে, পাইলটেরা বিমানের ঘূর্ণন থামাবার চেষ্টা করতে পারেননি। কারণ, ওই চেষ্টা করা হলে তাঁরা বিমানের গতি (থ্রাস্ট) অবশ্যই কমাতেন। ২০০৫ সালের এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ভুলবশত হয়তো ওই বিমানের আগের পাইলট ‘কেবিন এয়ার ভেন্ট’ খুলে রেখেছিলেন। ফলে অক্সিজেনের অভাবের কারণে নিজেদের উড়ানে গাগারিনেরা সংজ্ঞাহীন হয়েছিলেন, শেষ মুহূর্তে তাঁরা আর বিমান নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি।

অন্য তদন্ত-রিপোর্টে বিমানের ঘূর্ণনের কারণ হিসাবে পাখির ধাক্কা বা একই উচ্চতায় থাকা অন্য বিমানের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য বিমানের উপস্থিতির ব্যাপারে দাবি করেছিলেন আর এক তদন্তকারী আলেক্সি লিয়োনভ। গাগারিনের মৃত্যুর ১৫ বছর পরে তিনি জানান, ওই এলাকায় একই উচ্চতায় হয়তো আরও একটি সুখোই বিমান ছিল। খারাপ আবহাওয়ার কারণে তা বুঝতে পারেননি গ্যাগারিন। আর তাঁদের বিমানের খুব কাছে সুখোই বিমানটি হয়তো ‘সাউন্ড ব্যারিয়ার’ ভেঙেছিল। যার জেরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মিগ বিমানটি ঘূর্ণনের কবলে পড়েছিল। লিয়োনভ পরবর্তী কালে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার সময় তিনি ওই এলাকায় হেলিকপ্টারে ছিলেন। তিনি দু’টি বিকট শব্দ শুনেছিলেন। তাঁর মতে, একটি শব্দ গাগারিনের বিমান ভেঙে পড়ার, অন্যটি সম্ভব সুখোই বিমানের ‘সাউন্ড ব্যারিয়ার’ ভাঙার।

১৯৬১ সালে সফল ভাবে মহাকাশ থেকে ফেরার পরে গাগারিন ফের পাইলট হিসাবে আকাশে ওড়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। তাতে প্রথমে রাজি হননি তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কারণ নতুন মডেলের প্লেনগুলির তখনও ভাল ভাবে পরীক্ষা হয়নি। গাগারিনকে মহাকাশচারী প্রশিক্ষণ সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদের প্রস্তাব দিয়েছিলেন কর্তারা। কিন্তু গাগারিনের বারংবার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত ছাড় মেলে। এক উড়ান তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। আর অন্য এক উড়ানেই মারা যান তিনি। তবে এখনও গাগারিনের প্রসঙ্গ উঠলেই সেই সময়কার অধিকাংশ মানুষের কানে ভাসে উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে দেওয়া তাঁর বার্তা— ‘পইয়োখালে’!

ছবি: গেটি ইমেজেস

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement