চিন পাড়ি দিচ্ছে বাংলার টেরাকোটা

শিল্প রাজনীতি-কূটনীতির জটিলতা বোঝে না। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের পোড়ামাটির কাজ এখন ভারত ছাড়িয়ে চিন-এ। শিল্প রাজনীতি-কূটনীতির জটিলতা বোঝে না। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের পোড়ামাটির কাজ এখন ভারত ছাড়িয়ে চিন-এ।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৮ ০০:০০
Share:

কাজে মগ্ন আশিস বিশ্বাস।

একুশ শতকে চিন মানে কি শুধুই ডোকলাম? রাজনৈতিক প্রভুত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে এগিয়ে চলা এক দেশ? সারা বিশ্বে বাণিজ্যজাল ছড়িয়ে দেওয়া এক জাতি? দেশটা নিতেও জানে, এবং শুধু ভারত নয়, বাংলা থেকেও! উত্তর ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রাম ঠাকুরনগরের পোড়ামাটি পাড়ি দিচ্ছে চিন। বছর কুড়ি আগে এই এলাকায় পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু হয়েছিল টেরাকোটার কাজ। দেশে সমাদর পেয়েছে তা, এ বার গন্তব্য চিন। চিনের শিয়ান-এ ‘টেরাকোটা যোদ্ধা’ মিউজিয়াম খুব বিখ্যাত, মিশেল ওবামা থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদী, সবাই দেখে এসেছেন মিউজিয়ামে রাখা চিনা সম্রাট ও তাঁর সেনাদের বিরাটাকৃতি পোড়ামাটির মূর্তি। এ বার সে দেশে যাচ্ছে ঠাকুরনগরের পোড়ামাটির কাজও।

Advertisement

মাটির কাজ করে ঠাকুরনগরের নারী-পুরুষদের স্বনির্ভর করছেন মধ্য-চল্লিশের আশিস বিশ্বাস। কর্মশালায় তাঁর তৈরি টেরাকোটা সামগ্রী— টাইলস, ম্যুরাল, মুখোশ, ল্যাম্প-শেড, ঘড়ি, পেন স্ট্যান্ড এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ঘরে ঘরে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ইতিমধ্যেই জাতীয় পুরস্কার থেকে শুরু করে অনেক সম্মান আশিসের ঝুলিতে।

জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে চিনের কুনমিং-এ হবে ‘সাউথ- ইস্ট এশিয়ান আর্ট উইক’। সেখানেই এ রাজ্যের মাটি হাতে পাড়ি দিচ্ছেন আশিস। সঙ্গে যাচ্ছেন কুমোরটুলির প্রতিমাশিল্পী চায়না পালও। থাকবেন দশ দিন, সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশের শিল্পীদের হাতে গড়া শিল্পবস্তুর প্রদর্শন এবং বেচাকেনাও হবে। ঠাকুরনগরে গিয়ে দেখা গেল, চিনাদের মন জয় করতে তাই এখন পরীক্ষামুলক নতুন হাতের কাজ, বিশেষত নানা রূপের গৌতম বুদ্ধ গড়তে ব্যস্ত আশিস ও তাঁর সঙ্গীরা।

Advertisement

অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর, পরে বিএড পাশ করেও চাকরির দিকে ঝোঁকেননি আশিস। রাজ্য পুলিশে কর্মরত অবস্থায় বাবা মারা যাওয়ার পরে তাঁর চাকরিটি করার প্রস্তাবও এসেছিল। কিন্তু নিজে ব্যবসা করে প্রত্যন্ত গ্রামের আরও অনেককে স্বনির্ভর করে তুলবেন, সেই ইচ্ছাতেই ব্যবসা সংক্রান্ত পড়াশোনা শুরু করেন আশিস। ‘আর্ট’ নিয়ে প্রথাগত পড়াশোনা না করেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে ঘুরে লোকশিল্প, হস্তশিল্প সংগ্রহ করেন। আশিসের মৃৎসামগ্রীতে তাই মিশর, হরপ্পা, মহেঞ্জোদরো থেকে শুরু করে বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, পুরুলিয়া, উত্তরবঙ্গ, অসমের বিভিন্ন লোককথাও ঘুরেফিরে উঠে এসেছে।

শিল্পপ্রাণ যুবকটি নতুন কিছুর খোঁজ পেলেই ছুটে যান সেখানে। বর্ধমানের আমরুলে সাধনদাস বৈরাগ্যের আশ্রম, বোলপুরের তরুণ খ্যাপার আখড়া, সবেতেই ডাক পড়ে আশিসের। রাজ্যের নামী-অনামী হস্তশিল্পীদের কাছের মানুষ তিনি। রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় মাটিতে বসে থাকা কোচবিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের বৃদ্ধার ‘১০ টাকা’ দামের হস্তশিল্প ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলেন, ‘‘এ জিনিস একমাত্র ইনিই গড়তে পারেন। হাজার টাকা দিয়েও এই কাজ আর মিলবে না।’’

বিক্রি না হওয়া জিনিস বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বেশি খরচ, তাই মেলার শেষ দিনে মাঠেই নিজেদের শিল্পকর্ম গুঁড়িয়ে দিতেন গরিব হস্তশিল্পীরা। কয়েক বছর ধরে এর অনেকটাই কিনে নেন আশিস। তাঁর কথায়, ‘‘এক এক জন শিল্পীর মৃত্যুর সঙ্গে অনেক শিল্পকর্মও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই শিল্পীরা যদি বিপণনটা বুঝতেন তা হলেই ব্যাপারটা অন্য রকম হত।’’

বার্তাবহ: চিনের শিয়ান প্রদেশের বিখ্যাত ‘টেরাকোটা যোদ্ধা’ মূর্তির প্রতিরূপ। ছবি: গেটি ইমেজেস।

ঠাকুরনগর স্টেশন আর মতুয়া মহাসঙ্ঘের ঠাকুরবাড়ির মাঝে আশিসের ‘সেনসিটিভ ক্রিয়েশন’-এর কর্মশালা দেখতে যান অনেকে। টেরাকোটা দিয়ে সাজানো কর্মশালার চারদিকে কাজে ব্যস্ত অনেক মানুষ। রয়েছে সিসিটিভি, এসিও। এক দিকে ডাঁই করে রাখা গঙ্গার পলি। মাটি পেস্টিংয়ের পর নরম আর মসৃণ করা হচ্ছে। বিশাল কুমোরের চাকায় তৈরি হচ্ছে হাঁড়ি-কলসি। প্লাস্টার অব প্যারিসের ছাঁচ থেকে নিপুণ হাতে উঠে আসছে বুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথ থেকে গণেশজননী। হাতে গড়াও চলছে। রোদে শুকিয়ে সেগুলি বিশাল কাঠের চুল্লির চারপাশে পোড়ানো হচ্ছে— প্রাচীন পদ্ধতিতে, ৮০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়।

সেগুলিতে রং, কারুকাজ করছেন নমিতা দাস, টিপু বালার মতো মহিলারা। বৈরাগী দম্পতি, দীপু-কণিকা, দু’জনেই এখানে কাজ করেন। একমাত্র সন্তান, ছোট্ট সমুদ্র শুয়ে আছে মাটির পাত্রেই! মাটির কারুশিল্প শিরীষ কাগজের মতো জিনিস দিয়ে ঘষামাজা করে অ্যান্টিক রূপ দেওয়া হচ্ছে। আশিসের কথায়, ‘‘আদিম কালে চাকা আবিষ্কার থেকে শুরু করে আজকের প্রযুক্তি, গোটাটাই বিজ্ঞান। আর মাটি হল ছোট্ট বাচ্চার মতো। খেয়ালি। যত্নে আলতো করে রাখতে হয়।’’

মাটি দিয়েই মহিলাদের সমস্ত রকমের গয়না তৈরি চলছে। শিল্পী সত্যজিৎ বসুর কথায়, ‘‘আমাদের মাটির অলঙ্কার দিয়েই একটি মেয়েকে পুরো সাজিয়ে দেওয়া যাবে।’’ মাটির প্রতিমা বলতে কুমোরটুলি, মাটির পুতুল বলতে কৃষ্ণনগর আর টেরাকোটা মানে তো বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর। তা হলে ঠাকুরনগর? আশিস বলেন, ‘‘সে সব কাজও অনবদ্য। তবে হাতি, ঘোড়ার আকার অনেক বড়। নতুন শিল্পকর্ম হচ্ছে কম। আমাদের উদ্দেশ্য, ট্রাডিশনও থাকবে আবার নতুন হস্তশিল্প নিয়ে পরীক্ষাও হবে। যুগোপযোগী, আবার ঐতিহ্যবাহীও।’’

মাটি আর টেরাকোটা নিয়ে বংশ পরম্পরায় কাজ করে এখনও সুনাম ধরে রেখেছেন এ রাজ্যের আরও কেউ কেউ। আশিসের মতোই তাঁদের কর্মশালাতেও কাজ করছেন অনেকে। মাটির পট ছাড়াও চেয়ার, সোফা, সেন্টার টেবল-এর মতো আসবাবপত্র তৈরি করেন বিড়ার রঞ্জিত পাল। কৃষ্ণনগরের প্রদীপ পালের টেরাকোটার দেওয়ালচিত্র, বজবজের কানু পালের তৈরি মাটির বিভিন্ন মূর্তি, বিশেষ করে রাজস্থানি পুতুলেও রয়েছে অসাধারণ শিল্পনৈপু্ণ্য। বনগাঁর নান্টু রায়ের মাটির তৈরি ল্যাম্প শেড, বারাসতের রথীন কর্মকারের মাটির উপহার সামগ্রী ও ক্যালেন্ডার এখন কর্পোরেট দুনিয়াতেও জায়গা করে নিয়েছে।

নান্দনিকতায় বিশ্বাস রেখে এ ভাবেই ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটাচ্ছেন আশিসরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement