রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০০:০৩
Share:

সরষে

Advertisement

পিনাকী ভট্টাচার্য

তা র ভূমিকা তবলচির মতন— যেমন ওস্তাদ তবলচির বাজনা সংগতের মাধ্যমে গানকে সুখশ্রাব্য করে তোলে, তেমনই রান্নায় পড়েই খাবারকে আরও সুস্বাদু আর বৈচিত্রময় করতে সরষের জুড়ি নেই। ভারতেই জন্মে ছোটবেলায় দেশ ছেড়েছিল সে— আর দুনিয়া জয় করে দেশে ফিরেছিল বিদেশিদের সঙ্গে, বিদেশি উপকরণ সেজে।

Advertisement

বাইবেলে সরষের উল্লেখ আছে। সে কালে ইহুদিরা রান্নায় সরষে দিতেন। দেবদূতরা দেখা করতে এলে আব্রাহাম পরিবেশন করেছিলেন সরষে দিয়ে রাঁধা গরুর জিভ। তা আজও অনেক দেশেই ‘ডেলিকেসি’। গ্রিকরা রান্না ছাড়াও ডাক্তারিবিদ্যাতেও সরষে ব্যবহার করতেন। গণিতজ্ঞ-বৈজ্ঞানিক পাইথাগোরাস সরষেকে, কাঁকড়াবিছে কামড়ের অব্যর্থ ওষুধ বলে ঘোষণা করেছিলেন। হিপোক্রেতিস ওষুধ তৈরি আর পুলটিস দিতে সরষে ব্যবহার করতেন— ভেঙে গেলে বা মচকে গেলে কিছু কাল আগেও সরষের এই প্লাস্টার করা হত। তাই যুদ্ধক্ষেত্রেও সরষের বস্তা যেত। আলেকজান্ডার বিশ্বজয়ে বেরিয়ে ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বে যখন পারস্যে পৌঁছন, সে দেশের রাজা দারিউস একটা চমৎকার কাজ করেন। নিজের সৈন্যের সংখ্যা কী বিপুল, তা বোঝাতে, আর আলেকজান্ডারকে সাবধান করতে, এক বস্তা তিল উপহার দেন। আলেকজান্ডার জবাবটা দেন দুর্দান্ত। উনি রাজা দারিউসকে এক বস্তা সরষে উপহার দিয়ে বুঝিয়ে দেন: তাঁর সৈন্য অগুনতি তো বটেই, তাদের মেজাজও আগুনে।

৪২ খ্রিস্টাব্দে লেখা প্লিনির রেসিপি-বইয়ে, খাবারে সরষে-বাটা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে তখন গ্রিক-রোমানরা রোজের খাবারে সরষে দিত না। তার ঝাঁজের জন্য। সে কারণেই সরষে ছিল পালা-পরবের খাবার। টাটকা গোলমরিচ যেমন এখনও ‘পেপার ক্রাশার’ দিয়ে গুঁড়িয়ে ফরাসি খানার ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়, সেই জমানায় সরষে গুঁড়ো করে মদ বা জলে মিশিয়ে খাওয়াও ছিল এক রেওয়াজ। রোমানদের হাত ধরেই সরষে পৌঁছায় গল দেশে। সেখানে সাধুরা সরষের চাষ শুরু করেন আঙুর-খেতের পাশে। সহস্রাব্দের শেষে, সরষে চাষের দৌলতে ফরাসি মনাস্ট্রির রোজগার ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে। তখন প্যারিসের বণিকদের ফর্দে সরষে থাকবেই!

পোপ দ্বাদশ জন সরষে এতই পছন্দ করতেন যে ‘গ্রাঁ মতারদ্যু দ্য পোপ’ বা ‘পোপের জন্যে সরষে প্রস্তুতকারক’ নামে এক চাকরির পদ তৈরি করে, দিজোঁ নিবাসী এক বেকার আত্মীয়কে সেই পদে বসান। খ্রিস্টধর্মের আনুকূল্যে দিজোঁ ক্রমে বিশ্বের সরষে-কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সেখানে অর্থনীতি এতটাই সরষে-নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, ১৬৩৪ সালে আইন পাশ করে সাধারণ মানুষের হাতে সরষে চাষের অধিকার তুলে দেওয়া হয়— এত দিন তা গির্জার সাধুদের কুক্ষিগত ছিল। সেই কারণে সারা বিশ্বে জোগান দেওয়া যাচ্ছিল না।

ভারতে, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে, সেই সিন্ধু সভ্যতার আমল থেকেই সরষে চাষ শুরু হয়। বৈদিক শাস্ত্রে আলাদা করে সাদা সরষেকে রাই বা রাজিকা, আর সাধারণ কালো সরষেকে সিদ্ধার্থ নামে বর্ণনা করা হয়েছে। দুষ্ট আত্মা তাড়াতে সরষে ব্যবহারের কথাও রয়েছে। বৌদ্ধ শাস্ত্রে অবশ্য সরষে শুধুই রান্নার মশলা। কিন্তু তার পর বহু দিন সরষের কোনও খবর মেলে না। সরষে এ দেশে আবার ফেরত এল পর্তুগিজ বণিকদের জাহাজ চেপে— তার পর? পায়ের তলায় সরষে নিয়ে গোয়ার ভিন্দালু থেকে বাংলার ভাপা ইলিশ— সে ছড়িয়ে পড়ল ভারতের কোণে-কানাচে।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

সবুজ জবাটা বানাতে পারলেক নাই!

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

পানাগড় এখন বিখ্যাত হয়েছে মাটি উৎসবের জন্য। আগে বিখ্যাত ছিল মিলিটারি ঘাঁটির জন্য। একটা রানওয়ে আছে। ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের একটা শাখা এখনও আছে। আমি ওখানে কাজ করছিলাম, সালটা ১৯৭৮: আমার অফিসের বছর পঁচিশ বয়সি ঝাড়ুদার বেঁকা রুইদাসের সঙ্গে গল্পগাছা করতাম, জানলাম, ওর কিশোরী বউয়ের ওপর প্রতি অমাবস্যায় কালীর ভর হয়! এক দিন দেখতে গেলাম। ওর বউয়ের পরনের শাড়ি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা, নইলে খুলে ফেলবে। দু’হাতে নানা ভঙ্গি, কখনও যুদ্ধ করার, কখনও হাত আর আঙুলের কায়দায় অশ্লীল মুদ্রা, আবার কখনও আশীর্বাদের মুদ্রা। অনেক লোকসমাগম। ওদের কুঁড়েঘরটা ছিল রানওয়ের ধারে কুরুডিহা নামে একটা গ্রামে। সে দিন ওদের উঠোনে হ্যাজাক জ্বলত। প্রচুর জবাফুল পড়ত উঠোনে। তিন-চারটে মালসায় পড়ত খুচরো পয়সা, এক টাকা দু’টাকার নোট, দু-চারটে পাঁচ টাকাও। আশেপাশের আট-দশ গাঁ থেকে মানুষজন আসত। বেঁকার বউ কখনও কখনও খুব মুখ খারাপ করত। আমার জন্মবৃত্তান্ত নিয়েও ওর মন্তব্য ছিল। ওই মুখখিস্তির মধ্যে আমি চারু মজুমদার কথিত ‘পবিত্র শ্রেণীঘৃণা’র প্রকাশ দেখেছিলাম এবং এটা নিয়ে একটা গল্পও লিখে ফেলেছিলাম। তখনও রণজিৎ গুহরা ‘সাবঅল্টার্ন’ শব্দটা বাংলায় আনেননি, নিম্নবর্গও নয়। তখন ওরা নিপীড়িত কিংবা শোষিত। হাতের কাছে এক জন রেডিমেড নিপীড়িতকে পেয়ে, নিপীড়িতদের, মানে ওকে নিয়েই লেখা গল্পটা বেঁকাকেই শুনিয়েছিলাম। গল্পটার নাম ছিল ‘পচার বউয়ের অলিন্দ নিলয়’। শুরুতে ছিল পচার বউয়ের ভর হয়। এর ফ্রয়েডীয় বা ইয়ুংগীয় ব্যাখ্যা কী হতে পারে জানার দরকার নেই ওর, তবে থুতু ছেটানোর একটা অদম্য বাসনা ওর অন্তর্গত নিউরোন-শৃঙ্খলে খেলা করে... আড়াই হাজার শব্দ শুনতে হয়েছিল ওকে। গল্পটার শেষে ছিল, পচা রুইদাসের বউ ক্রমশ দেবী হয়ে উঠছিল বলে ওই গ্রামের এক ধনী ব্রাহ্মণের প্রতিষ্ঠিত জগদম্বার রমরমা কাটতি হচ্ছিল না। তাই পচার বউকে চক্রান্ত করে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হল। বেঁকাকে জিজ্ঞাসা করলাম, পচার বউকে কেন মরতে হল বল। ও বলল, কালে পেয়েছিল, কপালে নেকা ছিল, ভাগ্যে যদি নেকা রয়, অমেত্য খেলেও মরণ হয়।

১৯৭৮ সালে প্রথম পঞ্চায়েতের ভোট হয়। কুরুডিহা গ্রাম থেকে বেঁকা রুইদাসকে সিপিএম প্রার্থী করল। তখন জানলাম, ওর নাম বঙ্কিম। পোস্টার দেখলাম, বঙ্কিম রুইদাসকে ভোট দিন। হতে পারে সিটটা ‘এস.সি’র জন্য সংরক্ষিত ছিল। ও জিতল। ওর বউয়ের ওপর কালীর ভর হয়, সুতরাং না জেতার কারণ ছিল না। এ বার থেকে ওকে বেঁকা না বলে বঙ্কিমই বলব।

বঙ্কিম আমাদের অফিসঘর ঝাড়ু দিত ঠিকই, কিন্তু সরকারি কর্মী ছিল না। কনটিনজেন্সি বিল করে সামান্যই মাইনে দেওয়া হত। ও বলেছিল, লেম্বর হইছি বল্যে কি কাজ ছাড়ব নাকি? লেম্বরগিরির কী বুঝি! উরা বইল্যেক আমি ভুটে দাঁড়াইলাম, মায়ের দয়ায় জিতাইটাও হল। তো আমি কী করব? ১৯৮০ সালে আমি ওই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আকাশবাণীতে এলাম। আসার আগে এক অমাবস্যায় গেলাম বঙ্কিমের বাড়ি। উঠোনে দুটো হ্যাজাক, লাল কাচ দেওয়া। উঠোনময় লাল আলো। একটা লাল ঝান্ডাও পোঁতা আছে। একটা ছেলে কলাপাতায় ঢেলে জবাফুল বিক্রি করছে। উঠোনে বঙ্কিমও ধুতি আর লাল শার্ট পরে (কম)রেড। ওর ভর হওয়া বউকে নানা রকমের আর্জি জানাচ্ছে নানা রকমের মানুষ। সে কাউকে বলছে, বেবস্থা করে দুব, কাউকে বলছে, কালো বেড়ালের গু দিয়ে কপালে তেলক কাটবি। কাউকে বলছে, তোর গুষ্টির ক্যাঁতায় হাগি। সে হাত জোড় করে বলছে, রাগ কোরো না মা, পরের অমাবস্যায় জোড়া মোরগ বলি দিয়ে যাব। সে দিন ঘণ্টা দুয়েক ছিলাম, গোটা চারেক মোরগ বলি হতে দেখেছিলাম। মোরগের লাল রক্তে হ্যাজাকের লাল আলো। অমাবস্যার পর দিন কমরেড বঙ্কিম অফিসে আসত না। ধকল যেত কিনা, তা ছাড়া মোরগগুলোর সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে মদটাও বেশি খাওয়া হয়ে যেত।

২০০৮ সালে দুর্গাপুর থেকে ফেরার পথে এক বার কুরুডিহা গেলাম। শুনলাম বঙ্কিম ভোট হেরে গেছে। দীর্ঘ দিন পঞ্চায়েতের মেম্বার ছিল। বাড়িটা পাকা। ওর বউয়ের এখনও ভর হয়, তবে লোকজন তেমন হয় না। বঙ্কিম বেশ মোটা হয়েছে। সামান্য ভুঁড়িও। চেয়ারে বসাল। হাত জোড় করে বলল, একটা নিবেদন আছে। আমি আপনাকে দু-চারটে আনসান কথা বলব। সব মিছামিছি। মা’কে তুষ্ট করার জন্য। আগে কত লোক আসত, কত লোককে কত কিছু পাইয়ে দিতাম। এখন কেউ আসে না, মায়ের মন খুব খারাপ কিনা... এর পর আমাকে বলতে লাগল, আর আসার সময় পালেননি? ইখন দেরি করে ফেলাইছেন। ঠিক টাইমে না এলি আমার কিছু করার নাই, তবু দরখাস্তটা থাক, দেখি কী করতে পারি। মন্ত্রীকে বুলাবুলি করতে হবে।

তার পর খুব আস্তে বলল, আপনার মতো বাবুকেও হাকড়়াইতে পারি, এটা দেখে মা খুব খুশি হবে। বুঝবে, ইখনও আমার পাওয়ার আছে। আসল সুখটা পাওয়ারে— না কি বুলেন?

তার পর, এই বছর গত মাসেই এক বার গিয়েছিলাম। বঙ্কিমবাবুর স্ত্রী মারা গেছেন। উনি এখন আবার মেম্বার। প্রধানও। বাড়িটা দোতলা। উঠোনে প্রচুর জবাগাছ। লাল নয়, সাদা আর নীল। নীল জবাও হালে হচ্ছে। মাটি উৎসবে চারা বিক্রি হয়েছিল। বঙ্কিমবাবু বলেছিলেন, সবুজ জবাটা বিজ্ঞানীরা আজও বানাতে পারলেক নাই। দেওয়ালে দলনেত্রীর ছবি। বারান্দায় অনেক লোক। কাউকে বলছেন, বেবস্থা করে দুব, কাউকে বলছেন ক্যাঁতায় আগুন, কাউকে বলছেন, ঠিক আচে নবান্নে জানাই দুব। ওঁরও যেন ভর হচ্ছে, দেওয়ালের দেবীর!

swapnoc@rediffmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement