রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share:

নাম বিভ্রাট

Advertisement

পিনাকী ভট্টাচার্য

জার্মান চকোলেট কেকের সঙ্গে জার্মানির কোনও সম্পর্কই নেই। কস্মিনকালেও জার্মানিতে এই চকোলেট কেক তৈরি হয়নি। ১৯৫৭ সালে টেক্সাসের এক খবরকাগজে ‘বেকার’স জার্মানি’স চকোলেট কেক’-এর রেসিপি ছাপা হয়। জেমস বেকার ছিলেন আমেরিকার প্রথম চকোলেট ফ্যাক্টরিতে লগ্নিকারী, বেকারির সঙ্গে তাঁর কোনও সম্বন্ধ ছিল না। তাঁর এক বংশধরের কর্মচারী ছিলেন স্যামুয়েল জার্মানি বলে এক ভদ্রলোক। তাঁর তৈরি কেকের রেসিপিই ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ব্যক্তির কৃতিত্ব দেশের কাছে হেরে গেল— জার্মানি’স চকোলেট কেক হয়ে গেল জার্মান চকোলেট কেক।

Advertisement

ফ্রেঞ্চ ফ্রাই-কে ফ্রান্সে বলে ‘পম ফ্রিৎ’ আর ফ্রান্সের বাইরের দেশগুলোতে আমরা বলি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, যার আদতে জন্ম বেলজিয়ামে। লম্বা সরু ফালি করে কাটাকে ‘ফ্রেঞ্চিং’ বলে। আলু ফ্রেঞ্চিং করে ভাজলে সেটাকে এক সময় ‘ফ্রেঞ্চিং ফ্রাই’ বলা হত, তা থেকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।

‘বম্বে ডাক’ খুঁজতে যাঁরা বম্বের পুকুর পাড়ে গিয়েছেন, তাঁদের জানাই, এটা ভেসে বেড়ানো হাঁস নয়। এটি এ-দেশীয়দের বিবমিষা-সৃষ্টিকারী ও পূর্ববঙ্গীয়দের উল্লাস-সৃষ্টিকারী শুঁটকি মাছের ইংরেজি নাম।

টার্কি পাখির মাংস পৃথিবীর প্রায় সব খাদ্যরসিকের কাছে এক অতি উপাদেয় বস্তু। কিন্তু এই টার্কি পাখি কোনও ভাবেই টার্কি বা তুরস্ক দেশের আদিবাসী নয়। বরঞ্চ আমেরিকার সঙ্গে টার্কি পাখির এক আত্মিক সম্বন্ধ আছে। সাহেবরা আমেরিকায় পাড়ি জমানোর পর তাঁদের সঙ্গে টার্কি পাখির আলাপ পরিচয় হয় আর সেই শুরুর দিনগুলোতে টার্কি পাখির নীরব আত্মাহুতি সাহেবদের উদরপূর্তিতে প্রভূত সাহায্য করে। সেই থেকেই আমেরিকানরা টার্কি পাখিকে এত ভালবাসে, এক সময় বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন ঈগল পাখির বদলে টার্কি পাখিকে আমেরিকার জাতীয় পাখি হিসেবে ঘোষণা করার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন! তাঁর যুক্তি ছিল, ঈগলের নৈতিক চরিত্র খারাপ, মানুষের মতোই ওরা ডাকাতি ছিনতাই করে— বরঞ্চ টার্কি এক দিকে আমেরিকার আদি বাসিন্দা, অন্য দিকে তাদের চরিত্র দিব্যি চমৎকার।

টার্কি নামটা প্রথম ব্যবহার হয়েছিল আফ্রিকার গিনি-র ফাউলের জন্যে, যা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে প্রথম নিয়ে উপস্থিত হয় তুরস্কের বণিককুল। এ দিকে একই সময় স্প্যানিশরা মেক্সিকো থেকে টার্কি পাখি নিয়ে আসে। তাই মহা বিভ্রাটের সৃষ্টি হয়। আজকের ফরাসিতে যে টার্কিকে ‘দিন্দ্য’ বলা হয়, সেটার উৎস কিন্তু এই বিভ্রাট। ফরাসিরা সেই জমানায় টার্কিকে ‘পুল্যে দ্য ইন্দে’ বা ভারতের মুরগি বলত— কারণ তখনও স্পেন বা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জকে ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষ মনে করত, আসল ভারতবর্ষের হদিশ তখনও তারা পায়নি।

হ্যামবার্গার নামটা শুনলেই আজও অনেক খানদানি নিরামিষভোজীর ভ্রু কুঁচকে যায়, যদিও হ্যামবার্গারের সঙ্গে হ্যাম কেন, কোনও ধরনের শুয়োরের মাংসের কোনও সম্বন্ধ নেই। সম্বন্ধ আছে হ্যামবুর্গ শহরের— যেখানে ১৮৮৫ সালে এক গ্রামীণ মেলায় হ্যামবার্গার নামের স্যান্ডউইচের জন্ম, আর জন্মশহর থেকেই তার নামকরণ।

আইসক্রিম আর কেক দিয়ে তৈরি সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় ডিজার্ট ‘বেক্‌ড আলাস্কা’ বানিয়েছিলেন আমেরিকার দেল-মনিকো রেস্তোরাঁর শেফ চার্লস রানহফার, আমেরিকার আলাস্কা ক্রয়ের দ্বিতীয় বার্ষিকী উদ্‌যাপন করতে।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

হাফ সি.এল-এর বউ

আমি ‌বি.টেক পাশ করার পর প্রথম চাকরি পেলাম ঘাটশিলায়। হিন্দুস্তান কপার লিমিটেড-এর মৌভান্ডা-র কারখানায়, তামা নিষ্কাশনের পর আকরিকের যে অংশ থেকে যেত, তা থেকে নানা মূল্যবান ধাতু নিষ্কাশন করা হত। সবচেয়ে দামি সোনা, আমার পোস্টিং হল সেই সোনারুপোর প্ল্যান্টে। আমার বস মিত্রসাহেব ডেকে বলেছিলেন, ‘আমরা এই প্ল্যান্টে খুব বিশ্বস্ত লোক ছাড়া কাউকে ঢোকাই না। এখানে ঢোকা আর বেরনো, দুটোই কঠিন।’

দেখলাম, আক্ষরিক অর্থেই তাই। সোনার প্ল্যান্টে ত্রৈলঙ্গস্বামী হয়ে, শুধু একটা টাওয়েল পরে ঢুকতে হত। সিকিয়োরিটির লোক মেটাল ডিটেক্টর ঘোরাত সেই টাওয়েলের ওপর, অনেক ক্ষণ। অনুমতি পেলে ভেতরে গিয়ে, টাওয়েল ছেড়ে, পকেটহীন জামা আর প্যান্ট পরতে হত। যখন-তখন বেরনো যেত না। ছুটির পর সেই স্পেশাল জামাপ্যান্ট ছেড়ে, টাওয়েল পরে, বেল টিপে সিকিয়োরিটিকে ডেকে, ফের অন্তর্বাসহীন শরীরে মেটাল ডিটেক্টরের অবাধ প্রমোদ-ভ্রমণ শেষে, নিজের জামাপ্যান্ট পরার ছাড়পত্র মিলত।

প্রতি মাসে প্রায় কুড়ি কিলো সোনা আর চারশো কিলো রুপো তৈরি হত। তিন মাস অন্তর পঞ্চাশ-ষাট কেজি সোনা জমা করতে যেতে হত মুম্বই, ভারত সরকারের টাঁকশালে। সেখানে দেখেছিলাম, গুপ্তধনের মতো তাল তাল বিশুদ্ধ সোনা। চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। টাঁকশালে সোনা ওজন হত ব্রিটিশ আমলের দাঁড়িপাল্লায়। এক মিলিগ্রামও এদিক-ওদিক হত না। কোনও কারণে আমার আনা সোনার ওজন আর টাঁকশালের দাঁড়িপাল্লায় মাপা ওজন না মিললে, কপালে বিস্তর দুর্ভোগ জুটত।

সোনার বাংলা, সোনার ছেলে, সোনামণি— এ-সব সোনান্বিত কথা যাঁরা বলেন, মনে হয় না তাঁরা কখনও সোনার কারখানায় ঢুকেছেন। আমার কাছে আমার অফিসটা ছিল যেন ‘রক্তকরবী’ নাটকের জলজ্যান্ত যক্ষপুরী।

অদ্ভুত সব নিয়ম। কথাবার্তার ওপরও নিষেধাজ্ঞা। খুব দরকারি কাজের কথা ছাড়া, আর কথা বলার অধিকার ছিল না। আমরা অধস্তন কর্মীরা সে নিয়ম মানছি কি না, সেটা নাকি মিত্রসাহেব ঠিক খবর পেতেন। ‘চর’ ছিল। কেউ জানত না কে। সবাই একে অপরকে সন্দেহ করত।

বিশুদ্ধ আর বিশাল সোনা দেখার জন্য অনেক গণ্যমান্য মানুষ—চিত্রতারকা, রাজনীতিবিদ— মাঝেমধ্যেই পা দিতেন আমাদের সোনার প্ল্যান্টে। এক বার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী আর বউমা এসেছিলেন। দুই অসমবয়সী নারীকে দেখেছিলাম, দশ কিলোর একটা সোনার বাট নিয়ে অনেক ক্ষণ হাতে ধরে রাখতে। বউ আর শাশুড়ির মধ্যে প্রায় একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল, কে বেশি ক্ষণ সেই বিশাল সোনা হাতে ধরে রাখতে পারেন। ওঁরা সোনার সঙ্গে নিজেদের ছবি তুলতে চেয়েছিলেন। ছাড়পত্র ছিল না।

এক দিন অফিসে বসে সোনার হিসেব মেলাচ্ছি। হঠাৎ মনে হল, একটা মুখ কাচের দরজার ও-পারে দেখা দিয়েই সরে গেল। উঠে, দরজা খুলে দেখি, রামকৃষ্ণ হাঁসদা দাঁড়িয়ে। আমাদের প্ল্যান্টের সবচেয়ে পুরনো কর্মী। সবাই ওকে ‘দাদু’ বলে। আসল বয়স যে কত, কেউ জানে না। রামকৃষ্ণ এক দিনের জন্যও অফিস কামাই করত না। রোববারেও আসত, বন্ধ অফিসের বাইরে সিকিয়োরিটির সঙ্গে গল্পটল্প করে চলে যেত। বললাম, ‘কী রে, কিছু বলবি?’

‘টুকুন কথা ছিল।’

‘তো বল!’

‘বইলতে লারব।’

‘ঠিক আছে, বলতে হবে না। যা, কাজ করছি।’

‘জরুরি কথা বটে। বইলতে লারব।’

আচ্ছা গেরো! জরুরি কথা অথচ বলতে পারবে না। আমি ফকিরকে ডাকলাম। ফকির রামকৃষ্ণ হাঁসদার সবচেয়ে কাছের লোক। ওরা একসঙ্গে ডিউটিতে আসত, একসঙ্গে ফিরত। আমার অবাক লাগত: তাল তাল সোনা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও, কোনও দিন ওদের চোখেমুখে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিক কিছু দেখিনি। যেন সোনা না, মাটির তাল নিয়ে কাস্টিং করছে। দিব্যি হাসি-মশকরা করত, আর অধিকাংশ সময়ই, ঠাট্টার কেন্দ্রে ‘দাদু’, রামকৃষ্ণ। ও কক্ষনও কারও ওপর রাগ করত না। সোনার কারাগারে রামকৃষ্ণ ছিল এক উজ্জ্বল উপস্থিতি।

ফকির বলল, ‘দাদু, সাহেবকে বল। লাজ হচ্ছে?’

‘একটা সি.এল লিবো বটে।’

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। রামকৃষ্ণ আর সি.এল? দরখাস্তটা নিলাম। অন্য কেউ ভরে দিয়েছে। তাতে হাফ সি.এল-এর কথা লেখা।

‘আধখানা সি.এল নিয়ে কী করবি?’

‘বিহা করব!’

‘হাফ সি. এল-এ বিয়ে? তোর তো একটা বউ আছে না? সে কোথায়?’

‘পলায় গেছে। হাফ ছুটি লে, মুর্গি লিয়ে ঘর যাব, বিকালে বিহা হব্যাক, টুকুন লাচ হব্যাক, হাঁড়িয়া হব্যাক। রাত বাদে ডিউটি আসব। কামাই হব্যাক নাই।’

আমি কথা বাড়ালাম না। বললাম, ‘ঠিক আছে এখন যা, কাজ কর।’ রামকৃষ্ণ তখনও দাঁড়িয়ে। ‘কী রে, আবার কী দরকার?’

‘টুকুন লোন লিব। খরচা আছে বটে। লোক খাবে।’ একটা কাগজ এগিয়ে দিল, তাতে সব ভরা, শুধু ডেট অব বার্থটুকু বাদে। ‘জন্মসালটা বল, আমি ভরে দিচ্ছি।’ রামকৃষ্ণ নীরব। ‘কী হল সালটা বল, না হলে লোন হবে না।’

‘লোন হব্যাক নাই? বিহা হব্যাক নাই?’

‘নিজের বয়স যে জানে না, তার আবার বিহা?’

‘তুই একটা ভরাই করি দে।’

‘ও ভাবে হয় না। সরকারি ব্যাপার।’

অনেক ক্ষণ মাথা চুলকোল। তার পর, মুখটা আলো হয়ে উঠল হঠাৎ। ‘সেই যে, যে বছর মৌভান্ডারে সার্কাস থেনে একটো হাতি বনে পলাই গেল, সে বছর আমার মা’র বিহা হল বটে। নে এ বার হিসাব লাগা, আমি খাবার জল লিয়ে আসি...

আমার সোনারুপোর হিসেব সে দিন আর হল না।

অশোক চক্রবর্তী, আনোয়ার শাহ রোড

akcban@yahoo.com

যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ পিএনপিসি
হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement