সাদার ফাঁদ পাতা ভুবনে। মাইকেল জ্যাকসনকেও ছাড়েনি।
অভিনন্দন কঙ্গনা রানাওয়াত। চমৎকার অভিনয় করছেন আপনি। রিল-এ, রিয়েল-এও। অবশ্য ‘ফরসা হওয়ার ক্রিমের বিজ্ঞাপন করতে চাই না, যতই টাকা দিক’ মার্কা শহর-সরগরম বিবৃতিটা ঠিক কবে দিয়েছিলেন, তাই নিয়ে লোকের মনে বিস্তর ধন্দ। অনেকেই বলছেন, বছর দুয়েক আগেই কথাটি বলে হাজার হাততালি কুড়িয়েছিলেন। ইদানীং সোনার সময় চলছে আপনার কেরিয়ারের, চার দিকের আড্ডা-আলোচনা-মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন, তাই স্ট্র্যাটেজি হিসেবেই অতীতের ওই বাণীটিকে টেনে এনে ফের একটু প্রশংসার ব্যবস্থা।
তা, প্রশংসা হোক। আমার কিছু এসে যায় না। আমাকে চিনলেন না? আমিই সেই ‘ফরসা ভরসা কোং’, মানে, বলতে পারেন, ফেয়ারনেস ইন্ডাস্ট্রি। লোকের মনে ফরসা হওয়ার লোভ জাগিয়ে কোটি কোটি মুনাফা লুটি। আমার পরিবারের এক জনেরই দু’কোটি টাকার অফার সটান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আপনি। তার পর মিডিয়ায় গিয়ে বললেন, ফেয়ারনেস ক্রিমের কোনও বিজ্ঞাপনে কক্ষনও কাজ করবেন না। ছোট্টবেলা থেকেই নাকি ফরসা হওয়া বা না হওয়ার এই ঝঞ্ঝাটটাই আপনি বোঝেন না। বড় হয়ে সেলেব্রিটি হয়েছেন যখন, তখন পাবলিক ফিগার হওয়ার দায়িত্বটুকুও নিতে চান। ভক্তদের সামনে যেমন-তেমন উদাহরণ রাখবেন না। তার পর আবার, ছোট বোনের কর্তব্যটাও তো আছে। বাড়িতে বড় দিদি আছেন। তিনি মেঘলা ত্বকের অধিকারিণী। তাঁর মনে আঘাত দিতে পারবেন না আপনি।
তখনই বুঝলাম, আসল সমস্যাটা ঠিক কোন সেন্সিটিভ কোণটাতে। কিন্তু, এই কথাবার্তা আর হইহল্লায় আমায় কি এতটুকু আঘাত করা গেল, ম্যাডাম কুইন? আঘাত তো দূর, এতটুকু আঁচড়ও কাটতে পেরেছেন আমার দৈত্য-সাম্রাজ্যে? ছোঃ! এ দেশের নাম ভারতবর্ষ মাই ডিয়ার। বহু দিন আগে সেলুকাস একে দেখে এমনি এমনি বিচিত্র বলে যাননি। বিগলিত প্রশংসা না কচু, সলিড গালাগাল দিয়ে গিয়েছিলেন। লোকে বোঝেনি। এই দেখুন না, যুগ-যুগ ধরে ইউরোপীয়রা ভারতীয়দের ‘বাদামি ত্বক’, ‘কালা আদমি’ বলে ক্রমাগত খুঁচিয়েছে-কামড়েছে-অত্যাচার করেছে। তো লজিক বলে, এমন ওপেন বর্ণবিদ্বেষের এগেনস্টে আসমুদ্রহিমাচল এককাট্টা হয়ে লড়বে, যত সময় আর শিক্ষা এগোবে, তত জোরদার হবে তার আন্দোলন। কিন্তু এখানে গোটাটাই উলটো হাঁটলি গঙ্গারাম। এত বৈষম্য দেখে তেতে গিয়ে এরা নিজেদের মধ্যেই আরও সাব-ডিভিশন বানাতে বসে গেল। তুমি গম-রঙা, আমি দুধে-আলতা আর ও হল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। আর ওই যাচ্ছে কুচকুচে কালো। ঢিল মারো। চাবুক আনো। এমন এক বুদ্ধু-বোকার আস্তানায় যে কোনও ফেয়ারনেস প্রোডাক্ট যে সুপারহিট করবে, সে তো ক্লাস ওয়ানের অংক। কিন্তু এমন একখানা যে লেজেন্ড হয়ে যাব, সেটা খোদ আমারই কল্পনাতে ছিল না।
প্রথমে কাঁচা হলুদ-বেসন বাটা, লেবুর রস দিয়ে স্টার্ট করেছিলাম, তার রেসপন্স দেখে কুটিরশিল্পটাকে ইন্ডাস্ট্রি করে গুছিয়ে বসলাম। তার পর? গেল ২০১০ সালে হিসেব কষে দেখেছি, আমার ইন্ডাস্ট্রির বহর দাঁড়িয়েছে ২,৬০০ কোটি টাকা। শুধু ২০১২ সালে ২৩৩ টন ফরসা হওয়ার পণ্য ব্যবহার করেছে হাঁদা ভারতীয়রা। সিম্পল করে বললে, দেশে চায়ের থেকে বেশি বিক্রি হয়েছে ফেয়ারনেস ক্রিম, সাবান। আপনি তো এখন ‘পাকা’ অভিনেত্রী, যদি কখনও কোনও কেস স্টাডি করতে প্রত্যন্ত গ্রামে বা ছেঁড়াফাটা বস্তিতে যান, দেখবেন সেখানে হয়তো ডাব্বায় আটা নেই, কিন্তু ঠাকুরের ফোটোর পাশে আয়নার নীচের তাকে ঠিক জ্বলজ্বল করছে একটা ফেয়ারনেস ক্রিমের টিউব।
আমি তো ঈশ্বরই। সকলে মিলেই তো ঠিক করে নিয়েছে, কালো হওয়া একটা খারাপ অসুখ। তাই যে কালো তার জীবনসঙ্গী পেতে মুশকিল, চাকরি পেতেও প্রবল প্রবলেম। তার সমস্ত গুণ, বিশেষত্ব, প্রতিভা, পরিশ্রম ওই ত্বকের রঙেই চাপা পড়ে যায়। ছোট থেকেই লাখো একটা অন্যায়-অবিচারের শিকার হতে হয় তাকে। এই সব কষ্ট থেকে নিস্তারের রাস্তাটা দেখাই বলেই তো আমাকে নিয়ে এমন উন্মাদনা। শুধু কি ক্রিম, সাবান? সানস্ক্রিনের বিশাল রেঞ্জ, মেক-আপ কিট, পার্লারের অজস্র স্কিন লাইটনিং ট্রিটমেন্ট, ফেয়ারনেস ফেশিয়াল, ব্লিচিং, অ্যান্টি-ট্যানিং — চরাচর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি আমি। চাহিদা এমন, ব্যক্তিগত প্রত্যঙ্গকে পর্যন্ত সফেদ করার মলম পর্যন্ত বার করতে হয়েছে আমাকে। রমরম করে বিক্রি হচ্ছে তা।
আরে মশাই, আপনার ফিল্ম-দুনিয়া তো আমার সব চাইতে বড় খিদমতগার। জিজ্ঞেস করুন না আপনার শ্যামাঙ্গী সহকর্মীদের। দেখবেন কত জন রাগ আর অপমান উগরে দেয়। বলবে, কী ভাবে তাদের জন্মের অহংকার গায়ের রংখানাকে পোঁচের পর পোঁচ রং-পাউডার চাপিয়ে হালকা করার চেষ্টা করে মেক-আপ আর্টিস্ট। তার পর হেসে হেসে ছুরি বেঁধায় লাইট-ক্যামেরার কর্মীরা। ‘ভাববেন না, এডিটিংয়ের সময় আপনাকে ফরসা বানিয়ে দেব ঠিক।’ তার পর আছে ‘ডাস্কি বিউটি’ ‘সাল্ট্রি লুকস’ বলে দাগিয়ে দেওয়া। আর যারা কিছু বলেটলে না, ক’দিন পরে দেখবেন, তারা কোনও কসমেটিক মন্ত্রবলে যেন নিজেদের রংটাকে পরিষ্কার করে ফেলেছে। বড় বড় হিট নায়িকার প্রথম দিককার ছবি আর এখনকার মোমের মূর্তি মিলিয়ে দেখুন। মেলানিন ট্রিটমেন্ট করে কালো রংকে বিসর্জন দিয়ে এসেছেন ওঁরা। মাইকেল জ্যাকসনের মতো। এঁরা সক্কলে আমার দাসানুদাস।
সবই তো নিশ্চিত জানা কথা আপনার। আপনার আগে-পরে বিদ্রোহের চেষ্টা তো অনেকেই করেছে। রণবীর কপূর, রণদীপ হুডা। ওঁরাও ফেয়ারনেস অ্যাড করেন না। আর নন্দিতা দাস। তিনি ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ বলে যে ক্যাম্পেনটা চালাচ্ছেন এত পরিশ্রম ঢেলে, তাতে চারটে বাহবা ছাড়া কী পেয়েছেন? কত বুঝিয়েছেন সবাইকে, কৃত্রিম উপায়ে এই ফ্যাকাশে রং পেতে গেলে পরে বড় দামও দিতে হয়। ত্বক নষ্ট হয়ে যায় এক সময়। ক’জন শুনেছে? তার পর নিজেই তো রেগে টং হয়ে বলেছেন, ওঁর কাছে নাকি খালি নিম্নবিত্ত নিপীড়িতা মেয়ের চরিত্রই আসে। শিক্ষিত শহুরে কোনও মেয়ের গল্প নিয়ে কেউ এলে অনুরোধ করেন, আপনার গায়ের রংটা একটু মেজেঘষে নিন না প্লিজ।
কেন বারবার বর্ণবৈষম্য রেসিজ্ম এ সব বলে এত জটিল সব শোরগোল তুলছেন আপনারা? এত সাদা-কালো, ‘তোর আছে-আমার নেই’-এর ভারী কথাকে সরিয়ে রেখে সহজ কিন্তু কঠিন বাস্তবটাকে দেখুন। নাক-চোখ-মুখ যেমনই হোক, গায়ের রংটা সাফ হলেই দেখতে ভাল হওয়ার দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে থাকা যায়। ওই ফ্যাটফেটে রংটা না থাকলে প্রিন্স চার্লস-এর সঙ্গে পাড়ার পঞ্চানন্দের কোনও তফাত থাকত না।
সত্যি কথা সব সময়েই এরকম বিদ্বেষরসে ভরাই হয় মিস রানাওয়াত। আপনি তো নিজেকে জ্ঞানবুদ্ধিবিবেকসম্পন্ন মানুষ বলে দাবি তুলছেন। তাই ফরসা হওয়ার সপক্ষে কোনও প্রচার চালাবেন না। তার মানে কাউকে বলবেন না যে সে নিজেকে আর একটু সুন্দর করে তুলুক। সবাইকে বোঝাতে চান যে যেমন জন্মেছে তেমনটা নিয়েই খুশি থাকুক! তাই নিয়েই গর্ববোধ করুক! এই তো? কিন্তু, এক মিনিট, বলুন তো, আপনি নিজে নিজেকে আরও সুন্দর করে তোলার ক্রমাগত চেষ্টা করে চলছেন না? প্রতিনিয়ত আরও একটু রূপসি হওয়ার চেষ্টা করছেন না? ক্লাস সিক্সের স্কুলপড়ুয়া আপনি যেমনটা ছিলেন, তার সঙ্গে আজকের এই গ্ল্যামার-কুইন ফ্যাশন-গডেস কঙ্গনা রানাওয়াত-এর কোনও ফারাক নেই? মাঝখানে কি সত্যি কোনও ফেয়ারি গডমাদার দাঁড়িয়ে নেই? যাঁর কাঠির ছোঁয়ায় তরতর করে বেরিয়ে আসে হাজার-হাজার রূপচর্চা-বিধি, ফাউন্ডেশন লোশন-কমপ্যাক্ট-প্যানকেক, অ্যান্টি-পলিউশন অ্যান্টি-এজিং ড্যামেজ-কন্ট্রোল দামি দামি সুগন্ধি শিশি-বোতল, বিউটি পার্লার, শপিং ব্যাগ, ডিজাইনার-স্টাইলিস্ট? এত বৈষম্য-বিরোধী হতে গেলে কিন্তু ওয়াক্সিং করাও ছেড়ে দিতে হয়, থ্রেডিং-ও বাদ। চিরতরে রোমমুক্তির লেজার ট্রিটমেন্টকেও বরখাস্ত করুন। ঘুরুন দেখি নিজের আদিম প্রাকৃতিক রূপে। ব্রণ বেরলে তাকে পুষে রাখুন। চুল বাড়ুক খেয়ালখুশি, এলোমেলো। কাটবেন না, কোনও স্টাইল করবেন না তাতে। পেডিকিয়োর, ম্যানিকিয়োর, বডি পলিশিং, ফেশিয়াল সব তুলে দিন। হাত-পায়ের নখ উঠুক ছেতরে-কেতরে, উঁহু তাতেও রং মোটে নয়। লিপস্টিকও মানা। পারবেন ফ্রিডা কাহলোর মতো অমন ‘ন্যাচরাল বিউটি’র গনগনে গৌরব নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে? রোদ্দুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রং জ্বলিয়ে শুটিং করবেন আপনি? রূপে রোদ-জলের কালি পড়লে আমার কাছে আসবেন না তো সাহায্যের জন্য?
আপনাকে ‘ডিভা’ আমরাই বানিয়েছি বন্ধু। আমি আর আমার সাঙ্গোপাঙ্গরা মিলে আপনাকে এগিয়ে দিয়েছি রূপের হাটের সামনের সারিতে। কেউ আপনার ত্বকে মাখনের জেল্লা বুলিয়েছি, কেউ চোখের তারাকে সাগরনীল করেছে, কেউ সিল্কি চুল যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছে, কেউ সুডৌল করেছে আপনার শরীরের ছাঁদ, কেউ নিখুঁত টানে নরম আর লাল করেছে ঠোঁট। আপনি যদি আমাদের বিরোধিতা করতে চান, প্রথার বিপরীতে চলতে চান, তবে সবার আগে নিজের শরীর থেকে এই গ্ল্যামারের গয়নাগুলোকে নামিয়ে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে যে! কারণ এই সব সুবিধার ওপর ভর দিয়েই তো আজ আপনি পুতুল-মেয়ে। সিস্টেমের মধ্যে থেকে, তার খেয়েপরে তো সিস্টেমকেই চ্যালেঞ্জ ছোড়া যায় না সিস্টার। অন্যকে মুক্তির স্বপ্ন দেখানোর আগে নিজেকে মুক্ত হতে হবে তো!
শাহরুখ-জন-শাহিদ-দীপিকা-প্রিয়ঙ্কাও বিবেচনাহীন নন। ওঁরা আসলে এই কথাগুলো বুঝে গুলে গিলে ফেলেছেন। তাই তো টিভিতে কাগজে ‘জয় ফেয়ারনেসের জয়’ বলে বেড়াচ্ছেন। আপনি শুধু সবার সামনে নতি স্বীকার করতে একটুখানি কুণ্ঠা বোধ করছেন। ভাঙছেন তবু মচকাচ্ছেন না। একটা সন্ত ইমেজ বানিয়ে রাখার মোহে জনসমক্ষে একটু অভিনয় করছেন হয়তো। নিজের সামনেও অভিনয় করছেন কি?
আপনার প্রতি বিন্দুবিসর্গও খারাপ লাগা নেই। বরং কৌতুক ও মমতা অনুভব করছি। এত হইচই তুলে নেগেটিভ পাবলিসিটির ছলে আমার পরাক্রমটাই প্রতিষ্ঠা করে বসলেন আপনি। তাই শেষমেশ একেবারে বিনাপয়সায় অ্যাডটা করে দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আপনার বিশিষ্ট ও বিশ্বস্ত বন্ধু ফেয়ারনেস রেঞ্জ