ছবি: রৌদ্র মিত্র।
চোপ! গণতন্ত্র চলছে। যাঁরা এখনও দেখতে পাচ্ছেন না, কেমন সনাতন ধর্মে জারিত হয়ে সংসদীয় রাজনীতি পুনঃ পুনঃ ‘অচ্ছে দিন’ নিয়ে আসছে, গোমূত্রে গোবরে করোনা সারছে, এমস-এ গায়ত্রী মন্ত্র গুঞ্জরণের আবেগে নেমে আসছেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়, ধন্বন্তরি—তাদের মাথায় বজ্রাঘাত হোক।
সে না হয় হলও! কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এমন কঠোর-কঠিন বজ্রাঘাতও মাথা পেতে নেওয়ার জন্যও যে কিছু লোক পণ করেছে। সেই সারির সামনে এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে চিত্রশিল্পী মঞ্জুলকে। ভদ্রলোক কার্টুন এঁকে ফেলেছিলেন। একেবারে প্রতিবাদমূলক কার্টুন! ফলে আপাতত যে সংবাদ সংস্থায় কাজ করতেন, সেখান থেকে সাসপেনশন অর্ডার পেয়েছেন, আর হর্তা-কর্তা-বিধাতাদের কাছ থেকে নোটিস।
যে রাষ্ট্রধর্ম গ্রহণ করে ভারতভাগ্যবিধাতা উন্নতির জয়ধ্বজা উড়িয়ে চলেছেন, মুশকিল হল, সেই ধর্মেরই সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা বোধহয় তাঁরা ঠিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। কখনও কখনও ঠেকায় পড়ে মানতে হলেও মনে যে নিচ্ছেন না, সে তো আচরণেই স্পষ্ট। মানলে আকছার এমন বিরুদ্ধমতের অবদমন, যা একেবারেই শাস্ত্রসম্মত নয়, এ ভাবে করতে পারতেন না। সমাজকর্মী, পণ্ডিত, শিক্ষক মায় সাংবাদিক থেকে শুরু করে সকলের কণ্ঠরোধ করবার এ এক অদ্ভুত প্রবণতা শুরু হয়েছে।
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে বলে প্রবাদ হাঁকলেই চলবে না। স্বয়ং মনু মহারাজ বলছেন, দেশ অরাজক হলে কুকুরও নাকি যজ্ঞের ঘি চেটে দেবে। কিন্তু আগে চাটুক, তার পর না-হয় অমঙ্গল বা অরাজকতার কথা।
শাস্ত্রে দেখি, অর্জুনের প্রপৌত্র জনমেজয় তাঁর তিন ভাই শ্রুতসেন, উগ্রসেন ও ভীমসেনকে নিয়ে যজ্ঞ করছিলেন। সে সময় একটি কুকুরছানা সেখানে চলে এলে জনমেজয়ের ভাইয়েরা তাকে ঠেঙিয়ে তাড়িয়ে দেয়। বাচ্চাটি কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে কুকুর-মায়ের কাছে উপস্থিত হওয়ায় সে স্বাভাবিক ভাবেই ছানাকে জিজ্ঞেস করে— কী করেছিলি? ছানা বলে— নাপরাধ্যামি কিঞ্চিৎ, নাবেক্ষে হবীংষি নাবলিহে ইতি। অর্থাৎ, আমি তো কিছুই করিনি মা। যজ্ঞের ঘি তো চাটিইনি, এমনকি আমি সে দিকে ফিরেও তাকাইনি।
এই বার আসল ব্যাপার। সেই কুকুর-মা সম্রাটের সামনে উপস্থিত হয়ে সরবে বলল— এই যে আমার ছেলে, সে কোনও অপরাধ না করলেও তাকে মারা হল কেন?
আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, জনমেজয় এই সামান্যা কুকুরীর কথার কোনও জবাব দিতে পারলেন না। আর তার অপোগণ্ড ভাইয়েরা লজ্জায় অধোবদন হয়ে রইল।
নীতিকথা? শাস্ত্র-অজ্ঞরা মহাভারতের আদিপর্ব নিয়ে একটু মনন-চিন্তন করলে সেটা আর বলার দরকার পড়ত না। করলে জানতেন, একটি কুকুরীও সটান একেবারে রাজামশাইয়ের যজ্ঞাগারে গিয়ে প্রতিবাদী হতে পারে। হ্যাঁ, যে হেতু তার ছানাটিকে পূর্বে অকারণে আঘাত করা হয়েছিল, তাই সম্রাটকেও অভিযোগ শুনে নিশ্চুপ থাকতে হয়।
রূপক থাক, না-মানুষী থেকে মানব পর্যায়ে আসি। ফের মহাভারত। দুষ্মন্ত-সভায় বালক ভরতের হাত ধরে শকুন্তলার প্রবেশ— রাজা, এই নাও তোমার ছেলে।
মনে রাখতে হবে, এ কিন্তু কালিদাসের শকুন্তলা নয় যে, ফুলের ঘায়ে মুচ্ছো যাবে। এ ব্যাসদেবের ভাষ্য। এতে দুর্বাসা, অভিশাপ, আংটি কিচ্ছু নেই। ফলে কণ্বমুনির আশ্রম, তপোবন, আদাড়বাদাড়, লুকিয়ে দেখা, প্রণয় এবং শেষমেশ গান্ধর্বমতে পরিণয় কিছুই না বলে শকুন্তলা বললেন— আমার সঙ্গে সঙ্গমের পূর্বে তুমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে রাজা, শুধু সেটা স্মরণ করো।
রাজার এ দিকে শিরে সংক্রান্তি! মোটেই চিনতে চাইছেন না। ভাবখানা যেন, গরিব মেয়ের সঙ্গে কোথায় কোন বাগানে কবে একটু ফুর্তি-টুর্তি না হয় করেই ফেলেছি, তাই বলে কি সে সব দায় নিয়ে ঘুরতে হবে না কি?
কালিদাসের অমর কাব্যে তবু একটা অজুহাত ছিল— অভিশাপ। একটা নজরকাড়া অভিজ্ঞানও ছিল। এখানে কিন্তু সে সবের ব্যাপার নেই। ব্যাস সটান লিখে বসলেন— রাজার সব কথা মনে পড়া সত্ত্বেও তিনি মিথ্যে বলতে লাগলেন। ব্যস, লাগল ঝগড়া। ডেটিং-এর কোনও কথা দুষ্মন্ত তো মানবেনই না, উলটে শকুন্তলাকে ছোট করা শুরু করলেন— তুমি অনার্য, তোমাদের আর চরিত্র কী, এমনকি শেষটায় চরিত্রহনন পর্যন্ত করলেন। শকুন্তলা নিজের জন্মপরিচয় দিয়ে তিনি যে অপ্সরা মেনকার কন্যা, তাও বললেন। ব্যাপারটা তাতে আরও ঘাঁটল! দুষ্মন্ত যা বলে বসলেন তার মানে দাঁড়ায়— ঠিকই আছে, তোমার মা অপ্সরা, মানে স্বর্গবেশ্যা, তুমিও সেই মায়েরই মেয়ে!
এই বার শকুন্তলা আঁচল কোমরে গুঁজে দুষ্মন্তর মুখে নুড়ো জ্বালা শুরু করলেন। বললেন— সত্য ও ধর্ম রক্ষা তোমার স্বাভাবিক ধর্ম হলেও সেই তুমি কপটতা করছ। আর যখন সব জেনেশুনেও মিথ্যেটাকেই আঁকড়ে থাকবে, তখন তোমার মতো মিথ্যুক কপট লোকের সঙ্গে আমিই বা থাকি কেমন করে— আত্মনা হন্ত গচ্ছামি তাদৃশে নাস্তি সঙ্গতম্। তোমার সাহায্য ছাড়াই আমি এ ছেলেকে মানুষ করব। দেখার বিষয়, ব্যাসের কলম কিন্তু এখানে চাবুক!
ভাবার বিষয় এর পরবর্তী ঘটনাক্রম। এই ঝগড়াঝাঁটির পরই একটা দৈববাণী গোত্রীয় কিছু একটা হয়। রাজা সেটা শুনে চুপসে যায়। একটু খোলা মনে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, সম্ভবত রাজার পারিষদরাই তাঁকে পুনর্বিবেচনা করতে বলেছিলেন। না বলে উপায় কী— একে শকুন্তলার ওই দাপট, তায় ভরতের মধ্যে স্পষ্টতই দুষ্মন্তের ছায়া। সত্যের তেজে পুড়লেন রাজা।
নীতিকথা হাঁকার দরকার নেই। শুধু এটুকুই বলতে হয় যে, শকুন্তলাকে কিন্তু স্বয়ং রাজার দিকে আঙুল তোলার জন্য বন্দি হতে হয়নি।
সনাতন ধর্মটাকে জীবনদর্শনের তত্ত্বে গ্রহণ করলে হয়তো সত্যিই আমাদের অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। কিন্তু মন্দিরের বাইরে কিছু ভেবেই উঠতে পারলাম না। আর সেই মন্দিরের দেবতার আড়ালে, রাজা নিজেকেই স্থাপন করেছে।
না হলে অত বড় বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ এখনকার খুচরো যোগীটোগিদের চেয়ে মনে হয় দর্শনটা ভালই বুঝতেন। সেই তিনি কিনা দেবী-ভাগবত পুরাণে মহামায়া চণ্ডিকার কাছে দুঃখ করে বলছেন— এই যে এত কিছু করে সমুদ্রমন্থন হল, তাতে হলটা কী? অমৃত ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে গিয়ে শ্রীবিষ্ণু তো এই সব দেবাসুরেরই ভাগ-বাঁটোয়ারা করে বসলেন। ভেদাভেদ চরমে উঠল। ও দিকে
তিনি নারায়ণ। জগতের পালনকর্তা। তাঁর ভূমিকাটা কী? প্রথমেই মা লক্ষ্মীকে নিয়ে নিলেন। তা নিলেন নিলেন। তাঁর সাপোর্টে
ইন্দ্র প্রায় বাকি সবই ট্যাঁকস্থ করল।
প্রহ্লাদ একেবারে আরও খোলসা হচ্ছেন— অশ্বরাজ উচ্চৈঃশ্রবা, পেলাম না। গজরাজ ঐরাবত, ফস্কে গেল। সুরভি কামধেনু, তাও ভাগে এল না... ভেবে দেখার মতো, একেবারে নিখাদ নালিশ! তাও শ্রীবিষ্ণুকে সামনে দাঁড় করিয়ে— সুরৈঃ সর্বং গৃহীতং বৈষ্ণবেচ্ছয়া।
ভক্তশ্রেষ্ঠ আরও বলছেন— মানলাম আমাদের রাহু একটু লুকিয়ে অমৃত খেয়ে নিয়েছিল। তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হল যে অমন সত্ত্বগুণের আধার স্বয়ং ভগবান পর্যন্ত চক্র ছেড়ে রাহুর মাথাটাই কেটে ফেললেন— অপরাধং বিনা কামং তদা সত্ত্ববতাম্বিকে?
প্রহ্লাদ এ বারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে আসছেন। বলতে যখন শুরু করেছেন, তখন এটাও বলেই ফেললেন— এমনকি এই যে আমার ধার্মিক দানশীল নাতি (দৈত্যরাজ বলি), তাঁকে পর্যন্ত কিনা ভগবান বামন রূপ ধরে ছলনা করে পাতালে পাঠিয়ে দিলেন!
এখানে দর্শনীয়, কথাগুলো বলছেন ভক্তশ্রেষ্ঠ প্রহ্লাদ। আর লেফট অ্যান্ড রাইট নিচ্ছেন কাকে? তাঁরই আরাধ্য শ্রীবিষ্ণুকে।
প্রতিবাদ কিন্তু এখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের দিকে ধাবিত নয়, আরও এক কাঠি ওপরে উঠে একেবারে স্বয়ং পালনকর্তাকে নিয়ে টানাটানি।
অবাক লাগে সেখানেই যখন দেখি, এত দোষারোপের পরও সুদর্শন কিন্তু একটি বারের জন্যও প্রহ্লাদ সংহারে ধেয়ে আসছে না।
এখন কথা হচ্ছে, ‘সবই ব্যাদে আছে’ বলে চালাবার চেষ্টা করছি কেন? ‘ব্যাদ’ বলতেই আমরা ‘শাস্তর’ বুঝি, আর ‘শাস্তর’ মানেই মনুর বিধান। তাঁর মতো এত সমালোচিত কোনও কালে কোনও দেশে কোনও লোক হয়েছে বলে তো মনে হয় না। ফলে ও সব গালগল্প বলে উড়িয়ে দেওয়াটা প্রায় স্টাইল-স্টেটমেন্টের জায়গায় পৌঁছে গেছে। না গেলে চলবে কেন? আমরা আধুনিক যে!
তর্কে পারব না। তাই নতমস্তকে মেনে নেব— গালগল্পই বটে! কিন্তু সেই গালগল্পে যে সমাজের ছায়া পড়েছে, যে বোধের বিকাশ ঘটেছে, যে ইতিহাসের দলিল মিশেছে— সে সব কথা অস্বীকার করব কী করে? তাই, ‘ব্যাদে’ যাই থাকুক, ভারতে যা ছিল ভারতে কিন্তু আর এখন তা থাকছে না।
শাস্ত্রের প্রাচীনত্ব মানি, শাস্ত্র যে ধোয়া তুলসীপাতা নয়— তাও মানি। কিন্তু সেই শাস্ত্রেরই দুই স্তম্ভ— মহাকাব্য আর পুরাণ— কিন্তু এমন এমন কথাও বলেছে, শুধুমাত্র অমন অমন কথা বলে ছেড়ে দেয়নি। তাই, ‘ব্যাদের’ আদলে সমাজ গড়তে গেলে কিন্তু প্রথম ‘ব্যাদ’ আত্মস্থ করতে হবে।
স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, সনাতন ধর্মই হোক অথবা সংসদীয় গণতন্ত্র, বিরুদ্ধ মত পোষণ নতুন কিছু নয়। ঠিক সেই ভাবেই বিরুদ্ধ মত যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তা হলে তাকে গ্রহণ করার, নিদেনপক্ষে মেনে নেওয়ার রীতিও এ দেশে নতুন নয়। যে ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে ‘সুনার’ ভারত গড়ার প্রচেষ্টা চলেছে, সনাতন ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবার আয়োজন চলেছে, সেখানে এই সব কিছুও পরিপূর্ণ রূপে হৃদয়ঙ্গম করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
আর তা যদি হয়, তা হলে সেখানে এমন বলপূর্বক অবদমনের বা দণ্ডাদেশের কোনও স্থান নেই। কেন ভারাভারা রাও, কেন মিরন হায়দার, কেন নাতাশা নারওয়াল, কেন সিদ্দিকি কাপ্পান— আর কেনই বা টিকার রফতানি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেওয়াল লিখলে গ্রেফতারি? শাসনযন্ত্রের রক্ষকেরা কোন উপায়ে জানতে পারছেন, কে সমাজবিরোধী, কে অশান্তি পাকাতে চায়, কে দুষ্ট?
হ্যাঁ, আইন এগিয়ে এসেছে। সাংবাদিক বিনোদ দুয়াকে রাষ্ট্রশক্তি বাঁধার যে প্রয়াস করেছিল, আইন তাতে কিছু দিন আগেই জল ঢেলে দিয়েছে। তাতে কী? কিছুমাত্র চৈতন্যোদয় হয়েছে কি?
বড় কঠিন এ সময়। চরম অকর্মণ্যতার পরিচয় দিয়ে শাসক ল্যাজে-গোবরে হওয়ার পরও সজাগ দৃষ্টি রাখে ‘বিদ্রোহ’ দমনের দিকে। মৃত্যুর মিছিল চলেছে, পরের পর মিথ্যে প্রতিশ্রুতিতে মানুষ বিধ্বস্ত, একটার পর একটা ভুল পদক্ষেপে বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত খর্ব। তবু, প্রশ্ন করা যাবে না। নীতিকথাটা কী জানেন? শেষ পর্যন্ত জনতাই জনার্দন। আর এই যে তাকে ক্রমাগত চেপে রাখার প্রয়াসে মেতে ওঠা হচ্ছে, ইতিহাস কিন্তু বলে এই চাপ সে কোনও কালেই সহ্য করেনি।
শেষটায় সেই ১৭৮৯-এ না ফিরে যেতে হয়। যখন বাস্তিল দুর্গ ঘিরে ফেলেছিল হাজার হাজার লোক, রাজামশাই ষোড়শ লুই জানলা দিয়ে তা দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন— এ সব কী? বিদ্রোহ না কি?
উত্তর এসেছিল— না মহারাজ, বিপ্লব।
ফরাসি বিপ্লব সম্বন্ধে আমরা এমনটাই শুনেছিলাম কিন্তু।
তথ্যঋণ: কথা অমৃতসমান (প্রথম খণ্ড)— নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, দে’জ় পাবলিশিং