ছবি: কুনাল বর্মণ
আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, বড় মাপের বিজেতারা সর্বদা বড় মাপের রাজা হন না। পৃথিবীর বিভিন্ন মানবজাতি বহু সময়ে বর্বরদের অধীনে এসেছে এবং এই ধরনের বিজয় কয়েক বছরের মধ্যেই মুথ থুবড়ে পড়ে। তিনিই আসল রাজা হন যিনি সব প্রজাদের ভেদাভেদহীন ভাবে শাসনে জীবন অতিবাহিত করেন।”
সিংহাসন হারিয়ে সদ্য আগ্রা দুর্গে বন্দি মোগল সম্রাট শাহজাহান। তখনই তাঁর ছেলে আওরঙ্গজ়েবের এই চিঠি পৌঁছয় তাঁর হাতে। তখনও রাজসিংহাসন নিয়ে ছেলেদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষ হয়নি, আওরঙ্গজ়েবও ইতিহাসের কাহিনিতে ‘খলনায়ক’ আখ্যা পাননি। কিন্তু এই চিঠি রাজনীতির ময়দানে আওরঙ্গজ়েবের মেধার পরিচয় দেয়।
যুগে-যুগে কাহিনি কিংবা লোকমুখে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজ়েবকে ‘খলনায়ক’ বলা হয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটক হোক কিংবা তার পরবর্তী বিভিন্ন সাহিত্য, আওরঙ্গজ়েব চিরকালীন খল চরিত্রেই ঠাঁই পেয়েছেন। তিনি শুধু ‘গোঁড়া’ শাসক নন, তিনি দুরাচারী, অত্যাচারী, ভ্রাতৃঘাতী নবাব। ১৯৪৬ সালে জওহরলাল নেহরুও তাঁর বই ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’য় আওরঙ্গজ়েবকে প্রতিক্রিয়াশীল এবং গোঁড়া, অসহিষ্ণু শাসক হিসেবেই দেখছেন। নেহরু লিখছেন, ‘আওরঙ্গজ়েব সময়ের উল্টো দিকে ঘড়িকে চালাতে চেয়েছিলেন।’ কথায়-কথায় নেহরুকে দোষারোপে অভ্যস্ত বিজেপিও একবিংশ শতকে এসে দিল্লির রাস্তা থেকে আওরঙ্গজ়েবের নাম মুছে দিয়েছে।
সত্যিই কি আওরঙ্গজ়েব আদ্যোপান্ত ধর্মান্ধ ছিলেন? নাকি ইতিহাসে কল্পনার রং মিশিয়ে আখ্যান গড়ে তোলা হয়েছে? এ প্রসঙ্গে ইতিহাসচর্চার ধারার আলোচনা বোধহয় একান্ত জরুরি। ঔপনিবেশিক আমলে গোড়ার দিকে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদদের লক্ষ্য ছিল, নিজেদের শাসন ব্যবস্থাকে মোগলদের থেকে উন্নত প্রতিপন্ন করা এবং ব্রিটিশদের হাত ধরেই ভারতবাসী যে অন্ধকার যুগ পেরিয়ে এসেছে তা তুলে ধরা। সে দিক থেকে শেষ শক্তিশালী মোগল সম্রাট আওরঙ্গজ়েবকেই নিশানা করেছিলেন তাঁরা। পরবর্তী কালে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদদের কাছেও আওরঙ্গজ়েব মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী। সেই দায় বয়ে নিয়ে বেড়ায় তাঁর ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশাসনিক নীতি। সেই সূত্র ধরেই আওরঙ্গজ়েব শুধু ইতিহাসে আটকে থাকেননি, তাঁকে নিয়ে গড়ে উঠেছে নানা মিথ। সেই মিথকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে রাজনীতিও।
স্বাধীনতার পরের কয়েক দশকে ইতিহাসচর্চায় বদল এসেছে। ব্যক্তিনির্ভর ইতিহাস থেকে সরে রাষ্ট্র, অর্থনীতি, সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে মোগল সাম্রাজ্যকে বুঝতে চেয়েছেন ইতিহাসবিদেরা। গত কয়েক বছরে ফের চর্চার কেন্দ্রে ফিরে এসেছেন ব্যক্তিরা। তবে কিছুটা ভিন্ন ভাবে। মোগল রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য রাজপুরুষদের জীবন কাহিনিকে ব্যবহার করছেন ইতিহাসবিদেরা। এই নতুন ধারার চর্চার ক্ষেত্রেই ইতিহাস ও মিথের মাঝে থাকা আওরঙ্গজ়েবকে খুঁজেছেন ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রশকে। রাজসিংহাসনে শাহজাহানের উত্তরসূরির ধর্মীয় নীতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ট্রশকে তুলে ধরেছেন সাড়ে তিনশো বছর আগের এক ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনার কথা। কী সেই ঘটনা?
বারাণসীর মোগল রাজকর্মচারীরা দিল্লির বাদশার কাছ থেকে ‘ফরমান’ পেলেন। সেই রাজনির্দেশে লেখা রয়েছে, মোগল বাদশার কর্মচারীদের স্থানীয় কোনও মন্দিরের বিষয়ে অযাচিত ভাবে নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। আরও লিখেছেন বাদশা আওরঙ্গজ়েব ওরফে আলমগীর, ‘তোমাদের নিশ্চিত করা উচিত যাতে কেউ হিন্দু এবং ব্রাহ্মণদের অত্যাচার না করে এবং তাঁরা তাঁদের এলাকায় থাকতে পারেন এবং মন্দিরে সাম্রাজ্যের উন্নতির জন্য প্রার্থনা করতে পারেন।’ শুধু এখানেই শেষ নয়, পরবর্তী কালেও ব্রাহ্মণদের স্বার্থরক্ষায় আওরঙ্গজ়েবকে সক্রিয় হতে দেখা গিয়েছে। ১৬৮০ সালে তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন, বারাণসীর ভগবন্ত গোসাঁই নামে এক ব্রাহ্মণকে কোনও রকম অত্যাচার না করার। এর আগেও এমন উদাহরণ আছে। দিল্লির তখতে বসার ৯ বছর পরে আওরঙ্গজ়েব দান পাঠালেন গুয়াহাটির উমানন্দ মন্দিরে। শুধু জমি নয়, আশপাশের এলাকা থেকে রাজস্ব আদায় করার অনুমতিও পেলেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। ১৬৮৭ সালে ফের বারাণসীতেই রামজীবন গোসাঁই নামে এক ব্রাহ্মণকে গঙ্গার পাড়ে জমি দিলেন দিল্লির বাদশা। সেই জমিতে ব্রাহ্মণ এবং ফকিরদের আশ্রয় গড়ে তোলা হল। ১৬৯১ সালে চিত্রকূটের বালাজি মন্দিরের জন্য মহন্ত বালকদাস নির্বাণী আখড়াকে আটটি গ্রাম ও বড় মাপের করহীন জমি দান করেছেন। ১৬৯৮ সালে মধ্য ভারতের পূর্ব খান্দেশের রঙ্গ ভট্ট নামে এক ব্রাহ্মণকে করহীন জমি দান করেছিলেন আওরঙ্গজ়েব। এ সবের মাঝে ব্রাহ্মণদের ভাতাও বৃদ্ধি করছেন তিনি। ঈশ্বরদাস নামে এক ব্রাহ্মণ জ্যোতিষাচার্য আওরঙ্গজ়েবকে ‘ধার্মিক’ বলছেন এবং তাঁর কর পদ্ধতিকে ‘বৈধ’ তকমা দিচ্ছেন।
শুধু জনৈক ব্রাহ্মণ নয়, শৈব সাধুদের প্রতিও আওরঙ্গজ়েবের ‘নেকনজর’ লিপিবদ্ধ করেছেন ট্রশকে। দক্ষিণ ভারতের ‘জঙ্গম’ সম্প্রদায়ভুক্ত শৈব সাধুদের নিয়ে তিনি লিখছেন, আকবর বাদশা এই সাধুদের ১৫৬৪ সালে জমি দান করছেন। তার একশো বছর পরে আকবরের প্রপৌত্র আওরঙ্গজ়েব তিন-তিন বার (১৬৬৭ থেকে ১৬৭৪) বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছেন। শুধু ব্রাহ্মণ নয়, জৈন সাধুরাও সমান তালে আলমগীরের অনুগ্রহ লাভ করছে। মাউন্ট আবু, গিরনারের জৈন সাধুদের জমি দান করছেন তিনি। লালবিজয় নামে এক জৈন সন্ন্যাসীকে মঠ উপহার দিচ্ছেন। অনুদান পেয়ে খুশি জৈনরা সমসাময়িক গ্রন্থাবলিতে লিখে দিলেন, ‘মর্দানো অউর মহাবলী আওরঙ্গশাহী নরন্দ।’
তা হলে যে-আওরঙ্গজ়েবকে বছরের পর বছর ধরে গোঁড়া, ধর্মান্ধ বলে প্রচার করা হয়ে আসছিল, তিনি কোথায় গেলেন? এই প্রসঙ্গেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ১৬৬৯ সাল। এই বছরেই কাশীর বিখ্যাত শিব মন্দির ভাঙার নির্দেশ দেন আওরঙ্গজ়েব। সেখানে তৈরি হয় জ্ঞানবাপী মসজিদ। যা নিয়ে সম্প্রতি ফের বিতর্ক উস্কে উঠেছে। স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে উল্লেখ আছে, মহাদেব যে অষ্টমূর্তি বলে পুরাণে কথিত হন, তাঁরই জলময়ী মূর্তি এই জ্ঞানপ্রদায়িনী জ্ঞানোদতীর্থ জ্ঞানবাপী। বিশ্বে এই জ্ঞানবাপী মসজিদ সম্ভবত একটিই মসজিদ, যার নামটি পুরাণ-উল্লিখিত। আওরঙ্গজ়েব কিন্তু এই নামটিই বহাল রেখেছিলেন, পরিবর্তন করেননি। ১৬৭০ সালে মথুরার কেশব দেব মন্দির ভাঙার নির্দেশও দেন তিনি। ওই সময়ে মোগল বাদশার নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতেই ধর্মান্ধ তকমা পেয়েছেন আওরঙ্গজ়েব। ভিন্ন ধর্মের উপাসনাস্থল ভাঙা উদারপন্থী কাজ নয় ঠিকই। কিন্তু মন্দির ভাঙার পিছনে শুধুই ধর্মান্ধতা ছিল,নাকি রাজনৈতিক কারণও ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইতিহাসবিদেরা।
মাধুরী দেশাই তাঁর বারাণসীর উপরে গবেষণায় দেখিয়েছেন, এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আওরঙ্গজ়েবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ক্যাথরিন আশারের গবেষণায় উঠে এসেছে, সে সময়ে দাঁড়িয়ে বারাণসীর সামন্তরা মোগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। আবার বহু সময় ব্রাহ্মণরাও ইসলাম ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাকও গলাচ্ছিলেন। সতীশ চন্দ্রের লেখা থেকে জানা যায়, বারাণসী, মুলতানের মতো এলাকার মন্দিরগুলিতে শাসক-বিরোধী ষড়যন্ত্র চলছে বলেও বাদশার কাছে খবর পৌঁছচ্ছিল। তাই এ কথা বুঝতে সমস্যা হয় না যে, শাসকের ধর্ম এবং ক্ষমতা সম্পর্কে সতর্ক করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন মোগল বাদশা। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, অষ্টাদশ শতকের গোড়াতেই জ্ঞানবাপী মসজিদের অদূরেই বিশ্বনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজা সওয়াই জয় সিংহ। তিনি কিন্তু আওরঙ্গজ়েবের প্রিয়পাত্র ছিলেন। এই বিষয় থেকেই স্পষ্ট, শুধু ধর্মান্ধতা থাকলে মোগল আমলেই কাশীতে ফের বিশ্বনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা হত না। যেমন ইতিহাসবিদদের গবেষণা থেকে উঠে এসেছে, ১৬৭৯ সালের পর থেকে আওরঙ্গজ়েবের সাম্রাজ্যে বড় মাপে মন্দির ধ্বংসের কথা শোনা যায় না। যদি ধর্মই একমাত্র কারণ হত, তা হলে মন্দির ধ্বংস বন্ধ হত কি না, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
এই আলোচনার ক্ষেত্রে মন্দির সম্পর্কে আওরঙ্গজ়েবের নির্দেশও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রাচীন কোনও মন্দির ধ্বংস করা যাবে না। তবে নতুন মন্দিরও তৈরি করা যাবে না।’ নতুন মন্দির তৈরি করতে না-দেওয়াকে হিন্দুবিরোধী বলা হয় বটে। তবে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, সে সময়ে মোগলরা আর্থিক সঙ্কটে পড়েছিল। বিরাট সাম্রাজ্যের খরচ সামলাতে যে পরিমাণে কর দরকার, তা জমি থেকে আসছিল না। সে সময় রাজস্ব বাড়াতে নতুন এলাকা আওতায় আনা প্রয়োজন ছিল। এই পরিস্থিতিতে যদি একের পর এক মন্দির তৈরি হয় এবং তার অধীনে নিষ্কর জমি যায় তা হলে শাসকের আয় কমবে। হয়তো সেই কারণেই নতুন নতুন মন্দির তৈরিতে নিষেধ চাপিয়েছিলেন আওরঙ্গজ়েব। হিন্দুদের সম্পর্কে তাঁর বৈরিতা নিয়ে নানা কল্পকাহিনি ঘুরে বেড়ায় বটে, কিন্তু রাজপুতদের মতো হিন্দু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মোগলদের সখ্যও তাঁর আমলে ধরা পড়ে। অধ্যাপক সৈয়দ নাদিম আলি রেজ়াভির লেখা অনুসারে, ১৬৯৮ থেকে ১৭০৭, এই পর্বে আওরঙ্গজ়েবের তিন জন সেনাপতিই হিন্দু। রামসিংহ হাডা, দলপত বুন্দেলা এবং সওয়াই জয় সিংহ, এই তিন জনই মরাঠাদের বিরুদ্ধে মোগল সেনাকে নেতৃত্ব দিতেন। আতহার আলির গবেষণা থেকেও জানা যায়, আওরঙ্গজ়েবের আমলে মোগল প্রশাসনে ৩১ শতাংশ হিন্দু ছিলেন। আকবরের আমলে তা ছিল ২২ শতাংশ। হিন্দুদের সম্পর্কে অন্ধবৈরিতা থাকলে বোধ হয় এ কাজ আওরঙ্গজ়েব করতেন না।
আওরঙ্গজ়েবকে ধর্মান্ধ বলে দেগে দেওয়ার পিছনে ইসলাম ধর্ম এবং শরিয়তের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। কারণ, তিনি গান গাওয়া কিংবা ছবি আঁকার মতো ‘শরিয়ত-বিরোধী’ বিষয় বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, ছবি আঁকা বন্ধ হয়ে গেলে বৃদ্ধ আওরঙ্গজেবের এত ছবি এল কোথা থেকে? এ কথা অনস্বীকার্য যে, রাজ-দরবারে গান গাওয়ার রেওয়াজ বন্ধ করেছিলেন বাদশা আওরঙ্গজ়েব। কিন্তু যন্ত্রসঙ্গীত বন্ধ করেননি। ভুলে গেলে চলবে না, এই বাদশা নিজে অত্যন্ত গুণী বীণাবাদক ছিলেন। রাজদরবারের বাইরে মোগল হারেমে সে সময় সঙ্গীতচর্চা চলত। মোগল অভিজাত কিংবা সামাজিক পরিসরেও সঙ্গীত কিংবা ছবি আঁকা বন্ধ হয়নি। তাঁর আমলেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বই ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। তাই এ কথা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না যে, ইসলাম ধর্মের অনুরাগী আওরঙ্গজ়েব রাজদরবারে বিধিনিষেধ চালু করলেও ব্যক্তিজীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করতে দেননি। হিন্দুদের হোলি উৎসবে রাশ টেনেছিলেন এই মোগল বাদশা। কিন্তু এ কথাও ঠিক, যে তিনি ইদ এবং মহরমেও রাশ টেনেছিলেন। ১৬৭৯ সালে জিজ়িয়া কর আরোপ করেছিলেন তিনি। ইসলামি রাষ্ট্রে এই কর অ-মুসলিমদের বাধ্যতামূলক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তুর্কী-সুলতানি আমলে এই কর চালু থাকলেও মোগল সম্রাট আকবর তা বন্ধ করেন। ইতিহাসবিদদের আলোচনায় উঠে এসেছে, মরাঠা-সহ বিপক্ষ শক্তিগুলির বিরুদ্ধে মুসলিম অভিজাতদের ঐক্যবদ্ধ করতেই রাজত্বের ২২তম বছরে এই কর ফের চালু করেন আওরঙ্গজ়েব। কিন্তু তাঁর রাজত্বে মহিলা, শিশু, শারীরিক কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধীদের এই কর দিতে হত না। কর দেওয়া থেকে ছাড় ছিল রাজপুত, ব্রাহ্মণ এবং মোগল প্রশাসনের রাজকর্মচারীদের। যদিও এ কথাও ঠিক যে বহু ক্ষেত্রে হিন্দুরা এই কর দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজকর্মচারীদের নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কর আদায়ের নামে দুর্নীতির অভিযোগও জমা পড়েছিল বাদশার কাছে।
ব্যক্তি এবং শাসক, এই দু’ক্ষেত্রে আকবর পরবর্তী মোগল শাসকদের মধ্যে সব থেকে চর্চিত চরিত্র আওরঙ্গজ়েব। তাই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এই শাসককে বিশ্লেষণ করতে গেলে ব্যক্তিমানসের চর্চাও জরুরি। আচার্য যদুনাথ সরকার রচিত ‘হিস্ট্রি অব আওরঙ্গজ়িব’ বইয়েই উল্লিখিত, কী ভাবে ছোটবেলা থেকেই কোরান, হাদিসের মতো বই কার্যত গুলে খেয়েছিলেন আওরঙ্গজ়েব। আরবি, ফার্সি, চাঘতাই তুর্কির পাশাপাশি ঝরঝরে হিন্দুস্তানি ভাষাও (মোগল আমলে আমজনতার ভাষা ছিল হিন্দুস্তানিই। রাজপরিবারও ওই ভাষাতেই কথা বলত) বলতেন তিনি। শুধু তাই নয়, যদুনাথের লেখা থেকেই জানা যায়, অল্প বয়সে এক বার মত্ত হাতির মুখে পড়ে বাকি তিন রাজপুত্র পালালেও আওরঙ্গজ়েব পালাননি। সেই ঘটনা নিয়ে বাবা শাহজাহানকে বলেছিলেন, ‘হাতির সঙ্গে লড়াইয়ে আমি মরলেও তা লজ্জার হত না। সম্রাটরাও মারা যান। কিন্তু আমার ভাইয়েরা যা করেছে সেটা লজ্জার।’ অর্থাৎ এক দিকে নিরন্তর ধর্মচর্চার ফলে নিজের ধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগ যা অনেকাংশে গোঁড়ামির দিকে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে, আবার একই সঙ্গে ছিল রাজপুরুষোচিত সাহস।
এতদসত্ত্বেও রাজপরিবারে বোধ হয় কিছুটা ব্রাত্যই ছিলেন শাহজাহানের এই ষষ্ঠ সন্তান। বরং বড় ছেলে দারা শিকোর প্রতি বিশেষ স্নেহাসক্ত শাহজাহান। বড় ছেলেটি মন্দ নয় বটে, কিন্তু রাজপুত্র হিসেবে তেমন জোরালো নয়। দিল্লির দরবারে বিদ্যাচর্চাতেই মন বেশি তাঁর। এ দিকে মোগল সাম্রাজ্য তখন বিস্তৃত। অতঃপর ছেলে শাহ সুজাকে পাঠালেন বাংলায়, মুরাদ পেলেন গুজরাতের ভার। ছোট ছেলে আওরঙ্গজে়বকে পাঠালেন দাক্ষিণাত্যে। সব ঠিকই চলছিল। এমন সময়েই ঘটল সেই ঘটনা।
১৬৫৭ সালে এক দিন সকালে বিছানা ছাড়তে গিয়ে আচমকা অসুস্থতা টের পেলেন শাহজাহান। বুঝলেন বয়স হয়েছে। সে দিন বিছানা ছেড়ে উঠলেন না তিনি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রজাদের দর্শনও দিলেন না। এক দিন নয়, দু’দিন নয়, পরপর কয়েক দিন দেখা মিলল না বাদশার। দিল্লির অলিগলিতে শুরু হল কানাঘুষো, বাদশা আর নেই! সেই কানাঘুষো রাজকর্মচারী, গুপ্তচর হয়ে ছড়িয়ে পড়ল রাজকুমারদের কানেও। তা হলে কি দিল্লিতে থাকা দারা শিকো পরবর্তী বাদশা? শাহজাহান তেমনই চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় কন্যা জাহানারাও। তা হলে..
সাম্রাজ্যের তিন প্রান্তে থাকা তিন রাজকুমারের মাথাতেই চাড়া দিল সেই প্রাচীন প্রবাদ— মধ্য এশিয়া থেকে আসার সময় মোগলদের হাত ধরে যা ঢুকে পড়েছে দিল্লি দরবারেও— ‘ইয়া তখত ইয়া তাবুত’ (হয় রাজসিংহাসন নয় কবরের মাটি)। রাজসিংহাসন নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে বিবাদ নতুন নয়। মুরাদ গুজরাতে নিজেকে মোগল বাদশা বলে ঘোষণা করলেন, শাহ সুজাও বাদশা হওয়ার খোয়াবে মশগুল। প্রমাদ গুনলেন আওরঙ্গজ়েব। তিনিও ছুটলেন দিল্লির উদ্দেশে। কিন্তু ভাইয়ে ভাইয়ে যদি লাঠালাঠি হয় তা হলে মোগল সাম্রাজ্য বলে কিছু থাকবে না। অতঃপর, আওরঙ্গজ়েব বুঝলেন, বাপ-ঠাকুর্দার তৈরি করা এই সাম্রাজ্য ধরে রাখতে হলে কূটনৈতিক চাল চালতে হবে। তিনি যোগাযোগ করলেন ভাই মুরাদের সঙ্গে। বললেন, ‘দুই হৃদয় এক হলে পাহাড় সরাতে পারে। তা হলে এই বিপদ কাটবে না?’ এ-ও বললেন, বাকি দুই ভাইকে যদি শায়েস্তা করা যায় তা হলে মুরাদকে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের এলাকা ছেড়ে দেবেন তিনি। মনে মনে অবশ্য আওরঙ্গজ়েব জানতেন, সে প্রতিশ্রুতি তিনি কোনও দিনই রাখবেন না। মুরাদ ও আওরঙ্গজ়েব রওনা দিলেন দিল্লির পানে। তত দিনে শাহজাহান শয্যা ছেড়ে উঠে বসেছেন। তিনিও বুঝলেন বিপদ ঘনিয়েছে। তিনি আশ্রয় নিলেন আগ্রা দুর্গের মধ্যে। মুরাদ ও আওরঙ্গজ়েব এক দিন দুপুরে এসে দাঁড়ালেন আগ্রা দুর্গের বাইরে। দুর্গ অবরুদ্ধ করে বাইরে থেকে জলের সরবরাহ বন্ধ করে দিলেন। বাধ্য হয়েই বেরিয়ে এলেন শাহজাহান। ছেলেদের হাতে সঁপে দিলেন ধনরত্ন, অস্ত্রাগার। শাহজাহান স্বেচ্ছাবন্দি হলেন আগ্রা দুর্গে। তার সঙ্গে রইলেন কন্যা জাহানারাও। এ বারই শুরু হল রাজনীতির মারপ্যাঁচ। বন্দি হলেন মুরাদও! বাংলা থেকে সুজাকে তাড়িয়ে দিলেন আরাকানে। দারা শিকোও পালালেন। বাদশা হলেন আওরঙ্গজ়েব। শাহজাহানের পুত্র উপাধি নিলেন আলমগীর।
দারা শিকো তখন পালাচ্ছেন। পালাতে পালাতে পৌঁছলেন আফগানিস্তানে। পরিচিত এক আফগান সেনাপতির কাছে আশ্রয় চাইলেন তিনি। আশ্রয় মিলল বটে, কিন্তু শিকার হলেন বিশ্বাসঘাতকতার। সেনাপতি বাদশা আলমগীরের হাতে তুলে দিলেন তাঁর দাদাকে। সে সময়ের পর্যবেক্ষকেরা লিখছেন, দারা শিকো ও তাঁর নাবালক ছেলেকে ছেঁড়াফাটা পোশাক পরিয়ে হাতির পিঠে চাপিয়ে দিল্লির বাজারে ঘোরালেন সম্রাট। তার পর বসালেন বিচারসভা। সেই বিচারসভাতেই দাদার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়লেন বাদশা, ‘ধরো, আজ যদি তুমি আমার জায়গায় থাকতে এবং আমি তোমার জায়গায়, কী করতে আমার সঙ্গে?’ দারা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তোমায় চার টুকরো করে দিল্লির চার প্রান্তে টাঙিয়ে রাখতাম।’ দারার সঙ্গে অবশ্য ‘ততটা নৃশংস’ ব্যবহার করেননি আওরঙ্গজ়েব। তিনি শুধু ধড় থেকে মুণ্ড আলাদা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। নিহত দারার ঠাঁই হয় হুমায়ুনের সমাধি ক্ষেত্রের এক ফালি জমিতে। দারার বড় ছেলেকে পাকড়াও করেছিলেন কাকা আওরঙ্গজ়েব। কারাগারেই আফিম মেশানো জল খাইয়ে মেরে ফেলা হয় তাঁকে। ভ্রাতৃহত্যার এই ‘কলঙ্ক’ যুগ-যুগ ধরে তাড়া করেছে আওরঙ্গজ়েবকে।
ইতিহাস অবশ্য বলে, রাজসিংহাসনের লড়াইয়ে বারবার পরিবারের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা সম্রাট বলে পরিচিত অশোকের ক্ষেত্রেও একই উল্লেখ রয়েছে। একাধিক বৌদ্ধগ্রন্থেও সেই সাক্ষ্য মেলে। রোমিলা থাপার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, দিব্যাবদানে উল্লেখ করা হয়েছে, বিন্দুসার মৃত্যুকালে রাজপুত্র সুসীমকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু রাধাগুপ্ত-সহ বাকি মন্ত্রীদের সাহায্যে অশোক সিংহাসনে বসেন। মহাবংশে উল্লেখ করা হয়েছে, সুসীমকে হত্যা করেন অশোক। দীপবংশে বলা হয়েছে, অশোক তাঁর ৯৯ জন ভাইকে হত্যা করেন। যদিও ৯৯ সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদেরা। তবে লামা তারানাথের মতে, সম্রাট অশোক ছ’জন ভাইকে হত্যা করেসিংহাসনে বসেছিলেন।
এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরেও মৌর্য সাম্রাজ্যকে সামাজিক-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় উন্নীত করেছিলেন অশোক এবং প্রমাণ করেছিলেন, সিংহাসন নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব সুশাসক হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে না। মহাভারতে ‘ধর্মপুত্র’ বলে খ্যাত যুধিষ্ঠিরও তো জ্ঞাতি-নিধন করে সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। কিংবা মেবারের রাজা প্রথম সংগ্রাম সিংহ (রাণা সঙ্গ হিসেবেই যার বেশি পরিচিতি), তিনিও তো ভাইদের সঙ্গে লড়েই সিংহাসন দখল করেছিলেন। সিংহাসন, ক্ষমতা নিয়ে ভ্রাতৃঘাতী লড়াই যদি এতই থাকে, তা হলে কলঙ্ক শুধু আওরঙ্গজ়েবের বরাতে জুটবে কেন, সে প্রশ্ন তো ওঠেই।
উল্লেখ্য, অশোক সিংহাসনে বসে কিন্তু জ্ঞাতির উদ্দেশে দ্বেষভাব ধরে রাখেননি। ভাই তিস্সকে রাজপদে নিয়োগ করেছিলেন। সিংহাসনে বসার পরে আওরঙ্গজ়েবও নিজের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ভাইপো-ভাইঝিদের (দারার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে) বিয়ে দিয়েছেন। শাহজাহানের মৃত্যুর পরে জাহানারাকে দিল্লিতে সসম্মানে ফিরিয়ে এনেছিলেন। গুজরাতের এক শ্রেষ্ঠীর কাছে প্রচুর ধার করেছিলেন মুরাদ। জেলবন্দি ভাইয়ের সে সব দেনাও মিটিয়ে দিয়েছিলেন বাদশা।
এত লড়াই করে যে তখত দখল করলেন আওরঙ্গজ়েব, তাতে বসার পর কিন্তু চিরাচরিত রাজকীয় জীবন বেছে নেননি তিনি। এমনকি, ১৬৬৯ সালে দরবারি জৌলুসও বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। তবে এ কথাও সত্যি, জৌলুস বন্ধ করার পিছনে নিজস্ব পছন্দ যেমন ছিল, তেমনই মোগল সাম্রাজ্যের ভাঁড়ার যে খালি হচ্ছে সেটাও বুঝেছিলেন তিনি। বিরাট সাম্রাজ্য রাখতে গেলে যে বেহিসেবি খরচ কমাতে হবে তা বুঝতে পারা শাসকের বাস্তববোধের পরিচয় দেয়।
ব্যক্তি আওরঙ্গজ়েব ধরা দেন সে আমলের ইতালীয় পর্যটক নিকোলো মানুচ্চির বিবরণেও। মানুচ্চি লিখছেন, ‘তিনি ছিলেন নির্জনতাপ্রিয় সম্রাট। সব সময় কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকতেন এবং যথার্থ বিচার দেওয়া বা কোনও উপযুক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টায় থাকতেন।’ নির্জনতাপ্রিয়, ঠিক-ভুল নিয়ে খুঁতখুঁতে বাদশার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে লেখা চিঠিতেও সে সবেরই উল্লেখ পাওয়া যায়। কখনও নাতিকে ‘সৎ শাসনের’ উপদেশ দিচ্ছেন তিনি, বলে যাচ্ছেন, অন্তর্দ্বন্দ্বের ঘুণ ধরা সাম্রাজ্যকে টিঁকিয়ে রাখার উপায়। সেই চিঠিতে উঠে আসছে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে প্রজাশাসনের পরামর্শ। তবে একেবারে শেষ বেলায় মৃত্যু ও কর্মফলের ভয় যেন পেয়ে বসছে বাদশাকে। ছোট ছেলে কামবখশকে বলেছিলেন, তাঁর ভয় তাঁর মৃত্যুর পরে সেনাবাহিনী ও আধিকারিকদের হেনস্থার শিকার হতে হবে। তৃতীয় পুত্র আজম শাহকে বলেছিলেন, ‘‘আমি শাসক হিসেবে ব্যর্থ এবং প্রজাদের রক্ষা করতেও ব্যর্থ। জীবনে কিছুই করতে পারল না, ঈশ্বরকেও খুশি করতে পারলাম না।’’
১৭০৭ সালে মৃত্যুর পরে খুলদাবাদের একেবারে সাদামাটা সমাধিক্ষেত্রে ঠাঁই পেয়েছিলেন তাবৎ হিন্দুস্থানের বাদশা আওরঙ্গজ়েব। সেটাই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছে। নিজের দেশ, হিন্দুস্থান এবং এই বস্তুজগত ছেড়ে চিরতরে বিদায় নেওয়ার আগে শেষ বারের মতো চিঠি লিখেছিলেন আলমগীর। তাতে দু’ছত্রে ফুটে উঠেছিল জীবনদর্শনের সারসত্য। লিখেছিলেন, ‘এসেছিলাম একা, ফিরছিও একা।’
ইতিহাস কখনও ইশ্বরকে নিয়ে রচিত হয় না। বরং ইতিহাসের চরিত্রেরা নিখাদ রক্তমাংসের মানুষ। তাঁদের গুণ যেমন থাকে, তেমনইথাকে দোষও। তথ্য এবং সমসাময়িক পরিস্থিতির আতসকাচে ফেলেই তাঁদের বিচার হয়। সেইবিচারে আওরঙ্গজ়েব কি ধর্মান্ধ শয়তান, নাকি বাপ-ঠাকুর্দার সাম্রাজ্যকে বাঁচাতে তৎপর এক নিখাদ রাজনীতিবিদ প্রশাসক?
এর উত্তর হয়তো সময়ই দেবে।