dodo bird

শেষ প্রতিনিধি

পাখি, কিন্তু ওড়ে না। ওদের ধরে খেয়ে জীবন বাঁচালেন নাবিকরা। জানলেনও না, ওরাই ছিল পৃথিবীর শেষ ডোডোপাখিদের দল। সুবর্ণ বসু স্মৃতিচারণে ইভার্টসজ়ুন লিখেছিলেন, ‘‘ওরা আকারে হাঁসের চেয়েও বড় ছিল, কিন্তু উড়তে পারত না। কারণ ওদের ডানাগুলো খুবই ছোট এবং অগঠিত।’’

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৫৮
Share:

নিজের চোখকে বিশ্বাস হল না ওলন্দাজ নাবিক ভোলকার্ট ইভার্টসজ়ুন-এর। ভাবলেন, সমুদ্রেও কি মরীচিকা দেখা যায়! চোখেরই বা দোষ কী! টানা ন’দিন উপোস। খাবার জলটুকুও নেই। তেষ্টার জ্বালায় ইভার্টসজ়ুন এবং তাঁর সঙ্গীরা নিজেদের প্রস্রাবও পান করতে বাধ্য হয়েছেন। মাথার উপর অক্লান্ত আগুন ছড়াচ্ছে বিষুবসূর্য। জলকষ্টে পাগল হওয়ার অবস্থা। ভুল দেখা খুবই স্বাভাবিক।

Advertisement

কিন্তু খানিক অপেক্ষা করার পরও তো দৃশ্যটা মিলিয়ে গেল না! সঙ্গীরাও তত ক্ষণে দেখতে পেয়েছেন। খানিক ক্ষণ আগে পর্যন্তও ‘আর্নহেম’ লংবোটের যাত্রীদের অনাহারে মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। কিন্তু মরিশাসের পূর্ব উপকূল, আইল দি অ্যাম্বারে পৌঁছে তাঁরা বুঝলেন, মাসখানেক অন্তত অনাহারে মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখা যাবে।

স্মৃতিচারণে ইভার্টসজ়ুন লিখেছিলেন, ‘‘ওরা আকারে হাঁসের চেয়েও বড় ছিল, কিন্তু উড়তে পারত না। কারণ ওদের ডানাগুলো খুবই ছোট এবং অগঠিত।’’

Advertisement

সে দিন ইভার্টসজ়ুনরা জানতেন না, তাঁরাই ছিলেন বিলুপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দুর্ভাগা ডোডো পাখির শেষ ঝাঁকের শেষ সাক্ষী। ১৬৬২-র সেই বসন্তে, তাঁদের তীব্র খিদেই ছিল ডোডো পাখির পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণ।

১৫৯০ সালে মরিশাসে প্রথম মানুষ দেখতে পায় এই পাখিকে। তার পর থেকেই মানুষ যথেচ্ছ শিকার করত এদের। জাহাজে করে আসা মানুষের সঙ্গে মরিশাসে এল শূকর এবং ইঁদুর। ডোডো পাখির সমস্ত ডিম যেতে লাগল তাদের পেটে।

ডোডো পাখির মাংস কিন্তু মোটেই সুস্বাদু ছিল না। কিন্তু একে তো পাখিগুলো উড়তে পারত না, তার উপর এত বোকা ছিল যে, মানুষের মতো অচেনা প্রাণী দেখেও ভয় পায়নি মোটে! তাই পালিয়েও যায়নি। এগিয়ে এসেছিল। ফলে তাদের ধরা ছিল সবচেয়ে সোজা। ‘বোকামি’র খেসারত দেওয়া থেকে মানুষই পার পায় না, তো ডোডোপাখি।

১৫৯৮ সালে এক জাহাজি কম্যান্ডার, নাম ওয়াইব্র্যান্ড ভান ওয়ারউইক, লিখেছিলেন, ‘‘ডোডো পাখির মাংস ঢিমে আঁচে অনেক ক্ষণ ধরে রান্না করলে সবচেয়ে ভাল খেতে হয়। তাদের পেট এবং বুকের মাংস বেশ সুস্বাদু, চিবনোও সহজ।’’

এই স্বাদ-রহস্য জানা ছিল না ইভার্টসজ়ুনদের। তাঁদের তখন ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়...’। স্মৃতিকথায় ইভার্টসজ়ুন লিখেছিলেন, ‘‘মানুষ তাদের তাড়া করছে, তাতেও পাখিগুলো দৌড়োদৌড়ি করেনি। এতে অবশ্য সুবিধেই হয়েছিল। কারণ আমাদের সঙ্গে পাখি শিকার করার মতো গুলিবারুদ ছিল না।

‘‘তাদের ওড়ার মতো ডানা ছিল না, পালানোর জন্য পায়ের ব্যবহারও যেন তারা জানত না! অবাক চোখে তারা আমাদের অপরিচ্ছন্ন হা-ক্লান্ত চেহারাগুলোর দিকে তাকিয়েই রইল। আমরা ওদের খুব কাছে যেতেও ওদের ভাবান্তর হল না!’’

ফলে ইভার্টসজ়ুনরা সেই উপকূলে পা রাখার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল পক্ষিনিধন। তাঁরা দেখলেন, এক দল পাখি ধরা পড়লে, আর এক দল পালিয়ে না গিয়ে তাদের সাহায্য করতে ছুটে আসে। ফলে ধরা পড়ে। শেষে খাওয়ার মতো ডোডো মেরে ফেলার পর তাঁরা পরের বার খাওয়ার জন্য ডোডো বন্দি করা শুরু করলেন।

এক মাস নয়, পুরো তিন মাস ধরে সেই নাবিক দলকে খাদ্য জুগিয়েছিল ডোডো পাখির শেষ ঝাঁক। তিন মাস পর ইভার্টসজ়ুনের দলের প্রত্যেককে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে ব্রিটিশ জাহাজ ‘ট্রুরো’।

ইভার্টসজ়ুন আর তার সঙ্গীরা জানতেন না যে, পৃথিবীর বুক থেকে ডোডো পাখির শেষ ঝাঁকটিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছেন তাঁরা। তার পর থেকে ওই দ্বীপে আর-একটাও ডোডো পাখি দেখা যায়নি।

২৬ বছর পর, ১৬৮৮-তে ওলন্দাজ শিকারি আইজ়্যাক ল্যামোটিয়াস দাবি করেছিলেন, তিনি ওই উপকূলে ডোডো পাখি দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু বিবরণ ডোডোর সঙ্গে মেলে না। ডোডো পাখির লালরঙা লেজ ছিল না। ওলন্দাজ ভাষায় এই নতুন পাখিটার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডোডেয়ার্স’।

প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সেই উপকূলে তিনশো বছরের পুরনো অনেক বড় গাছ রয়েছে। কিন্তু সেই গাছগুলোর কোনও নতুন প্রজন্ম নেই। এদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাবে প্রজাতি। ডোডো পাখির বিলুপ্তির সঙ্গে এদের সম্পর্ক স্পষ্ট। ডোডো পাখিরা এই সব গাছের মাটিতে পড়ে থাকা ফল খেত। তাদের বিষ্ঠার মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় বীজ ছড়িয়ে যেত। ফলে সেই সব গাছেদের বংশ বিস্তার হত। ডোডো পাখিদের বিলুপ্তির সঙ্গে-সঙ্গে সমস্যায় পড়েছে গাছেরাও। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এক ধরনের টার্কির ঝাঁক সেই দ্বীপে ছেড়ে দিয়েছেন। সেই সব গাছের ফল খেয়ে ডোডোদের মতো করে গাছগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে টার্কিরা।

গাছেরা সুযোগ দিয়েছে। ডোডোরা দেয়নি। আঁকা ছবি বা ট্যাক্সিডার্মিতেই রয়ে গিয়েছে তারা। নতুন ধরনের প্রাণী দেখে অসীম কৌতূহলে হয়তো বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল ওরা। তাই পালানোর চেষ্টা করেনি। জীবন দিয়ে বুঝেছে, খাদ্য আর খাদকের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement