‘সব তীর্থ বারবার গঙ্গাসাগর এক বার’

এখানেই মায়ানমার থেকে আসত বাণিজ্যসম্ভার, বাঘের হাত থেকে তীর্থযাত্রীদের বাঁচাতে তোপ দাগতেন সাহেবরা। বাঙালির সংস্কার, কুসংস্কার, আলোকপ্রাপ্তি, সব এই দ্বীপভূমিতে মাখামাখি। এখানেই মায়ানমার থেকে আসত বাণিজ্যসম্ভার, বাঘের হাত থেকে তীর্থযাত্রীদের বাঁচাতে তোপ দাগতেন সাহেবরা। বাঙালির সংস্কার, কুসংস্কার, আলোকপ্রাপ্তি, সব এই দ্বীপভূমিতে মাখামাখি।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:১৪
Share:

পাঁচ মাসের প্রস্তুতি শেষ, আজ রবিবার ভোররাত থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে চূড়ান্ত পরীক্ষা। বাবুঘাটে সাধুসন্ত ও দেহাতি তীর্থযাত্রীরা গত সপ্তাহ থেকেই ভিড় জমিয়েছেন, সারা রাস্তা ‘সব তীর্থ বারবার গঙ্গাসাগর একবার’ লেখা ফেস্টুন ও ব্যানারে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। আজই সেই পুণ্যস্নান!

Advertisement

এ বার উদ্দীপনা কিঞ্চিৎ বেশি। গত রবিবারই দেখেছি, হারউড পয়েন্টে উপচে পড়ছে সর্পিল লাইন, ওখান থেকেই লঞ্চে পৌঁছতে হবে সাগরধাম। শোনা গেল, ২৬০টা যাত্রীবোঝাই বাস ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে, এক বার স্নান সেরে চলে গিয়েছেন পুরীর শঙ্করাচার্য নিশ্চলানন্দ সরস্বতীও। ‘‘প্রায় কুড়ি হাজার লোক ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছেন,’’ বলছিলেন জেলাশাসক ইয়েলুরি রত্নাকর রাও। প্রশাসনের হিসাব, ভিড় এ বার ৩০ লক্ষে পৌঁছতে পারে। অনেকেই বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী সাগরে ঘুরে যাওয়ার পরই উদ্দীপনাটা বেড়েছে। হতে পারে। প্রাচীন ভারতে রাজা-রাজড়াদের অনুগ্রহেই তো জনপদে তীর্থ গড়ে উঠত।

গঙ্গাসাগরেরও একটি প্রাচীন কাল আছে। তখন আলো ছিল না, রাস্তাঘাট এত উন্নত ছিল না। প্রায় আড়াই দশক আগে সাগরসঙ্গমে প্রথম গিয়েছিলাম। তখন প্রাইভেট বাসে যাত্রীদের বসার জন্য মেঝেতে খড় বিছিয়ে দেওয়া হত। রেক্সিন-আঁটা সিটে বসলে ১০ টাকা ভাড়া, খড়ের মেঝেতে বসলে ৭ টাকা। জেটিঘাট পৌঁছতে ভরসা ভ্যানরিকশা। এখন ধর্মতলা, বাবুঘাট থেকে বাস সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে লট নম্বর ৮-এর জেটিঘাটে। উপরন্তু কাকদ্বীপ, নামখানা অবধি সরাসরি ট্রেন। ঘাটে যাওয়ার জন্য টাটা ম্যাজিক থেকে টোটো, সবই মজুত। ২৫-৩০ বছর আগের প্রাক-আধুনিক গঙ্গাসাগরে ছিল না বিদ্যুৎ। মেলার সময় চলত ডিজেল-চালিত জেনারেটর সেট। এ বার অবশ্য লঞ্চে মুড়িগঙ্গা পেরনোর সময়েই চোখে পড়ল, নদীর ওপর প্ল্যাটফর্ম বসিয়ে ছ’টা ইলেকট্রিসিটি টাওয়ার। সাগরে এখন সারা ক্ষণ বিদ্যুৎ। মোবাইল-সংযোগ আরও সক্রিয় করার জন্য টানা হয়েছে অপটিকাল ফাইবার। লঞ্চ এবং ভেসেল ছাড়াও গত বছর ছিল দু’টি বার্জ। এ বার তিনটি। এক-একটি বার্জে একসঙ্গে প্রায় হাজার পাঁচেক যাত্রী পারাপারের বন্দোবস্ত। থাকছে ১০ হাজার শৌচাগার। এবং তিন হাজারের বেশি পুলিশ। লট নম্বর আট, কচুবেড়িয়া, সাগরতটের ছ’টি এলাকায় উড়তে উড়তে নজর রাখবে ক্যামেরা-বসানো ড্রোন। বাবুঘাট থেকে নামখানা, সাগর অবধি নজরদারির জন্য জায়গায় জায়গায় বসানো হয়েছে ৫০০-রও বেশি সিসিটিভি।

Advertisement

আরও পড়ুন: নুড়ি পাথরের দিনগুলি

প্রায় ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সাগরমেলা এ বার কি তা হলে নতুন কুম্ভ? এই চিন্তায় বঙ্গীয় আত্মপ্রসাদ থাকতে পারে, বাস্তবতা নেই। কুম্ভমেলা, সে হরিদ্বার, প্রয়াগ, উজ্জয়িনী যেখানেই হোক, সব সময় মূল ভূখণ্ডে। অন্তত এক মাস ধরে। আর গঙ্গাসাগর মূল ভূখণ্ডের বাইরে এক দ্বীপ। এক দিকে ভাগীরথী, অন্য দিকে মুড়িগঙ্গা, আর এক দিকে বড়তলা নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। আন্দামান বা লাক্ষাদ্বীপ নয়। এই ভারতে জলবেষ্টিত দ্বীপে একটিই সর্বভারতীয় ধর্মীয় মেলা হয়, তার নাম গঙ্গাসাগর।

লঞ্চ থেকেই দেখতে পেলাম, দেখলাম, মুড়িগঙ্গায় দু’টো বড় বড় ড্রেজার আর চারটে এক্সক্যাভেটর। নদীকে পলিমুক্ত করে লঞ্চ চলাচলের এই চ্যালেঞ্জ অন্য মেলায় থাকে না।

আরও একটা চ্যালেঞ্জ আছে। কুম্ভমেলায় দু’-তিনটি শাহি স্নানের লগ্ন থাকে। গঙ্গাসাগরে সে রকম নয়। মাত্র এক দিন, পৌষসংক্রান্তিতেই ভিড়ের অবগাহন। ‘‘এক দিনে দ্বীপে এত লোকের জমায়েত, তার পর তাঁদের নিরাপদে ফিরিয়ে দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ,’’ বলছিলেন সরকারি অফিসারেরা।

নদীর ভাঙন আর একটা সমস্যা। আগে মুড়িগঙ্গায় লোহাচরা নামে একটা দ্বীপ ছিল, এখন সেটি নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে। ভাঙন আছড়ে পড়েছে ঘোড়ামারা দ্বীপেও। আর গঙ্গাসাগর? তিরিশ মাইল লম্বা দ্বীপ কমতে কমতে এখন মাত্র ১৯ মাইল।

সেই সাগরতটে মেলা। ১৮৩৭-এর ৪ ফেব্রুয়ারি ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা জানাচ্ছে, ‘ভারতবর্ষের অতি দূর দেশ অর্থাৎ লাহোর, দিল্লি ও বোম্বাই হইতে যে বহুতর যাত্রী সমাগত হইয়াছিল তৎসংখ্যা ৫ লক্ষের ন্যূন নহে…

অর্চনা: কপিল মুনি মন্দিরের গর্ভগৃহে— বাঁ দিক থেকে, ভগীরথকে কোলে নিয়ে মকরবাহিনী চতুর্ভুজা গঙ্গা, কপিল মুনি, সগর রাজা।

বাণিজ্যকারি সওদাগর ও ক্ষুদ্র দোকানদারেরা যে ভূরি ভূরি বিক্রয়দ্রব্য আনয়ন করিয়াছিল, তাহা লক্ষ টাকারো অধিক হইবে।’ সাগরমেলায় এখন প্রচার আছে, কিন্তু সেই বাণিজ্য নেই। গত সপ্তাহেই দেখে এলাম, পসরা সাজিয়ে বসতে শুরু করেছে অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র, হাঁড়ি, কড়াই, প্লাস্টিকের খেলনা, কড়ি ও ঝিনুকের মালা। কড়ি, ঝিনুক কিছুই গঙ্গাসাগরের বেলাভূমিতে পাওয়া যায় না, সবই মেদিনীপুর থেকে নৌকোয় আসে।

উনিশ শতকে মেলাটার একটা আন্তর্জাতিক চরিত্র ছিল। সমাচার দর্পণ জানাচ্ছে, ‘ব্রহ্মদেশ হইতে অধিকতর লোক আসিয়াছিল।’ স্বাভাবিক! আউং সান সু চি-র দেশ না থাকলে গঙ্গাসাগরে বসতি থাকত না।

সাগরের উন্নয়নযজ্ঞ? আজকের ড্রেজার, অপটিকাল ফাইবারের ঢের আগে জনবিরল দ্বীপে বসতি স্থাপনের প্রথম উদ্যোগ ওয়ারেন হেস্টিংসের। জঙ্গল কেটে লোক বসানোর জন্য ১৮১৯-এ ৩০ হাজার টাকা অনুমোদন করেন তিনি। বাঙালিরা গেল না, আরাকান থেকে পাঁচশো পরিবার বসতি গড়ল সেখানে। ১৮২২-এ দ্বীপে তৈরি হল রাস্তা, ১৮৩১-এ বসল টেলিগ্রাফের তার। কপিল মুনি নন, ওয়ারেন হেস্টিংস-ই সাগরতীর্থের আসল প্রাণপুরুষ।

সাগরে পৌঁছে, গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম কপিল মুনির মন্দিরেও। দেওয়ালে কালো পাথরের ফলকে ইংরেজিতে লেখা, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন সাজে এই মন্দির উদ্বোধন করেছেন। নতুন সাজ মানে, জয়পুরি পাথরে তৈরি বাসুকির ছাতার নীচে নৃসিংহ মুর্তি, পাশে রাধাকৃষ্ণ। পুরনো মূর্তি তিনটি। সিঁদুরলেপা লাল… ভগীরথকে কোলে নিয়ে মকরবাহিনী গঙ্গা, পাশে যোগাসনে-বসা, পইতেধারী, শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত কপিল মুনি। আর এক পাশে প্রায় এক রকম দেখতে সগর রাজা।

নব সাজের এই মন্দিরটি ১৯৭৪ সালে তৈরি। কপিল মুনির মন্দির সমুদ্রস্রোতে বারংবার ভেঙেছে, ফের তৈরি হয়েছে। আগে বাঁশের তৈরি অস্থায়ী মন্দির ছিল। সেটি বিনষ্ট হওয়ার পরে ১৯৬১ সালে ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় ইটের তৈরি, অ্যাসবেস্টসে ছাওয়া ছোট্ট মন্দির। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ১১ হাজার টাকা সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু প্রস্তুতকারক ‘এস চক্রবর্তী অ্যান্ড কোং’ ছাড়া সে দিন আর কোনও নাম ছিল না। মুখ্যমন্ত্রীরও নয়!

কিন্তু একটা ব্যাপারে সে দিন আর এ দিনে কোনও তফাত নেই। সে দিনও এই আখড়ার দায়িত্বে ছিল অযোধ্যার শ্রীরামানন্দী আখড়া, আজও! স্থানীয় ইতিহাস: গোড়ার দিকে সাগরদ্বীপের এক জমিদার, তাঁর নাম যদুরাম, মেদিনীপুর থেকে এসেছিলেন। যদুরামই রামানন্দী সাধুদের মন্দিরের দায়িত্বে প্রথম নিয়ে আসেন। কিছু দিন বাদে সেই সাধুরা দাবি করেন, এটি রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভগীরথের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কপিল মুনিও স্বয়ং বিষ্ণু। তাঁর বাবা কর্দম মুনি বিষ্ণুকে পুত্র হিসাবে চেয়েছিলেন। ফলে বিষ্ণু কপিল হিসাবে জন্ম নেন। বিষ্ণু ও রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষদের এই মন্দিরের অধিকারী তাই তাঁরাই, জমিদার নন। আখড়াগুলি উত্তর ভারতে জমিদারি, তেজারতি ব্যবসায় অভ্যস্ত, দ্বীপভূমিতে মন্দির দখল এই প্রথম। বলছিলাম না, ওয়ারেন হেস্টিংস-ই প্রাণপুরুষ। তিনি না থাকলে লাট অঞ্চলে জঙ্গল সাফ করে পরবর্তী কালে জমিদারি, কপিল মুনি কিছুই ভাবা যেত না।

সন্ধ্যায় বন্দুকধারী প্রহরীর পাশ কাটিয়ে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মন্দিরের পিছনে দেখা করা গেল মোহান্ত শ্রীজ্ঞানদাসের সঙ্গে। জ্ঞানদাসজী প্রায় বারো বছর সর্বভারতীয় আখড়া পরিষদের সভাপতি ছিলেন। ঘরের দেওয়ালে শ্রীরামের বাঁধানো ছবি। পাশাপাশি সমান সাইজের গৌর-নিতাই, লক্ষ্মী ও কালী। ছবিই প্রমাণ, আখড়া এখানে বাঙালিয়ানার তেলে জলে পুষ্ট। মোহান্তর সঙ্গে কথাবার্তা হল…

প্রশ্ন: এখনও হাঁটেন? প্রয়াগ কুম্ভে দেখতাম, পুলিশরাও আপনার হাঁটার সঙ্গে তাল রাখতে পারত না।

মোহান্ত: ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠে জপধ্যান সারি। তার পর কালীবাজার অবধি ৫ কিমি হাঁটতে যাই, হেঁটে ফিরি।

প্রশ্ন: আপনার আখড়া তো অযোধ্যায়। রামমন্দির হবে?

মোহান্ত: ওগুলি বিজেপি-র প্রচার। বিজেপি একটা পলিটিকাল পার্টি, শুধু হাওয়া গরমের চেষ্টা!

প্রশ্ন: আপনার কপিল মন্দির নিয়েও তো অনেকে নানা কথা বলে।

মোহান্ত: কী কথা?

প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গ সরকার যাতায়াত, থাকাখাওয়ার এত বন্দোবস্ত করে দেয়, অথচ প্রণামীর কোটি কোটি টাকা সবই অযোধ্যায় পাঠিয়ে দেন।

মোহান্ত: এখানে সাগরস্নানে যারা আসে, সবাই গরিব মানুষ। তারা দু’দিনে স্নান সেরে কোটি টাকা প্রণামী দেয়! সম্ভব?

প্রশ্ন: তাও কত? নিজেই বলুন না।

মোহান্ত: কত আর? গত বছর পাঠাতে পেরেছিলাম বড়জোর ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা।

প্রশ্ন: রাজস্থানি মার্বেলের নতুন মূর্তিগুলি?

মোহান্ত: ওগুলি ডোনেশন।

মন্দিরের মোহান্ত শ্রীজ্ঞানদাস

গঙ্গাসাগর যে প্রয়াগ, হরিদ্বারের কুম্ভমেলার চেয়ে আলাদা, তার কারণ এই বৈষ্ণব আখড়ার জনসংস্কৃতি। আজও সাগরে ভোরবেলায় এক দিকে কপিলমন্দিরে স্তোত্রপাঠ, অন্য দিকে ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের মন্দিরে নামগান। কুম্ভমেলায় দশনামী শৈব ও বৈরাগী আখড়া পাশাপাশি, আর গঙ্গাসাগরে বৈষ্ণব একাধিপত্য।

বাঙালির ধর্মমোহ, কৃচ্ছ্রসাধন, বন কেটে বসত, রোম্যান্টিকতা— সব এখানে পরতে পরতে একসঙ্গে। ১৮৬৬ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে সাগরফেরত যাত্রী ও মাঝিরা নবকুমারকে জঙ্গলে ফেলে পালিয়ে যায়। তাদের ধারণা, নবকুমারকে বাঘে খেয়েছে। এর তেরো বছর আগে, ১৮৫৩ সালে সম্বাদ প্রভাকর রিপোর্টিং করছে: ‘সাগর হইতে প্রত্যাগত ব্যক্তির দ্বারা অবগত হইলাম…. টৌন মেজর সাহেব চারিটা তোপ ও এক দল সৈন্যসহ তথায় উপস্থিত থাকিয়া অবিশ্রান্ত রূপে তোপ করাতে ব্যাঘ্রের ভয়বৃদ্ধি হয় নাই, কেবল তিন জন নাবিক বনমধ্যে কাষ্ঠ কাটিতে গিয়া উক্ত জন্তুর দ্বারা হত হইয়াছে।’

তারও আগে, বাঙালি কৃচ্ছ্রসাধনের জায়গা হিসাবে বেছে নিয়েছে এই সাগরকে। বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা এখানে আত্মহত্যা করতে চায়, ‘সাগরসঙ্গমজলে ত্যজিব মো কলেবরে।’ পুণ্যস্থান হতে পারে, কিন্তু স্পষ্টত মেলা ছিল না। মেলার ভিড়ে রাধা কী ভাবে আত্মহত্যা করবে?

তার পর সাগরে ‘দেবতার গ্রাস’, সন্তান বিসর্জন। কোন তীর্থক্ষেত্রে লোকে স্বেচ্ছায় সন্তানকে ভাসিয়ে দেয়? লর্ড ওয়েলেসলি না থাকলে এই প্রথাটিও রদ হত না।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পদসঞ্চার’ উপন্যাসে মারাত্মক এক জায়গা আছে। পর্তুগিজ আক্রমণের পটভূমিকায় উপন্যাস, নায়িকা গত দু’-তিন বছর ধরে কথা বলে না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তান্ত্রিক কুলপুরোহিত এক পর্তুগিজ কিশোরকে বলি দিয়েছিলেন, তার পর থেকেই নীরব হয়ে গিয়েছে সেই মেয়ে। গঙ্গাসাগরে দেখা গেল, সন্তান ভাসাতে এসেছেন এক রানি। পর দিন মূক সেই মেয়ে ‘আঁ আঁ’ চিৎকার করে ওঠে। সাগরের স্রোতে তার সামনে এক শিশুর ছিন্ন শরীর, গঙ্গায় অর্ঘ্য দেওয়া হয়েছিল, তার পর মাছেরা খুবলে খেয়েছে। নরবলি আর সন্তান বিসর্জনকে পাশাপাশি রেখে দিয়েছিলেন লেখক।

গঙ্গাসাগর তাই নতুন এক তীর্থ। প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কারকে ত্যাগ করে বারংবার নতুন ধর্মের কথা বলে সে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তার প্রথম উপস্থাপন ‘কপালকুণ্ডলা’। সেখানে নবকুমার তীর্থযাত্রার কথা ভাবে না, উলটে ‘রঘুবংশম্’ আওড়ায়, ‘দুরাদয়শ্চক্রনিভস্য তণ্বী তমালতালী বনরাজিনীলা।’ প্রকৃতি নিয়ে রোম্যান্টিকতাও শেক্সপিয়র, শেলি, কিট্স ও ইংরেজি সাহিত্যের অবদান।

সাগরসঙ্গমের রোম্যান্টিকতা ছেড়ে পরে বাঙালি উত্তীর্ণ হল আরও বড় মানব ধর্মে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সাগরসঙ্গম’ গল্পে মুখুজ্যেবাড়ির আচারসর্বস্ব বিধবা দাক্ষায়ণী প্রতিবেশীদের সঙ্গে চলেছেন সাগরস্নানে। যৌনকর্মীদের একটি দলও সেই নৌকায়, তাদের মেয়েটি মিথ্যে কথার ঝুড়ি। বিধবা ব্রাহ্মণীর গা রাগে রিরি করে ওঠে। গল্পের শেষে মেয়েটি গঙ্গাসাগরের হাসপাতালে জ্বরে মারা যায়। ডাক্তার তাকে দাক্ষায়ণীর মেয়ে ঠাওরান, বামুনের বিধবাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘স্বামীর নাম?’’ আচারসর্বস্ব বিধবা বলেন, ‘‘দিন, লিখে দিচ্ছি।’’ গঙ্গাসাগরই মহিলাকে ব্রাহ্মণত্বের সংস্কার ছাপিয়ে মানুষের ধর্মে উত্তীর্ণ করে।

এই গঙ্গাসাগরকে শুধু দু’ দিনের জনসমাগম দিয়ে বোঝা যাবে না। মেলা নাহয় আগামী কাল শেষ, কিন্তু পুণ্যার্থীদের ভিড় ফিরে গেলেই জায়গাটা ডুবে যাবে না অন্ধকারে। এলাকায় ১৪৮টি গ্রাম, সব মিলিয়ে প্রায় ২ লক্ষেরও বেশি মানুষের বাস। দে়ড় বছর আগেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রথম ‘ওপন ডেফিকেশন-ফ্রি ব্লক’, খোলা মাঠে ও নদীতীরে শৌচে আর যান না এখানকার লোকেরা। সারা এলাকায় ৪৪টা হাই স্কুল, সঙ্গে কলেজ ও আইটিআই। সাক্ষরতার হার সর্বভারতীয় গড়ের থেকে বেশি, প্রায় ৮২ শতাংশ। মকরসংক্রান্তির পর মাঘী পূর্ণিমা, শিবরাত্রি, মহালয়াতেও স্নানে জড়ো হন লাখো লাখো মানুষ। স্নান, দানের পাশাপাশি গঙ্গাসাগরের তাই অন্য এক শিক্ষার ঐতিহ্যও আছে।

সন্ধ্যায় ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল, ঘি আর কর্পূরে বাতি তৈরি করে সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছেন দেহাতি মহিলারা। সাগরতটে কয়েক গজের মধ্যে তিনটি আলাদা ব্রাহ্মণ সেবাসমিতি।

এই সব দেখতে দেখতে পাঁচ নম্বর রাস্তা পেরিয়ে গ্রামের পথে। ইটের রাস্তা, সাগরতটের আলোকবৃত্ত নেই। এখানেই গঙ্গাসাগরের একমাত্র মসজিদ। ইমাম জানালেন, প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজ পড়া হয়। শেখ সুবেদ নামে এক জন জানালেন, মেলায় তাঁরাও দোকানপাট বসান। ‘‘আমরা মেলায় যাই, দুর্গাপুজোয় যাই, প্রতিবেশীরা ইদে কুশল শুধোতে আসেন, এতে আশ্চর্যের কী আছে?’’ রেজাউল হক নামে এক গ্রামবাসী গলা চড়ালেন, ‘‘শোনেন, পুরনো কপিল মুনির মন্দিরে যখন জল উঠেছিল, আমার দাদা-পরদাদারা বুক দিয়ে আগলেছিলেন। আমাদের মধ্যে বিভেদ নাই।’’

ভিড়ের সংখ্যা, মসৃণ রাস্তা আর যাতায়াতের সুবিধাই সব নয়। রোম্যান্টিকতা আর দুই সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ফূর্ত মানবিকতাতেই আজও সাগরস্নানের মুক্তি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement