মাতৃসমা: অঞ্জলি লাহিড়ী।
চেরাপুঞ্জি পাহাড়ে ওই বিশেষ পাথরটার নাম ‘মমলু’। ‘ম’ মানে পাথর, ‘মলু’ মানে লবণ। ননখলাও স্টেটের ‘সিয়েম’ (রাজা) তীর্থ সিংহ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। ওই পাথরের উপর দাঁড়িয়ে তলোয়ারের মুখে লবণ দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বিনা যুদ্ধে হার মানবেন না।
মমলু থেকে দেখা যায়, দূরে নদী। নদীর ও পারে বাংলাদেশ। ১৯৭১–এ তার নাম পূর্ব পাকিস্তান। সেখান থেকে শরণার্থী ঢুকছে সেলা বাজারে। খান সেনাদের তাড়া খেয়ে, প্রাণ বাঁচাতে দলে দলে ঢুকে পড়েছে তারা। শুধু সেলা নয়, বালাট-মাইলাম-ডাউকি-বাঁশতলা-দোয়ারাবাজার-তামাবিল-আমলারেং, মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী জনমানবহীন রুক্ষ প্রান্তরে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য শরণার্থী শিবির। শুধু মেঘালয়েই ঢুকেছে তিরিশ লাখ মানুষ।
ঢেউয়ের মতো উত্তাল জনস্রোত। মাথায় ছোট ছোট পুঁটলি, কাঁধে–পিঠে বাঁধা বুভুক্ষু বাচ্চার দল। উমিয়াম নদীর চড়ায় গ্রানাইট পাথরের ছড়ানো বোল্ডার, পায়ে ছেঁকা-লাগা বালি। চারটে বাঁশের খুঁটির উপর ছেঁড়া পলিথিনের টুকরো বেঁধে মাথা গোঁজার আস্তানা। তার উপরে এক নাগাড়ে চলছে বৃষ্টি। ছেঁড়া পলিথিনের ছিদ্র দিয়ে জলে–কাদায় ভরে গেছে চারপাশ। বৃষ্টিতে আর খিদেয় মানুষগুলো যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। চারদিকে কলেরা, আমাশা। রাতারাতি মরে যাচ্ছে মানুষ। জলে ভাসছে মৃতদেহ। লাশ পোড়ানোর কাঠ নেই। পচা মাংসের উৎকট গন্ধ। শকুন আর কাকের উৎসব লাশের স্তূপের উপর। বালির তলা থেকে কুকুরের দল টেনে বের করে খুবলে খাচ্ছে মানুসের মাংস।
সেলা বাজারের শরণার্থী শিবিরের সাত নম্বর ব্যারাক। এখানেই আস্তানা গেড়েছেন ময়মনসিংহের এক নামকরা উকিল। সঙ্গে স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে। বস্তায় বাঁধা কাঁসার বাসনপত্র। পাতার ছাউনির ঢাল দিয়ে জল পড়েই চলেছে। সাহেবের মত অ্যাকসেন্ট দিয়ে ইংরেজিতে কথা বলেন। কেতাদুরস্ত মানুষ, ভাগ্যবিপর্যয়ে আজ সবার সঙ্গে ভাগ করে খাচ্ছেন ত্রাণের খাবার।
’৭১-এ শরণার্থীদের ঢল
পাশের আর একটা ঝুপড়িতে ষোলো–সতেরো বছরের একটি মেয়ে। প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় বসে আছে। দু–তিনটে ছেঁড়া গেঞ্জি জোগাড় করে তালি লাগিয়ে কোনওক্রমে লজ্জা ঢেকেছে। মাথায় জট। চামড়া ফেটে যেন এখনই রক্ত পড়বে। মেয়েদের আব্রু বলতে আজ আর কিছু নেই। স্কুল–কলেজে পড়া এই মেয়েগুলো শৌচালয়ের খোঁজ করে, কিন্তু চারদিকে তো ধু–ধু বালির চর!
ভারত সরকার শরণার্থীদের ত্রাণের জন্য বরাদ্দ করেছে দশ কোটি টাকা। বিদেশ থেকেও প্রচুর ত্রাণ আসছে। কিন্তু সে সব মাঝপথেই লুঠ হয়ে যাচ্ছে। ছোট বোতলে বরাদ্দ রেশনের সরষের তেল গরম কড়াইয়ে ঢালতেই পাত্র ফেনায় ভরে ওঠে। আমলারেং ক্যাম্পে এক সপ্তাহে আশি জন লোক উদরী রোগে মারা গেছে। শিলঙের পেস্টার ইনস্টিটিউটে ওই ভোজ্য তেল পরীক্ষা করে দেখা গেল, মবিল মেশানো হয়েছে তাতে।
মেঘালয়ের এক মন্ত্রী শিবিরে এসে হুমকি দিয়ে গেছেন জ্বালানির জন্য একটা খড়িও জঙ্গল থেকে কাটা চলবে না। ক্যাম্পের দু’টো ছেলে কাঠের সন্ধানে জঙ্গলে গিয়েছিল, কয়েকটা খাসিয়া ছেলে মেরে তাদের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। যারা শিলঙে কোনও আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নিতে যেতে চায়, মাঝরাস্তায় খাসিয়ারা তির–ধনুক, লোহার রড নিয়ে মারধর করে। বলে, ক্যাম্পের কলেরা শহরে চলে যাবে। টেংরাটিলা ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের খবর, সিমেন্টের কারখানায় খান সেনারা সতেরোটা ছেলেকে দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে, পাথর বইয়ে, সেই গর্তেই ওদের ছুড়ে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছে। জীবন্ত মানুষের সমাধি! এখন বাঁশের খুঁটি দিয়ে চারপাশটা ঘেরাও করে রেখেছে। হুমকি দিচ্ছে, মুক্তি ফৌজকে সাহায্য করলেই এই হাল হবে। খবর আসে আরও। তবে সবই খারাপ খবর। গ্রামের যে সব মুসলমান পরিবার পালিয়ে আসতে পারেনি তাদের মেয়েদের, আর শরণার্থী দল থেকে হিন্দু যুবতীদের ধরে মিলিটারি ছাউনিতে নিয়ে গিয়েছে। কয়েকটা মেয়ে শাড়ির খুঁটে দড়ি বানিয়ে আত্মহত্যা করার পর ওরা শিবিরে মেয়েদের উলঙ্গ করে রেখেছে। যাদের লম্বা চুল ছিল কেটে দিয়েছে, যাতে চুল গলায় পেঁচিয়ে মরতে না পারে।
ধারালো বর্শার মতো বৃষ্টির ধারা। পাহাড়ে ধস নেমে কাদা আর কাঁচা মাটিতে জিপের চাকা বারবার ডুবে যায়। জিপ বিপজ্জনকভাবে কাত হয়ে যাচ্ছে। গাড়ির চালক মুয়াজ্জেম চৌধুরী। পাশে বসে আছেন অঞ্জলি লাহিড়ী। যাচ্ছেন মাইলাম ত্রাণ শিবিরে। মেঘালয়ের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট সুবর্ণপ্রভা দাসের কন্যা অঞ্জলি। বাবা ভারতের ‘ভেষজ রসায়নের জনক’ ড. প্রেমানন্দ দাস। স্বামী মেঘালয়ের অ্যাডভোকেট জেনারেল নীরেন্দ্রনাথ লাহিড়ী।
অঞ্জলির সঙ্গে ওষুধপত্র, শুকনো খাবার। রোজই ঘুরে বেড়ান নানা ত্রাণ শিবিরে। শহর থেকে ত্রাণ তুলে দিয়ে আসেন শরণার্থীদের। সরকারি দফতরে আবেদন-নিবেদনও করেন। এক কালে বৃহত্তর অসমের বামপন্থী রাজনীতির বড় নেত্রী। দল যখন নিষিদ্ধ, জেলও খেটেছেন তিনি আর সুরমা ঘটক। সুরমা ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী। এই শিলঙেই ঋত্বিক আর সুরমার বিয়ে হয়েছিল। কনে সাজিয়েছিলেন অঞ্জলিই। অনেক পরে হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁকে একটা চিঠিতে লিখবেন: ‘একটি সামন্তীয় পরিবারের সমস্ত সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলে অসুস্থ দেহে শিলং–এ এসে যখন আশ্রয় নিলাম, তখন পার্টির প্রতিনিধি হয়ে তুমিই আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। সেসব দিন কখনো ভুলব না।’
মাইলামে জিপ পৌঁছতেই অঞ্জলিকে ঘিরে ধরল একগাদা বাচ্চা। তাদের থেকে উদ্ধার করলেন যিনি, তার নাম রাকেশ দাস। মাঝবয়সি কৃষ্ণকায় মজবুত চেহারার ভদ্রলোক। রোজ দু’বেলা বালাট নদী সাঁতরে এ পারে আসেন রেশনের তদারকি করতে। অধিকাংশই নিরক্ষর মানুষ, নামও লিখতে জানে না। চাল, তেল, চিনি না পেয়েও রেশন পেয়েছে বলে টিপসই দিয়ে দেয়। শিবিরের ছনের ছাউনি এই নিয়ে তিন বার কারা আগুনে পুড়িয়ে দিল।
মহামারি দেখা দিয়েছে মাইলামে। সে দিন সকালের মধ্যে দু’শো লোক কলেরায় মারা গিয়েছে। স্যালাইন নেই। থাকলেও পনেরো টাকার স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে পাঁচশো টাকায়। একটা ছাউনিতে এক সৌম্য চেহারার মুসলিম বৃদ্ধ হাউহাউ করে কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করতে আঙুল দিয়ে দেখালেন, ‘‘ওই যে বড় নাতনি আমিনা, ওর দাস্ত বমি।’’ বাঁশের চাঙের উপর শুয়ে এক কিশোরী। একমাথা ঘন কালো চুল। টিকালো নাকে একটা সাদা পাথরের নাকছাবি, আলো পড়ে চকচক করছে। ডাগর দু’টো চোখ। অঞ্জলির হাত জড়িয়ে ধরল মেয়েটি, ‘‘মাসিমা, আমারে বাঁচান। আমি মরতে চাই না।’’ স্যালাইনের অভাবে তাকে বাঁচানো গেল না।
সে দিন শিলঙে ফিরে এলেও দিন তিনেকের মধ্যে মাইলাম থেকে আবার জরুরি ডাক পড়ল অঞ্জলির। মাইলাম ক্যাম্পে পৌঁছে দেখলেন, চারদিকে শ্মশানের নীরবতা। বসতির কোনও চিহ্ন নেই। সারি সারি পুড়ে যাওয়া মানুষের মৃতদেহ। কাল রাতে কারা যেন পুরো ব্যারাকে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
ছেলেরা নিয়ে গেল রাকেশবাবুর কাছে। তাঁর আস্তানা পুড়ে ছাই। বাঁশের মাচায় নিথর পড়ে আছেন ভদ্রলোক। বিকৃত মুখ, ছাল–চামড়া জ্বলে গেছে। দু’হাতের চামড়া জ্বলে মাংস থেকে আলগা হয়ে কনুইয়ের কাছে ঝুলছে। ঝলসানো দেহের রক্ত আর জল টপটপ পড়ছে মাটিতে। তাকানো যায় না। ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন অঞ্জলি। তাঁর চোখের সামনেই ধীরে ধীরে মৃত্যুঘুমে ঢলে পড়লেন রাকেশ দাস।
সে দিনও অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। জুলাই মাস। শিলঙে অঞ্জলির বাড়িতে হঠাৎই আট–দশটা ছেলে এসে হাজির। পরনে লুঙ্গি, ভেজা গেঞ্জি, হাতে বন্দুক। এদের মধ্যে সব চেয়ে উজ্জ্বল যে ছেলেটি, তার নাম জগৎজ্যোতি। বছর কুড়ি বয়স। সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র। অঞ্জলিকে বলল, ‘‘মাসিমা, আমি পাক সৈন্যদের সতেরোটা বার্জ দখল করেছি।’’ ভীষণ খিদে পেয়েছে সবার। অঞ্জলি মিষ্টি, শিঙাড়া আনালেন। অন্য একটা ছেলে জানাল, জগৎজ্যোতির শরীরে বুলেটের আট–দশটা স্প্লিন্টার আছে। অঞ্জলি বললেন, ‘‘এখানকার মিলিটারি হাসপাতালের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। তুমি কিছু দিন বিশ্রাম নিয়ে যাও।’’ জগৎজ্যোতির উত্তর, ‘‘কী যে বলেন মাসিমা! এখন যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। এখন আমার বিশ্রাম নেয়ার সময় নাই।’’
ঘণ্টা দুয়েক থেকে তারা চলে গিয়েছিল। পরে জগৎজ্যোতি ধরা পড়ে পাক সেনার হাতে। তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারে তারা। দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যায় সুনামগঞ্জ বাজারে। সেখানে অর্ধমৃত অবস্থায় গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলে রাখে। দেড় দিন বেঁচে ছিল সে। কেউ একটু জল দিতে সাহস করেনি।
আশির দশকের শেষে বিলেতে এক সভায় অঞ্জলির মুখে রাকেশ–জগৎজ্যোতির কথা শুনে বাংলাদেশের কয়েক জন বলেছিলেন, ‘‘আমাদের ধারণা ছিল, শুধু মুসলমানরাই মুক্তিযুদ্ধ করেছে, হিন্দুদের কোনও ভূমিকা ছিল না। ভুল জানতাম।’’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সম্প্রতি মেঘালয় সফরে এসে স্মৃতিচারণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের, সেই সময় দীর্ঘ দিন তিনি ছিলেন মেঘালয়ের বালাটেই।
২০১৩-র ডিসেম্বরে শিলঙে মারা গিয়েছেন অঞ্জলি। শেষ হল এক ইতিহাসেরও। যে দেশের মুক্তির লড়াইয়ে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে হাতে হাত রেখেছিল, ভয় হয়, সেই সত্য অন্ধকারে ডুবে যাবে না তো?