বিপ্লব: লন্ডনের মার্ক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরির দেওয়ালে বিখ্যাত ম্যুরাল। শ্রমজীবী মানুষকে ঘিরে আছেন লেনিন, মার্ক্স, এঙ্গেলস।
ছোট্ট একটা স্মারক বোর্ড আছে উত্তর লন্ডনের ইজলিংটনে। তাতে লেখা, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, বিশ্বের সর্বহারাদের নেতা এক সময় এখানে থাকতেন। ১৯০২-১৯০৩ সালে লন্ডনে নির্বাসনে থাকাকালীন সস্ত্রীক লেনিন ছিলেন ফিন্সবেরির ৩০ হলফোর্ড স্কোয়্যার ঠিকানায়। বাড়িটা আজ নেই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৪২ সালে রুশ স্থপতি বার্টোল্ড লুবেতকিন বাড়ির উলটো দিকে একটি স্মারক— লেনিনের আবক্ষ মূর্তি ও একটি ফলক—স্থাপন করেন।
যুদ্ধের পর লুবেতকিনকে বলা হল ওই জায়গায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক তৈরি করতে। তিনি এর নাম দেন ‘লেনিন কোর্ট’। অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির সময় স্মারকটি কাছের এক বাগানে সাময়িক ভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। দূরদূরান্ত থেকে কমিউনিস্টরা এটি দেখতে আসতেন, আবার কমিউনিজম-বিরোধীরাও বহু বার এর ক্ষতি করেছে। ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন ব্লক নির্মাণ ও স্থাপনা সম্পূর্ণ হল, তখন ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে। প্রাক্তন ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী আর্নেস্ট বেভিন-এর নামে বাড়িটির নামকরণ করা হয় ‘বেভিন কোর্ট’। ‘লেনিন কোর্ট’ নামটা থেকে যায় শুধু কাউন্সিল প্ল্যানিং সংক্রান্ত বইয়ে।
লেনিনের স্মারক ও এই অ্যাপার্টমেন্টের নামকরণের পিছনে আছে অন্য এক গল্প। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুর বছরগুলিতে লন্ডনের লাইব্রেরি আর সভাকক্ষগুলি কী ভাবে রুশ বিপ্লবের মতাদর্শ ধরে রেখেছিল, সেই গল্প।
লেনিন ও তাঁর স্ত্রী নাদেজদা ক্রুপস্কায়া বিশ শতকের শুরু থেকেই দেশছাড়া। জারের পুলিশকে এড়াতে জেনেভা, মিউনিখে অজ্ঞাতবাসে। কিন্তু ব্যাভেরিয়া প্রদেশের পুলিশও তখন বিপ্লবীর খোঁজে। অতঃপর ১৯০২-এর এপ্রিলে মিউনিখ থেকে লন্ডনে এসে পৌঁছন লেনিনরা। লেনিনের মুখ্য উদ্দেশ্য তখন রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি-র মুখপত্র ‘ইসক্রা’-র প্রকাশ ও মুদ্রণ অব্যাহত রাখা। চেরিং ক্রস স্টেশনে এক বন্ধু— নিকোলাই আলেক্সিভ লেনিন-দম্পতির সঙ্গে দেখা করেন। ৩০ হলফোর্ড স্কোয়্যারে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়।
এই বাড়িতে থাকাকালীনই লেনিন ব্রিটিশ মিউজিয়ম লাইব্রেরির বইপত্র ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছিলেন। ১৯০২-এর এপ্রিলে তিনি জেকব রিখটার নাম ব্যবহার করে একটি ‘রিডার্স টিকিট’-এর অনুমতি চান। জারপন্থী পুলিশের চোখে ধুলো দিতেই এই নাম। আবেদনপত্রে লেখা ছিল, তিনি রাশিয়া থেকে এসেছেন ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে পড়াশোনার জন্য। আবেদন গৃহীত হয়েছিল। ২৯ এপ্রিল তাঁকে একটি টিকিট দেওয়া হয়, নম্বর A72453। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে হাতে-লেখা সেই আবেদনপত্রটি রাখা আছে। হলফোর্ড স্কোয়্যারের বাড়িতে লেনিনরা ছিলেন এক বছরের কিছু বেশি সময়। মিসেস এমা ইয়ো, তাঁদের বুর্জোয়া বাড়িওয়ালি— এই দম্পতির বাউন্ডুলে জীবনযাপনে যারপরনাই অতিষ্ঠ ছিলেন।
আবাস: টাভিস্টক প্লেসে লেনিন-স্মারক
গোড়ার দিকে ভাষার সমস্যা সহ অনেক বিপত্তি দেখা দিয়েছিল। লেনিন ও ক্রুপস্কায়া সাইবেরিয়া থাকাকালীন বিয়াত্রিচ ও সিডনি ওয়েব-এর ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেমোক্রেসি’ অনুবাদ করেছিলেন বটে, কিন্তু দু’জনের কারওই কথ্য ইংরেজির অভিজ্ঞতা ছিল না।
লেনিন সকালগুলো কাটাতেন ব্রিটিশ মিউজিয়মের রিডিং রুমে। ক্রুপস্কায়ার মতে, ‘বিশ্বের সমৃদ্ধতম লাইব্রেরি’ দেখে তাঁর খুব ভাল লেগেছিল, মিউজিয়ম দেখে ততটা নয়। ফেরার পথে, ৩৫ ক্লার্কেনওয়েল স্ট্রিটের অফিসে— যেটি ছিল ‘পেট্রিয়টিক ক্লাব’-এর আস্তানা, তিনি ইসক্রা-র কাজ করার জন্য থামতেন। এখানে এখন আছে মার্ক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরি।
আরও পড়ুন: গা ছাড়া কেন, নেতাদের প্রশ্ন করলেন অভিষেক
ইসক্রা, বাংলা অর্থ স্ফুলিঙ্গ। দেশছাড়া দম্পতি তখন লন্ডনের কাগজে ছড়াচ্ছেন বিপ্লবের প্রস্তুতির স্ফুলিঙ্গ। সাইবেরিয়ায় নির্বাসন শেষে এই লন্ডনে তাঁর সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন লেভ দাভিদোব্রিচ ব্রনস্টাইন নামে ইউক্রেনের এক বিপ্লবী। তাঁর পকেটে তখন একটি পয়সাও নেই। সকালবেলায় লেনিনের ফ্ল্যাটে এসেছেন। নাদেজদা জানান, লেনিন ঘুমোচ্ছেন। ক’দিন তাঁর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে। স্নায়বিক উত্তেজনা শান্ত করতে সকালে উঠে ফরাসি ব্যাকরণ পড়েন। তখনই লেনিনকে আগন্তুকের কথা বলবেন! কিন্তু লেভ-এর তর সয় না। ভবিষ্যৎ তাঁকে চিনবে লিওন ট্রটস্কি নামে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানীতেই তখন শুরু হয়ে গিয়েছে রুশ বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্ব। ইসক্রার দফতরে তখন জোরদার বিতর্ক: কোন পথে রাশিয়াতে আসবে বিপ্লব? মার্তভ ও অন্যরা বলছেন, বিপ্লবী পার্টিই সব নয়। সবাই যেন পার্টির আনুগত্য ছাড়াও নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম। লেনিন বিপক্ষে। তাঁর যুক্তি, শক্তিশালী পার্টিই বিপ্লবের অগ্রপথিক। ইসক্রার দফতর পরে বিভক্ত হয়ে গেল। বিতর্কে সংখ্যালঘু মার্তভরা মেনশেভিক। আর লেনিনরা বলশেভিক। রুশ ভাষায় বলশেভিক কথাটার অর্থ, সংখ্যাগরিষ্ঠ।
লন্ডন ঘুরতে ভালবাসতেন লেনিন। বিশেষ করে প্রিমরোজ হিলে হাঁটতে, রিজেন্ট’স পার্ক চিড়িয়াখানায় ঘুরতে। অবসর বিনোদনের অনেক কিছু যুক্ত ছিল তাঁর কাজের সঙ্গেই। হাইড পার্কের ‘স্পিকার্স কর্নার’-এ নিয়মিত বক্তৃতা শুনতেন।
ক্রুপস্কায়া লিখেছেন, ‘‘ইলিচ লন্ডনে থাকার সময় পড়াশোনা করত। বাসের দোতলায় বসে শহরের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ যাত্রা পছন্দ করত। বিরাট এই বাণিজ্যনগরীর ব্যস্ত রাস্তাঘাট, শান্ত স্কোয়্যারগুলির সবুজে-ঢাকা অভিজাত বাড়ি, তার সামনে ধোপদুরস্ত ব্রুহাম গাড়ি— ওর ভাল লাগত। অন্য সব জায়গাও ছিল— সরু, ছোট্ট গলিপথ, যেখানে লন্ডনের শ্রমজীবী মানুষরা ভাড়া থাকতেন, যেখানে রাস্তা জুড়ে জামাকাপড় মেলার তার, দোরগোড়ায় খেলছে রক্তাল্পতায় ভোগা শিশুরা। এই জায়গাগুলোয় আমরা যেতাম পায়ে হেঁটে। বৈভব ও দারিদ্রের এই চোখ-ধাঁধানো বৈপরীত্য দেখে, ইলিচ দাঁতে দাঁত চেপে ইংরেজিতে বলত: টু নেশন্স!’’
ব্রিটিশ মিউজিয়মের রিডিং রুমেই লেনিন জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স-এর লেখা পড়েছিলেন। সেই মার্ক্স, যিনি ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে বসেই ‘দাস ক্যাপিটাল’ লিখেছিলেন। তার প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৭ সালে, তত দিনে মার্ক্স সপরিবারে লন্ডনে থিতু। তাঁকে অর্থসাহায্য করেন এক তুলোর কলের মালিকের ধনী পুত্র— ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস। ১৮৮৩ সালে লন্ডনেই মার্ক্স মারা যান। তাঁর রেখে যাওয়া নোটস থেকে দাস ক্যাপিটাল-এর বাকি দু’খণ্ড লেখা ও প্রকাশের কাজ সমাপন করেন এঙ্গেলস। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে আজও আছে ‘দাস ক্যাপিটাল’-এর প্রথম সংস্করণ, যে বই রাশিয়া, চিন, কিউবা সহ বহু সমাজতন্ত্রী দেশে বিপ্লবের সূচনা করেছিল। বইটির রুশ সংস্করণ এক বছরে বিক্রি হয়েছিল ৩০০০ কপি, যেখানে আসল জার্মান সংস্করণটি পাঁচ বছরে বিক্রি হয়েছিল মাত্র হাজার কপি।
‘কন্সপিরেটর, লেনিন ইন এক্সাইল’ গ্রন্থের লেখক, ঐতিহাসিক হেলেন রাপাপোর্ট-এর মতে, লন্ডনে বহু মানুষের স্মৃতিতে বেঁচে আছেন লেনিন। বেঁটেখাটো পরিশ্রমী মানুষটি প্রচুর পড়াশোনা করতেন।
সব সময় গাদা বই চেয়ে পাঠাতেন, পড়তেনও খুব দ্রুত। লন্ডনেই লেনিন লেখেন তাঁর ‘ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড, টু স্টেপস ব্যাকওয়ার্ড’ বই। মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে বলশেভিক আপত্তিটা ঠিক কোথায়, পার্টি কংগ্রেসের মিনিট্স ধরে বিশ্লেষণ।
১৯০২ সাল থেকে লেনিন ছ’বার লন্ডনে এসেছিলেন। এই শহর তাঁর কাছে ছিল অশুভের প্রতীক, যা তিনি নির্মূল করতে চান। ইস্ট এন্ড-এ বন্ধুদের নিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখাতেন সেখানকার দগদগে শ্রেণিবৈষম্য।
ইস্ট লন্ডনের হোয়াইটচ্যাপেল সেই সময় আইরিশ শ্রমিক আর রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে আসা ইহুদি অভিবাসীতে ভরা। বিংশ শতাব্দী শুরুর সেই দিনগুলিতে স্বাভাবিক ভাবেই এলাকাটি হয়ে উঠেছিল রুশ বিপ্লবীদের আখড়া। ১৯০২, ১৯০৫ ও ১৯০৭ সালে, রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি কংগ্রেস চলাকালীন বলশেভিক আর মেনশেভিকরা জমিয়ে রাখতেন এই অঞ্চলের পাব, ক্যাফে, হোটেলগুলি। ই-ওয়ান পোস্টাল কোডযুক্ত জায়গাটুকুতে বহু বিপ্লবীর পা পড়েছে। ১৯০৩ কংগ্রেস চলাকালীন এক মতান্তরের ফলেই বলশেভিক ও মেনশেভিকরা চূড়ান্ত ভাবে আলাদা হয়ে যান।
ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে এই হোয়াইটচ্যাপেলই কুখ্যাত ছিল জ্যাক দ্য রিপারের জন্য। এখানেই সে তার শিকারদের খুন করত। এই হোয়াইটচ্যাপেলেই মিলিত হতেন রুশ বিপ্লবীরাও। বাড়ি থেকে ১৩০০ মাইল দূরে এখানে বসে তাঁরা রাশিয়ায় জার-শাসন উৎখাত করার পরিকল্পনা করতেন। মাইল এন্ড রোড-এর এক সভায় উপস্থিত ছিলেন ৭,০০০ মানুষ। তাঁদের এক জন বলেছিলেন, ‘‘ওই আবহাওয়া ভোলার নয়। মানুষের প্রাণশক্তি ছিল পাগলের মতো।’’
এখন এই এলাকায় মূলত বাংলাদেশি মানুষের বাস। ইলিশ, রুই-পাবদা বিক্রি হয় দোকানে দোকানে। জুবিলি স্ট্রিটে একটি বাংলা সংবাদপত্রের কার্যালয় ও একটি ইহুদি বেকারির কাছেই কতকগুলো ফ্ল্যাট। এখানকারই ১৬৫ নম্বর বাড়িতে ছিল জুবিলি স্ট্রিট ক্লাব। তখন বলা হত ‘নিউ আলেকজান্দ্রা হল’। বিতর্ক, অনুষ্ঠানে জমজমাট এই বাড়িতেই ছিল ‘ওয়ার্কার্স ফ্রেন্ড’ নামের একটি বামপন্থী সংবাদপত্রের ব্যবস্থাপনা দফতর। এই ক্লাবেই লেনিন লন্ডনে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, উপলক্ষ ছিল প্যারিস কমিউন-এর উদ্যাপন। তখন তাঁর বয়স ৩৫।
হোয়াইটচ্যাপেল টিউব স্টেশন থেকে দু’মিনিট দূরে, ফুলবোর্ন স্ট্রিটের এক কোনায় এখনও আছে একটা বাড়ি। ১৯০৭ কংগ্রেস চলাকালীন এটাই ছিল রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্র। ‘‘আর সব রুশ, পোলিশ, লিথুয়ানিয়ান মানুষের সঙ্গে লেনিনও এখানেই রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন। ব্রিটিশ লেবার মুভমেন্ট-এর সদস্যরা তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন,’’ বলছিলেন ডেভিড রোজেনবার্গ। ডেভিড আয়োজন করেন ‘ইস্ট এন্ড ওয়াক’, ইস্ট এন্ড ও রুশ বিপ্লবের যোগসূত্রগুলি ঘুরে দেখান সবাইকে।
আলোকশিখা: মার্ক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরিতে লেনিন-সম্পাদিত ইসক্রা
১৯০৮-এর মে মাসে লেনিন আবার লন্ডনে আসেন। থাকতেন ২১ টাভিস্টক প্লেস-এ। ব্যস্ত ছিলেন ‘মেটেরিয়ালিজম অ্যান্ড এম্পিরিও-ক্রিটিসিজম’ লেখার জোগাড়যন্ত্রে, পরের বছরই যা প্রকাশিত হবে। ৩৬ টাভিস্টক প্লেসের (এটাই আগে ছিল ২১ নম্বর) বাড়িতে একটা ফলক আছে। তাতে লেখা: ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন ১৮৭০-১৯২৪, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা, ১৯০৮ সালে এখানে থাকতেন।
লেনিনের শেষ ও সংক্ষিপ্ত লন্ডন-বাস ১৯১১ সালে। মর্নিংটন ক্রেসেন্ট-এর কাছে, ৬ নম্বর ওকলি স্কোয়্যার-এ ছিলেন। ১১ নভেম্বর কমার্শিয়াল রোডের নিউ কিংস হল-এ একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
১৯০৭ সালে জোসেফ স্তালিন থাকতেন ইস্ট লন্ডনের ফিল্ডগেট স্ট্রিটে, ‘টাওয়ার হাউস’-এর সাদামাটা এক আস্তানায়। রোজ রাতের ভাড়া ছিল মোটে ছ’পেন্স। তিনি পঞ্চম কংগ্রেসে অংশগ্রহণ করতে এসেছিলেন। আর যাঁরা এই কংগ্রেসে ছিলেন তাঁরা হলেন লিওন ট্রটস্কি, রোজা লুক্সেমবুর্গ আর অবশ্যই লেনিন। সেই টাওয়ার হাউস এখন বিলাসবহুল এক অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক— ফান্ড-ম্যানেজার ও স্টক-ব্রোকারদের প্রিয় স্থান। ১১০ বছর আগে এখানেই থাকতেন সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীরা!
লন্ডনের ক্লার্কেনওয়েলের ‘ক্রাউন ট্যাভান’-এ লেনিন ও স্তালিনের প্রথম সাক্ষাৎ, এমনটাই মনে করা হয়ে থাকে। যদিও খুব একটা প্রমাণ নেই। ১৯০৭ সালে স্তালিন লন্ডনে ছিলেন তা নিশ্চিত, কিন্তু ১৯০৫ সালে, যখন দু’জনের সাক্ষাৎ হয়েছিল বলে দাবি করা হয়, তখন সত্যিই তিনি লন্ডনে ছিলেন কি না, তার সত্যতা মেলেনি।
পাব-এর বাড়িওয়ালা জেসন রবিনসনের বিশ্বাস, এখানেই তাঁদের প্রথম দেখা হয়েছিল। ‘‘লেনিন যে প্রায়ই আমাদের পাবে আসতেন তা আমি জানি,’’ রবিনসন বলেন। ‘‘আমাদের আর্কাইভে আছে, ১৯০৫ সালে লেনিন এখানে স্তালিনের সঙ্গে মিটিং করেছিলেন। ১০০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে এখনও মানুষ এখানে আসেন সেই ইতিহাস রোমন্থন করতে।’’
এই ক্লার্কেনওয়েলেই আছে মার্ক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরি। ৩৭এ ক্লার্কেনওয়াল গ্রিন নামের বাড়িটা ‘পেট্রিয়টিক ক্লাব’-এর মতো বহু বিপ্লবী সংঘের ঠিকানা ছিল। ১৯০২ সালের এপ্রিল থেকে ১৯০৩-এর মে পর্যন্ত এখান থেকেই লেনিন ‘ইসক্রা’ সংবাদপত্রের ১৭টি সংখ্যা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছিলেন। ১৮৮৩-র ১৪ মার্চ লন্ডনে মার্ক্সের মৃত্যুর ৫০ বছর স্মরণে ১৯৩৩ সালে এখানে এই লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা হয়।
জার্মানিতে যখন নাত্সিরা মার্ক্সের বইপত্র পোড়াচ্ছে, এই লাইব্রেরিটি তখন স্প্যানিশ বিপ্লব সহ বিশ্বের অন্যান্য বিপ্লবের উপরে লেখা বইপত্র সংগ্রহ শুরু করে। এখানে আছে ‘দাস ক্যাপিটাল’-এর প্রথম সংস্করণ, মার্ক্সের অন্যান্য বই, অন্য হাজার হাজার বই। যে ঘরটিতে বসে লেনিন ইসক্রা সম্পাদনা করতেন, সেটি রাখা আছে অতীতের মতোই।
১৯৩৫ সালের একটি বিখ্যাত ম্যুরাল রাখা আছে লাইব্রেরিতে। তাতে দেখা যাচ্ছে খালি গায়ের এক শ্রমজীবী মানুষকে, তাঁকে ঘিরে আছেন লেনিন, মার্ক্স, এঙ্গেলস। শ্রমিক মানুষটি শেকল ভাঙছেন, কাঁপিয়ে দিচ্ছেন সমগ্র পৃথিবী, আর ভেঙে পড়া বিগ বেন-এর তলায় চাপা পড়ে মরছে পুঁজিবাদীরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বাড়িতে বোমা পড়লেও এই ম্যুরালটি রক্ষা পায়। লাইব্রেরিটিতে এখন লেনিনের বেশ কতকগুলি আবক্ষ মূর্তি রাখা আছে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বহু তাবড় নেতা— নিকিতা ক্রুশ্চেভ, মিখাইল গর্বাচেভ— এখানে এসেছেন। বক্তৃতা করে গেছেন বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, সিপিএম নেতা প্রকাশ কারাটও। উত্তর লন্ডনের হাইগেট সেমেটরিতে কার্ল মার্ক্সের মূর্তি ও সমাধির রক্ষণাবেক্ষণের ভারও এই মার্ক্স মেমোরিয়াল লাইব্রেরির উপরেই। প্রতি বছর তা দেখতে ভিড় জমান হাজার হাজার মানুষ।
তা হলে হলফোর্ড স্কোয়্যারের বাইরে বসানো লেনিনের সেই আবক্ষ মূর্তিটির কী হল? সেটি পাকাপাকি ভাবে ঠাঁই পেয়েছে ইজলিংটন মিউজিয়মে। আর কী অদ্ভুত সমাপতন, ইজলিংটন হল লেবার পার্টির নেতা, সোশ্যালিস্ট জেরেমি করবিন-এর নির্বাচনকেন্দ্র। অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষে আজও খুবই প্রাসঙ্গিক এই অঞ্চল, একদা যা ছিল রুশ বিপ্লবের বৌদ্ধিক ভিত্তিভূমি।
ওঁরা বলেছেন
রুশ বিপ্লবের সময়েই, ভারতে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন অধ্যায়ে পৌঁছই। গাঁধীর নেতৃত্বে আমরা অন্য পথে এগিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু লেনিনের উদাহরণও আমাদের মনে প্রভাব ফেলেছিল।
জওহরলাল নেহরু
আমরা ভাবি না, সমাজতন্ত্রে পৌঁছনোর রাস্তা মার্ক্স জানতেন। সে রকম দাবি কেউ করলে সেটি পাগলের প্রলাপ।
লেনিন
রক্তাক্ত: রুশ বিপ্লব নিয়ে সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ ছবির দৃশ্য
কোনও রুশ একচ্ছত্র ক্ষমতা পেলেই আমার মনে সন্দেহ হয়। কয়েক বছর আগেও যারা ভূমিদাস ছিল, প্রতিবেশীর ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ পেলে তারাই হয়তো সবচেয়ে অত্যাচারী হয়ে উঠবে।
ম্যাক্সিম গোর্কি
রুশ বিপ্লবের নায়করা কেউই রাশিয়ান নয়। রাশিয়ার মানুষকে তারা ঘৃণা করত। ঘৃণা করত খ্রিস্টানদেরও। তাই বিন্দুমাত্র অনুতাপ ব্যতিরেকে তারা লাখো লাখো রুশকে কোতল করেছিল। বলশেভিক বিপ্লব দুনিয়ার বৃহত্তম সংখ্যক মানুষকে হত্যার ইতিহাস।
আলেকজান্দার সলঝেনিৎসিন