টরেটক্কার গপ্পো

টেলিগ্রাফের তার শুধু ফিঙেপাখির লেজ ঝুলিয়ে বসার জায়গা নয়। সিপাহি বিদ্রোহ থেকে  প্রফুল্ল চাকী, রবীন্দ্রনাথ থেকে আমজনতার জীবন জড়িয়ে ছিল  তার সঙ্গে। কুন্তক চট্টোপাধ্যায়দেশজুড়ে সিপাইদের একটা গোলমাল শুরু হয়েছে। সে সব কিছু না কি! নড়েচড়ে বসলেন যন্ত্রের সামনে থাকা অফিসার। নাহ! কিছুই তো স্পষ্ট করে বলছে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৪৮
Share:

প্রাচীন: টেলিগ্রাফের খুঁটিতে চলছে কাজ, তখন দেখা যেত প্রায়ই। ছবি: পরিমল গোস্বামী।

আজ থেকে ১৬০ বছর আগের কথা। মে মাসের দুপুরে অম্বালার টেলিগ্রাফ অফিস দেখল, যন্ত্রের সরু পিনটা নড়ছে। দিল্লি অফিস থেকে কেউ যেন কিছু বলতে চাইছে! কী?

Advertisement

দেশজুড়ে সিপাইদের একটা গোলমাল শুরু হয়েছে। সে সব কিছু না কি! নড়েচড়ে বসলেন যন্ত্রের সামনে থাকা অফিসার। নাহ! কিছুই তো স্পষ্ট করে বলছে না। ব্যাপারটা বুঝতে পাল্টা প্রশ্ন করলেন অম্বালায় বসে থাকা টেলিগ্রাফ অফিসার। ‘‘আপনার নাম কী?’’ না, তারও উত্তর মিলল না। অফিসার বুঝলেন, টেলিগ্রাফ অফিসে এমন কেউ ঢুকে ঘাঁটি গেড়েছে যে টেলিগ্রাফের ব্যবহারই জানে না।

আসলে ১৮৫৭ সালের ১১ মে দিল্লির টেলিগ্রাফ অফিসের দখল নিয়েছিল বিদ্রোহী সিপাইরা। নতুন আমদানি হওয়া এই বিলিতি যন্ত্র কী ভাবে চালায়, কিছুই জানত না তারা। জানবেই বা কেমন করে! দিনভর তো অফিসে লালমুখো সাহেবরাই বসে থাকত। ‘টরেটক্কা’ করে কী সব যেন চালাচালি করত।

Advertisement

এ রাজ্যে নিজেদের ক্ষমতা কায়েম করতে নানা ফিকির বের করেছিল ব্রিটিশরা। দ্রুত খবর পাঠানোর জন্য টেলিগ্রাফ তার উপরের দিকেই থাকবে। সেই সূত্রেই টেলিগ্রাফ জড়িয়ে গিয়েছে ভারতের ইতিহাসেও। তা নিয়ে গবেষণাও চলছে। তারই ফসল বিশ্বভারতীর ইতিহাসের রিডার দীপকান্ত লাহিড়ি চৌধুরীর ‘টেলিগ্রাফিক ইম্পেরিয়ালিজম’।

তখনও কলকাতা থেকেই চলছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। সিদ্ধান্ত হল, দ্রুত যোগাযোগের জন্য টেলিগ্রাফের লাইন পাততে হবে। চালু করলেই তো হল না, আগে পরীক্ষা করতে হবে। ১৮৫০ সালে কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার বসল টেলিগ্রাফের লাইন। কিন্তু তা সাধারণের জন্য নয়। চার বছর পরীক্ষার পর, ১৮৫৪ সালে এ দেশে চালু হল টেলিগ্রাফ। অল্প কথায় এক প্রান্ত থেকে বার্তা পৌঁছে গেল অন্য প্রান্তে।

সদ্য চালু হওয়া ব্যবস্থা। রাস্তার পাশে পাশে খুঁটিতে লাইন লাগানো। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হতে এর উপরেই চোখ পড়ল বিদ্রোহীদের। টেলিগ্রাফের খুঁটি উপড়ে, তার কেটে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল শাসককে। দীপকান্ত তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিদ্রোহের সময় প্রায় ৯১৮ মাইল টেলিগ্রাফের তার নষ্ট করা হয়েছিল। তার দিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে গুলি তৈরি, কাঠের খুঁটি দিয়ে আগুন জ্বালানো আর সদ্য বিলেত থেকে আসা রট আয়রনের খুঁটি দিয়ে কামানের নল বানানোর চেষ্টাও চলেছিল।

হাঙ্গামায় বিপদে পড়েছিল ব্রিটিশরা। ১৮৫৭-র অগস্টে ১৪ দিন রানিগঞ্জ-বারাণসীর যোগাযোগ ছিল না। কলকাতার সঙ্গে সদ্য তৈরি হওয়া সামরিক ছাউনি আগরার যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন! তবে টেলিগ্রাফ বাঁচিয়েও দিয়েছিল। সিপাহি বিদ্রোহ চলার সময়ই টেলিগ্রাফে বার্তা গিয়েছিল, প়ঞ্জাবকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হতে পারে। বিপদ বাঁচানোর পরে স্যর জন লরেন্সের উক্তি, ‘‘দ্য টেলিগ্রাফ সেভড আস।’’

এই নয়া ব্যবস্থা নিয়ে কিন্তু ব্রিটিশদের ঝক্কিও কম ছিল না। একে তো দেশ জুড়ে সেপাইগুলো এমন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে, তার উপরে বম্বে টেলিগ্রাফ অফিসের এক ছোকরা ইংরেজ জেমস ব্ল্যাকনাইট সরকারি বার্তা ফাঁস করে হট্টগোল বাঁধিয়ে দিল! কলকাতা থেকে পুণে ও নাশিকের জন্য বার্তা গিয়েছিল বম্বেতে। বলা হয়েছিল, গায়কোয়াড়দের কোনও উত্তরসূরিকে মেজর ডেভিডসন যেন শাসক হিসেবে স্বীক়ৃতি না দেন। এই কাজ মেজরকে এক্কেবারে চুপিসারে করতে হবে। গোপন কথাটি কিন্তু গোপন রইল না, পর দিনই ‘বম্বে টেলিগ্রাফ ক্যুরিয়ার’-এ বেরিয়ে গেল বার্তার নির্যাস। তা নিয়ে কী হইচই! জেমস এমনিতে ছোকরা ভালই ছিল। তার উপরওয়ালা বলেছিলেন, ‘‘ছোকরার ব্যবহারটি বেশ। হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে রয়েছে। কিন্তু টেলিগ্রাফের সঙ্কেত বোঝে না।’’

টেলিগ্রাম মেশিন

এ সব ঝক্কি এড়াতে শেষমেশ ব্রিটিশরা নিয়মই করে দিল, ম্যাজিস্ট্রেটরা সরকার সম্পর্কে কোনও বার্তা টেলিগ্রাফ মারফত ছড়াতে পারবেন না। ব্যক্তিগত বার্তা পাঠাতে হলেও তাতে ওপরওয়ালাকে দিয়ে সই করাতে হবে। বার্তা ফাঁস এড়াতে শাস্তির ব্যবস্থা করতেও ছাড়েননি সাহেবরা। নিয়ম করা হয়েছিল, বার্তা যদি ফাঁস হয়, তা হলে সিগনালারকে জেলে তো পোরা হবেই, ২০০ টাকা জরিমানাও করা হবে।

২০০ টাকা! মাথায় রাখতে হবে সময়টা ১৮৫৭। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে দু’শো টাকার মূল্য কত ছিল তা হিসেব না করা গেলেও অনুমান তো করাই যায়।

বিদ্রোহ তো চুকেবুকে গেল। ঝক্কি এড়িয়ে কাটছিল বেশ। টেলিগ্রাফকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসাতেও জাঁকিয়ে বসছিল ব্রিটিশরা। ১৮৬৬ সালের মার্চ মাস। বম্বের বন্দরে জাহাজ থেকে নামলেন ব্রিটিশ যুবক হেনরি কলিন্স। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের হয়ে এ দেশে কাজ করতে এসেছেন তিনি। খোঁজ নিয়ে এ দেশের তুলোর দামদস্তুর সময়মতো পাঠাতেন লন্ডনে। সেই সব হিসেব থেকেই জানা গেল, এ দেশে তুলোর দাম বেশি। উলটে গেল আমদানি-রফতানির হিসেব। বম্বের সুতো ব্যবসায়ীদের হটিয়ে বাজারের দখল নিল বিলিতি বণিকেরা।

১৯০৮ সালে ফের ঝক্কি শুরু টেলিগ্রাফকে নিয়ে। আচমকা শুরু করলেন কর্মীরা। ১৭৩ জন স্থায়ী কর্মী এবং ১৯৩ জন ঠিকা কর্মী শুরু করলেন আন্দোলন। একে একে সেই ধর্মঘট ছড়াতে শুরু করল অন্য বিভাগেও। তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে মিটিং হত অক্টারলোনি মনুমেন্টের (শহিদ মিনার) তলায়। আন্দোলনের জায়গাটা কোনও কালেই বদলায়নি। টেলিগ্রাফ কর্মীদের এই ধর্মঘটে এমন নাকাল হয়েছিলেন সাহেবরা যে ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে বণিকসভাগুলি রীতিমতো মুখঝামটা খেয়েছিল। কাজ পণ্ড হচ্ছে দেখে জাঠ রেজিমেন্টের সেনাদের নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বাঙালির বুদ্ধি। জাঠেদের কানে কী ফুসমন্তর দিল, সেনাও যেন কাজে মন লাগাল না!

সেই যে কিংসফোর্ড সাহেবকে মারতে গিয়ে ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী ধরা প়়ড়ে গেলেন, তাতেও কিন্তু টেলিগ্রাফের ভূমিকা কম নয়। বোমা মারার পর আলাদা হয়ে পালাচ্ছেন দু’জনে। প্রফুল্ল চাকী ট্রেন ধরতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এমন সময় নজরে প়়ড়লেন ছুটিতে থাকা পুলিশ অফিসার নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নন্দলালের সন্দেহ তো জেগেছে, কিন্তু করবেন কী? আগুপিছু না ভেবে নন্দলাল সোজা টেলিগ্রাফে বার্তা অর্থাৎ টেলিগ্রাম পাঠালেন কলকাতায়। এখান থেকে বার্তা গেল, পাকড়ো উসকো। কিন্তু নাহ! শেষমেশ ধরা দেননি প্রফুল্ল। পিস্তলের শেষ গুলিটা খরচ করেছিলেন নিজের জন্যই।

মুরারিপুকুর বোমা মামলায় অরবিন্দ ঘোষের অফিস-বাড়ি থেকে ‘মিষ্টি বিলোনোর সময় এসেছে’ বলে ছোট্ট চিঠিটা মিলেছিল, সেটা কী টেলিগ্রাম করেই ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল? শোনা যায়, জেলবন্দি কাজী নজরুল ইসলাম অনশন করার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘‘গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেমস ইউ।’’ সে বার্তা অবশ্য কাজীর হাতে পৌঁছয়নি। রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে। কাজীকে তার আগেই হুগলি জেলে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।

শুধু মনীষীরাই নন, টেলিগ্রাফ জড়িয়ে ছিল আমজনতার জীবনেও। সে সব আজও মনে করতে পারেন অনেক প্রবীণই। ছোট্টবেলায় গাঁয়ে টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙে বা নীলকণ্ঠ পাখি। ওই তার বেয়েই কখনও আনন্দের খবর আসত, কখনও বুক ফেটে যেত দু-তিনটে অক্ষরে। সেই কত দিন আগে, ছোট্ট মেয়েটা ধানবাদে রাঙাদাদার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। এক দিন বিকেলে ডাকপিওন এসে টেলিগ্রাম ধরাল। বিরাটির বাড়ি থেকে খবর এসেছে ছোট্ট দু’টি শব্দে। ‘কানু এক্সপায়ার্ড’! মেজদাদার মৃত্যুর খবর নিয়ে আসা সেই টেলিগ্রাম আজও প্রৌঢ়ত্বে এসেও ভুলতে পারেননি বোন।

বহু বছর আগে এক পঞ্জাবি যুবক সেনা অফিসার হিসেবে ব্যারাকপুরে এসেছিলেন। সেখানেই পরিচয় বাঙালি প্রেয়সীর সঙ্গে। কিন্তু সেনার জীবন! ব্যারাকপুর ছেড়ে সোজা কাশ্মীর। এখন প্রবীণ সেনাকর্তা বলেন, ‘‘তখন তো মোবাইল ছিল না। খবর পাঠাতে টেলিগ্রামের কয়েকটা শব্দই ভরসা ছিল।’’ সেই সব টেলিগ্রামের সুবাদেই বাঙালি প্রেয়সী আজ পঞ্জাবি-ঘরনি।

আজকের খুদেরা জানবেই না, ক্লাস এইটে উঠলেই এক সময় ইংরেজিতে টেলিগ্রাম লিখতে হত। খাঁটি, বিশুদ্ধ ইংরেজিতে কম শব্দে সব কথা বলতে হবে। সে সব কথা উঠতেই তিরিশ পেরোনো এক যুবক হেসেই কুটোপাটি। ‘‘আমার বেশির ভাগ টেলিগ্রাম যেত এক বন্ধুর কাছে।’’

ফোনের ব্যবহার বা়ড়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে পিছোচ্ছিল টেলিগ্রাফ। বোঝা যাচ্ছিল, আস্তে আস্তে বুড়িয়ে যাচ্ছে সে। ই-মেল, এসএমএস চলে আসার পর এক্কেবারে মৃত্যুঘণ্টাই বাজতে শুরু করল। অবশেষে সরকার ঠিক করল, অনেক হয়েছে, আর নয়। এ বার চিরতরে উপড়ে ফেলা হোক টেলিগ্রাফের খুঁটি। ‘পি অ্যান্ড টি’ থেকে বাদ দেওয়া হোক টি-কে। দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গেল, ১৪ এপ্রিল, ২০১৩। সেই রবিবারে কোথাও রাত ১১টা ৩ মিনিট, কোথাও বা রাত ১১টা ৪৫ মিনিট— লেখা হল শেষ টেলিগ্রাম।

শেষ দিনেও ঘটল নানা ঘটনা, লেখা রইল নানা ইতিহাস। শেষ দিনে কলকাতার অফিসে ফিরে এল ১০৫ বছর আগের স্মৃতি। না, কোনও পুরনো জিনিসের হাত ধরে নয়। সে দিন টেলিগ্রাফ তুলে দেওয়ার বিরোধে কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন কর্মীরা। রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে দিল্লির জনপথের টেলিগ্রাফ অফিস থেকে অশ্বিনী মিশ্র শেষ টেলিগ্রাম পাঠালেন রাহুল গাঁধীকে। অশ্বিনী কী লিখেছিলেন তাতে?

জনপথের টেলিগ্রাফ অফিসে সে দিন জেমস ব্ল্যাকনাইট-এর কোনও উত্তরসূরি ছিলেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement