ফ্রেডরিক শ্যোপাঁ মিউজ়িয়ম। এখানেই সংরক্ষিত আছে শ্যোপাঁর নিজস্ব পিয়ানোটি।
সকাল আটটা পঁয়ত্রিশে প্লেনের চাকা যখন মাটি ছুঁল, মনে হল কোনও আনকোরা পিয়ানিস্টের কাঁচা হাত আছড়ে পড়ল সাদা-কালো রিডে। মনে হল তাঁর কাছে চলে এসেছি, তাঁর শহরে, তাঁর পাড়ায়। যাঁর সৃষ্টি অনেক কোলাহলের (তাইপেই মেট্রো) মাঝে ‘আধোখানি’ শুনেছি, ‘আধেক আছে বাকি’। এসে নামলাম ফ্রেডরিক শ্যোপাঁ এয়ারপোর্ট।
কলা বেচতেই আশা, নইলে রথ দেখা দুঃসাধ্য। যাত্রার প্রথম রথ ওয়ারশ’ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি। স্থাপত্যে গির্জা-প্রাসাদের মতো, বিদ্যালয়ের মতো নয়। তার শ্বেতপাথরের অলিন্দগুলোয় বিজ্ঞানে বিখ্যাতদের পদচিহ্ন। গাউন পরিহিতা মারি কুরির মর্মরমূর্তি পথ দেখায়। বিহ্বলতা গ্রাস করে। ঠিক যেমন হয়েছিল রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের পালিত বিল্ডিংয়ের দোতলার লেকচার কক্ষে সি ভি রামনের পিয়ানোর সামনে দাঁড়িয়ে। ইতিহাসের যত্ন আর অবহেলার কী ভীষণ বৈপরীত্য। বিজ্ঞানের সঙ্গে সৌন্দর্যের এই আশ্চর্য ইউরোপীয় মিশেল এখনও অনুপ্রাণিত করে। মনে হয় আরও কিছুটা পথ আসা যেত, আরও কিছু একটু করা যেত।
পড়ে এসেছিলাম যে, নানা ঐতিহাসিক মিটিং-মিছিলের জায়গা পোল্যান্ড প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেস। সেখানে, ওয়ারশ’ ওল্ড টাউন, যাওয়ার পথে অন্তত তিন বার থামতে হল। জাতীয় থিয়েটার, অনেকটা আমাদের অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর মতো, রাস্তার পাশের অখ্যাত গির্জা, হোটেল (পোল্যান্ড প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেস এর অংশ ছিল আগে)— এ সব দেখতে। প্রতিটা সাধারণ বাড়িই যেখানে ছবি, সেখানে প্রাসাদ তো পিকাসো। মন্দার বোস সঙ্গী হলে নির্ঘাত বলতেন, “যেখানে পেরেছে একটা প্রাসাদ কী গির্জা গুঁজে রেখেছে মশাই!”
প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেস বাঁ দিকে রেখে পরের বাঁ দিকের পাথুরে গলিটায় ঢুকে পড়লাম হারা উদ্দেশ্যে হাঁটার জন্য। রাস্তাগুলো কফিশপের মুক্তমঞ্চ। অমোঘ আমন্ত্রণ নিয়ে চেয়ে থাকে। দেখলেই মনে হয় বসে পড়ি। প্রাসাদের পিছনের চৌমাথাটায় নানা দিক-নির্দেশ। একটায় লেখা ছিল ‘ফ্রেডরিক শ্যোপাঁ মিউজ়িয়ম’, ১৭০ মিটার ডান দিকে। বলে কী? আবার সেই কাঁচা হাতের কর্ডটা ঝম করে বেজে উঠল।
সোনাটা, এট্যুড, ব্যালাড, নক্টার্ন, ওয়ালজ়, কম্পোজ়িশনের রাজা শ্যোপাঁর জাদুঘর ১৭০ মিটার দূরে? ‘দস্তুরমতো প্রস্তুত আমি’। জাদুঘরের পিছনেই ফ্রেডারিক শ্যোপাঁ মিউজ়িক ইউনিভার্সিটি, তার পাশেই বিরাট পার্ক। তার কোন এক ঘরে কোনও এক ছাত্র পিয়ানো বাজাচ্ছে। ভিতরে ঢুকব কী, বাইরেই বাক্রুদ্ধ। মনে হল শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহে ‘সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে’ গাইছে কেউ।
বহু অত্যাচার ও অমানবিকতার সাক্ষি আউশভিৎজ়ের মূল প্রবেশদ্বার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা হয়নি। বিরাট কাঠের দরজা ঠেলে জাদুঘরে ঢুকে দেখি, অন্তরঙ্গে সেই ইউরোপীয় গাম্ভীর্য আর মনোনিবেশ। ছয় থেকে বারো বছরের বাচ্চাদের সঙ্গে পৃথিবীর অজানা প্রান্ত থেকে আসা পক্বকেশ বৃদ্ধ অপলক তাকিয়ে শ্যোপাঁর নিজের হাতে বাজানো পিয়ানোর দিকে।
শ্যোপাঁর হাতে লেখা কাটাকুটি-ভর্তি মিউজ়িক স্কোর দেখে মনে হল এরা সব সৃষ্টির বেদনা। কত ঘষে তবে না রূপ পায়। রাত-জাগা সেই যুদ্ধগুলো আজ জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে। রোমান্টিক যুগের অগ্রগণ্য শিল্পী শ্যোপাঁ দুঃখকে সম্মান জানাতে, একলা থেকে আরও একাকিত্বে যাওয়ার সুর বানিয়ে গেছেন। এই সাঙ্গীতিক বিস্ময় মনে করাবে আরণ্যকের একলা-হাঁটা বিভুতিভূষণকে। মনে করাবে প্রায় সমসাময়িক ভ্যান গঘকে। ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়েও এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা এই মানুষগুলো। একাকিত্বের রোমান্টিসিজ়মের সুর, রং, তুলি কলম দিয়েই এদের জাত নির্মিত। আঁধার তো তাঁদের ভাল লাগবেই।
প্রায় এক দিন পর, একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। দেওয়ালে লাগানো স্পিকার থেকে উচ্চারিত হচ্ছে ‘হের্থা ফেইনার’, ‘পিটার গিনজ’, ‘রাচেল আবাস’, ‘ম্যানুয়েল এলেগ্রো’... এমন সব নাম। এক একটা আর্তনাদ, কান্না, মৃত্যু, পেরিয়ে ঢুকছি ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়ে, যার নাম অউশভিৎজ়। বেশ কিছু ডকুমেন্টরি দেখার পর থেকেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, এখানে আসতে হবে, দাঁড়াতে হবে, অনুভব করতে হবে।
জানলা, জল, খাবার, শৌচালয়বিহীন মালগাড়ি করে হতভাগ্য ইহুদিদের তিন দিনের পথ পাড়ি দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল বার্কনিউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে হয়েছিল ঝাড়াই-বাছাই। বন্দুককে শল্যচিকিৎসকের ছুরির মতো ব্যবহার করে সম্পর্কগুলোকে ছেঁড়া হয়েছিল। বাবার থেকে ছেলে, মায়ের থেকে মেয়ে, ভাইয়ের থেকে বোনকে টেনে-হিঁচড়ে আলাদা করা হয়েছিল বার্কনিউ স্টেশনে। বাছাইয়ের শেষে কেউ বাঁ দিকে, কেউ ডান দিকে। ছিঁড়ে আলাদা হওয়ার সময়ে মা মেয়ের কোঁচড়ে হিরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেছে ‘খিদে পেলে পাউরুটি কিনিস’। সেই অভিশপ্ত স্টেশন। যেখানে চোদ্দো লক্ষ মানুষের কান্না ট্রেনের হুইসল হয়ে বাজে। ত্রস্ত পদশব্দ, শিশুর অস্ফুট প্রশ্ন ‘বাবাকে কোথায় নিয়ে গেল?’ কান পাতলে ঠিক শোনা যায়। বহুপঠিত ইতিহাস, তবু কী দুষ্পাচ্য।
সার দিয়ে ব্যারাক দু’দিকে। সার দিয়ে একলা মানুষ পৃথিবীতে তাদের শেষ আশ্রয়ে চলেছে। ব্যারাক। ছেলেদের ব্যারাক, মেয়েদের ব্যারাক, সুস্থদের ব্যারাক, অসুস্থদের ব্যারাক, হাসপাতালের ব্যারাক, রান্নাঘরের ব্যারাক, নির্যাতনের ব্যারাক, ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার গিনিপিগদের ব্যারাক আর সব শেষে বিদায়ের ব্যারাক।
অউশভিৎজ়ের ইট-চুন-সুরকির ব্যারাক, আর বার্কনিউয়ের কাঠের ব্যারাক। স্বপ্নের শব-ব্যবচ্ছেদ হয়েছিল ছারপোকায় ভরা এই ব্যারাকের বিছানায়। এই ব্যারাকগুলোয় একটা নয়, রাশি রাশি অ্যানা ফ্রাঙ্ক-এর ডায়েরি পড়ে আছে— স্তূপীকৃত জুতো, চশমা, চিরুনি, বাটি আর কেটে নেওয়া চুলের পাহাড়ে। থমকে যেতে হয় অভিঘাতে। এক জোড়া ছোট্ট জুতো দেখলাম স্তূপের থেকে একটু তফাতে পড়ে। একটা প্রাণচঞ্চল ইহুদি শিশুর সপ্রশ্ন অবয়ব অনায়াসে কল্পনা করে নেওয়া যায়, ‘কেন?’। গাইডের ভাষ্য বেজে চলে আমাদের বধির কানে।
অউশভিৎজ়ের ব্যারাকগুলোয় জানলা থাকলেও, মৃত্যুর দেওয়ালের (ওয়াল অব ডেথ) পাশের ব্যারাকগুলোয় সব জানলা কাঠের পাটাতন দিয়ে বন্ধ করা। সার দিয়ে দাঁড় করিয়ে যখন সঙ্গীদের গুলি করে মারা হবে, তখন দেখা চলবে না, শুধু ভয় পেতে হবে। গ্যাস চেম্বারের ছাদের গর্ত দিয়ে ফেলে দেওয়া হবে মারণগ্যাস, যার ধোঁয়ায় সব কান্নার অবসান হবে। তার পর জ্বালানোর পালা। শ্মশান ব্যারাক। মানুষ-পোড়া ধোঁয়া উঠবে চিমনি দিয়ে, আর জীবিত মানুষগুলো দেখবে, খুঁজবে, কে গেল!
আস্তাবলের আদলে তৈরি বার্কনিউয়ের কাঠের ব্যারাক, ৫১টা ঘোড়ার থাকার মতো জায়গায় গাদাগাদি করে চারশো মানুষ প্রহর গুনেছে সময়ের। প্রহর গুনতে গুনতে এক দিন বারো বছরের মেয়ে ইরকা জানোভস্কি গান লিখল ‘আয়্যাম স্টিল ইয়ং, আই ওয়ান্ট টু লিভ’। সব কষ্ট আশ্রয় পেল গানে, সুরে, লেখায়। অ্যারন লাইবেস্কিন্ড লিখলেন তাঁর তিন বছরের পুত্রসন্তান খুন হওয়ার আখ্যান। কিছু দূরের হাসপাতালের বিছানা থেকে স্তানিস্লো রোজকভস্কি লিখলেন ‘হোয়েন দ্য স্মোক রাইজ়, সো উইল আই’। দিনভর দুঃসহ ধোঁয়া উঠত চিমনিগুলো থেকে, আর নোনতা জলের জমাট-বাঁধা রাত গলে গান হয়ে উঠত ‘যখন ধোঁয়া উঠবে, জেনো আমিও উঠব’। কেটে নেওয়া চুলের গোছা থেকে, জুতোর পাহাড় থেকে, ছেঁড়া কম্বলের থেকে ধোঁয়া উঠছে। ওরা গাইছে। ছেড়ে আসা বাড়ির বসার ঘরে ওদের পিয়ানো বাজছে। ওরা বাজাচ্ছে। একাকী রাতের গান, শ্যোঁপা তোমার গান। প্রতিটা আস্তাবল থেকে শয়ে শয়ে পিয়ানোয় বেজে উঠছে তোমার নক্টার্ন, তোমার নিঃসঙ্গ রাতের গান। শতক পেরিয়ে ওরা গাইছে ‘তারা দিয়ে সাজিয়ো না আমার আকাশ’।
আরও, আরও ট্রেন আসছে, লাইনের পাথরগুলো কাঁপছে। এক দিন তো নয়, পাঁচ-পাঁচটা বছর। তবে হতেও পারে এরা রুশ সৈন্যদল। তারা বেঁচে যাওয়া ছোট্ট মেয়েটাকে পাঠিয়ে দেবে আমেরিকায়। আজকের প্রৌঢ়ার গলায় পাউরুটি কেনার সেই অমূল্য হিরের পেন্ডেন্ট আমি দেখেছি। অনেক জেগেছ অউশভিৎজ়, এ বার ঘুমোও যদি পারো। চিমনিগুলোও ক্লান্ত।