এমনি এমনি খাই

আমেরিকার পরেই, ভারতে সবচেয়ে বেশি মেয়ে সিগারেট খায়। কেন? কেন আবার! ছেলেরা যে জন্য খায়। ভাল লাগে তাই।কেন? কী পাও? কত ক্ষতি হয় জানো? এ সব না করলে বুঝি আধুনিক হওয়া যায় না? ছেলেদের সমান হওয়া যায় না? বয়স্ক মানুষ কথা বলছেন বলে সম্মান দিয়েই শুনছিলুম। শেষের দুটো প্রশ্নে পিত্তি জ্বলে গেল। মনে মনে বললুম, এই বস্তাপচা প্রশ্নগুলো করেই বা আপনারা কী পান?

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৯
Share:

‘এনএইচ টেন’ ছবির একটি দৃশ্য

কেন? কী পাও? কত ক্ষতি হয় জানো? এ সব না করলে বুঝি আধুনিক হওয়া যায় না? ছেলেদের সমান হওয়া যায় না?

Advertisement

বয়স্ক মানুষ কথা বলছেন বলে সম্মান দিয়েই শুনছিলুম। শেষের দুটো প্রশ্নে পিত্তি জ্বলে গেল। মনে মনে বললুম, এই বস্তাপচা প্রশ্নগুলো করেই বা আপনারা কী পান? কত বার আর কত বার বলতে হবে যে, খাওয়ার জিনিস খাই। খেতে ভাল লাগে বলে খাই! সিগারেট বিক্রি যদি নিষিদ্ধ হয়ে না যায়, তা হলে যত দিন না শরীর জবাব দিচ্ছে, আমার সঙ্গে সিগারেট থাকবে। সারা পৃথিবী দুয়ো দিলেও থাকবে। গোটা পুরুষজাতি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিলেও থাকবে। সিগারেটের গন্ধটা, ঈষৎ তেতো, কষাটে স্বাদটা আমার বন্ধু!

কোনও রকম বিপ্লবের ধ্বজা ওড়ানোর খাতিরে সিগারেট খাওয়া শুরু করিনি। ছোটবেলা থেকে চেনা-জানা-ভাল লাগা একটা গন্ধকে প্রাপ্তবয়সে এসে রোজগেরে হয়ে আপন করে নিয়েছিলুম। প্রথম টিউশনের প্রথম মাইনে পেয়ে একটা সিগারেট ছিল নিজেকে আমার প্রথম উপহার। তার আগে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে খেয়েছি এর-ওর ভাগাভাগি করে। কিন্তু নিজে কিনে নিজের মতো করে খাইনি।

Advertisement

বাড়িতে জানাজানি হওয়ামাত্র সমুদ্র একেবারে ফুঁসে উঠল। কারা এ সব শেখাচ্ছে? এ সব করে কী প্রমাণ করার আছে? লেখাপড়া করে অন্যের নকল করতে শিখলে? ছেলেদের থেকে কত ভাল জিনিস নেওয়ার আছে (অহো), খারাপ জিনিসগুলোই নেবে? প্রশ্নমালা বেশ তাত্ত্বিক রং নিয়ে শুরু হয়েছিল। শেষ কালে পাড়াপ্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন কী বলবে আর বাবা বকবে-র আঘাটায় এসে থামল। আমার মনে পড়ছিল, জীবনে প্রথম যে নারীকে সিগারেট খেতে দেখি সামনাসামনি, তিনি এ বাড়িরই অতিথি। পারিবারিক বন্ধু। যে দিন তিনি আসেন, ফ্রক পরা আমাকে আলাদা করে ডেকে বলে দেওয়া হয়েছিল, অমুক মাসি কিন্তু সিগারেট খায়! তুমি চমকে যাবে না, কেমন? এ বাড়িতেই শুনেছিলাম বিমলপ্রতিভা দেবীর গল্প। স্বাধীনতা সংগ্রামী, পরে ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী। শ্রমিক বস্তিতে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে ধূমপান করতেন।

সে সব মহতী আখ্যান। আমার তো কোনও বৃহত্তর সংগ্রাম নেই। তাই আমার ভাল লাগাটা অসার হয়ে গেল। শুধু অসারই হল না, ওটা যে নিখাদ ভাল লাগাই, সেটাও অপ্রমাণ হল। বলা হল, স্রেফ নকলনবিশি আর স্বাস্থ্যক্ষয়। ব্যক্তিত্বের অভাব। নইলে কেউ নেশার দাস হয়? কী আর করা যাবে! মানবসভ্যতা যত দিন আছে, নেশাও আছে। ব্যক্তিত্বের এই অভাবটুকু নিয়েই ইতিহাস চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে।

আমি আপ্রাণ বোঝাতে চেয়েছিলাম, সিগারেটকে আশ্রয় করে কোনও রকম তালেবর সাজতে যাইনি। উত্তমকুমার, ফেলুদা, সোফিয়া লোরেন, ব্রিজিত বার্দো— কাউকে নকল করতে চাইনি। যে ভাবে বিউলির ডাল, সজনে ফুল আর ঝিঙেপোস্ত ভালবেসেছি, সে ভাবেই ভালবেসেছি সিগারেট। যারা ভালবাসে না, তাদের সঙ্গেও কোনও অসদ্ভাব নেই। আমিও তো ভালবাসি না পাকা পেয়ারা, দুধ দেওয়া চা। তাতে কী?

অনেক কিছু। সহজ কথা সহজে হজম করতে না চাওয়া পিতৃতন্ত্রের অভ্যাস। কারণ সে সবজান্তা। পূর্বনির্ধারিত গতে বাঁধা দৃষ্টিকোণ থেকে সব কিছু যাচাই করা, রায় দেওয়া তার কাজ। আমার ঘনিষ্ঠতম বান্ধবী পুজোআচ্চা করতে খুব ভালবাসে। সিগারেটও খায়। কী অনাসৃষ্টি! কেতাদুরস্ত জামাকাপড় পরা ফটফটিয়ে ইংরেজি বলা-রা খেলে তাও কথা ছিল! সদ্য-আলাপী এক বাহাদুর তাকে বলে বসল, সিগারেট খাচ্ছ কেন? জাগরীর নকল করতে? আমরা দুই বন্ধু হেসে বাঁচি না। ছোকরা বলে কী রে? বিপুলা এ ধরণীর কতটুকু জানে? ওই মেয়ে যে ক্লাস এইট-নাইন থেকে বাবার প্যাকেট থেকে চুরি করে সিগারেট খায়! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার ঢের আগে আসানসোলে মেয়েদের কলেজেই তাদের জনা দশেকের বাহিনী নিয়মিত সিগারেট খেত! অথচ জনগণের ধারণা, যাদবপুর-প্রেসিডেন্সি নাকি মেয়েদের বিড়ি টানার আঁতুড়ঘর।

এ কথা ঠিক, কিছু প্রতিষ্ঠানের আবহাওয়ায় একটা বাড়তি সহজতা আছে। ছাত্র-শিক্ষক, ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে সেখানে সিগারেট খাওয়ার চল। কিন্তু তার মানে এ নয়, এই ক’টি দ্বীপরাজ্যের বাইরে সব শান্তিকল্যাণ। এখানে যা ওপেন, ওখানে সে সব গোপেন। মফস্‌সলে মেয়ে-বউরা সিগারেট খায় লুকিয়ে। ঘরের কোণে, ছাদে। বাগানে। কারও সামনে খায় না, দোকানে গিয়ে কেনে না। একে ওকে দিয়ে আনায়। জলপাইগুড়ি থেকে নদিয়া, বর্ধমান থেকে মেদিনীপুর, সর্বত্র এ জিনিস দেখেছি।

অত দূরে যাওয়ার দরকার নেই। এক বান্ধবীর বাড়ি ছিল খড়দহে। সিগারেট খেতে হলে ছাদে ওঠা হত। আমি কলকাতা থেকে স্টক নিয়ে যেতুম। ঘরের মধ্যে খেলে সঙ্গে সঙ্গে একটা করে ধূপ জ্বালিয়ে নেওয়া নিয়ম ছিল। এই যে নতুন সমীক্ষা বলছে, ভারতে মেয়েদের ধূমপান হু-হু করে বাড়ছে, তার একটা বড় কারণ আজকাল এই সব ঘোমটা কিছুটা খসে যাচ্ছে। আগে খারাপ মেয়ে বোঝাতে হাতে সিগারেট দেখানো হত। ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’-এর কথা ভাবুন। এখন শহুরে বাংলা ছবিতে অন্তত নায়িকার হাতে সিগারেট একটা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মেয়েদের মধ্যে যারা সত্যিই সিগারেট-প্রেমী, তারা কিন্তু স্বপ্ন দেখে: একটা দিন সিগারেট আলাদা করে আর কোনও বার্তা দেবে না। সিগারেট খেয়ে বা না খেয়ে কিছু প্রমাণ করতে হবে না। সিগারেট ধরানোর আগে দু’বার ভাবতে হবে না, এখানে খাওয়াটা ঠিক হবে তো? অস্বস্তিকর চাউনি, অভব্য মন্তব্য, সভ্যতার সঙ্কট নিয়ে হাহাকার— প্রকাশ্যে সিগারেট খেলে এ সব ফাউ। কর্মস্থলের সামনের রাস্তাতেই কত দিন যে এমন হয়েছে! এক বার একটি লোক হাঁ করে মেয়েদের ধোঁয়া ছাড়া দেখতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়েই গেল! কেন অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান বা নির্দিষ্ট কিছু চত্বর সম্পর্কে মানুষের ধারণা হয় যে, ওখানেই কেবল এই সব পাপকর্ম চলে, তার আর একটা কারণ এটাও। হাতে গোনা কিছু জায়গায় মেয়েরা সিগারেট খেতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে আর সেখানে তাদের ভিড় জমাতে দেখা যায়। লোকে ধরে নেয়, ওই জায়গাগুলোই ওঁচা! মেয়েরা যদি সর্বত্র নির্ভাবনায় দেশলাই বের করতে পারত, তা হলে সিগারেট মানচিত্র আরও অনেক ব্যাপ্ত হত।

অথচ পুরাকাল থেকেই তামাকের নেশায় মেয়েদের ভরপুর যোগদান ছিল! জর্দা, দোক্তা, মিশি, গুড়াকু, গড়গড়া...আজ কিনা আমাদের খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে, কোথায় একটু বিনা উপদ্রবে, নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করে, দর্শনীয় চিড়িয়ায় পরিণত না হয়ে দুটো টান মারা যায়! এক বার এ শহরেরই এক রাস্তায় দুই সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাচ্ছি। সিগারেট কেনা হল। আমাকে অফারও করা হল। আমি বললাম, এখানে নয়, ওই ও-দিকটায় গিয়ে খাব। এক সহকর্মী ফুট কাটলেন, বিপ্লব চুপসে গেল?

আবার সেই প্রশ্ন। আবার আমাকে আউড়ে যেতে হল, বিপ্লব তো করছি না। খেতে ভাল লাগে, খাই। যেখানে নিশ্চিন্তে খেতে পারব, সেখানেই তো খাব! সহকর্মীটি কথাগুলো জানতেন না, এমন নয়। তাঁর উদ্দেশ্য, আমাকে চুপসে দেওয়া! এঁদের চোখে মেয়েদের সিগারেট খাওয়া অনেকটা বাচ্চা ছেলের গোঁফ আঁকার মতোই। যাঁরা সরাসরি সিগারেট খাওয়া মেয়েদের খারাপ ভাবেন, যাঁরা স্বাস্থ্যবিধির মোড়কে নিজেদের আপত্তি জানান, তাঁদের সহজে চেনা যায়। অন্যরা আরও হাইলি সাসপিশাস! অনেকের কাছেই বউ বা প্রেমিকা সিগারেট খাবে, নৈব নৈব চ। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে, পার্টিতে, ট্যুরে সিগারেট খাওয়া বান্ধবী খুব পছন্দ। অনেকে আবার উদারতাকেই ঘুঁটি বানিয়েছেন। যে পুরুষরা সিগারেট খাওয়া নিয়ে কটূক্তি করেন, তাঁরা কত রক্ষণশীল আর ইনি কত দিলদরিয়া, সেটা গা ঘেঁষে শুনিয়ে যাবেন। জ্বলন্ত সিগারেটের ধূম্রজাল প্রতি পদে মনে করিয়ে দেবে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমোঘ বাক্য— স্ত্রীস্বাধীনতা বাঞ্ছনীয় বস্তু, কিন্তু ভদ্রবেশী লুচ্চাদের ঠেকাইয়া রাখা যায় না।

অথচ এই ধোঁয়াই আবার এমন সব মুহূর্ত তৈরি করে যেখানে স্ত্রী-পুরুষ নেই। আছে শুধু ধূমপানের প্রজাতন্ত্র। সিনেমার বিরতি। স্মোকিং রুমে সলজ্জ হাসি নিয়ে এগিয়ে আসেন এক ভদ্রলোক। আপনার দেশলাইটা একটু দেবেন? আরাম করে প্রথম টানের পরে যে থ্যাঙ্ক ইউ-টা বলেন, অত অকৃত্রিম ধন্যবাদ কম পেয়েছি জীবনে। আর এক বার এয়ারপোর্টে। উড়ানের সময় পিছিয়েছে। প্রাণটা উসখুস করছে একটা সিগারেটের জন্য। অথচ পকেট ফাঁকা। জয় মা বলে স্মোকিং রুমে এক ভদ্রলোককে বলি, একটা বাড়তি হবে আপনার? নিন, একটাই আছে! আমি সিগারেট ধরাই আর হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয় একটি ছেলে। ওই ভদ্রলোককেই জিজ্ঞেস করে, হবে? আমরা চোখ চাওয়াচাওয়ি করি। বলে উঠি, আপনি চাইলে আমার কাউন্টারটা নিতে পারেন! ছেলেটি এক কথায় রাজি। তিনটি অপরিচিত প্রাণী নিমেষে খুশি হয়ে যাই! সব্বার সুখটান জুটল যে!

এই সুখটান শব্দটাই সিগারেট অভিধানের আসল কথা। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পুড়িয়ে, হৃদ্‌যন্ত্র আর ফুসফুস ঝাঁঝরা করে সত্যিই কী পাই? কয়েকটা মুহূর্তের সুখ। জানি, রোগবালাই হবে। আর হলেই ‘কেমন, এ বার হল তো?’ বলার জন্য মুখিয়ে থাকবে পৃথিবী। থাকুক। এ অনেকটা নিজের ভিটেয় পড়ে থাকার মতো। এঁদো-পচা জেনেও আঁকড়ে থাকার মতো। নেশাড়ুরা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বাঁচে না। তারা বাঁচে বর্তমানে। এটা ধূমপানের গুণগান নয়। ভাবনার একটা গড়ন মাত্র।

ধূমপান ক্ষতিকর অভ্যাস। হাত না ধুয়ে খাওয়া, জুতো না পরে বেরনোর মতোই। কাউকে ধূমপানে উৎসাহ দিইনি কখনও, দেবও না। কারণ সিগারেট খাওয়াটা আমার কোনও স্টেটমেন্ট নয়। খুব ব্যক্তিগত একটা ভাল লাগা। কিন্তু মেয়েদের নিজস্ব ভাল লাগা-না লাগা নিয়ে নিজের মতো করে থাকার অধিকার, অন্যের আতশ কাচে ধরা না দেওয়ার অধিকারটাই বড্ড ঝাপসা তো! ভাল লাগে তাই খাই, এই কথাটাও অগত্যা স্টেটমেন্ট হয়ে ওঠে! অনাবশ্যক নীতি-নৈতিকতা ভিড় করে এসে একটা অতি সাধারণ শখ-আহ্লাদের জিনিসকে বিদ্রোহের নিশান বানিয়ে দেয়। সিগারেটের মাথায় জ্বলজ্বল করতে থাকে এক চিলতে স্বাধীনতা!

jagorib@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement