স্মারকসৌধ: শহরের অন্যতম ইহুদি ধর্মস্তান বেথ এল সিনাগগ। ছবি দেবকল্যাণ চৌধুরী।
পবিত্র রমজান মাসেও ইজ়রায়েলি আগ্রাসন থেকে নিস্তার পায়নি প্যালেস্টাইনিরা। সাময়িক যুদ্ধ বিরতি থাকলেও ইজ়রায়েলি সেনার বোমা হামলায় শিশু, কিশোর, গর্ভবতী মহিলা, হাসপাতাল, এমনকি মসজিদও রেহাই পায়নি। এই গভীর মানবিক সঙ্কটের ছবি অহরহ ভেসে উঠেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
ঠিক এই সময় গাজ়া থেকে প্রায় আড়াই হাজার মাইল দূরে, কলকাতা নামক এক শহরে ছ’জন মুসলমান আগলে রেখেছেন শহরের ইহুদি স্মারকসৌধগুলো। এর মধ্যে আছে নেভেহ শালোমে (১৮৩১), মাগেন ডেভিড সিনাগগ (১৮৮৪), বেথ এল সিনাগগ (১৮৮৫)। ওড়িশার পুরী জেলার কাতকপুর গ্রামের কিছু পরিবার, বংশপরম্পরায় সিনাগগের দেখাশোনা করে আসছেন।
স্বাধীনতার বেশ কিছু কাল আগেও ইহুদি প্রার্থনাগৃহগুলো গমগম করত। এক সময় প্রায় পাঁচ হাজার ইহুদিদের বসবাস ছিল এই শহরে, এখন তা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে হাতে গোনা দু’ডজনে। তাই সিনাগগ-এর দৈনন্দিন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ছাড়া বিশেষ ব্যস্ততা তাঁদের থাকে না। রমজান মাসের এক নিঝুম দুপুরে ব্রেবোর্ন রোডের ‘নেভেহ শালোমে’ সিনাগগে মাঝবয়সি মাসুদ হোসেনের সঙ্গে দেখা। তখন ব্রেবোর্ন রোডের অদূরে মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আসরের নমাজের আজান। এত ক্ষণ সিনাগগ-এ ছিলাম বলে, ইহুদি প্রথা অনুসারে দু’জনে মাথায় ‘কিপ্পাহ’ পরেছিলাম। মাসুদ নমাজ পড়তে যাবেন বলে ‘কিপ্পাহ’ মাথা থেকে নামিয়ে, টুপি পরে হন্তদন্ত হয়ে রাস্তা পেরিয়ে চলে গেলেন। এক মানুষের একাধিক পরিচিতির এ দৃশ্য শুধু এ দেশের অন্যত্রই নয়, বিশ্বেও অতিবিরল। কলকাতা জন্মলগ্ন থেকেই বহুত্ববাদের বাহক।
হাওড়া ব্রিজ থেকে কলকাতার প্রবেশ পথ, ব্রেবোর্ন রোড থেকে যাত্রা শুরু করলে মাত্র দু’কিলোমিটার হাঁটাপথে ছ’থেকে সাতটা ধর্মসম্প্রদায়ের সহাবস্থান। ক্যানিং স্ট্রিটের ইহুদি সিনাগগ থেকে জাকারিয়ার নাখোদা মসজিদের মাঝে একাধিক খ্রিস্টান গির্জা, পার্সি ফায়ার টেম্পল, জৈন মন্দির, বুদ্ধ মন্দির, হিন্দু মন্দির, চিনা পাড়ার মন্দির ও গির্জা, একাধিক মসজিদ ও ইমামবাড়া। এ যেন এক মিনি ভারতবর্ষ, সগর্বে বিরাজমান সর্ব ধর্মের ধর্মস্থান। এত বছর ধরে বেঁধে বেঁধে আছে, এক সঙ্গে থাকার অজস্র গল্প ছড়িয়ে আছে। ছেচল্লিশের দাঙ্গার কঠিন সময়েও এক সঙ্গে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছেন এই অঞ্চলের বাসিন্দারা।
বর্তমান কলকাতার বৈচিত্রই বা কম কিসে? ২০১১-র জনগণনা অনুসারে, শতাধিক মাতৃভাষায় কথা বলেন এই শহরে বাসিন্দারা। এই ভাষাগুলোর আবার অজস্র উপভাষা আছে, তবে কলকাতায় বাংলা ভাষায় এখনও সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলেন। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ কী ভাবে পাশাপাশি বসবাস করেন, তা এই চত্বর ঘুরলেই বোঝা যায়। সিনাগগের কেয়ারটেকারের মাতৃভাষা ওড়িয়া, তিনি হিব্রু ভাষার ধর্মগ্রন্থ রক্ষার কাজ করেন, আবার কাজের জন্য কথা তাঁকে বলতে হয় হিন্দি বা বাংলায়। পড়াশোনা খুব বেশি এগোয়নি, তবে এখানে কাজ করতে করতে অন্য ধর্মের সঙ্গে যে সংযোগ তিনি গড়ে তুলেছেন, তা ক্রমশ ভারতবর্ষে বিরল হয়ে পড়ছে। মুসলমান-ইহুদি বৈরিতা আজকের নয়, অথচ মাসুদ বলছেন, ‘খেয়াল করে দেখবেন আমাদের মধ্যে মিল অনেক। তারা দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করে। আমরা বসে প্রার্থনা করি। এটাই আমাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য।’
উপাসনাস্থল: মধ্য কলকাতার নাখোদা মসজিদ
একটু খুঁটিয়ে দেখলে জানা যায় আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মধ্যে ধর্মীয় রীতি ও আচারে প্রভূত সাযুজ্য, তা সে একেশ্বরবাদী প্রার্থনা হোক বা উপবাস। এই সব ধর্মে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ উপবাস। হিব্রু ভাষায় উপবাসকে ‘তানিদ’ বলা হয়। বর্তমানে ইহুদিরা বছরে ছ’দিন উপবাস পালন করে। তাদের উপবাস ঐতিহাসিক ভাবে একেশ্বরবাদী ধর্মের সঙ্গে যুক্ত।
খ্রিস্টানদের মধ্যেও উপবাসের প্রচলন আছে। তবে এ উপবাস ইহুদিদের মতো কঠোর নয়। চার্চের ধর্মীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তাদের টানা চল্লিশ দিনের উপবাস শুরু হয় ‘অ্যাশ ওয়েডনেসডে’-তে এবং শেষ হয় ‘গুড ফ্রাইডে’তে। ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ আব্রাহামিক ধর্ম ইসলামের উপবাস ‘রমজান’ নামে খ্যাত। হিন্দু, পার্সি ও জৈনদের মধ্যেও উপবাস পালনের পরম্পরা আছে।
মাসুদের কাছে বিদায় নিয়ে রাস্তা পেরোচ্ছিলাম, কানে ভেসে এল পর্তুগিজ চার্চের ঘণ্টাধ্বনি। সবেমাত্র রবিবারের প্রার্থনা শেষ হয়েছে। সামনে কিছু মধ্যবয়সি মানুষের জটলা। অন্য দিন ব্রেবোর্ন রোডের হকারদের পসরায় চার্চের মূল ফটক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। চার্চে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের বাইরে নানা জনকল্যাণমুখী কাজ চলে, তবে এই সব কাজের প্রধান উপভোক্তা আশপাশের ফুটপাতবাসী, এলাকার মুসলমান ও হিন্দু পরিবারগুলো। প্রচলিত গথিক স্থাপত্য শৈলী অনুসরণ করে এই চার্চের ভিত্তি স্থাপন করা হয় ১৭৯৭-এ। এই চার্চের পোশাকি নাম ‘ক্যাথিড্রাল অব দ্য মোস্ট হোলি রোজ়ারি’ হলেও পর্তুগিজ চার্চ বা মুরগিহাটা চার্চ নামে বেশি পরিচিত। ব্রিটিশদের অনেক আগেই বাণিজ্যসূত্রে এই শহরে পর্তুগিজদের আগমন। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশরা কলকাতা থেকে পর্তুগিজদের বের করে দেয়, ফলে সাময়িক ভাবে তাদের কাজ কর্মে ভাটা পড়ে। পর্তুগিজরা এই অঞ্চলে বসতি গড়ে পোল্ট্রি ব্যবসায় যুক্ত ছিল বলে জায়গাটির নাম ‘মুরগিহাটা’।
এই চার্চের স্থাপত্য আমাদের মুগ্ধ করে। গঠনে ইন্দো-পার্সিয়ান স্থাপত্যের ছাপ আছে। এই চার্চের অন্যতম আকর্ষণ, চোদ্দোটি কাঠের কাঠামোয় শিল্পীর আশ্চর্য মুনশিয়ানায় জিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণের ঐতিহাসিক চিত্র। ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে গির্জাটির পুরনো কাঠামো ভেঙে নতুন করে গড়া হয়। সে সময়ে সরকার রাস্তা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করে চার্চকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেছিল।
খ্রিস্টানরা প্রায় সম্মতি দিয়ে দিলেও স্থানীয় হিন্দু এবং মুসলমানরা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন।
একই রাস্তা ধরে মহাকরণের দিকে একটু এগোলে ব্রেবোর্ন রোডের উপর সাদা রঙের একটা পেল্লায় মসজিদ দেখা যায় যা ‘সাইফি’ মসজিদ নামে খ্যাত। ১৯২১ সালে কলকাতায় দাউদি বোহরা সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় এই মসজিদ তৈরি হয়। মুল্লা ফতেহাল্লি আবেদ আলি এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। তবে এর শুরুটা বর্তমান স্থানে না পোলক স্ট্রিটে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। সম্প্রদায়ের ৫১তম নেতা মহামান্য ডক্টর সৈয়দনা তাহের সাইফুদ্দিন ধর্মীয় আচরণের মধ্য দিয়ে মসজিদের উদ্বোধন করেছিলেন। হাওড়া স্টেশন থেকে রাজকীয় অভ্যর্থনা করে তাঁকে মসজিদে নিয়ে আসা হয়। এই মসজিদ ১৯২১ সাল থেকে দাউদি বোহরা সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক, শিক্ষাগত এবং সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর প্রধান কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে উঠে। এই মসজিদ গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাক্ষী, অনবদ্য পোশাক পরা ‘বুরহানি স্কাউটস’ এবং ‘ইজি স্কাউটস’ ব্যান্ডের অনুষ্ঠান হয় বিশেষ উপলক্ষে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি জাতীয় অনুষ্ঠান, অর্থাৎ স্বাধীনতা দিবস এবং প্রজাতন্ত্র দিবসে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। মুসলমানদের শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে তাইয়েবি নামে এক উপগোষ্ঠীর সদস্য এই দাউদি বোহরা। গুজরাত থেকে আসায় এদের অনেকে গুজরাতি মুসলমানও বলেন।
মূলত ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এই সম্প্রদায় আর্থিক ও শিক্ষার দিক দিয়ে অন্য মুসলমানদের থেকে এগিয়ে। এঁদের পোশাকেও নিজেদের সাংস্কৃতিক দিক ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষিত হয়। প্রধানত মধ্য কলকাতা যেমন, চাঁদনি চক ও ধর্মতলায় এদের বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়। ধর্মতলা চত্বরে ‘জে এস মহম্মদ আলি’ ও ‘আকবর আলি অ্যান্ড সন্স’ নামে শতকপ্রাচীন কাপড়ের দোকানের কথা কে না জানেন! অথবা বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের অধুনালুপ্ত ‘বোম্বে সুইটস’ বেশ জনপ্রিয় মিষ্টির দোকান ছিল। এদের বানানো ‘আফলাতুন’ অথবা ‘লাড্ডু’ মিষ্টিপ্রিয় বাঙালির কাছে ছিল অতি উপভোগ্য।
এই মসজিদ যেখানে প্রথম শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়, অর্থাৎ পোলক স্ট্রিটে গিয়ে দেখলাম গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মসজিদ সিনাগগ, পার্সি ফায়ার টেম্পল দাঁড়িয়ে আছে। জৈন ব্যবসায়ীদের একটা দল সেবা, শিক্ষা এবং সাধনার মূলমন্ত্র নিয়ে ১৯২৮ সালে ‘জৈন শ্বেতাম্বর স্থানক ভাসি গুজরাত’ নামে জৈন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে এই পোলক স্ট্রীটে। এখানে এখনও ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মসূচি চলে সারাবছর।
পোলক স্ট্রিটের লাগোয়া এজরা স্ট্রিটে দু’শো বছরের পুরনো ‘রুস্তমজি কাওয়াজজি বানাজি পার্সি ফায়ার টেম্পল’। ২০০১ সালে এটাকে হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল, তবে এই শহরের সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য। মার্বেল নির্মিত গথিক স্থাপত্যের এই নিদর্শন কী ভাবে জবরদখল হয়ে গিয়েছে, দেখলে মন খারাপ হয়। ইহুদিদের মতো পার্সি সম্প্রদায়ও মন্দিরের আশপাশে বসতি স্থাপন শুরু করেছিল। এই পার্সি ফায়ার টেম্পলের দেখভালের জন্য দীর্ঘ দিন এক বৃদ্ধ মুসলমান নিযুক্ত ছিলেন।
এজরা স্ট্রিটের অদূরে মেটকাফ স্ট্রিট বা বৌবাজারের বন্দুকগলিতে অবস্থিত একটা সচল পার্সি ফায়ার টেম্পল (বা আগিয়ারি) হল ‘এরভাদ ধুঞ্জিভয় বাইরামজি মেহতা জ়োরাস্ট্রিয়ান আঞ্জুমান আতশ আদারন’। এখানে পার্সি সম্প্রদায়ের প্রার্থনা এবং অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। ইহুদিদের মতো কলকাতার পার্সিদের সংখ্যাও ক্রমশ কমে আসছে। রমজানের সময়ই তাদের নববর্ষ, ‘জামশেদি নওরোজ’ পালিত হয়েছে ২১ মার্চ। প্রাচী মেহতার কথা অনুসারে বর্তমানে কলকাতায় পার্সিরা মাত্র ৩৬০ জন, এর মধ্যে ৬০ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের বেশি। এই শহরে গড়ে উঠতে পার্সিদের অবদান অনস্বীকার্য। রুস্তমজি কাওয়াসজি বানাজি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে, কলকাতা কর্পোরেশন এবং খিদিরপুর ও সালকিয়া ডক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বন্দুকগলি থেকে ছাতাওয়ালা গলি পায়ে হেঁটে মিনিটদুয়েক। কলকাতার চিনেপাড়া। বৌবাজার থেকে মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত এলাকাটি পরিচিত ছিল চায়না টাউন হিসেবে। এখানেও প্রায় দু’শো বছর আগে চিনাদের আগমন হয়। প্রথমে হাকা সম্প্রদায়, পরে ক্যান্টোনিজ, হুপে এবং সাংহাই-এর মানুষ এখানে বসতি গড়ে। দাঁতের ডাক্তার, চর্মশিল্পী এবং অবশ্যই চাইনিজ় খাবারের সঙ্গে এই মানুষদের যোগ অনেক দিনের। কলকাতার চিনেপাড়ায় প্রাতরাশের জন্য এখনও অনেকে আসেন। চিন-ভারত যুদ্ধের পর কলকাতার অনেক চিনা বাসিন্দাই চলে যান অন্য দেশে। এখন কলকাতায় তাঁদের সংখ্যা সাকুল্যে পাঁচ হাজার। ইহুদি ও পার্সিদের মতো কলকাতায় চিনাদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে।
ছাতাওয়ালা গলির প্রথম বাড়িটা রং আর স্থাপত্যে আশপাশের অন্য বাড়িগুলির থেকে বেশ আলাদা। মূল ফটকের বাইরেই লেখা সি আইপি চার্চ (Sea Ip Church)। এটি চার্চ বটে, তবে খ্রিস্টানদের নয়। ১১১ বছর আগে এটি তৈরি করেছিলেন কলকাতার চিনা বাসিন্দারা। এটি বৌদ্ধ মন্দিরও নয়, চৈনিক দেবীর মন্দির। ক্যালেন্ডারের প্রথম আর ১৫-তম দিনে পুজো হয় দেবী চয়সানের। মন্দিরের একতলার সভাকক্ষেও দেখা গেল, জ্বলজ্বল করছে গান্ধীজির ছবি। এখানে চিনাদের ছ’টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে। চিনা মন্দিরগুলিকেও প্রথাগতভাবে ‘গির্জা’ বলা হয়। পরের গলিতে টুং চার্চ। ১৯২৪ সাল থেকে এর নীচের তলায় নানকিং রেস্তরাঁ এবং দোতলায় চিনা মন্দির ছিল। অন্য চারটি চিনা মন্দির কামার হোটেলের পাশের গলিতে। ব্ল্যাকবার্ন লেনের একেবারে প্রবেশপথে ‘জি হিং’ চার্চ, ‘সি ভোই ইউনে লিওং ফুথ’ চার্চ এবং ‘থিয়েন হাউ’ চার্চ। ড্যামজেন লেনের একেবারে শেষের দিকে ‘ন্যাম সুন’ চার্চ, যেটি যুদ্ধের চিনা দেবতা ‘কুয়ান তি’-কে উৎসর্গ করা হয়েছে। মন্দিরটিতে অস্ত্রের একটি সেটের পাশাপাশি চিনা দেবদেবীর অসংখ্য ছবি ও মূর্তি রয়েছে। চাইনিজ় নববর্ষে এই পাড়ায় জমজমাট ও বর্ণময় নাচের অনুষ্ঠান হয়।
চিনেপাড়া থেকে বো-ব্যারাকের দূরত্ব বেশি নয়। বো-ব্যারাকে এখনও রয়েছেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিবারগুলি। বিগত দশক ধরে তাঁরা ধীরে ধীরে কলকাতার অন্যত্র ছড়িয়ে পড়লেও, এখনও কলকাতার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়া হিসেবেই পরিচিত বো-ব্যারাক। সংস্কারের অভাবে বেশ কয়েকটি বিল্ডিং এখন ভগ্নদশায়। পরিবারগুলি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। এই পাড়াতেই আবার দেখা যায় এক বৌদ্ধ মন্দির। বেঙ্গল বৌদ্ধ সমিতি ১৯০৩ সালে, ‘ধর্মাঙ্কুর বৌদ্ধ মন্দির’টি কলকাতার বো-ব্যারাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কর্মযোগী ভেন।
বৌবাজারের মেটকাফ স্ট্রিটে অবস্থিত পার্সিদের ধর্মস্থান।
এখান থেকে ফিয়ার্স লেন ধরে কলুটোলায় ঢুকে পড়ি।
কলুটোলা-জ়াকারিয়া আমরা মুসলমান সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকা বলেই জানি, তাই এ অঞ্চলের বৈচিত্র্যের কথা আমাদের অজানা। এই অঞ্চল থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল, কলকাতা মেডিকেল কলেজ এবং কলেজ স্ট্রিটের মতো ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান। এই পাড়ার বনেদি কিছু পরিবারের সক্রিয় সহযোগিতায় এই প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠে। কলকাতা মেডিকেল কলেজ নির্মাণে মতিলাল শীলের অবদান বিপুল।
দেশভাগের মর্মান্তিক পরিণতিতে শহরের জনবিন্যাসের যে আমূল পরিবর্তন হয়, সেখানে একটা মিশ্র জনপদ ক্রমশ মুসলমান পাড়া হয়ে গেছে। শহরবাসীর সঙ্গে এই পাড়ার যোগযোগ বেশ ক্ষীণ। সময়ের হাত ধরে এই অঞ্চল গড়েছে এক স্বতন্ত্র ঐতিহ্য, যা ফুটে ওঠে স্থাপত্য, ব্যবসা, খাদ্য এবং জীবনধারায়। এখানকার ঐতিহ্য ইতিহাসচর্চার অঙ্গ হয়ে ওঠেনি, অথচ প্রতি পদে ছড়িয়ে আছে ঐতিহ্য ও বহুত্ববাদের প্রভূত রসদ। কলুটোলা স্ট্রিট ধরে এগোতে থাকলে প্রথমেই পড়ে শতকপ্রাচীন ইসলামিয়া হোটেল। এখানে পাবেন ইরানি চায়ের স্বাদ, যা তৈরি করা হয়েছে প্রায় আশি বছরের প্রাচীন এক কেটলিতে।
কলুটোলা স্ট্রিটে মতিলালের বাড়ির পুজো ২০০ বছরের। ছেচল্লিশের দাঙ্গার আগুন শহরের বিভিন্ন অঞ্চল ক্রমশ গ্রাস করে ফেলে। আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়েছিল কলুটোলার মতো মিশ্র সংস্কৃতির এলাকাতেও। শহরের নানা অঞ্চলে অশান্তি সত্ত্বেও শীলবাড়ির পুজো নির্বিঘ্নে সম্পূর্ণ হয়।
গোপালচন্দ্র লেনে বদনচন্দ্র রায় এস্টেটের দুর্গাপুজো এ বছর ১৬৮ বর্ষে পড়ল। মতিলাল শীলের পরিবারের মতো কলকাতা মেডিকেল কলেজ তৈরির পিছনে এই পরিবারেরও অবদান আছে। বদনচন্দ্র রায় এস্টেট সংলগ্ন ফিয়ার্স লেন, কবিরাজ রো প্রভৃতি রাস্তায় হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানদের বসবাস। পুজোর ক’টা দিন বরাবরই এই বাড়ির দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত। ২০১৭ সালে এ বাড়ির দুর্গাপুজোর দেড়শো বছর উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন ব্রেবোর্ন রোডস্থিত চার্চের ফাদার, রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ ও প্রতিবেশীরা।
বিগত কয়েক বছর ইফতারের সন্ধেয় লোভনীয় খাবারের টানে নাখোদা চত্বরে জড় হচ্ছেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। নাখোদা মসজিদের নাম কলকাতাবাসীর জানা। নাখোদা মসজিদের প্রতিষ্ঠাবর্ষ ১৯২৬। তবে এর আগে ওখানেই ছোট একটা মসজিদ ছিল বলে মনে করা হয়। এই মসজিদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদের পিতা মৌলানা খাইরুদ্দিন। নাখোদায় নিয়মিত ‘বায়ান’ (বক্তৃতা) দিতেন।
প্রায় আড়াই থেকে তিন বিঘা জমির উপরে তৈরি নাখোদা মসজিদ। শুক্রবারের জুম্মার নমাজে নিয়মিত প্রায় পনেরো হাজার মানুষ এই মসজিদে নমাজ পড়েন, তবে ইদের নমাজে সেই সংখ্যা পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। মসজিদের মূল ফটকটি যে ফতেপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজার আদলে তৈরি, তা অনেকেই জানেন না। যেমন জানেন না মাইক্রোফোন আবিষ্কারের বহু আগেই সুপ্রাচীন এই মসজিদটির স্থাপত্যগত বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয়েছিল অডিয়ো সিস্টেম। গোলকুন্ডা দুর্গের তলায় হাততালি দিলে যেমন তা শোনা যায় পাহাড়চূড়ার থেকে, অনেকটা তেমনই অডিয়ো সিস্টেম রয়েছে নাখোদা মসজিদে। মসজিদ তৈরির সময় বিখ্যাত শিল্পী গওহরজানের সঙ্গে মসজিদ কমিটির জায়গা নিয়ে গোল বেঁধেছিল। মসজিদ কমিটি গওহরজানের কাছ থেকে বিনামূল্যে তাঁর জায়গা নিতে অস্বীকার করায়, মসজিদের সে দিকের অংশে সম্প্রসারণ সম্ভব হয়নি।
মসজিদকে (নাখোদা মসজিদের পূর্ববর্তী) কেন্দ্র করে সম্প্রীতির আর এক অনন্য নজির মেলে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ গঙ্গাস্নান করে গঙ্গাতীরেই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের হাতে রাখি পরিয়ে, রাস্তার দু’পাশে সব মানুষকে রাখি পরাতে পরাতে এগিয়ে গেলেন নাখোদা মসজিদের দিকে। চিৎপুর রোডের দু’ধারে মানুষের উৎসাহ ও ভালবাসা নিয়ে উদ্যাপন করলেন এক অনন্য রাখিবন্ধন উৎসব। জানা যায়, তিনি মসজিদের ইমামসহ ও অন্যদের হাতেও রাখি পরিয়েছিলেন।
চিৎপুর রোড, অধুনা রবীন্দ্র সরণিতে স্থিত আরও দু’টি ইসলামিক স্থাপত্য আমাদের অনেকেরই অজানা। সিরাজ-উদ-দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সঙ্গে কলকাতার শিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাব শহরের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পড়ে। সিরাজ-উদ-দৌল্লা এস্টেটও শহরে বেশ কিছু ইমামবাড়া তৈরি করে। ওয়াজেদ আলি শাহ তৈরি রাজকীয় ‘সিবতানাবাদ ইমামবাড়া’র কথা আমরা জানলেও মধ্য কলকাতার চিৎপুর রোডে দুই প্রাচীন ইমামবাড়াও উল্লেখযোগ্য। ১৮৫২ সালে সেদি আমান আলি গড়ে তোলেন ‘গোল কোঠি’ ইমামবাড়া। ২০০৩ সালে সংস্কার করা হয়। ইমামবাড়ার দেওয়ালে কোরানের আয়াত ও মহরমের কাহিনির উপর নির্মিত শিল্পকলা প্রশংসার যোগ্য। মহরম মাসে ‘আশুরা’র দিনে শহরের শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ ভিড় জমায়। ঠিক এর উল্টো দিকে আর এক ইমামবাড়া, ‘বাগওয়ালি কোঠি’। এর মূল ফটকের মার্বেল ফলক থেকে জানা যায়, প্রয়াত হাজি মহম্মদ জাফর ইসপাহানির ওয়াকফ এস্টেট এই কোঠির রক্ষণাবেক্ষণ করে। ইমামবাড়ার দেওয়ালে কারবালার যুদ্ধের উপর একশো বছরের পুরনো এক শিল্পকলা দেখা যায়।
দু’পায়ে মাত্র দু’কিলো মিটার হেঁটে এই শহরের সাংস্কৃতিক নৈকট্যের যে ছবি ভেসে আসে, তা নিয়ে আরও বেশি বেশি করে এবং ধারাবাহিক চর্চার প্রয়োজন। যে ভাবে দেশের বহু ঐতিহ্যবাহী ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে বরবাদ করে দিতে এক ধরনের মানুষ চেষ্টা চালাচ্ছে, শত্রুতা ও বিভাজনের ইন্ধন জোগাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অবলম্বন অন্যত্র খুঁজতে হবে না, সংযুক্ত সাধনার ইতিহাস পাওয়া যাবে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেশীর আখ্যানেই।