ছবি: সৌমেন দাস
বাড়ির গেটে দড়াদ্দাম আওয়াজে ঘুম ভাঙল। ভাঙার একটু আগে মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি। অনেকগুলো বছর আগে এ ভাবেই সকালে বাড়ির গেট বাজাত দুধওলা, জল দিতে আসা ভারী। তারা কলকাতার পাড়া থেকে প্রায় উঠেই গিয়েছে। এখন প্যাকেটের দুধ, সাপ্লাইয়ের জল। এই সময় তা হলে
কে এল?
ঘুমের রেশ নিয়েই উঠে বসলাম বিছানায়। খবরের কাগজ গেটের উপর দিয়ে দালানে ফেলে যায় ছেলেটা। আর তো কারও আসার কথা নয়। আবার বাজছে গেট। মা যে কোথায় গেল! গেট মা খুলবে। মায়ের দিন শুরু হয় অনেক আগে। যে এসেছে, নিশ্চয়ই জরুরি কোনও দরকার। নয়তো ও ভাবে গেট ধাক্কাত না। মশারির মধ্যে বসে থাকি অপেক্ষায়। দেখা যাক, মা এসে কী খবর দেয়!
গেট খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। খানিক বাদেই ঘরে এসে ঢুকল ইন্দ্র। আমার বাল্যবন্ধু। পাশের পাড়ায় থাকে। এতই জরুরি তার প্রয়োজন, ঢুকে এল মশারির ভিতরে। প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে, ‘‘এ তো বিরাট ঝামেলা হয়ে গেল রে সুজয়!’’
‘‘কীসের ঝামেলা? হয়েছেটা কী?’’ ঠান্ডা মাথায় জানতে চাইলাম। ইন্দ্র বলল, ‘‘থ্রেটনিং-এর চিঠি! বাড়ির লেটারবক্সে রাখা ছিল।’’
বুকপকেটে রাখা খামসুদ্ধ চিঠিটা এগিয়ে দিল ইন্দ্র। সাদা খামের উপর নাম-ঠিকানা কিছু লেখা নেই। চিঠিটা কম্পিউটারে বাংলা ফন্টে লেখা, ‘বাড়ি বিক্রি করার চেষ্টা করবেন না। বিশাল ক্ষতি করে দেব আপনার। আর যেন কোনও প্রোমোটারের সঙ্গে কথা বলতে না দেখি।’ চিঠি শেষ। প্রেরকের নাম নেই। ইন্দ্র বলে, ‘‘কে হতে পারে বল তো? আমাদের বাড়ি বিক্রি হলে কার কী সমস্যা?’’
‘‘সেটা আমি কী করে বলব! আশপাশের কোনও বাড়ির সঙ্গে তোদের ঝামেলা নেই তো?’’
আমার কথার উত্তর দিতে একটু সময় নেয় ইন্দ্র। মা এসে মশারি খুলতে শুরু করেছে। ইন্দ্র বলে ওঠে, ‘‘না, সে রকম শত্রুতা তো কারও সঙ্গে নেই। এক-দু’টো পরিবার হয়তো হিংসে করে। দোতলা বাড়ি, তার সঙ্গে অতটা জমি নিয়ে থাকি। মোটে তিন জন। আর্থিক দিক থেকেও সচ্ছল, একটু জ্বালা তো হবেই। তবে সেটা এমন নয় যে তারা আমাদের বাড়ি বিক্রিতে বাগড়া দেবে।
মশারি পাট করা হয়ে গিয়েছে মায়ের। আমাকে বলে, ‘‘বিছানাটা গুছিয়ে নিস।’’ ইন্দ্রকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘চা খাবি তো?’’
ঘাড় হেলায় ইন্দ্র। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় মা। ইন্দ্র বলতে শুরু করে, ‘‘আচ্ছা, আমি যে বাড়ি বিক্রি করব, আমার বউ ছাড়া জানিস তুই আর জেনেছে প্রোমোটার, যাকে তুই নিয়ে এসেছিলিস। পাড়ার লোকেদের তো বাড়ি বিক্রি ব্যাপারটা জানার কথা নয়!’’
‘‘প্রোমোটারকে আসতে দেখে হয়তো আন্দাজ করেছে পাড়ার উঠতি মস্তানের দল,’’ বললাম আমি।
ইন্দ্র বলে, ‘‘আমার কিন্তু তা মনে হয় না। পাড়ায় অলরেডি অনেক ফ্ল্যাট উঠেছে। দু’টো প্লটে কাজ চলছে। কোথাও গিয়ে মস্তানদের দল হুমকি দিয়েছে বলে শুনিনি। ইন ফ্যাক্ট, সে রকম দল এখনও অবধি গজিয়ে ওঠেনি আমাদের পাড়ায়।’’
‘‘তা হলে হয়তো তোদের জমিতে ফ্ল্যাট উঠলে কোনও বাড়ি একদম আড়ালে পড়ে যাবে, আলো-বাতাস আসবে না। তারাই দিয়েছে চিঠিটা।’’
ইন্দ্র বলল, ‘‘মানতে পারলাম না। এমনিতে আমাদের বাড়ির পিছনে বাইপাস। ও দিকটায় কোনও বাড়ি গার্ড হওয়ার প্রশ্নই নেই। তা ছাড়া এখনও যে ক’টা বাড়ি আছে, পাড়ায় তারাও দরদাম করছে নানা প্রোমোটারের সঙ্গে। আমাদের মতো সত্তর বছরের পুরনো বাড়ি কারও নেই। বিশ-পঁচিশ বছরের পুরনো বাড়ির বাসিন্দারাও চাইছে তাদের জমিতে ফ্ল্যাট হোক, আর্থিক অবস্থা এক ঝটকায় উপরে উঠুক। তাদের বসবাসের জায়গাটা ছোট হয়ে গেলেও, মডার্ন হওয়াটা জরুরি। কে কার বাড়ি আড়াল করছে, তা নিয়ে পাড়ার লোক এখন আর মাথা ঘামাবে বলে মনে হয় না।’’
‘‘তা হলে কি মামার কোনও শত্রু?’’
সমর্থনসূচক মাথা নেড়ে ইন্দ্র বলে, ‘‘হতেই পারে। হয়তো মামার থেকেই কথাটা লিক হয়েছে। প্রোমোটারদের শত্রুও থাকে।’’
দু’জনের জন্য চা নিয়ে ঘরে ঢুকল মা। প্লেটে বিস্কুট। চায়ের কাপ-প্লেট নিলাম দুই বন্ধু। মা বলল, ‘হ্যাঁ রে ইন্দ্র, আজ অফিস যাবি না? তুই তো সাতসকালে বেরিয়ে যাস।’’
‘‘আর অফিস! যা ঝামেলায় পড়েছি না জেঠিমা!’’
‘‘কেন, কী হয়েছে রে? তোদের কথার যতটুকু শুনলাম, বাড়িটা বিক্রি করে দিতে চাইছিস। বিক্রি নিয়ে কোনও সমস্যা?’’
‘‘পরে সুজয়ের থেকে সব শুনে নিও,’’ বলে কাপে চুমুক দিল ইন্দ্র। আলোচনার গুরুত্ব অনুমান করে কৌতূহল চাপতে হল মাকে। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যে ‘মামা’র কথা আমাদের মধ্যে হল, সে আমার মায়েরও কেউ না, ইন্দ্ররও মামা নয়। এক জন প্রোমোটারের নাম। বিহারের লোক হলেও, অনেক বছর বাংলায় আছে। তার আসল নাম জানি না। সবাই ‘মামা’ বলেই ডাকে। আমার সঙ্গে আলাপ জোড়ামন্দির বাজারে প্রতুলদার চা-দোকানের ঠেকে। এক দিন বলল, ‘‘সুজয়দা, আমি প্রোমোটারি শুরু করেছি। তোমার সন্ধানে জমি-বাড়ি থাকলে বোলো। বাজারে যে কমিশন চলছে, তার চেয়ে বেশিই দেব।’’
মামার বয়স আমার চেয়ে বেশি। তবু আমাকে ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করে। বাইরে থেকে এসে জমিয়ে ব্যবসা করছে, তাই ভূমিপুত্রদের একটু খাতির করে আর কী। মামা আগে প্রোমোটারদের লেবার সাপ্লাই দিত। এখন নিজেই প্রোমোটার। যে দিন মামা জমি-বাড়ির সন্ধান দিতে বলেছিল, তার ঠিক পরের রবিবার ইন্দ্র এসেছিল আমাদের বাড়িতে আড্ডা দিতে। কথায় কথায় জানাল, ওদের বাড়িটা বিক্রি করে দেবে। প্রোমোটার খুঁজছে। মায়ের মতো আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘হঠাৎ বিক্রি করার দরকার পড়ছে কেন? আছিস তো আরামে। বাবা ছাড়াও জ্যাঠা-কাকার সম্পত্তি ভোগ করছিস।’’
ব্যাজার মুখে ইন্দ্র জানিয়েছিল, ‘‘ওটাই তো এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ি যত পুরনো হচ্ছে, রক্ষণাবেক্ষণের খরচা তত বাড়ছে। বিদেশে থাকা জেঠতুতো, খুড়তুতো ভাই-দাদাদের থেকে যখন বাড়ি সারানোর খরচা চাই, টাকা পাঠায় ঠিকই, তার সঙ্গে ইদানীং এটাও বলে, ‘বাড়িটা এবার প্রোমোটারকে দিয়ে দে। মন করলে ওই কমপ্লেক্সেই একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাক। শেয়ারের অংশও কিছুটা বেশি নিস। কেননা এত দিন তো তুইই বাড়িটার দেখাশোনা করলি।’’’ কথা শেষ করে একটু ভেবে নিয়ে ফের ইন্দ্র বলেছিল, ‘‘সহেলিরও বাড়ি বিক্রিতেই সায়। বলে, পুরনো বাড়িতে আমাদের মেয়েটা ঠিকঠাক স্মার্ট হয়ে উঠতে পারছে না। পড়ে নামী ইংলিশ মিডিয়ামে অথচ হাবভাব কেমন যেন সেকেলে। স্কুলফ্রেন্ডদের মাঝে ওকে অড ওয়ান লাগে।’’
ইন্দ্রর কথাবার্তা শুনে বুঝেছিলাম, বাড়ি ওরা বিক্রি করবেই। আমাদের এলাকা থেকে পায়ে-হাঁটা কুড়ি মিনিট দূরত্বে বিশাল শপিং মল, পাশে মাল্টি-স্ক্রিন সিনেমা হল। পিছনে বাইপাসের ধার ঘেঁষে কত ঝাঁ চকচকে হোটেল-রেস্তরাঁ। সেখানে যাতায়াত করতে গেলে শুধু মেয়ে নয়, ইন্দ্র-সহেলিকেও আরও কয়েক ধাপ স্মার্ট হতে হবে। বাড়ি যখন বিক্রি করবেই ওরা, আমি কেন কমিশন হাতছাড়া করি! আমার আর্থিক অবস্থা খুব একটা পদের নয়। ছোট কারখানায় চাকরি করা বাবা দুই মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে সঞ্চয় তো বটেই, আয়ুটাও ফুরিয়ে ফেলেছিলেন। চলে গেলেন তাড়াতাড়ি। আমার কোনও ভদ্রস্থ চাকরি জোটেনি। বাড়িতে কোচিং পড়াই। স্কুল মাস্টার নই বলে ছাত্রছাত্রী ধরে রাখতে হয় অনেক তোয়াজ করে। ইন্দ্রর মেয়ের বয়স ছয়-সাত হবে বোধহয়, আমি এখনও অবধি সাহস করে বিয়ে করে উঠতে পারলাম না। সব দিক ভেবে ইন্দ্রকে বলেছিলাম, ‘‘আমার এক পরিচিত প্রোমোটার আছে। কথা বলবি?’’
ইন্দ্র তৎক্ষণাৎ রাজি। বলেছিল, ‘‘অবশ্যই। চেনাজানার মধ্যে হলে তো ভালই।’’
পর দিনই মামাকে নিয়ে গেলাম। কথাবার্তা অনেকটাই এগিয়েছে। তার মধ্যে আবার এই ঝামেলা। চা খাওয়া শেষ হলে ওকে বললাম, ‘‘তা হলে কী করা যায়? মামার কাছে যাবি? শত্রুটা ওর দিক থেকে না হলেও এই ধরনের কেস তো ওরা ফেস করে, পরামর্শ দিতে পারবে।’’
‘‘তাই চ’। এখনই যাই। সহেলি তো ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছে। বলছে, ‘তুমি সেই কোন সকালে বেরিয়ে যাও, ফিরতে ফিরতে রাত। মেয়েকে নিয়ে একা থাকি, কখন কী ধরনের যে ক্ষতি করবে, কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না।’ ’’
******
আমরা এখন থানায়। ‘আমরা’ মানে তিন জন। আমি, ইন্দ্র আর মামা। এত তাড়াতাড়ি পুলিশের সাহায্য নেওয়ার ইচ্ছে আমাদের দুই বন্ধুরই ছিল না। নির্ঝঞ্ঝাট, ভিরু পরিবারে বড় হয়েছি দু’জনে, থানা-পুলিশ মানে আমাদের কাছে চূড়ান্ত পরিস্থিতি। মামা জোর করল। বাংলা পড়তে পারে না মামা। মুখে চিঠির বয়ান শুনে বলল, ‘‘আমার যে কোনও শত্রু হয়েছে, এখন অবধি কিছু টের পাইনি। সবে তো একটা-দু’টো কাজে হাত দিয়েছি। তবে কেসটা হালকা ভাবে না নেওয়াই ভাল। এখনই থানায় গিয়ে একটা রিপোর্ট করা উচিত। একগাদা টাকা ওই সাইটে ইনভেস্ট করে বসে থাকব, পরে কাজ করতে গিয়ে কোনও ঝামেলায় পড়তে চাই না।’’
সত্যিই প্রচুর টাকা দিয়ে কিনতে হবে ইন্দ্রদের জমি। মোটা কমিশন পাব আমিও, ইন্দ্র জানবে না। আমাদের এলাকায় দু’ধরনের জমি আছে, বিশুদ্ধ মালিকানা, যেমন ইন্দ্রদের। আর ঠিকা টেনেন্সি, আমাদের মতো শরণার্থী পরিবারের জমি, লিজে দিয়ে রেখেছে সরকার। বিক্রি করা যাবে না। পাকা ছাদ বানানোর পারমিশন নেই। চালার ঘর করে থাকতে হবে। তবু এ দিক ও দিক টাকা খাইয়ে হাতবদল হয়ে যাচ্ছে ঠিকার জমি। তেরপল ঢাকা দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে উঠে যাচ্ছে ফ্ল্যাট। সমস্যা একটাই, ওই জমির ফ্ল্যাটে লোন দেয় না ব্যাঙ্ক। তাই জমির দাম বেশ কম। আমাদের জমি বিক্রি নিয়ে সেই কারণেই কোনও দিন কিছু ভাবিনি। জায়গাও নামমাত্র। ফ্ল্যাট ওঠার মতো নয়।
‘‘হ্যাঁ, বলুন। আপনাদের কী ব্যাপার?’’ নিজের চেয়ারে বসা ডিউটি অফিসার জানতে চাইলেন। বেশ ইয়ং, টিভি সিরিয়ালের পুলিশ অফিসারের মতো দেখতে। ওঁর সামনে এত ক্ষণ একটা জটলা ছিল। আমরা অপেক্ষা করছিলাম পিছনের বেঞ্চে। ভিড় সরে গিয়েছে। অফিসারের টেবিলের সামনে গিয়ে তিনটি চেয়ারের দখল নিলাম। ইন্দ্র হুমকির চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করল ঘটনাটা।
মিনিট দশ ধরে আমরা তিন জন মিলেই গোটা ব্যাপারটা বোঝালাম অফিসারকে। উনি মন দিয়ে আমাদের কথা শুনলেন এবং বার তিনেক চোখ বোলালেন চিঠিটা উপর। চুপ করে কিছু ক্ষণ ভেবে বললেন, ‘‘চিঠিটা যে দিয়েছে, খুব একটা দম আছে বলে মনে হচ্ছে না। সত্যিকারের গুন্ডা-মস্তান হলে সামনে হুমকি দিত।’’
‘‘আড়াল থেকে দিচ্ছে বলেই তো চিন্তায় আছি। অফিসের কাজে সারাটা দিন বাইরে থাকি, বাড়িতে বউ আর মেয়ে। কখন কী হয়...’’
ইন্দ্রর কথা শেষ করতে না দিয়ে অফিসার বলে উঠলেন, ‘‘দেখুন, একটা উড়ো চিঠির উপর বেস করে পুলিশ তো আর তদন্তে নেমে পড়তে পারে না। আমাদের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আপনার সঙ্গে কেউ ইয়ার্কিও করে থাকতে পারে। ক’টা দিন দেখুন, প্রোমোটারকে ডেকে আরও কয়েকটা মিটিং করুন। দেখা যাক লোকটা আর কোনও থ্রেট দেয় কি না। তার পর নাহয় ইনভেস্টিগেট করা যাবে।’’
ইন্দ্রর মুখটা শুকিয়েই রইল। বোঝাই যাচ্ছে এখানে বসে থেকে আর লাভ নেই। কিন্তু না। ফের অফিসারই কথা শুরু করলেন, ‘‘চিঠির বয়ানটা ঠিক অ্যান্টি-সোশ্যালের মতো নয়, একটাও বানান ভুল নেই।’’ একটু থেমে অফিসার জানতে চান, ‘‘আচ্ছা, আপনাদের বাড়ির চৌহদ্দিতে অনেকটা ফাঁকা জায়গা আছে কি? বাচ্চারা খেলে-টেলে? মানে বাচ্চাদের খেলা বন্ধ হয়ে যাবে দেখে কোনও প্রতিবেশীও হয়তো চিঠিটা দিয়ে থাকতে পারে।
‘‘জমি অনেকটাই আছে, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তবে বাচ্চারা খেলতে-টেলতে আসে না। আজকালকার বাচ্চাদের আউটডোর গেমে ইন্টারেস্ট কোথায়? পাড়ার যে ক’জন ছেলে-মেয়ে খোলা জায়গায় খেলতে আগ্রহী, তারা লেকের মাঠে যায়, নয়তো নির্দিষ্ট কোনও ক্লাবে। আমাদের বাগানে ঠিক মতো খেলা সম্ভবও নয়, প্রচুর গাছ আছে। বড় জোর হুড়োহুড়ি করা যেতে পারে। যেমন ছোটবেলায় করতাম আমরা।’’
ইন্দ্রর কথা কেড়ে বলতে শুরু করলাম, ‘‘অনেক ধরনের গাছ স্যর। বেনারসের পেয়ারা, আম্রপালী আম! কত ফুলগাছ। কদম, কাঠচাঁপা, টগর, ছাতিম আরও অনেক! আমিও ওদের বাড়িতে খেলতে যেতাম। তখন ওর জেঠতুতো, খুড়তুতো ভাই-বোনেরা থাকত। ওদের বিশাল ছাদে ঘুড়ি ওড়াতাম সবাই মিলে। এখন ছাদও আছে, গাছগুলোও। ছেলেপুলেরা আর আসে না।’’
ফের ইন্দ্র বলতে থাকে, ‘‘এই তো। যে দিন সকালে সুজয় এই প্রোমোটার দাদাকে নিয়ে এল বাড়িতে, দরজা খোলার পর দেখি ওরা দাঁড়িয়েই আছে। সুজয়কে বললাম, কী হল? আয় ভিতরে! আমাকে অবাক করে সুজয় উবু হয়ে বসল ওখানেই। সদর লাগোয়া একটা শিউলি গাছ আছে, সামনের চাতালে পড়েছিল প্রচুর ফুল। সুজয় হাত দিয়ে শিউলি ফুলগুলো সরিয়ে তবে ভিতরে...’’ থেমে গিয়েছে ইন্দ্র। ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
চোখ সরিয়ে নিই আমি। অফিসারের মুখের দিকে তাকাই, এ কী, ওঁর ঠোঁটে মিটমিটে হাসি! মামার দিকে ঘাড় না ঘুরিয়েও বুঝতে পারি, সে-ও আমাকে অবাক দৃষ্টিতে দেখেছ। তা হলে কি ধরা পড়ে গেলাম? গুন্ডা-মস্তানদের মতোই শাস্তি হবে আমার? আমি কমিশনের কথা ভুলে এই শহরে দুর্লভ হয়ে যাওয়া কিছু গাছ, একটা পুরনো বাড়ি, বহু বছর ধরে রোদ-জ্যোৎস্নার ছোঁয়া পাওয়া ছাদ বাঁচাতে গিয়েছিলাম। এটা কি খুব বড় কোনও অপরাধ?