ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল
গণেশ বাউরি বলল, ‘‘এ তোমার কেমন কতার ছিরি! মেলায় বেটারি-গাড়ি বেটারি-ঘোড়া যদি বিক্কিরি হয়, তাইলে বেটারি-পুতুল হবে নে কেনে?’’
‘‘কেনে হবে? বাপ-ঠাউদ্দার আমল থেঙে মেলা চলতিচে। বছরের ক’টা মাত্তর দিন। গেরামের দুধুসুখু নোক মাটির কাজ, পাতার সেপাই, ঘাড়নাড়া বুড়ো, নক্ষিপিতিমে, কাটির চরকা বেচে দুটো পয়সা করে। বাইরে থেঙে এই সব পেলাস্টিক মেলাস্টিক ঢুক্কে নোক এসে পয়সা নুটে নে চলি যাচ্ছে। এ তুমি কেমন ম্যানেজার খুড়ো? কাঁদন ঢালি থাকলি বিবেচনা করতো মোর কতাডা। তারকেশ্বরকে বেচতে দিত না বেটারি পুতুল,’’ রাগে গজগজ করতে করতে বলল নাদির।
নাগরদোলা চক্কর মারছে। প্যাঁ-পোঁ বাঁশি বাজছে এ দিক-ও দিক। ঘটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হোগলার ছইয়ের নীচে সুবল ময়রা জিলিপি ছাড়ছে। গণেশ বললো, ‘‘দেখো নাদিরভাই দেখো? বাবার মন্দিরের দেওয়ালটা দেখো! চুড়ো গার্ড করে সাইনবোর্ডের মেয়েটা বোতলে চুমুক দিচ্ছে। কেমন নাইট জলতেচে ভিতরে। তার পাশে ফোন কোম্পানির ছবিটা দেখো? মেয়েটারে সক্কলির সামনে জাপটে ধরি দাঁত বার করি কতা কইচে ছোকরাটা। খ্যাপা মহেশ্বরের সিমেন্টের ষাঁড়টার গায়ে লাল নীল টুনি জ্বলতেচে। নাদিরভাই, বেটারির পুতুলকে আর তুমি এটকে রাখতে পারবা? বলি কি ও সব মাটির ঢিপি এবরে রাখো। তার চেয়ে শহুরে যাও। ক্যানিং ইস্টিট, চিনে পট্টি থেঙে সস্তায় খেলনা এনে মেলায় বেচো। দুটো পয়সা পাবে।’’
গণেশের কথায় মনটা দমে গেল নাদিরের। পুতুল গড়ার চালার নীচে জমে আছে তিন পুরুষের ছাঁচ। কোনওটা বাপের হাতে গড়া, কোনও আবার ঠাকুরদার— হাতি, ঘোড়া, পাখি, শিশু। কত অন্ন জুগিয়েছে ওই সব পোড়ামাটি।
নাদির ঘাড় হেঁট করে চলে যাচ্ছিল। গণেশ বলল, ‘‘এ বার মেলায় নতুন কাজ কী আনলে গো চাচা?’’ লুঙির ওপর সাদা টেরিকটের পাঞ্জাবিটা থেমে গেল। হেলে পড়া ঘোড়ানিমের ডাল থেকে বসন্তের তাড়া খাওয়া হলুদ এক দল পাতা ঝুরঝুর করে পড়ল সেই ময়লা সাদা পাঞ্জাবির ওপর। এক গাল হেসে বলল, ‘‘হাঁসের পিঠে এবেরে পয়সা ঢোকানোর ছোট্ট একটা ছাঁদ্যা করে দিইচি বুঝলে কি না? মা-ঝিয়েরা দেখলেই নে যাচ্চে। আপদে বিপদে কাজে নাগবে।’’
মেলার ধার ঘেঁষে ছাউনি টাঙিয়ে তারকেশ্বর তার ওই প্লাস্টিকের পুতুলগুলো সাজাচ্ছে। উড়ো ধুলো পাক খেয়ে মাঝে মাঝে এসে পড়ছে পুতুলগুলোর ওপর। সন্ধ্যামণি একটা লাঠির মাথায় একগোছা কাপড়ের ফিতে বেঁধে সেই ধুলো ঝাড়ছে। পুতুলটি বেশ মজার।
দু-হাতের দুর্গা। অসুরকে বাণ মারছে। ন’বার ঠিক ঠিক লাগছে আর দশ বারের বার ফস্কে যাচ্ছে ত্রিশূল। অসুরটা তখন খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসছে। ঠিক নয় বারের পরই প্রতি বার ফস্কে যাচ্ছে। এক বারের জন্যেও নড়চড় নেই এই প্রক্রিয়ার।
এ সব তারকেশ্বরের নিজের হাতে তৈরি। দাম ব্যাটারি সমেত ত্রিশ টাকা। কচিকাঁচাদের ভিড় লেগে গেল। চারপেয়ে একটা ছোট্ট টুলে তারকেশ্বর দেখাতে লাগল পুতুলের খেল। বাচ্চাগুলো দু’চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে দেখছিল খেলনাটা। ঠিক দশ বারের মাথায় হইহই করে উঠল। দু-চার জন হাততালিও দিল সেই হাসি শুনে।
একটা পুতুলও কিনল না কেউ। আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে গেল ভিড়। সন্ধ্যামণি বলল, ‘‘তোমার এই পুতুল চলবেনি বাপু। পেলান পাল্টাও।’’
‘‘কেন?’’
‘‘নোকে দেখে বেশি, কেনে কম।’’
‘‘আজ দেখে যাচ্ছে, দেখবি কাল কিনে নে যাবে।’’
এমন সময় দুজন ভদ্রলোক এসে দাঁড়াল তারকেশ্বরের দোকানের সামনে। এক জন একটা পুতুল তুলে নিয়ে বলল, ‘‘কত দাম ভাই?’’
‘‘এজ্ঞে বাবু তিরিশ টাকা।’’
‘‘তিরিশ টাকা!’’
‘‘বাবু এ শুধু পুতুল নয়! এর ভিতরি বেটারি আচে। দম দিলে ন’বার বাণ মারে এক বার ফস্কায়। এই দেখুন বাবু,’’ তারকেশ্বর দম দিয়ে তার পুতুলের কেরামতি দেখাতে লাগল।
অন্য লোকটি বলল, ‘‘বাঃ! ভারী মজার তো! কিন্তু ধরুন, যদি পাঁচ-ছ’বারের মাথায় ফস্কে যায়? এমনটাও তো হতে পারে?’’
‘‘না বাবু। য্যাখন ত্যাখন ও ফস্কাবেনি। যে কোনও একটা তুলে আপনি পরীক্ষে করে দেকে নিতে পারেন।’’
‘‘ফাইন,’’ লোকটি চশমাটা চোখ থেকে তুলে কপালের ওপর ঠেলে দিল। বলল, ‘‘আমরা আপনাকে কিছু উপহার দিতে চাই। কিন্তু একটা ছোট্ট শর্তে। আমরা আপনার এই খেলনা থেকে যে কোনও একটায় দম দেব। তার পর পর পর সাত বার চালাব। যদি আপনার কথামতো প্রতি দশ বারের মাথায় ঠিকঠাক ফস্কায় তা হলে আমরা আপনাকে একটা দামি সেলফোন অথবা বড় এলসিডি টিভি দেব। কিন্তু তার আগে ফস্কে গেলে, সব ক’টা পুতুল আমরা নিয়ে চলে যাব। বিনামূল্যে। এর ডাইস, পেনিয়ন ভিতরের কলকব্জা, সব তখন আমাদের। সব কিছু।’’
তারকেশ্বর বৌয়ের দিকে তাকাল। সন্ধ্যামণি জড়োসড়ো।
একটা বেলুনওয়ালা বাঁশি বাজিয়ে ঘুরছে। একই দেহে দু-মুখো শিশু গঙ্গা-যমুনাকে দেখার জন্য ঘোষণা হচ্ছে, ‘দশ টাকা... দশ টাকা... দশ টাকা। এই দশ টাকার বিনিময়ে আপনারা দেখতে...’
প্রথম লোকটি বলল, ‘‘তা হলে আসুন শুরু করি। আচ্ছা আপনিই বলুন, কোন পুতুলটা তুলে নেব আমরা?’’
তারকেশ্বর খুঁজতে লাগল। খুঁজতে লাগল একটা পুতুল। তার সাজানো খেলনা থেকে একটাকে তুলে আনতে পারছে না তারকেশ্বর। তার নিজের হাতে গড়া জিনিসটা থেকে ঠিকরে আসছে একটা অবিশ্বাস। সে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘‘আমাকে একটু সময় দিন বাবু।’’
‘‘বেশ, ভাবুন। আমরা তত ক্ষণ একটু ঘুরে আসছি। কিন্তু এত সহজ শর্ত আপনাকে কেন ভাবাচ্ছে বুঝতে পারছি না। ঠিক আছে আপনি ভাবতে থাকুন।’’
তারকেশ্বর ভাবতে থাকে তার প্রযুক্তির খুঁটিনাটি। গভীর ভাবে চিন্তা করতে থাকে ন’বারের পরে ফস্কে যাওয়ার অঙ্ক। সন্ধ্যামণি গজগজ করতে করতে পুতুলের গা থেকে ধুলো ঝাড়ে।
নিজের গরজে পাতা খসিয়ে দেওয়া চৈত্রের ডালের ফাঁক দিয়ে পশ্চিম দিগন্তে ছুঁই-ছুঁই নৌকাচিহ্ন চাঁদ। গঙ্গা-যমুনার শো আজকের মতো শেষ। কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতলে চুমুক দেওয়া মেয়েটার মুখে ছুটে বেড়াচ্ছে অসংখ্য পোকা।
ব্যাগের ভিতর খেলনাগুলো একটা একটা করে গুছিয়ে রাখছে তারকেশ্বর। সন্ধ্যামণি তখনও গজগজ করছে, ‘‘না বাবুরা আর এলোনি।’’
গোছাতে গোছাতে তারকেশ্বর বলল, ‘‘সময় এখন অনেক চতুর হয়েছে রে সন্ধ্যামণি। কৌশলটা বুঝতে এখন সময় নাগে।’’
‘‘কী যে বলো! সময় আবার ক্যামনে চতুর হবে! মোর মাতায় তোমার কতা কিছু ঢুকচেনে বাপু!’’
‘‘আরে সময়ের মানুষগুলোর কতা বলতিচিরে পাগলি! দেকলি না আমাদের চিরকালের বিশ্বেস ভেঙে কেমন নোভ জাগিয়ে চলি গেল,’’ সন্ধ্যামণির দিকে চেয়ে তার সরল হাসিটা এ বার ছড়িয়ে দিল সে। যে হাসিটা কিছু ক্ষণের জন্য মুখ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল তারকেশ্বরের।