ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল
ফোনটা বাজছে। ‘ও মধু, ও মধু, আই লাভ ইউ’— ফোনের রিংটোনটা নিজেরই সেট করা, নামের সঙ্গে মিলিয়ে। এই নিয়ে চতুর্থ বার বাজল ফোনটা। চলন্ত বাসে গুটিকয়েক লোক। সকলেই মাস্ক পরে থাকায় মুখভাব বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বাসে ওঠা থেকে সকলে যে অপাঙ্গে ওকেই দেখছে বেশ কৌতূহল নিয়ে, এ ব্যাপারে মধু নিঃসংশয়। তার প্রথম কারণ মোবাইল ফোনটার পনেরো মিনিটে চার বার বাজা এবং ওর না ধরা। দ্বিতীয় কারণটাও ওর হাতেই— টবে হাতদুয়েক লম্বা হৃষ্টপুষ্ট গাছটায় কিম্ভূত একটা ফল ধরে রয়েছে, যেটা পেকে প্রায় পড়ব পড়ব করছে। একটু অসাবধান হলেই ওটা পড়ে যেতে পারে, এই ভয়েই ফোনটা এত ক্ষণ ধরেনি। কিন্তু নাঃ, এ বার ধরতেই হবে। রায় লোকটা নাছোড়বান্দা।
রায় পিডব্লিউডি-র ইঞ্জিনিয়ার। মাথাজোড়া টাক, বেঁটেখাটো চেহারা। মুখখানা সব সময় হাসি-হাসি। ওকে দেখলে হিজিবিজবিজের কথা মনে পড়ে। কথাও চিনি মাখানো, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বদের বাসা। ‘হিজিবিজবিজ কলিং’ দেখে কোলের উপর গাছটা সন্তর্পণে চেপে রেখে ফোনটা ধরে মধু বলল, “বলুন স্যর।”
“ফোনটা হাতের কাছে থাকে না ভাই তোমার?” মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করছে রায়।
“সাইলেন্ট ছিল স্যর, শুনতে পাইনি, বলুন।”
“আমি আর কী বলব মধু, বলবে তো তুমিই। সাইটে আরও চারটে লেবার লাগবে, আগেই তো বলেছি তোমাকে। রেগুলার লেবারগুলোই ফাঁকি মারছে। সাইট থেকে গতকাল বলল তিনটে অ্যাবসেন্ট...” একটু অধৈর্য রায়ের গলা।
“দেখছি স্যর কেন আসেনি। আর স্যর, আমার অনেকগুলো পেমেন্ট বাকি, একটু যদি দেখেন।”
“মধু, পেমেন্ট পাওনি, এ রকম কি ঘটেছে কখনও?” কথা শেষ হওয়ার আগেই কেড়ে নিচ্ছে রায়, “বড়সাহেব বলে দিয়েছেন, প্রসেসিং-এ কিছুটা ডিলে হবে। যা সিচুয়েশন এখন। ধৈর্য ধরতে হবে।”
প্রবল ইচ্ছে হয় মধুর পাল্টা জবাব দেওয়ার, ‘ধৈর্য আপনাকেও ধরতে হবে স্যর। লেবারগুলো তো অটোমেটিক পুতুল নয় যে, রোবটের মতো কাজ করতে আসবে সব পরিস্থিতিতেই। প্রত্যেকেরই সুবিধে-অসুবিধে আছে।’ সিচুয়েশনের কথা বলছে শালা! যেন ভাইরাসের উৎপাত শুধু ওকেই ঝামেলায় ফেলেছে, আর কারও কোনও প্রবলেম নেই।
কিন্তু মুখে কিছু বলল না মধু। এক জন ঠিকাদারের মুখে ও সব কথা মানায় না। মুখ বুজে লেবার খাটানো, পেমেন্ট নেওয়া, কাজ তুলে দেওয়াই তার কাজ। “দেখছি স্যর, কী করা যায়,” বলে ফোনটা রেখে দিল ও।
‘হয়ে যাবে ম্যাডাম’, ‘করে দিচ্ছি স্যর’ ওর মুখের লব্জ। কাজটা আদৌ উতরোবে কি না যখন জানা থাকে না, তখনও এই রকম ঠেকনা দেওয়া কথায় খুব কাজ দেয়। যাকে বলছে সেও নিশ্চিন্ত হয়, নিজেরও একটা আত্মতৃপ্তি হয়।
মধুময় বিশ্বাস নামে ওকে প্রায় কেউই ডাকে না, শুধু শ্বশুরবাড়ির লোক ছাড়া। শ্বশুর-শাশুড়ি বহু দিন গত, থাকার মধ্যে দুই শালা আর এক মামাশ্বশুর। বয়স হলেও মামাশ্বশুরের প্রতাপ অব্যাহত। এক কালে দারোগা ছিলেন বলে সবাইকেই ক্রিমিনাল মনে করেন। অনেক কাল দেখাসাক্ষাৎ না থাকার পর হালে একটা বিশেষ কারণে মধু নিজের গরজেই আবার যোগাযোগ করেছে।
দু’দিন আগে ও বারুইপুরে গিয়েছিল মামাশ্বশুরের বাড়িতে। ট্রেন চালু থাকলে যাওয়াটা কোনও ব্যাপার নয়। হাঁটাপথে কলেজ স্ট্রিটের বাড়ি থেকে শিয়ালদা এসে সাউথের ট্রেনে চাপলেই মিনিট চল্লিশেক। কিন্তু এখন ট্রেন বন্ধ। করোনা আতঙ্কে কেউ কারও বাড়িও বেড়াতে যায় না। মধুকে তাও যেতে হয়েছিল বিশেষ কারণে। ঘণ্টাদুয়েক বাস-জার্নির পর বেলা বারোটা নাগাদ যখন পৌঁছল, তখন খিদে পেয়েছিল মারাত্মক। পেটের মধ্যে ভুটভাট আওয়াজ আর গ্যাসের ব্যথা চাগাড় দিচ্ছিল। মামিশাশুড়ি দরজা খুলে খুব দায়সারা ভাবে জিজ্ঞেস করেছিল চা খাবে কি না। শুনেই আরও অম্বল হয়ে যাচ্ছিল। ক্ষীণ স্বরে বলেছিল, “নাঃ, একটু জল খাব।”
মামাশ্বশুর ঝাঁকিদর্শন দিয়েছিলেন মুখে মাস্ক আর বর্মের মতো প্লাস্টিকের স্বচ্ছ মুখোশ পরে। মাস্কের আড়ালে ওঁর ঝাঁটার মতো গোঁফজোড়া দেখা যায়নি, কিন্তু মুখোশের আড়ালেও চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করছিল।
আগে বলা ছিল বলে তিন-চারটে রেয়ার গাছ রেডি করেই রেখেছিলেন ওঁরা। কিন্তু দু’টোর বেশি নেওয়া যাবে না। জীবনে এই প্রথম চারটে হাত নেই বলে বেশ কষ্ট হচ্ছিল মধুর। ভেবেচিন্তে ড্রাগনফ্রুট গাছটাই পছন্দ করেছিল ও। আর সাদাজামটা। ওটা দেবে বলে কমিট করেছে ম্যাডামকে।
“ফল আসতে তো দেরি হবে?” খানিক কথা চালাবার জন্যই মধু প্রশ্ন করেছিল মিউমিউ করে।
“সেটা নির্ভর করে দেরি বলতে তুমি কী বোঝো তার উপর। যদি কালকেই চাও তবে বলব, না, ও রকম ইনস্ট্যান্ট ফল অসম্ভব। কিন্তু নেক্সট ইয়ারে ইয়া তাগড়া জাম ফলবে, গ্যারান্টি দিচ্ছি,” মামাবাবু মুখোশের মধ্যে দিয়ে হুঙ্কার ছাড়ছিলেন।
ইনস্ট্যান্ট ফলই মধুর দরকার। চক্ষুলজ্জায় সেকথা ও বলতে পারেনি। যাঁকে খুশি করার জন্য এত দূর ঠেঙিয়ে আসা, সেই ম্যাডামের সঙ্গে জাম-বিষয়ক কথোপকথন মনে পড়ে গেছিল। ও বলেছিল, “ম্যাডাম, আপনার এত গার্ডেনের শখ। আমি আমার মামাশ্বশুরকে বলে রেখেছি, ওঁর ওখান থেকে একটা সাদাজামের গাছ আপনার জন্য এনে দেব।”
“সাদাজাম? সে আবার কেমন খেতে?” ম্যাডাম একটু সরু চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন।
“দারুণ খেতে ম্যাডাম, কালোজামের চেয়ে অনেক বেটার,” এমন ভাবে বলেছিল, যেন সারা জীবন সাদাজামই খেয়ে আসছে ও। আসলে ওরও সঠিক জানা নেই কেমন খেতে। তাতে কী! কনফিডেন্সটাই আসল কথা।
ভাবতে ভাবতে বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল মধু। হঠাৎ শুনল, “আর মিষ্টি যেন গুড়! এ বার কালোজাম একটাও হল না। সব ভাইরাসে খেয়ে গেল। কিন্তু সাদাজামগুলো দিব্যি হল। করোনা ওদের কাবু করতে পারল না।” মামিশাশুড়ি শাড়ির আঁচলটাকেই নাক-মুখের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে মাস্কের মতো করে তার ভেতর দিয়েই কথা বলছেন গুঙিয়ে গুঙিয়ে। সাদাজামে করোনা লাগল না কেন, এ বিষয়ে হয়তো আরও খানিক ক্ষণ কথা চালানো যেত, কিন্তু গাছদু’টো পেয়ে যাওয়ার পর আর জড়ভরতের মতো মুখোশ পরে ওখানে বসে থাকার মানে হয় না।
“আচ্ছা, আসি তা হলে।”
“এসো। এমন অসময়ে এলে মধুময়, তোমাকে একটু মিষ্টিমুখ করাতেও পারলাম না। করোনার জন্য সব মিষ্টির দোকান বন্ধ।”
আজকে দু’টো গাছ এক সঙ্গে আনতে পারেনি মধু। ড্রাগনফ্রুটটা কোনও রকমে এনেছে। সাদাজামটা পরের বার আনবে। ম্যাডামদের বাড়ি ম্যাডক্স স্কোয়ারে। মাঠটা ওঁদের দোতলার বারান্দা থেকে দেখা যায়। ঢোকার মুখে একটা অর্ধচন্দ্রাকার লোহার গেটে মাধবীলতা ঝাঁকড়া হয়ে আছে। ম্যাডামের বয়স পঞ্চাশের উপর হবে নিশ্চয়ই। কলপ করা চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা। একটা ফুলছাপ হাউসকোট পরে কাজের মেয়েকে কী একটা নির্দেশ দিচ্ছিলেন উনি। একটু খান্ডারনি টাইপ, সব সময়ই তিরিক্ষি। আজ অবশ্য মুড ভালই মনে হচ্ছে। ওকে দেখে খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, “তুমি এসে গেছ, মধু? খুব ভাল হয়েছে। হাতে ওটা কী? সাদাজাম এটাই না কি?” এত সহজ ভাবে বলছেন, যেন শনিবার সকালে ড্রাগনফ্রুটের এই অদ্ভুত গাছটা বয়ে নিয়ে ওর এ বাড়িতে আসাটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। মধু দোতলার ব্যালকনির এক কোণে গাছটা রেখে দিল। স্যরও আজ বাড়িতে, ব্যালকনির পাশের ঘরটায় বসে সিএনএন দেখছেন। আড়চোখে মধুকে একটা মাছি দেখার ভঙ্গিতে দেখে নিয়ে আবার টিভির পর্দায় মন দিলেন। মধু জানে লেবার কন্ট্র্যাক্টর হিসেবে কাজের চুক্তির রিনিউয়াল হবে কি না, তা এই বড়সায়েবের একটা কলমের খোঁচায় ঠিক হয়। কিন্তু অফিসের বড়বাবুর সঙ্গে আগে এক-আধ বার এ বাড়ি এসেই ও চট করে বুঝে নিয়েছে, আসল বস ম্যাডামই। ওঁকে খুশি রাখতে পারলেই তার রিনিউয়াল ঠেকায় কে? শুধু তার মতো চুনোপুঁটিরাই নয়, অফিসের অনেক রাঘব বোয়ালও এই লাইনেই খেলে। কিন্তু কেউ কারও কাছে ভাঙতে চায় না টপ সিক্রেটটা। ম্যাডামের নেকনজরে পড়ে যাওয়ার পর আর অসুবিধে হয়নি। ক্রমে নিজের গুণে মধু এখন ম্যাডামের অন্ধের যষ্টির মতো, বাথরুমের পাইপ সারানো থেকে ইঁদুরের বিষ এনে দেওয়া, সব কাজই উনি চোখ বুজে ওর উপর ছেড়ে দেন। মধুও সব সময় জানে না কী ভাবে কাজটা হবে। তবে আজকাল ও কায়দাটা শিখে গেছে। ম্যাডাম যা-ই বলুন না কেন, ও ঘাড়টা একটু হেলিয়ে বলে ‘দেখছি ম্যাডাম।’ বা অন্য দিকে কথা ঘুরিয়ে দেয়।
তবে সব সময় বোঝা যায় না ম্যাডাম খুশি হচ্ছেন কি না। সমস্যা না থাকলেও সমস্যা তৈরি করেন মহিলা। আজ আসার পরই মধুকে মাধবীলতার ঝাড়টার দিকে নিয়ে গেল ম্যাডাম, বলল, “মধু, মাধবীলতাটা চমৎকার বাড়ছে, কিন্তু ফুল ফুটছে না। কী করা যায় বলো তো?”
মধুও খুব অবাক হয়েছিল। এটা ফুলের সিজ়ন। ঝাড়টা ফুলে ফুলে ভরে থাকার কথা। অথচ গাছটায় একটাও ফুল নেই। কী বলা উচিত এখন মধুর? গাছের দিকে তাকিয়ে মাথাটা একটু চুলকোতে চুলকোতে ও বলল, “গাছটার প্রবলেম আছে।”
“কেন ফুল ধরছে না বল তো? এ গাছের কি মেল ফিমেল কিছু থাকে?” একটু আকুল ভাবে ম্যাডাম বললেন।
এ প্রশ্নের উত্তর মধুর কাছে নেই। তবু কোমরে হাত রেখে একটু গভীর ভাবে চিন্তা করার ভঙ্গিতে ও বলল, “দেখছি কী করা যায়।”
আজকাল শেষ রাতে ঘুম ভেঙে যায় মধুময়ের, অজস্র চিন্তা মনে ভিড় করে আসে। নয় নয় করে পঁয়তাল্লিশ হল তার। ছন্দারও বিয়াল্লিশ। ছন্দার ঘুমন্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে কেমন একটা টনটন করে বুক। আর্থ্রাইটিসের ব্যথাটা ক’দিন হল বেড়েছে ছন্দার। লকডাউনে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন উধাও বাজার থেকে। করোনার ওষুধ হিসেবে কিনে হোর্ড করছে লোকে।
“ক্রিমিনাল্স! সব ক’টাকে জেলে পোরা উচিত,” বোধহয় একটু জোরেই হয়ে গেছে স্বগতোক্তিটা। ছন্দা ঘুম-জড়ানো গলায় বলে, “আবার তুমি ঘুমের ঘোরে কথা বলছ?”
আজকাল ঘুমের সমস্যা হচ্ছে খুব। অন্ধকারের মধ্যে খটখটে চোখ মেলে শুয়ে থাকে ও। মনটা হু হু করে ওঠে। সময় ফুরিয়ে আসছে। পনেরো বছরের দাম্পত্যেও তাদের কোনও সন্তান আসেনি। আজকাল অনেক রকম চিকিৎসা বেরিয়েছে। কিন্তু এত বয়সে আর ও সব চেষ্টা করতে লজ্জা করে মধুময়ের। আগে ছন্দা কী সব তাবিজ, কবচ, মাদুলি এনে পরত। ইদানিং ওগুলো পরাও ছেড়ে দিয়েছে ও, লক্ষ করেছে মধুময়। একটা সময় আসে যখন পুরনো অভ্যেস ছেড়ে দিতে হয়। নতুন অভ্যেস তৈরি হয়। একটা কথা খুব চলছে আজকাল। নিউ নর্মাল। নতুন স্বাভাবিকতা দখল নিচ্ছে জীবনযাপনের। খুব একটা ভাল ছাত্র ছিল না কোনও কালেই। কিন্তু আটচল্লিশে এ পারে এসে ঠাকুরদা একটা ছোটখাটো বইয়ের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলেন। তখন অনেক গল্পের বই পড়ত মধুময়। কলেজে পড়ার সময় কবিতা লিখত প্রায়ই। পাল্টে যাওয়ার, পাল্টে দেওয়ার কবিতা। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল কবিতাটা পড়ে কবির সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হয়েছিল অনেক বার। মধুময়ের লেখা দিস্তে দিস্তে কবিতা পুরনো কাগজের সঙ্গে বিক্রি হয়ে ঠোঙা হয়ে গেছে। এখন সে শুধু রোজকার খরচের হিসেব লেখে। জমার ভাঁড়ার শূন্য।
কখন যেন চোখটা আবার লেগে এল। মধুময় স্বপ্ন দেখল, ঘরে তালা লাগিয়ে ছন্দা আর ও একটা গোড়ালি-ডোবা নদীর ক্ষীণপ্রবাহ জলের সঙ্গে আস্তে আস্তে নদীর শেষ প্রান্তটির দিকে চলে যাচ্ছে। বেশ তারিয়ে তারিয়ে স্বপ্নটা দেখছিল সে। হঠাৎ ‘ও মধু ও মধু’— বিকট শব্দে মোবাইলটা বেজে উঠল। ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে ফোনটা ধরল ও। হেড লেবারার ছগনের ফোন, খবর দিচ্ছে শম্ভু বলে লেবারটার এক্সপায়ারি হয়ে গেছে। বেশ কয়েক দিন হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে ছিল। ওর বৌটাও জ্বরে বেহুঁশ। ছোট বাচ্চাটা ঘরে মা-বাবাকে না দেখে হেঁচকি তুলে কাঁদছে। এক বার কি একটু আসতে পারে মধু?
মেডিক্যালে গিয়েও লাভ হল না। কোভিডে মরলে হাজার গ্যাঁড়াকল। বডি নেওয়ার নিয়ম নেই। শম্ভুর ক্ষেত্রে নেওয়ারও কেউ নেই। অচৈতন্য বৌটাও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, জানেও না যে স্বামী মারা গেছে। হাসপাতালের পিছনেই শম্ভু, ছগন, আরও অনেক লেবারের ঘর। মাস্ক ভেদ করে কাদা, মল-মূত্রের গন্ধ ধাক্কা দিল নাকে। বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। শম্ভুর দাওয়ায় ক’টি দেহাতি বৌ বসে। এক পাশে কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে শম্ভুর তিন বছরের ছেলে। মলিন একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর ইজের পরনে, নাকের শিকনি গড়িয়ে দাগ রেখেছে গালের উপর। ছগন জানিয়েছিল, কেউ ওর দায়িত্ব নিতে চাইছে না। এমনি অবস্থায় হলে নিত। কিন্তু সবার ঘরেই বালবাচ্চা আছে। বাচ্চাটার বাপ তো মরেছে, মা-টাও বাঁচবে কি না ঠিক নেই। ওরও সংক্রমণ হয়েছে কিনা কে জানে? এই বাজারে আপনি বাঁচলে বাপের নাম…
মধুময় ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে তুলে নিল কোলে। পিছনে পড়ে রইল পা-ভাঙা পুতুলটা। থাকুক। পুরনো অভ্যেস ছাড়তে ছাড়তেই বড় হয় মানুষ। মেডিক্যালের পিছনের বস্তি থেকে মধুময়ের এক কামরার ভাড়া বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়, তবু বাচ্চা কোলে হেঁটে বেশ খানিকটা। জোরে জোরে পা চালাল মধুময়। বাচ্চাটার জ্বর রয়েছে একটু। ওর জ্বরতপ্ত মাথাটা পরম নিশ্চিন্তে এলিয়ে আছে মধুময়ের কাঁধে। ভাদ্রের খররোদে শ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে মধুময়ের, কারণ মুখে মাস্ক। হাঁপ ধরছে। বাচ্চাটার মুখের লালা ভিজিয়ে দিচ্ছে মধুময়ের শার্টের কাঁধ। বেলা পড়ে আসছে। বিকেলের রোদ এসে পড়ছে ওর মুখে। দমবন্ধ লাগছে। মধুময় এক টানে মুখোশটা খুলে ফেলল মুখ থেকে। আরোপিত সমস্ত নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। আঃ, কী আরাম! এক ঝলক টাটকা বাতাস এসে ঝাপটা মারল মুখে। কোথায় যেন বৃষ্টি আসছে। মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ উঠছে একটা। বাচ্চাটা এখনও ঘুমে কাদা। কোনও স্বপ্ন দেখে হেসে উঠল যেন। ঘুমোক বেচারা।
‘ও মধু, ও মধু, আই লাভ ইউ’— পকেটে বাজছে মোবাইলটা। বাজুক। রিংটোনটা পাল্টে নিতে হবে এ বার। বড় বড় পায়ে হেঁটে রোদ্দুর হওয়ার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল মধুময় বিশ্বাস। মামাশ্বশুর-মামিশাশুড়ি, সায়েব, ম্যাডাম, পিডব্লিউডি-র রায়, ড্রাগনফ্রুট, মাধবীলতা, সাদাজাম আর জমা-খরচের হিসেব আর তাকে ছুঁতে পারল না।
ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল
ফ
োনটা বাজছে। ‘ও মধু, ও মধু, আই লাভ ইউ’— ফোনের রিংটোনটা নিজেরই সেট করা, নামের সঙ্গে মিলিয়ে। এই নিয়ে চতুর্থ বার বাজল ফোনটা। চলন্ত বাসে গুটিকয়েক লোক। সকলেই মাস্ক পরে থাকায় মুখভাব বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বাসে ওঠা থেকে সকলে যে অপাঙ্গে ওকেই দেখছে বেশ কৌতূহল নিয়ে, এ ব্যাপারে মধু নিঃসংশয়। তার প্রথম কারণ মোবাইল ফোনটার পনেরো মিনিটে চার বার বাজা এবং ওর না ধরা। দ্বিতীয় কারণটাও ওর হাতেই— টবে হাতদুয়েক লম্বা হৃষ্টপুষ্ট গাছটায় কিম্ভূত একটা ফল ধরে রয়েছে, যেটা পেকে প্রায় পড়ব পড়ব করছে। একটু অসাবধান হলেই ওটা পড়ে যেতে পারে, এই ভয়েই ফোনটা এত ক্ষণ ধরেনি। কিন্তু নাঃ, এ বার ধরতেই হবে। রায় লোকটা নাছোড়বান্দা।
রায় পিডব্লিউডি-র ইঞ্জিনিয়ার। মাথাজোড়া টাক, বেঁটেখাটো চেহারা। মুখখানা সব সময় হাসি-হাসি। ওকে দেখলে হিজিবিজবিজের কথা মনে পড়ে। কথাও চিনি মাখানো, কিন্তু ভিতরে ভিতরে বদের বাসা। ‘হিজিবিজবিজ কলিং’ দেখে কোলের উপর গাছটা সন্তর্পণে চেপে রেখে ফোনটা ধরে মধু বলল, “বলুন স্যর।”
“ফোনটা হাতের কাছে থাকে না ভাই তোমার?” মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করছে রায়।
“সাইলেন্ট ছিল স্যর, শুনতে পাইনি, বলুন।”
“আমি আর কী বলব মধু, বলবে তো তুমিই। সাইটে আরও চারটে লেবার লাগবে, আগেই তো বলেছি তোমাকে। রেগুলার লেবারগুলোই ফাঁকি মারছে। সাইট থেকে গতকাল বলল তিনটে অ্যাবসেন্ট...” একটু অধৈর্য রায়ের গলা।
“দেখছি স্যর কেন আসেনি। আর স্যর, আমার অনেকগুলো পেমেন্ট বাকি, একটু যদি দেখেন।”
“মধু, পেমেন্ট পাওনি, এ রকম কি ঘটেছে কখনও?” কথা শেষ হওয়ার আগেই কেড়ে নিচ্ছে রায়, “বড়সাহেব বলে দিয়েছেন, প্রসেসিং-এ কিছুটা ডিলে হবে। যা সিচুয়েশন এখন। ধৈর্য ধরতে হবে।”
প্রবল ইচ্ছে হয় মধুর পাল্টা জবাব দেওয়ার, ‘ধৈর্য আপনাকেও ধরতে হবে স্যর। লেবারগুলো তো অটোমেটিক পুতুল নয় যে, রোবটের মতো কাজ করতে আসবে সব পরিস্থিতিতেই। প্রত্যেকেরই সুবিধে-অসুবিধে আছে।’ সিচুয়েশনের কথা বলছে শালা! যেন ভাইরাসের উৎপাত শুধু ওকেই ঝামেলায় ফেলেছে, আর কারও কোনও প্রবলেম নেই।
কিন্তু মুখে কিছু বলল না মধু। এক জন ঠিকাদারের মুখে ও সব কথা মানায় না। মুখ বুজে লেবার খাটানো, পেমেন্ট নেওয়া, কাজ তুলে দেওয়াই তার কাজ। “দেখছি স্যর, কী করা যায়,” বলে ফোনটা রেখে দিল ও।
‘হয়ে যাবে ম্যাডাম’, ‘করে দিচ্ছি স্যর’ ওর মুখের লব্জ। কাজটা আদৌ উতরোবে কি না যখন জানা থাকে না, তখনও এই রকম ঠেকনা দেওয়া কথায় খুব কাজ দেয়। যাকে বলছে সেও নিশ্চিন্ত হয়, নিজেরও একটা আত্মতৃপ্তি হয়।
মধুময় বিশ্বাস নামে ওকে প্রায় কেউই ডাকে না, শুধু শ্বশুরবাড়ির লোক ছাড়া। শ্বশুর-শাশুড়ি বহু দিন গত, থাকার মধ্যে দুই শালা আর এক মামাশ্বশুর। বয়স হলেও মামাশ্বশুরের প্রতাপ অব্যাহত। এক কালে দারোগা ছিলেন বলে সবাইকেই ক্রিমিনাল মনে করেন। অনেক কাল দেখাসাক্ষাৎ না থাকার পর হালে একটা বিশেষ কারণে মধু নিজের গরজেই আবার যোগাযোগ করেছে।
দু’দিন আগে ও বারুইপুরে গিয়েছিল মামাশ্বশুরের বাড়িতে। ট্রেন চালু থাকলে যাওয়াটা কোনও ব্যাপার নয়। হাঁটাপথে কলেজ স্ট্রিটের বাড়ি থেকে শিয়ালদা এসে সাউথের ট্রেনে চাপলেই মিনিট চল্লিশেক। কিন্তু এখন ট্রেন বন্ধ। করোনা আতঙ্কে কেউ কারও বাড়িও বেড়াতে যায় না। মধুকে তাও যেতে হয়েছিল বিশেষ কারণে। ঘণ্টাদুয়েক বাস-জার্নির পর বেলা বারোটা নাগাদ যখন পৌঁছল, তখন খিদে পেয়েছিল মারাত্মক। পেটের মধ্যে ভুটভাট আওয়াজ আর গ্যাসের ব্যথা চাগাড় দিচ্ছিল। মামিশাশুড়ি দরজা খুলে খুব দায়সারা ভাবে জিজ্ঞেস করেছিল চা খাবে কি না। শুনেই আরও অম্বল হয়ে যাচ্ছিল। ক্ষীণ স্বরে বলেছিল, “নাঃ, একটু জল খাব।”
মামাশ্বশুর ঝাঁকিদর্শন দিয়েছিলেন মুখে মাস্ক আর বর্মের মতো প্লাস্টিকের স্বচ্ছ মুখোশ পরে। মাস্কের আড়ালে ওঁর ঝাঁটার মতো গোঁফজোড়া দেখা যায়নি, কিন্তু মুখোশের আড়ালেও চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করছিল।
আগে বলা ছিল বলে তিন-চারটে রেয়ার গাছ রেডি করেই রেখেছিলেন ওঁরা। কিন্তু দু’টোর বেশি নেওয়া যাবে না। জীবনে এই প্রথম চারটে হাত নেই বলে বেশ কষ্ট হচ্ছিল মধুর। ভেবেচিন্তে ড্রাগনফ্রুট গাছটাই পছন্দ করেছিল ও। আর সাদাজামটা। ওটা দেবে বলে কমিট করেছে ম্যাডামকে।
“ফল আসতে তো দেরি হবে?” খানিক কথা চালাবার জন্যই মধু প্রশ্ন করেছিল মিউমিউ করে।
“সেটা নির্ভর করে দেরি বলতে তুমি কী বোঝো তার উপর। যদি কালকেই চাও তবে বলব, না, ও রকম ইনস্ট্যান্ট ফল অসম্ভব। কিন্তু নেক্সট ইয়ারে ইয়া তাগড়া জাম ফলবে, গ্যারান্টি দিচ্ছি,” মামাবাবু মুখোশের মধ্যে দিয়ে হুঙ্কার ছাড়ছিলেন।
ইনস্ট্যান্ট ফলই মধুর দরকার। চক্ষুলজ্জায় সেকথা ও বলতে পারেনি। যাঁকে খুশি করার জন্য এত দূর ঠেঙিয়ে আসা, সেই ম্যাডামের সঙ্গে জাম-বিষয়ক কথোপকথন মনে পড়ে গেছিল। ও বলেছিল, “ম্যাডাম, আপনার এত গার্ডেনের শখ। আমি আমার মামাশ্বশুরকে বলে রেখেছি, ওঁর ওখান থেকে একটা সাদাজামের গাছ আপনার জন্য এনে দেব।”
“সাদাজাম? সে আবার কেমন খেতে?” ম্যাডাম একটু সরু চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন।
“দারুণ খেতে ম্যাডাম, কালোজামের চেয়ে অনেক বেটার,” এমন ভাবে বলেছিল, যেন সারা জীবন সাদাজামই খেয়ে আসছে ও। আসলে ওরও সঠিক জানা নেই কেমন খেতে। তাতে কী! কনফিডেন্সটাই আসল কথা।
ভাবতে ভাবতে বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল মধু। হঠাৎ শুনল, “আর মিষ্টি যেন গুড়! এ বার কালোজাম একটাও হল না। সব ভাইরাসে খেয়ে গেল। কিন্তু সাদাজামগুলো দিব্যি হল। করোনা ওদের কাবু করতে পারল না।” মামিশাশুড়ি শাড়ির আঁচলটাকেই নাক-মুখের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে মাস্কের মতো করে তার ভেতর দিয়েই কথা বলছেন গুঙিয়ে গুঙিয়ে। সাদাজামে করোনা লাগল না কেন, এ বিষয়ে হয়তো আরও খানিক ক্ষণ কথা চালানো যেত, কিন্তু গাছদু’টো পেয়ে যাওয়ার পর আর জড়ভরতের মতো মুখোশ পরে ওখানে বসে থাকার মানে হয় না।
“আচ্ছা, আসি তা হলে।”
“এসো। এমন অসময়ে এলে মধুময়, তোমাকে একটু মিষ্টিমুখ করাতেও পারলাম না। করোনার জন্য সব মিষ্টির দোকান বন্ধ।”
আজকে দু’টো গাছ এক সঙ্গে আনতে পারেনি মধু। ড্রাগনফ্রুটটা কোনও রকমে এনেছে। সাদাজামটা পরের বার আনবে। ম্যাডামদের বাড়ি ম্যাডক্স স্কোয়ারে। মাঠটা ওঁদের দোতলার বারান্দা থেকে দেখা যায়। ঢোকার মুখে একটা অর্ধচন্দ্রাকার লোহার গেটে মাধবীলতা ঝাঁকড়া হয়ে আছে। ম্যাডামের বয়স পঞ্চাশের উপর হবে নিশ্চয়ই। কলপ করা চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা। একটা ফুলছাপ হাউসকোট পরে কাজের মেয়েকে কী একটা নির্দেশ দিচ্ছিলেন উনি। একটু খান্ডারনি টাইপ, সব সময়ই তিরিক্ষি। আজ অবশ্য মুড ভালই মনে হচ্ছে। ওকে দেখে খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, “তুমি এসে গেছ, মধু? খুব ভাল হয়েছে। হাতে ওটা কী? সাদাজাম এটাই না কি?” এত সহজ ভাবে বলছেন, যেন শনিবার সকালে ড্রাগনফ্রুটের এই অদ্ভুত গাছটা বয়ে নিয়ে ওর এ বাড়িতে আসাটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। মধু দোতলার ব্যালকনির এক কোণে গাছটা রেখে দিল। স্যরও আজ বাড়িতে, ব্যালকনির পাশের ঘরটায় বসে সিএনএন দেখছেন। আড়চোখে মধুকে একটা মাছি দেখার ভঙ্গিতে দেখে নিয়ে আবার টিভির পর্দায় মন দিলেন। মধু জানে লেবার কন্ট্র্যাক্টর হিসেবে কাজের চুক্তির রিনিউয়াল হবে কি না, তা এই বড়সায়েবের একটা কলমের খোঁচায় ঠিক হয়। কিন্তু অফিসের বড়বাবুর সঙ্গে আগে এক-আধ বার এ বাড়ি এসেই ও চট করে বুঝে নিয়েছে, আসল বস ম্যাডামই। ওঁকে খুশি রাখতে পারলেই তার রিনিউয়াল ঠেকায় কে? শুধু তার মতো চুনোপুঁটিরাই নয়, অফিসের অনেক রাঘব বোয়ালও এই লাইনেই খেলে। কিন্তু কেউ কারও কাছে ভাঙতে চায় না টপ সিক্রেটটা। ম্যাডামের নেকনজরে পড়ে যাওয়ার পর আর অসুবিধে হয়নি। ক্রমে নিজের গুণে মধু এখন ম্যাডামের অন্ধের যষ্টির মতো, বাথরুমের পাইপ সারানো থেকে ইঁদুরের বিষ এনে দেওয়া, সব কাজই উনি চোখ বুজে ওর উপর ছেড়ে দেন। মধুও সব সময় জানে না কী ভাবে কাজটা হবে। তবে আজকাল ও কায়দাটা শিখে গেছে। ম্যাডাম যা-ই বলুন না কেন, ও ঘাড়টা একটু হেলিয়ে বলে ‘দেখছি ম্যাডাম।’ বা অন্য দিকে কথা ঘুরিয়ে দেয়।
তবে সব সময় বোঝা যায় না ম্যাডাম খুশি হচ্ছেন কি না। সমস্যা না থাকলেও সমস্যা তৈরি করেন মহিলা। আজ আসার পরই মধুকে মাধবীলতার ঝাড়টার দিকে নিয়ে গেল ম্যাডাম, বলল, “মধু, মাধবীলতাটা চমৎকার বাড়ছে, কিন্তু ফুল ফুটছে না। কী করা যায় বলো তো?”
মধুও খুব অবাক হয়েছিল। এটা ফুলের সিজ়ন। ঝাড়টা ফুলে ফুলে ভরে থাকার কথা। অথচ গাছটায় একটাও ফুল নেই। কী বলা উচিত এখন মধুর? গাছের দিকে তাকিয়ে মাথাটা একটু চুলকোতে চুলকোতে ও বলল, “গাছটার প্রবলেম আছে।”
“কেন ফুল ধরছে না বল তো? এ গাছের কি মেল ফিমেল কিছু থাকে?” একটু আকুল ভাবে ম্যাডাম বললেন।
এ প্রশ্নের উত্তর মধুর কাছে নেই। তবু কোমরে হাত রেখে একটু গভীর ভাবে চিন্তা করার ভঙ্গিতে ও বলল, “দেখছি কী করা যায়।”
আজকাল শেষ রাতে ঘুম ভেঙে যায় মধুময়ের, অজস্র চিন্তা মনে ভিড় করে আসে। নয় নয় করে পঁয়তাল্লিশ হল তার। ছন্দারও বিয়াল্লিশ। ছন্দার ঘুমন্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে কেমন একটা টনটন করে বুক। আর্থ্রাইটিসের ব্যথাটা ক’দিন হল বেড়েছে ছন্দার। লকডাউনে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন উধাও বাজার থেকে। করোনার ওষুধ হিসেবে কিনে হোর্ড করছে লোকে।
“ক্রিমিনাল্স! সব ক’টাকে জেলে পোরা উচিত,” বোধহয় একটু জোরেই হয়ে গেছে স্বগতোক্তিটা। ছন্দা ঘুম-জড়ানো গলায় বলে, “আবার তুমি ঘুমের ঘোরে কথা বলছ?”
আজকাল ঘুমের সমস্যা হচ্ছে খুব। অন্ধকারের মধ্যে খটখটে চোখ মেলে শুয়ে থাকে ও। মনটা হু হু করে ওঠে। সময় ফুরিয়ে আসছে। পনেরো বছরের দাম্পত্যেও তাদের কোনও সন্তান আসেনি। আজকাল অনেক রকম চিকিৎসা বেরিয়েছে। কিন্তু এত বয়সে আর ও সব চেষ্টা করতে লজ্জা করে মধুময়ের। আগে ছন্দা কী সব তাবিজ, কবচ, মাদুলি এনে পরত। ইদানিং ওগুলো পরাও ছেড়ে দিয়েছে ও, লক্ষ করেছে মধুময়। একটা সময় আসে যখন পুরনো অভ্যেস ছেড়ে দিতে হয়। নতুন অভ্যেস তৈরি হয়। একটা কথা খুব চলছে আজকাল। নিউ নর্মাল। নতুন স্বাভাবিকতা দখল নিচ্ছে জীবনযাপনের। খুব একটা ভাল ছাত্র ছিল না কোনও কালেই। কিন্তু আটচল্লিশে এ পারে এসে ঠাকুরদা একটা ছোটখাটো বইয়ের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলেন। তখন অনেক গল্পের বই পড়ত মধুময়। কলেজে পড়ার সময় কবিতা লিখত প্রায়ই। পাল্টে যাওয়ার, পাল্টে দেওয়ার কবিতা। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল কবিতাটা পড়ে কবির সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হয়েছিল অনেক বার। মধুময়ের লেখা দিস্তে দিস্তে কবিতা পুরনো কাগজের সঙ্গে বিক্রি হয়ে ঠোঙা হয়ে গেছে। এখন সে শুধু রোজকার খরচের হিসেব লেখে। জমার ভাঁড়ার শূন্য।
কখন যেন চোখটা আবার লেগে এল। মধুময় স্বপ্ন দেখল, ঘরে তালা লাগিয়ে ছন্দা আর ও একটা গোড়ালি-ডোবা নদীর ক্ষীণপ্রবাহ জলের সঙ্গে আস্তে আস্তে নদীর শেষ প্রান্তটির দিকে চলে যাচ্ছে। বেশ তারিয়ে তারিয়ে স্বপ্নটা দেখছিল সে। হঠাৎ ‘ও মধু ও মধু’— বিকট শব্দে মোবাইলটা বেজে উঠল। ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে ফোনটা ধরল ও। হেড লেবারার ছগনের ফোন, খবর দিচ্ছে শম্ভু বলে লেবারটার এক্সপায়ারি হয়ে গেছে। বেশ কয়েক দিন হাসপাতালে ভেন্টিলেশনে ছিল। ওর বৌটাও জ্বরে বেহুঁশ। ছোট বাচ্চাটা ঘরে মা-বাবাকে না দেখে হেঁচকি তুলে কাঁদছে। এক বার কি একটু আসতে পারে মধু?
মেডিক্যালে গিয়েও লাভ হল না। কোভিডে মরলে হাজার গ্যাঁড়াকল। বডি নেওয়ার নিয়ম নেই। শম্ভুর ক্ষেত্রে নেওয়ারও কেউ নেই। অচৈতন্য বৌটাও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, জানেও না যে স্বামী মারা গেছে। হাসপাতালের পিছনেই শম্ভু, ছগন, আরও অনেক লেবারের ঘর। মাস্ক ভেদ করে কাদা, মল-মূত্রের গন্ধ ধাক্কা দিল নাকে। বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। শম্ভুর দাওয়ায় ক’টি দেহাতি বৌ বসে। এক পাশে কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে শম্ভুর তিন বছরের ছেলে। মলিন একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর ইজের পরনে, নাকের শিকনি গড়িয়ে দাগ রেখেছে গালের উপর। ছগন জানিয়েছিল, কেউ ওর দায়িত্ব নিতে চাইছে না। এমনি অবস্থায় হলে নিত। কিন্তু সবার ঘরেই বালবাচ্চা আছে। বাচ্চাটার বাপ তো মরেছে, মা-টাও বাঁচবে কি না ঠিক নেই। ওরও সংক্রমণ হয়েছে কিনা কে জানে? এই বাজারে আপনি বাঁচলে বাপের নাম…
মধুময় ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে তুলে নিল কোলে। পিছনে পড়ে রইল পা-ভাঙা পুতুলটা। থাকুক। পুরনো অভ্যেস ছাড়তে ছাড়তেই বড় হয় মানুষ। মেডিক্যালের পিছনের বস্তি থেকে মধুময়ের এক কামরার ভাড়া বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়, তবু বাচ্চা কোলে হেঁটে বেশ খানিকটা। জোরে জোরে পা চালাল মধুময়। বাচ্চাটার জ্বর রয়েছে একটু। ওর জ্বরতপ্ত মাথাটা পরম নিশ্চিন্তে এলিয়ে আছে মধুময়ের কাঁধে। ভাদ্রের খররোদে শ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে মধুময়ের, কারণ মুখে মাস্ক। হাঁপ ধরছে। বাচ্চাটার মুখের লালা ভিজিয়ে দিচ্ছে মধুময়ের শার্টের কাঁধ। বেলা পড়ে আসছে। বিকেলের রোদ এসে পড়ছে ওর মুখে। দমবন্ধ লাগছে। মধুময় এক টানে মুখোশটা খুলে ফেলল মুখ থেকে। আরোপিত সমস্ত নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। আঃ, কী আরাম! এক ঝলক টাটকা বাতাস এসে ঝাপটা মারল মুখে। কোথায় যেন বৃষ্টি আসছে। মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ উঠছে একটা। বাচ্চাটা এখনও ঘুমে কাদা। কোনও স্বপ্ন দেখে হেসে উঠল যেন। ঘুমোক বেচারা।
‘ও মধু, ও মধু, আই লাভ ইউ’— পকেটে বাজছে মোবাইলটা। বাজুক। রিংটোনটা পাল্টে নিতে হবে এ বার। বড় বড় পায়ে হেঁটে রোদ্দুর হওয়ার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল মধুময় বিশ্বাস। মামাশ্বশুর-মামিশাশুড়ি, সায়েব, ম্যাডাম, পিডব্লিউডি-র রায়, ড্রাগনফ্রুট, মাধবীলতা, সাদাজাম আর জমা-খরচের হিসেব আর তাকে ছুঁতে পারল না।