ছবি: কুনাল বর্মণ
অপালা আমাকে এতখানি প্রশংসা এনে দেবে ভাবিনি। এই তো, আমার সামনেই, চল্লিশ-বিয়াল্লিশ জোড়া মুগ্ধ চোখের দৃষ্টিতে যেন স্নান করছে অপালা। তার পশ্চাৎপটের সবুজে নানা অনুপানে ও অনুপাতে মিশে আছে জলপাই, শ্যাওলা, সমুদ্র এবং পাতিলেবুর রং। দু’পাশের প্রাগৈতিহাসিক ধূসর-বাদামি বৃক্ষরাজি, পিছনের অরণ্যানী এবং তলায় সফেন সমুদ্র পরস্পরের সঙ্গে মিশে একাকার। মাঝের শূন্যতা জুড়ে অপালা। আশ্চর্য মৃদু এক মায়াবী আলোয় তার মুখমণ্ডল স্নিগ্ধোজ্জ্বল। তার চোখ দু’টিতে গভীর প্রশান্তি, মৃদুবদ্ধ ওষ্ঠাধরে পরিতৃপ্তি, দু’হাত প্রসারিত, রক্তাভ করতল, চাঁপার কলির মতো আঙুলে নির্দেশমুদ্রা, তার গঙ্গাজলরঙা শাড়ির লালপাড়, পায়ের আলতা, কপালের এবং সিঁথির সিঁদুরের লাল যেন গলন্ত এবং ব্যাপনরত— একটি নির্দিষ্ট গতিতে সমসত্ত্ব প্রক্ষেপে সমস্ত লাল মিশে যাচ্ছে চারপাশের সবুজের সঙ্গে, যেন অদৃশ্য এক বর্ষণে ধুয়ে যাচ্ছে তার সমস্ত এয়োতিচিহ্ন। বৃক্ষলতার এক নৈসর্গিক উদ্বন্ধনে সে ঝুলন্ত। তার আর কষ্ট নেই। কাউকে কৈফিয়ত দেওয়ার নেই। কিছু পাওয়ার নেই।
এই আমার অপালা। অয়েল অন ক্যানভাস। পাঁচ ফুট বাই সাড়ে তিন ফুট।
******
আমি অরণি মিত্র। বয়স বত্রিশ। আমি একজন প্রতিশ্রুতিমান উঠতি চিত্রকর। এই মুহূর্তে আমি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে, আমার একক প্রদর্শনীর উদ্বোধনে। এখানে আরও চব্বিশটি নানা মাপের তৈলচিত্রের সঙ্গে রয়েছে অপালাও। ওটা বিক্রির জন্য নয়।
এখন আমাকে এই এগজিবিশন নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতে হবে। গত বছর লন্ডনে একটা আর্ট ওয়ার্কশপে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। সেখানে টেট ব্রিটেন আর্ট মিউজিয়ামের গ্যালারিতে প্রথম স্যর জন এভারেট মিলিয়ার আঁকা ‘ওফেলিয়া’ ছবিটি দেখা, সেখান থেকেই ‘অপালা’ আঁকার অনুপ্রেরণা। এই ছবি স্যর জনের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্যও বটে।
এই বক্তব্যটুকু পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে প্রেসকে বলার জন্য। ঘটনার পিছনের আসল ঘটনা আরও এক যুগ আগের। সে অতীত না থাকলে ‘ওফেলিয়া’ এ ভাবে ঝাঁকিয়ে দিতে পারত না। এই ছবিটি প্রথম বার সামনে থেকে দেখে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলাম! এ ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, ছবিটিতে শেক্সপিয়রের নাটক ‘হ্যামলেট’-এর চরিত্র ওফেলিয়া ডেনমার্কের গভীর এক অরণ্যের মাঝে, গান গাইতে-গাইতে জলে ডুবে যাচ্ছে। তার চোখদু’টি বন্ধ, তাকে দেখলে দু’হাত ছড়িয়ে জলে ভেসে ওঠা এক মৃতা রমণী বলে মনে হয়। ছবিটি দেখামাত্রই আমার চোখের সামনে এক যুগ আগের সমস্ত ঘটনা সিনেমার ছবির মতো ভেসে ওঠে।
******
তখন আমি উনিশ। উত্তর কলকাতার হরি ঘোষ স্ট্রিট ধরে খানিক এগিয়ে ডান দিকে মসজিদবাড়ি স্ট্রিট। এই রাস্তায় বাঁ দিকে বড় ফটক, দু’দিকে থামের মাথায় সিংহওয়ালা বাড়িটাই সিংহিবাড়ি। সেখানেই মিন্টিকে টিউশনি পড়াতে যেতাম। মসজিদবাড়ি স্ট্রিট পর পর দু’বার চুলের কাঁটার মতো ভাঁজ খেয়ে যে রাস্তাটায় গিয়ে পড়েছে, তার নাম ঈশ্বর মিত্র লেন। সেখানে আমি থাকতাম। আশপাশের পাড়ায় থাকত আমার ছোটবেলার বন্ধু, বোতাম, প্যাটন, ডাবু, রন্টা, পুটাই-রা। ওদের মধ্যে হরি ঘোষ স্ট্রিটের বোতাম আমার চেয়ে বছরখানেকের ছোট হলেও ওর সঙ্গেই আমার জমত বেশি।
সিংহিবাড়ির ব্যাপারই ছিল আলাদা। ভিতরে মার্বেল পাথরের পরি, ভাঙা ফোয়ারা, রাধাবিনোদের মন্দির, সামনে টানা নাটমন্দির, বিশাল মোটা থাম, কড়ি-বরগায় ধবধবে নোটন পায়রার ঝাঁক— চোখ ফেরানোই যেত না। তখন ক্লাস ফাইভের মিন্টিকে অঙ্ক কষাতে যেতাম। মিন্টি ও বাড়ির বড় ছেলে রণজয় সিংহির ছোট মেয়ে। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করেছিলাম বলে এলাকায় পরিচিতি ছিল। সেখান থেকেই গল্পের শুরু। মিন্টির মা-ই রোজ চা দিয়ে যেত। এক দিন উনি ছিলেন না। সে দিন মিন্টির কাকিমা, যাকে আমরা অপুবউদি বলে চিনতাম, উনি চা দিতে এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। অপুবউদি রণজয়দার ছোটভাই দুর্জয়ের বউ। তাঁর টানা-টানা চোখ, পানের মতো মুখ, পুরন্ত ঠোঁট, লম্বাটে দাঁত আমায় একেবারে পেড়ে ফেলল। আমি দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে অপুবউদির প্রেমে পড়ে গেলাম।
তখন বসন্তকাল। মিন্টির অ্যানুয়াল হয়ে ছুটি পড়ে গিয়েছে, তবু নতুন ক্লাসের পড়া আগাম এগিয়ে রাখার অছিলায় মাঝে-মাঝেই দুপুরে হানা দিতাম। তার পর এমন হল, মিন্টিকে কাটিয়ে সোজা বউদির সঙ্গেই দেখা করতাম। ছাদে, নাচঘরে, বাগানে, বারমহলের পিছনে— অত বড় বাড়িতে জায়গার তো অভাব ছিল না। আমাদের প্রেম হল, প্রেম গভীর হল। সেই আমার প্রথম সত্যিকারের প্রেম। ফাঁকতালে শোয়ার কোনও উদ্দেশ্য আমার ছিল না, শুইওনি।
কিন্তু অপুবউদি যেন দিন দিন কেমন শরীরী হয়ে উঠতে চাইছিল! খালি বিছানার দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত, বউদির আঁচল খসে পড়লেই দেখা যেত বুকের উপরের দু’টো হুক খোলা, কথা বলতে-বলতে গায়ের কাছে ঘেঁষে আসা, কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কানের লতি ছুঁয়ে দেওয়া, এমন আরও কত কী! আমি সাড়া না দিলে অভিমান করে বলত, ‘‘তুমি আমায় ভালবাস না, না? আমার কিন্তু অনেক ঘুমের ওষুধ জমানো আছে, জানো...’’ বলতে-বলতে ঠোঁট ফুলে উঠত অপুবউদির। আমার অস্বস্তি হত। আমি তো লুকিয়ে মধু খেতে যাইনি! আমার তো শরীর-বিষয়ক তাড়া ছিল না কোনও! আমি তো জানতাম, অপুবউদি তার স্বামীকে ভালবাসে না, সে এক দিন আমার সঙ্গে পালাবে আর ডিভোর্স করবে তার স্বামী দুর্জয় সিংহিকে। আমি কেন লুকিয়ে-চুরিয়ে শরীর পাওয়ার লোভ করতে যাব! কিন্তু আমার প্রতিরোধ টিকছিল না।
এক দিন দুপুর। বসন্তের রোদে-হাওয়ায় গোপন ফিসফাস। ক’দিন পরেই দোল। সিংহিবাড়িতে রাধাবিনোদ প্রতিষ্ঠার দেড়শো বছর পূর্তি উৎসব। বাড়িতে ভারা বেঁধে মিস্তিরিরা কাজ করছে, বাড়ি রং হচ্ছে। বাড়ির লোক কেউ নেই, সকলেই নানা আয়োজনে এদিক-সেদিক গিয়েছে। সেই দুপুরে বুঝলাম, অপুবউদিকে আটকানো যাবে না। দামি গোলাপ আতর আর বেনারসি জর্দার গন্ধ নিয়ে অজগরের মতো সাপটে ধরে আমাকে সে তার দোতলার শোওয়ার ঘরের বিছানায় নিয়ে গিয়ে তুলল। আমার মনটা আরও আড় হয়ে উঠল, অন্যের বিছানায় কেন আমি... কিন্তু আর পারছিলাম না। বাধা দেওয়ার মনটা অবশ হয়ে আসছিল, আর নিজের ভিতরে এক ঘুমন্ত বাঘের জেগে-ওঠা টের পাচ্ছিলাম।
নিজেকে নিয়তির হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলাম, বুঝেছিলাম যে আমার নিস্তার নেই। নিজের পোশাকের ভার কমিয়ে ধীরে ধীরে হালকা হচ্ছে অপুবউদি, এমন সময় হঠাৎ বিছানার চাদরে আলোছায়ার নকশা সামান্য বদলে গেল। চমকে জানালার বাইরে তাকিয়েই অস্ফুটে চিৎকার করে গায়ের কাপড় টেনে নিজেকে সরিয়ে নিল অপুবউদি। তাকিয়ে দেখলাম, জানলার বাইরে লাগানো ভারায় এক মাঝবয়সি মিস্ত্রি হাতের কাজ থামিয়ে চিত্রার্পিতের মতো ঘরের ভিতরে তাকিয়ে আছে। তড়িদাহত মানুষের মতো ছিটকে বিছানা থেকে উঠে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে-ছুটতে সিংহিবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। তখন আমার সব মোহ কেটে গিয়েছে। শুধু মনে হচ্ছে, পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার জন্য আমার এলাকায় বেশ সুনাম আছে, আমি চারটে টিউশনি করি, আজকের কথা জানাজানি হওয়ার পর কি সেগুলো থাকবে? আমার ইচ্ছে করছিল নিজের গালে চড় মারতে।
উফ্ ভগবান! এ কী হল! কাউকে কিছু বলতে না পেরে সারা রাত ওই এক কথা নিজের মনে বলে গেলাম। পেট ভাল নেই বলে রাতে খেলাম না। সারা রাত খিদে-তেষ্টায় শুকিয়ে আসা শরীর নিয়ে বলে গেলাম, ‘‘একটা কিছু করো, ঠাকুর!’’ তার পর ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে-সঙ্গে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
******
আমার ধর্মপ্রাণ ঠাকুরদাদা বলতেন, ‘‘তাঁকে তেমন ভাবে ডাকতে পারলে অনেক অসম্ভব ঘটনাও ঘটে... বিশ্বাস না হয়, জানপ্রাণ লাগিয়ে ডেকে দেখ!’’
আমার ডাকে কী হল বুঝলাম না, সকালে উঠেই দুঃসংবাদ পেলাম, অপুবউদি আত্মহত্যা করেছেন!
হাত-পা কাঠ হয়ে গেল। মনে হল, আমাকে যে ভাবে চেয়েছিল, সে ভাবে পায়নি বলেই কি! আর ঘুমের ওষুধগুলো সত্যিই ছিল তা হলে! প্রথমে মনে হল, পালিয়ে যাই। তার পর মনে হল, তাতে সন্দেহটা যেচে নিজের উপরে ডেকে আনা হবে। ভাবলাম, যদি এ ব্যাপারে আদৌ যুক্ত না থাকতাম, তা হলে কী করতাম! এমন একটা খবর শুনে ছুটে যেতাম নিশ্চয়ই। মনের ভিতর থেকে কে যেন সাহস জোগাল। গেলাম, দেখলাম অপুবউদির মৃতদেহ। স্নানঘরের বাথটবে চিত হয়ে আধশোয়া। মাথা আর হাত দু’টো বাইরে বেরিয়ে। শ্যাওলা-ধরা বাথটব আর দেওয়ালে চতুর্দিক সবুজ, মাঝে যেন সবুজে মিশে শুয়ে আছে অপুবউদি। তার মুখের অন্য পাশটা দেখা যাচ্ছে না। কপাল আর সিঁথির সিঁদুর জলে ধুয়ে গড়িয়ে নামছে নাক-গাল বেয়ে। কেউ একটা লালপাড় শাড়ি ওই বাথটবের উপরেই ঢাকা দিয়ে দিয়েছে। তখনও লাশ তোলা হয়নি। বাড়ির পুরুষেরা কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর এই ঘটনা। তাদের খবর পাঠানো হয়েছে, তারা এলে দেহ তোলা হবে। কয়েক জন গিয়েছে অভয় ঘোষ লেনের চেম্বার থেকে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান সুজিত ডাক্তারকে ডাকতে। পা দু’টো ঠকঠক করে কাঁপছিল আমার, শুধু মনে হচ্ছিল, অপুবউদি এখনই মুখ তুলে চোখ ফেরাবে আমার দিকে। ভিজে সাদা হয়ে যাওয়া, সিঁদুর গলে গড়িয়ে পড়া পানপাতার মতো সেই মুখ আমার অসহ্য ভয়ঙ্কর লাগছে। ছুটে বেরিয়ে গেলাম।
সেই দৃশ্য তার পরও বহু রাত শান্তিতে ঘুমোতে দেয়নি।
সপ্তাহ গেল, মাস গেল, আরও কয়েক মাস গেল... অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, কোথাও আমার নাম কেউ করল না। পাড়ার বন্ধুদের মধ্যে বোতামকে কখনও কিছু লুকোতাম না, কিন্তু এ ব্যাপারে ওকেও বিন্দুবিসর্গ জানালাম না। বছরখানেক পর বাবা রিটায়ার করলেন। আমাদের লেক টাউনে একটা ফ্ল্যাট ছিল, ঈশ্বর মিত্র লেনের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ওখানে উঠে এলাম আমরা।
নতুন পরিবেশে মনের অস্বস্তি কমল। ইংরেজি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হলাম। অপুবউদির মৃত্যুদৃশ্যটা চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল প্রায় এক যুগ পর, যে দিন টেট মডার্ন আর্ট গ্যালারিতে ওফেলিয়ার ছবিটা দেখলাম। মাথা ঘুরে গেল। এ তো অপুবউদিরই ছবি! হুবহু এক ভঙ্গি। এক মুখ। শুধু পোশাক আলাদা।
সে দিন থেকেই মাথায় ঢুকল এক অদ্ভুত খেয়াল, যে ছবি আমি গত এক যুগেও ভুলতে পারিনি, সে ছবি অন্য কেউ এঁকে ফেলবে কেন! আমাকেই আঁকতে হবে, অন্য ভাবে। তার পর সারা বছর ধরে অন্যান্য সমস্ত কাজের ফাঁকে-ফাঁকে নানা ভাবে ভাবনা-চিন্তা-চেষ্টা করার পর শেষ অবধি এই ছবি দাঁড়িয়েছে। স্যর জন এভারেট মিলিয়ার ওফেলিয়া আর আমার অপু, দু’জনের সম্মিলিত সংশ্লেষ আমার ‘অপালা’, অয়েল অন ক্যানভাস।
গল্পটা এখানে শেষ হতে পারত, কিন্তু আজকের দিনটা আরও কিছু রেখেছিল আমার জন্য।
******
প্রদর্শনীর সময় শেষ হতেই হল থেকে বেরচ্ছি, পাশ থেকে কেউ আলতো করে কাঁধে হাত দিল, একটু অবাক হয়ে তাকাতেই দেখি এক জন বেশ দশাসই চেহারার স্যুট পরা ভদ্রলোক। ঠোঁটে চাপা হাসি। আমি প্রথমে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম, তার পরই চমকে উঠে চেঁচিয়ে বললাম, ‘‘আরে বোতাম! তুই এখানে?’’
আমার সেই ছোটবেলার বন্ধু! হরি ঘোষ স্ট্রিটের বোতাম! বছর কুড়ি বয়সে ঈশ্বর মিত্র লেন ছেড়ে চলে আসার পর আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না, রাখার আগ্রহও ছিল না তেমন।
বোতামকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে একটা কফিশপে বসলাম। কাগজে আমার এগজিবিশনের কথা পড়ে ও আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে আজ। আড্ডায় উঠে এল অনেক পুরনো কথা।
কোল্ড কফি শেষ করে টিসু দিয়ে মুখ মুছে বোতাম বলেছিল, ‘‘ইনসিডেন্টালি অর অ্যাকসিডেন্টালি, তোর অপালার মুখটা অনেকটা আমাদের সিংহিবাড়ির ছোটবউ অপরাজিতা, মানে অপুবউদির মতো! দশ না বারো বছর আগে সুইসাইড করল, মনে নেই তোর?’’
ভুরু কুঁচকে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে মনে করার অভিনয় করি।
‘‘তুই কি তা হলে তার আগেই চলে গিয়েছিলি লেক টাউন? তাই হবে হয়তো!’’ আমার অভিনয়ে বোতাম কনফিউজড! কিন্তু ও বলে চলল...
‘‘আর বলিস না, খুব লুজ ছিল, ইয়ং ছেলে দেখলেই ঢলে পড়ত, ও দিকে ওর বর দুর্জয় সিংহি নাকি তেমন পারত-টারত না। তাই তার উপোসি বউ শিকার ধরে বেড়াত। অভয় ঘোষ লেনের সুজিত ডাক্তার তো দুর্জয় সিংহির ছোটবেলার বন্ধু, ঝপ করে এসে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে তড়িঘড়ি শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিল। পরে খবর বেরল, মরার সময় অপুবউদির পেটে তিন মাসের বাচ্চা ছিল। বাচ্চাটা কার জানিস?’’
বোতামের কথাগুলো আমার গায়ে ছুঁচের মতো বিঁধছে, কিন্তু বোতাম চুপ করবে না... আমিও কি চাই বোতাম চুপ করুক?
‘‘বাচ্চাটা সুজিত ডাক্তারেরই! শুনে দুর্জয়ই গলা টিপে বউটাকে মেরে ফেলে, নিজের পরিবারের সম্মান বাঁচাতে ডাক্তারের কপালে বন্দুক ধরে ডেথ সার্টিফিকেট আদায় করে। বউটা নাকি অনেকের সঙ্গেই শোয়ার এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, যাতে বাচ্চাটাকে অন্যের ঘাড়ে চাপানো যায়! তুই তো আর পুরনো পাড়ার সঙ্গে যোগাযোগই রাখলি না, রাখলে শুনতে পেতিস। বউটা মারা যাওয়ার আগে ওদের বাড়ি মেরামত হচ্ছিল, অনেক মিস্তিরি কাজ করছিল। তাদের ভিতর এক জন নাকি অপুবউদিকে একটা ছেলের সঙ্গে শোবার ঘরে দেখে ফেলে! ছেলেটার মুখটা সে দেখতে পায়নি। সেখান থেকেই খবর লিক হয়। বউদি মারা যেতেই বাড়ি থেকে মিস্তিরিগুলোকে বিদেয় করে সিংহিরা। দুর্জয় সিংহি তাদের মুখ বন্ধ করেছিল। ভয় দেখিয়ে না টাকাপয়সা দিয়ে, তা জানা নেই...’’
বুকের ভিতর অবিরাম ঢেউয়ের ধাক্কায় পাড় ভাঙার আওয়াজ পাচ্ছি আমি, কিন্তু পাকা জুয়াড়ির মতোই আমার মুখের একটা রেখাও কাঁপল না। শুধু গত বারো-তেরো বছর ধরে যে ভার বয়ে এসেছি, সে ভার হালকা হল, না কি আরও ভারী হয়ে উঠল— কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।