ছোটগল্প
Short Stories

উপরচালাক

গদাইলশকরি চালে দোকানে এসে হাজির হলেন শ্রীধরদা। বাজারের থলেটা পায়ের কাছে নামিয়ে রাখেন।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২৩ ১০:১৮
Share:

আমাদের দর্শনপুর গ্রামে শ্রীধর ঘোষাল পড়তি জমিদারবাড়ির আয়েশি সন্তান। স্ত্রী প্রীতি, ছেলে ধৃতি এবং মেয়ে তিথিকে নিয়ে তাঁর সংসার। কাজকর্ম কিছু করেন না। জমির ভাগচাষ থেকে যেটুকু ফসলের ভাগ পান, তা দিয়ে সংসার চালান প্রীতিদেবী। শ্রীধরবাবু আপনমনে শ্যামাসঙ্গীত গান আর আর নিজের নানা রকম ফোলানো ফাঁপানো বানানো কৃতিত্ব শুনিয়ে বেড়ান। তাই ঘরে বাইরে, ছোট-বড় সকলেরই বিরক্তির পাত্র হয়ে উঠেছেন। আমরাও ওই স্বভাবকে হাতিয়ার করে তাঁকে খোরাক করি। তাঁর ঘাড় ভেঙে এটা-সেটা খাই। ফিস্ট করি।

Advertisement

সে দিন চায়ের ঠেকেও তাঁকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। তখনই বাজার করে ফিরছিলেন তিনি। তাঁকে দেখে আমরা মজা করার জন্য উসখুস করে উঠি। গলা তুলে ডাকি, “ও শ্রীধরদা, আসুন। চা খেয়ে যান।”

গদাইলশকরি চালে দোকানে এসে হাজির হলেন শ্রীধরদা। বাজারের থলেটা পায়ের কাছে নামিয়ে রাখেন। পেটমোটা ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে ফুলকপি, পেঁয়াজকলি, ধনেপাতা, বড় মাছ। শ্রাবণ খোঁচানোর সুযোগ ছাড়ে না। সে বলে ওঠে, “কী ব্যাপার দাদা, এত আয়োজন! বাড়িতে ভিআইপি-টিআইপি কেউ আসবে বুঝি?"

Advertisement

তত ক্ষণে প্রশান্তর অর্ডারে আর এক রাউন্ড করে চায়ের গ্লাস সবার হাতে এসে গেছে। গ্লাসে চুমুক দিয়ে শ্রীধরদা বলেন, “ঠিকই ধরেছ। ভিআইপি-ই বটে।”

অমনি শ্রাবণ গ্যাস খাওয়াতে শুরু করে, “সে তো হবেই। আপনার তো সব ভিআইপিদের সঙ্গেই দহরম মহরম। নেহাত বাপ-ঠাকুরদার ভিটে আর আমাদের ভালবাসেন বলেই দর্শনপুরে পড়ে আছেন। তা এ বার কে আসছেন দাদা?”

“আত্মপ্রকাশ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক অভিজয় রায়চৌধুরী। খুব মান্যিগণ্যি মানুষ।”

আমরা সাহিত্যের ধারকাছ মাড়াই না। তাই অভিজয় রায়চৌধুরীর নাম শোনা ছিল না। তবুও শ্রীধরদার কথার সূত্র ধরে প্রশান্ত বলে, “তিনি তো খুব নামী লোক গো দাদা। তা তিনি কী করতে আসছেন?”

“আর বোলো না ভাই, ওরা সোনাগঞ্জে সাহিত্য সম্মেলন করছে। সেখানে সভাপতিত্ব করার জন্য ধরেছে আমাকে।”

শ্রাবণ কপট বিস্ময় দেখায়, “সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি! আপনারও কি লেখালিখির অভ্যেস আছে নাকি দাদা? জানতাম না তো!”

শ্রীধরদা লজ্জা-লজ্জা মুখে বিনয় দেখান, “গোপনে একটু-আধটু লিখি আর কী! ছদ্মনামে সে সব বিভিন্ন পত্রিকায় বেরোয়। অভিজয়ই শুধু জানে। এ বারে আমাকে প্রকাশ্যে আনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।”

শ্রাবণ তোল্লাই দেয়, “করবেই তো! আপনি দাদা ছাইচাপা আগুন! গ্রামের গর্ব। তলে তলে এত বড় কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছেন অথচ কেউ জানতে পারলাম না।”

তার কথা শেষ হয় না, শ্রীমন্ত খেই ধরে নেয়, “জানতে যখন পেরেছি আর ছাড়ছি না। হয়ে যাক দু’-একটা কবিতা।”

শোনামাত্র শ্রীধরদার ব্যস্ততা, “সে হবে’খন এক দিন। আজ সময় নেই ভাই। দেরি হলে তোমাদের বৌদি ছেড়ে কথা কইবে না। রান্নাবান্না সব তো তাকেই করতে হবে।”

কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ দেন না শ্রীধরদা। চায়ের গ্লাসটা টুক করে নামিয়ে হাটের থলেটা তুলে নিয়ে হনহনিয়ে এগিয়ে যান। তাঁর কান বাঁচিয়ে শ্রাবণ বলে, “বাতেলাবাজ আর কাকে বলে!”

আমাদের মধ্যে অমল টিকটিকি-স্বভাব। সে অনেকের গূঢ় কথা অনুসন্ধান চালিয়ে উদ্ধার করেছে। পর দিন চায়ের আসরে অমল এসে পৌঁছতেই আমরা আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারি না, “কী রে! কিছু জানতে পারলি?”

অমলের চোখেমুখে তখন আত্মবিশ্বাসের আলো। সে বলে, “পারব না মানে? কোনও কাজে ফেলিয়োর হওয়ার রেকর্ড আছে এই শর্মার? ওদের বাড়ির কাজের মেয়েটাকে একটা সেন্টের শিশি দিয়ে হাত করতেই পর্দা ফাঁস!”

“পর্দা ফাঁস মানে? অভিজয় রায়চৌধুরী আসেননি?”

“এসেছিল, তবে সেটা অভিজয়বাবু নন। বড়কুটুম। বৌদির বড়দাদা। বৌদির তাড়নায় শ্রীধরদাকে ভাল করে বাজার করতে হয়েছে।”

শ্রাবণ বেমক্কা রেগে ওঠে, “দাঁড়া, মালটা আসুক আজ। বাতেলাবাজি ঘুচিয়ে দিচ্ছি।”

“খবরদার না। তা হলে ওকে নিয়ে মজা করার আনন্দটাই ঘুচে যাবে। তার চেয়ে কিছু না জানার ভান করে বোকা সেজে বরং...”

ঠিক সেই সময় অদূরে শ্রীধর ঘোষালকে আসতে দেখা যায়। আমরাও দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলি। দোকানের কাছাকাছি পৌঁছোতেই শ্রাবণ টিপ্পনী ছুড়ে দেয়, “কী গো শ্রীধরদা, তোমার সাহিত্য সম্মেলন কেমন হল?”

শ্রাবণের খোঁচা খেয়ে কাঁচুমাচু হয়ে পড়লেও সামলে নেন শ্রীধরদা। সপ্রতিভ হতে অবশ্য দেরি হয় না, “আর বোলো না, যাব না যাব না করেও জোরাজুরিতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু যাওয়া আর হল কই? বেরোতে যাব, এমন সময় লক্ষ্মণ দাস এসে হাজির। অভিজয়বাবুর কাছে ক্ষমাটমা চেয়ে ফেরতপাঠাতে হল।”

“লক্ষ্মণ দাসটা আবার কে?”

“আরে লক্ষ্মণ দাসের নাম শোনোনি? উনি বিরোধী দলের জেলা সম্পাদক। আমার বন্ধুস্থানীয়। এ বারের পঞ্চায়েত ভোটে আমাকে এখান থেকে প্রধান পদে প্রার্থী করতে চায়। ওদের কাছে খবর আছে শাসক দলের মধ্যেও নাকি আমার নাম আলোচিত হচ্ছে। তাই ওরা আগে আমাকে দলে টানতে ছুটে এসেছিল।”

তাঁর তাৎক্ষণিক উপস্থাপনা আমাদের হতবাক করে দেয়। পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকি আমরা। শ্রাবণ খুব দুশ্চিন্তার ভাব দেখিয়ে বলে ওঠে, “আপনি আবার রাজি হয়ে যাননি তো?”

“খেপেছ? আমি সাফ বলে দিয়েছি তুমি বন্ধু মানুষ, যখন ইচ্ছে আসবে, খাবে, গল্প করবে। কিন্তু রাজনীতিতে নামতে বোলো না। আমি ও সবের যোগ্য নই।”

শ্রাবণ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে, “ঠিক করেছেন। অমন বোকামি কেউ করে! শাসক দলে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকলে বিরোধী দলের হয়ে কেউ দাঁড়াতে যায়?”

“শাসক দলে দাঁড়ানোর সুযোগ বলতে?” শ্রীধরদা আরও ভ্যাবাচ্যাকা।

শ্রাবণ তাঁকে খেলাতে শুরু করে, “আপনার বন্ধু ঠিকই বলে গিয়েছেন। শাসক দলে আপনাকে নিয়ে আলোচনা চলছে।”

“তাই না কি? কই, আমাকে কেউ কিছু বলেনি তো?”

“বলবে বলবে। কালই তো অরুণ বলল, দল থেকে এ বারে প্রধান পদে রাজনীতির বাইরে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কাউকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বেশ কয়েক জনের কথা ভাবা হয়েছে। তার মধ্যে শ্রীধরদাই এগিয়ে।”

আগ্রহের আতিশয্যে শ্রীধরদা বলেন, “তাই বলেছে বুঝি? কিন্তু আমার কি এখন ও সবে জড়ানো উচিত হবে?”

“কেন হবে না? আপনার মতো যোগ্য লোক এ তল্লাটে আর আছে? প্রধান হিসেবে আমরা আপনাকেই দেখতে চাই।”

“বেশ, তোমরা যখন অত করে বলছ, তখন আর না করি কী করে? অরুণকে না-হয় বলে দিয়ো, ওরা চাইলে আমার অমত নেই।”

“চাইবে না মানে? আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। আমরা সব ফাইনাল করে আপনাকে জানাচ্ছি।”

উৎফুল্ল চিত্তে গুনগুন করে, ‘সকলই তোমারি ইচ্ছা’ গাইতে গাইতে শ্রীধরদা বাড়ির পথ ধরেন। আমি শ্রাবণকে জিজ্ঞেস করি, “এটা কী রকম হল?”

“দেখ না, এ বার মালটাকে মুরগি করে কেমন একটা জম্পেশ খাওয়াদাওয়া আদায় করি।”

“কী করে করবি?”

“সেটা আপাতত টপ সিক্রেট!” রহস্যময় হেসে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে সে।

পরদিন সাতসকালেই উত্তেজনার আঁচে ফুটতে ফুটতে আমরা চায়ের ঠেকে হাজির হই। কিছু ক্ষণের মধ্যেই শ্রীধরদা আর অরুণকে সঙ্গে নিয়ে শ্রাবণকে আসতে দেখা যায়। অরুণ শাসক দলের স্থানীয় নেতা। বন্ধুস্থানীয় হলেও আমাদের সঙ্গে চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে আসে না। তাকে দেখেই বোঝা যায় শ্রাবণ নির্ঘাত কোনও প্যাঁচ কষেছে।

চায়ের অর্ডার দিয়েছিল অমল। তারা ঠেকে পৌঁছনো মাত্র হাতে হাতে চায়ের গ্লাস পৌঁছে যায়। চায়ে চুমুক দিতে দিতে শ্রাবণ শ্রীধরদার মুখের দিকে চেয়ে বলে, “নিন, আমার কথা মিলিয়ে নিন। আপনার প্রার্থী পদ পাকা। বিশ্বাস না হয় অরুণকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।”

শ্রীধরদা জিভ কাটেন, “ছি ছি, তোমরা আমাকে এতখানি ভালবাসো, আর তোমাদেরই অবিশ্বাস করব?”

“সে ঠিক আছে। তবুও অরুণের কাছে জেনে নিন। অরুণ, দাদাকে ভিতরের ব্যাপারটা বল।”

শ্রাবণের তাড়ায় অরুণ বলে, “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে শ্রাবণ। প্রধান পদের জন্য তিন জনের প্যানেল তৈরি হয়েছে। আপনার নামটা শেষে ছিল। শ্রাবণরা বলার পর সেটাকে প্রথমে করে জেলা নেতৃত্বের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন জেলা নেতৃত্বের মর্জি। তবে আপনার নামটাই বিবেচিত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।”

তার কথা শেষ হয় না। শ্রীধরদা বিনয়ে বিগলিত হয়ে পড়েন, “তোমাদের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। আজ কিন্তু সবাইকে আমার বাড়িতে এক বার পায়ের ধুলো দিতে হবে। আমি যৎসামান্য খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করতে চাই।”

“আমার তো আজ হবে না, পরে হবে’খন। আজ শ্রাবণদের খাইয়ে দিন...” শ্রাবণকে চোখ টিপে দিয়ে উঠে পড়ে অরুণ। শ্রীধরদাও আমাদের সে দিন রাতে খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়ে ব্যস্ত হয়ে বাড়ি চলে যান। তিনি একটু দূরে যেতেই আমি শ্রাবণকে নিয়ে পড়ি, “হ্যাঁ রে, অরুণ এত সহজে রাজি হল?”

“সহজে কী হয়? অনেক ক্ষণ জপাতে হল। রাজনীতি করছে, আর একটু ছলনা করতে পারবে না!”

“শেষ পর্যন্ত শ্রীধরদাকে প্রার্থী করবে তো?”

“দূর! দেশে যেন প্রার্থী করার লোকের অভাব! বলল, শুনলি না? জেলা কমিটিতে তিনটি নাম পাঠানো হয়েছে। এর পর জেলার নেতাদের মর্জি। তার আগে আজই তো আমাদের খাওয়াদাওয়া হয়ে যাচ্ছে।”

তা জম্পেশ খাওয়াদাওয়ার আয়োজনই করেছিলেন শ্রীধরদা। শুক্তো, বেগুনভাজা, মুগের ডাল, দিশি মুরগির মাংস আর চাটনি। শেষ পাতে দুটো করে নলেনগুড়ের মিষ্টিও। আয়োজনেই স্পষ্ট, প্রধান হচ্ছেন ধরে নিয়ে এত সব আয়োজন করেছেন শ্রীধরদা। খাওয়া শেষে সবাই যখন তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে শুরু করছি, তখন শ্রাবণের মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাগাড় দিয়ে ওঠে। সে বলে বসে, “দাদা, এ বার দু’-একটা কবিতাপাঠ হয়ে যাক।”

তার কথা শুনে আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকি। শ্রীধরদা যথারীতি ভাঙলেও মচকান না, “নিশ্চয়ই, খাতাটা নিয়ে আসি দাঁড়াও...” বলেই ত্রস্তপায়েউপরে ছোটেন।

তখনই দরজার আড়াল থেকে বৌদির অনুচ্চ গলা শোনা যায়, “ঠাকুরপো, তোমরা অতিথি, অতিথিনারায়ণ। তোমরা এসেছ, খেয়েছ, আমি খুব আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু খাওয়ার জন্য লোকটার সঙ্গে এই রকম করতে হবে ভাই? লোকটা তো কারও কোনও ক্ষতি করেনি। বোকাসোকা মানুষ। নিজের সম্পর্কে বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে কী যে পায় কে জানে! তা নিয়ে আমরা বকাবকি কম করি? কিন্তু কিছুতেই শোধরায় না।”

আমাদের মুখে কথা সরে না। গালে কেউ যেন একটা মোক্ষম চড় বসিয়ে দিয়েছেন। শ্রীধরদা বিড়বিড় করতে করতে উপর থেকে নেমে আসেন, “কবিতার খাতা দুটো যে সে দিন অভিজয় নিয়ে গিয়েছে, তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। আজ আর তোমাদের কবিতা শোনাতে পারলাম না। পরে এক দিন শোনাব।”

আর কবিতা! তখন আমরা পালাতে পারলে বাঁচি। কোনও রকমে হুঁ-হাঁ বলে চোরের মতো পালিয়ে আসি। প্রতিজ্ঞা করি, ওই ধরনের রসিকতা আর কারও সঙ্গে করব না।

কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা থাকে না। সেই সময় আমাদের গ্রামে একটি কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কলেজ স্থাপনের অর্থ সংগ্রহের জন্য একটা দানমেলা করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই বিষয়েই চায়ের ঠেকে আলোচনা হচ্ছিল। তখনই এসে পৌঁছন শ্রীধরদা। তাঁকে দেখে শ্রাবণ দুম করে বলে বসে, “এই তো শ্রীধরদা, আপনার কথাই হচ্ছিল এত ক্ষণ।”

তত দিনে পঞ্চায়েতের প্রধান না হতে পারার গ্লানি বেমালুম ভুলে গিয়েছেন শ্রীধরদা। জিজ্ঞেস করেন, “আমাকে নিয়ে আবার টানাটানিকেন ভাই?”

“কলেজের দানমেলায় আপনাকে সভাপতি করার কথা ভেবেছি আমরা। আপনি সে দিন অবশ্যই সকাল সকাল চলে আসবেন।”

“এত লোক থাকতে আবার আমাকে বাছলে কেন ভাই? আমি কি আর তেমন যোগ্য লোক?”

“আপনার মতো যোগ্য আর আছে কে? কোনও অজুহাত শুনছি না। আপনাকে আসতেই হবে।”

“বেশ তোমরা যখন ভালবেসে বলছ তখন...”

শ্রীধরদা চলে যাওয়ার পর শ্রাবণকে বকুনি দিই, “আবার ঝামেলা করলি! এ বার কাটাবি কী করে?”

শ্রাবণ নির্বিকার, “কী করে আবার? যাঁকে সভাপতি করা হবে, মাইকে তাঁর নাম ঘোষণা শুনেই মালটা মুখ লুকিয়ে পালাতে পথ পাবে না। অম্বুজাক্ষ পালকে সভাপতি নির্বাচন করা হয়ে গিয়েছে। অম্বুজাক্ষ মোটা টাকা দান করবেন। সেই টাকা দেওয়ার ক্ষমতা শ্রীধরদার আছে?”

নির্ধারিত দিনে শুরু হয়ে যায় দানমেলা। তাবড় তাবড় লোকেরা সব মঞ্চ অলঙ্কৃত করে বসেন। তাঁদের অভ্যর্থনা আর আপায়ন করতে করতে শ্রীধরদার কথা ভুলে যাই বেমালুম।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে মঞ্চে ওঠার সিঁড়ির মুখে চোখ পড়তেই আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সিঁড়ির নীচে শ্রীধরদা। পরনে চুনোট করা ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, গলায় উত্তরীয়। সভাপতির যথার্থ ড্রেস কোড। সাজপোশাকে জমিদারি আভিজাত্য, মুখ বিষাদাচ্ছন্ন। আমি তখন পালাতে পারলে বাঁচি। কিন্তু পালানো হয় না। শ্রীধরদা হাত তুলে ডাকেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই। কাছে যেতেই একটা প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, “এটা রাখো। আমার তো দান করার মতো কিছু নেই। বিপদ-আপদের জন্য সাহেবি আমলের চারটে রুপোর কয়েন ছিল। সেগুলোই নিয়ে এসেছি। দেশ ও দশের কাজে সবাই হাত না বাড়ালে কি হয়? খুব ভাল কাজ করেছ তোমরা। আর অম্বুজাক্ষকে সভাপতি করেও ঠিক করেছ। তাঁর সঙ্গে কি আমার তুলনা হয়? দোহাই তোমাদের, দাতা হিসেবে আমার নামটা যেন আবার মাইকে ঘোষণা করে বোসো না ভাই। তোমাদের বৌদি, ছেলেমেয়েরা সব এসেছে। বোঝোই তো মেয়েদের মন। বাড়ি গিয়ে অশান্তি করবে। অশান্তিকে আমি বড় ভয় পাই ভাই।”

মাইকে তখন সমানে ঘোষণা চলছে, “আজকের এই দানমেলায় এখনও পর্যন্ত সব থেকে বেশি এক হাজার টাকা দান করেছেন আমাদের এই অনুষ্ঠানের মাননীয় সভাপতি দানবীর অম্বুজাক্ষ পাল...”

শুনে আমার কান ভোঁ-ভোঁ করে ওঠে। কোথায় হাজার টাকা, আর কোথায় সাহেবি আমলের চার-চারটে রুপোর কয়েন! চোখ তুলে শ্রীধরদাকে খোঁজার চেষ্টা করি। তিনি তখন মানুষের ভিড়ে মিশে গিয়েছেন।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement