ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: বাবা সৌহার্দ্যকে জোর করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছিলেন। রগচটা মানুষটাকে সে এড়িয়ে চলত। শ্রীকণাও লোকটার সামনে গুটিয়ে থাকতেন, কাঁদতেন গোপনে। শ্রীকণা ছেলেকে তাঁর জীবনের গোপন কষ্টের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, তিনি আসলে যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, সে কিছু না বলে পালিয়ে গিয়েছিল।
ভুরু কুঁচকে সৌহার্দ্য বলেছিল, ‘‘পরে আর খোঁজ পাওনি?’’ শ্রীকণা বলেছিলেন, ‘‘চেষ্টাও করিনি। নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়েছেন। আমার মতো সাধারণ মেয়েকে মনে রাখার কোনও কারণ নেই। তা ছাড়া, তার পর তো তোর বাবার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।’’
সৌহার্দ্য দাঁত চেপে বলেছিল, ‘‘স্কাউন্ড্রেল।’’
শ্রীকণা বলেছিলেন, ‘‘ছি, ও রকম বলতে নেই।’’
সৌহার্দ্য বলেছিল, ‘‘কেন বলতে নেই? অপেক্ষা করতে বলে যে ভ্যানিশ হয়ে যায় তাকে খিস্তি ছাড়া আর কী দেব? কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করব?’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘হয়তো মুখ ফুটে বলতে পারেননি।’’
সৌহার্দ্য নাকমুখ কুঁচকে বলেছিল, ‘‘তোমাদের জেনারেশনের এই সব প্রেম-ভালবাসাকে সাধে কি আমরা রিজেক্ট করেছি মা! আমরা যা করি সরাসরি করি। পরস্পরকে বলে করি। পছন্দ হলেও বলি, না হলেও বলি। আমাদের রিলেশন এবং ব্রেক-আপ দু’টোই ওপেন। নো অ্যাম্বিগুইটি। আমাদের ছলনা করতে হয় না, পালাতেও হয় না। উই আর জেনুইন।’’
শ্রীকণা বলেছিলেন, ‘‘হয়তো তাই। তবে সবাই সমান নয়। আমার কোনও আপশোস নেই। বরং আমি খুব খুশি। তোর বাবাকে বিয়ে না করলে তোকে পেতাম না।’’
সৌহার্দ্য বলেছিল, ‘‘আপশোস কেন হবে? তুমি কম কিসের? কথাটা তা নয়, কথা হল, উনি পালালেন কেন?’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘ভুলে যা।’’
সৌহার্দ্য ঝাঁঝ নিয়ে বলেছিল, ‘‘ভুলে তো এখনই গিয়েছি, তার পরেও যদি কোনও দিন দেখা হয়, কলার চেপে ধরব।’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘ছি ছি, বলছি না ও রকম বলে না!’’
সৌহার্দ্য ঠোঁট উলটে বলেছিল, ‘‘ঠিক আছে, দেখা হলে হ্যান্ডশেক করে বলব, আপনি এক জন সাহসী মানুষ মিস্টার। এক সুন্দরী তরুণীকে দঁাড় করিয়ে রেখে ভেগে গিয়েছিলেন। এর জন্য আপনাকে ব্রেভারি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া উচিত।’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘থাক ও সব কথা।’’
সৌহার্দ্য কৌতুক-ভরা গলায় বলল, ‘‘জানে মা, সে দিন আমি আমার বসের ঘরে একটা মজার কাণ্ড করেছি। চা খাওয়ার পর একটা দামি কাপ টেবিল থেকে ফেলে দিয়েছি।’’
নবনী থমকে গিয়ে বললেন, ‘‘সে কী!’’
সৌহার্দ্য হেসে বলল, ‘‘আরও মজার কথা কী জানো? বস বুঝতেই পারেনি, আমি ইচ্ছে করে কাপটা ফেলে দিয়েছি।’’
‘‘তুই কি পাগল?’’
সৌহার্দ্য ঝুঁকে পড়ে মায়ের গালে গাল ছুঁইয়ে বলল, ‘‘লোকটা ভাল, কিন্তু লোকটার নাম আমার পছন্দ নয় মা। সো আই মেক দ্য ফান।’’
শ্রীকণা বললেন, ‘‘নাম পছন্দ নয়! কী নাম? যত বড় হচ্ছিস পাগলামি বাড়ছে তোর।’’
সৌহার্দ্য কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘‘চললাম মা। ফিরতে রাত হবে। খেয়ে শুয়ে পড়বে।’’
কৃতির বার্থডে পার্টিতে হার্ড ড্রিংক্স বলতে শুধু ওয়াইনের ব্যবস্থা ছিল। সেই ওয়াইনই সৌহার্দ্য অনেকটা খেয়ে ফেলল। যত ক্ষণ না মাথা ঝিমঝিম করে। পার্টি ফাঁকা হতে কৃতি এসে চাপা গলায় বলল, ‘‘নো মোর সো! ইউ হ্যাভ টু ড্রাইভ।’’
সুন্দরী কৃতি একটা চকলেট রঙের অফ-শোল্ডার স্লিভলেস গাউন পরেছে। বুক থেকে শুরু হওয়া সেই পোশাকে তাকে দেখাচ্ছে হলিউডের ফিল্মস্টারের মতো। কানে বড় ঝোলা দুল রাখলেও গলায় কিছু পরেনি। এতে তার নগ্নতা আরও বেড়েছে।
সৌহার্দ্য হেসে বলল, ‘‘কৃতি, ভাবছি, আজ রাতে আর ফিরব না। তোমার কাছে থেকে যাব।’’
কৃতি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘‘ডোন্ট বি নটি সো! তুমি কি চাও আমার বর তোমাকে খুন করুক? সে মেট্রো স্টেশনে এক জনকে নামাতে গিয়েছে। এক্ষুনি ফিরবে। যদি এসে দেখে তুমি আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করছ তা হলে কী হবে বলো তো?’’
সৌহার্দ্য বলল, ‘‘যা খুশি হোক, তোমার ওয়াইল্ড বিউটি আমাকে অলরেডি খুন করে ফেলেছে কৃতি। নাউ আই অ্যাম আ ডেড ম্যান।’’
কঁাধে চড় মেরে কৃতি ফিসফিস করে বলল, ‘‘সত্যি মেরে ফেলব কিন্তু।’’
সৌহার্দ্য অভিনয় করে বলল, ‘‘ইস, বিয়ে করবার আগে এক বার বললে না!’’
কৃতি চোখে কৌতুক এনে বলল, ‘‘কেন? বললে কী হত? আমাকে বিয়ে করতে?’’
সৌহার্দ্য বলল, ‘‘শিয়োর!’’
কৃতি বলল, ‘‘সেই কারণেই বলিনি। তোমার অন্য গার্লফ্রেন্ডদের কী হত তখন?’’
সৌহার্দ্য হেসে বলল, ‘‘এই জন্য তোমাকে এত পছন্দ করি। তুমি আমার জন্য ভাবো।’’
ফ্ল্যাট থেকে বেরনোর আগে, দরজার সামনে কৃতিকে এক হাতে জড়িয়ে চুমু খেল সৌহার্দ্য। বেশি সময় দিল না কৃতি। নিজেকে মুক্ত করে হাত দিয়ে ঠোঁটের শেড ঠিক করতে করতে গাঢ় গলায় বলল, ‘‘শুধু চুমুতে হবে না নটি বয়। বর ট্যুরে গেলে খবর পাঠাব। আসতে হবে।’’
নীচে নেমে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে সৌহার্দ্য ফোনে নম্বর টিপল। ও পাশে এক বার ফোন বাজতেই চিকন গলায় জবাব পেল।
‘‘সৌহার্দ্যদা, তুমি! হোয়াট আ সারপ্রাইজ! এত দিন কোথায় ভ্যানিশ হয়েছিলে?’
এক হাতে স্টিয়ারিং সামলে সৌহার্দ্য বলল, ‘‘মনানী, বালিগঞ্জ ফাঁড়ি দিয়ে যাচ্ছি। তোমাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। এক বার ঘুরে যাই?’’
মনানী গলায় আপশোসের সুর এনে বলল, ‘‘ইস, ব্যাড লাক। আমি এখন বেঙ্গালুরুতে। দু’মাস হল প্রোমোশন দিয়ে কোম্পানি পাঠিয়ে দিয়েছে।’’
সৌহার্দ্য বলল, ‘‘কনগ্রাচুলেশনস! কিন্তু আমি যে ভেঙে পড়লাম মনানী। এখনই তোমাকে যে আদর করতে ইচ্ছে করছে।’’
মনানী বলল, ‘‘নো প্রবলেম। ফ্লাইট ধরে চলে এস। রাত তিনটেয় একটা ফ্লাইট আছে না?’’ কথা শেষ করে খিলখিল করে হেসে উঠল মনানী।
সৌহার্দ্য ছদ্ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘‘ঠাট্টা করছ?’’
মনানী নামের মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, ‘‘রাগ কোরো না সৌহার্দ্যদা। নেক্সট মান্থে কলকাতা যাচ্ছি, একটা ফুল ডে তোমার জন্য। এখন একটা উমম্ নাও।’’
মোবাইলে চুমুর জবাব দিয়ে ফোন কেটে দিল সৌহার্দ্য। গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। ওয়াইনটা চমৎকার ছিল। যত সময় যাচ্ছে, ফুরফুরে ভাবটা বাড়ছে। সৌহার্দ্য নিজেকেই মনে মনে প্রশ্ন করল, রিয়েল না ভার্চুয়াল? কোন চুমুটা ভাল? দু’টোই দু’রকম ভাবে ইন্টারেস্টিং নয় কি? বাবা যদি বেঁচে থাকত, এখন ছেলেকে দেখে কী ভাবত? কোন সৌহার্দ্যটা ভাল? রিয়েল না ভার্চুয়াল? নাকি দু’জনে দু’রকম ভাবে ইন্টারেস্টিং? হেসে ফেলল সৌহার্দ্য।
৫
এখন রাত এগারোটা বেজে দশ মিনিট। নবনী ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছেন। থমথমে মুখ। সামনে টিভি চলছে। নবনী রিমোট টিপে খবরের চ্যানেলগুলো সার্ফ করে চলেছেন। যদি কোথাও আহিরীদের কলেজের খবর দেখায়। দেখাচ্ছে না। আটটা নাগাদ এক বার দেখিয়েছিল। নবমী নিজে দেখেননি। টালিগঞ্জ থেকে মেজদি’র ছোট মেয়ে মঞ্জরি ফোন করে বলল।
‘‘মাসি, আহিদির কলেজে গোলমাল হচ্ছে?’’
নবনী বলল, ‘‘হ্যাঁ হচ্ছে। ছাত্রদের কী একটা গোলমাল চলছে। তুই কোথা থেকে শুনলি?’’
মঞ্জরি বলল, ‘‘এই তো নিউজে দেখাল। ছেলেমেয়েরা সিঁড়িতে বসে চেঁচাচ্ছে। কলেজের নাম শুনে বুঝতে পারলাম, আহিদির কলেজ। ওদের প্রিন্সিপাল না কে, গোল মতো মুখ, টিভিতে বলল, ছাত্ররা নাকি হুলিগানিজম করেছে। ভাঙচুর করেছে, ওঁকেও নাকি মারতে গিয়েছিল।’’
মঞ্জরি মেডিকেলে পড়ে। দিদির কলেজের খবর নিউজে বলেছে বলে সে গর্বিত। গোলমালে ঘাবড়েছে বলে মনে হল না। নবনীর উদ্বেগ বাড়ছে। নিউজে দেখিয়েছে মানে পরিস্থিতি ঘোরালো।
মঞ্জরি বলল, ‘‘আমি আহিদিকে ফোন করেছিলাম। ফোন বন্ধ। মা চিন্তা করছে।’’
নবনী নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘‘আমি কথা বলেছি। ওর মোবাইলে চার্জ ফুরিয়ে গেছে। মা’কে চিন্তা করতে বারণ কর। সব টিচার একসঙ্গে আছে, ভয়ের কিছু নেই। আমার সঙ্গে কথা হলে তোদের ফোন করতে বলব।’’
মঞ্জরির ফোন কেটে দেওয়ার পর নবনী আবার আহিরীকে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হয়নি। ফোন বন্ধ। তার পর থেকে সিরিয়াল দেখা বন্ধ করে, টিভির খবরগুলো দেখছেন, আবার যদি কিছু দেখায়। দেখাচ্ছে না। মারপিট, গুন্ডামির কথা তো আহিরী কিছু বলেনি! চেপে গেছে। তার সঙ্গে দু’বার কথা হয়েছে। প্রথম বার নিজেই ফোন করেছিল। আহিরী শান্ত গলায় বলেছিল, ‘‘মা, ফিরতে দেরি হবে। কলেজে আটকে গেছি।’’
‘আটকে গেছি’ মানে যে কলেজের গেট বন্ধ করে আটকে রাখা হয়েছে, সে কথা বুঝতে পারেননি নবনী। আহিরীও বলেনি কিছু।
‘‘কখন ফিরবি?’’
আহিরী বলল, ‘‘বলতে পারছি না। রাত হবে।’’
নবনী অবাক হয়ে বললেন, ‘‘রাত! কলেজে রাত পর্যন্ত কী কাজ?’’
আহিরী বিরক্ত গলায় বলল, ‘‘কী কাজ জেনে তুমি কী করবে? রাত হবে বললাম তো। খেয়ে নিও। আমি এখন ফোন ছাড়ছি।’’
ক্রমশ