ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
পূর্বানুবৃত্তি: আহিরী ফোনে নবনীকে জানাল, তারা কলেজে ঘেরাও হয়ে আছে। কমলেশ বাড়ি ফিরে স্নান সেরে রোজকার মতো স্টাডিতে বসে ছিলেন। ভাবছিলেন নবনীর কথা। এক বার তিনি ট্যুর থেকে ফেরার পর নবনী ভাল করে কথা বলছিলেন না। কমলেশ বুঝেছিলেন, নবনীকে সময় দিয়ে জানতে হবে কী হয়েছে তাঁর, সমস্যাটা কোথায়।
বাইরে গিয়েছিলেন দু’জনে। আহিরীই পরামর্শ দিয়েছিল বাবাকে। বাবা-মায়ের গোলমালে নিজেকে যতটা দূরত্বে রেখে পরামর্শ দেওয়া যায় আর কী। বুদ্ধিমতী মেয়ে।
‘‘মা’কে নিয়ে কোথাও ঘুরে এস না!’’
কমলেশ বলেছিলেন, ‘‘কেন বলছিস?’’
আহিরী বলেছিল, ‘‘ঘ্যানঘ্যানানি থেকে ক’দিন রিলিফ পাব। সকাল থেকে শুরু হয়ে যায়। কখন ঘুম থেকে উঠবি, কখন স্নানে যাবি, কখন বেরোবি, কখন ফিরবি। যেন এখনও স্কুলে পড়ি। উফ, মনে হয় ডাক ছেড়ে কাঁদি। ঘুরে এস, আমাকে বঁাচাও।’’
কথাটা কমলেশের মনে ধরে। বাইরে ক’দিন থাকলে নবনীর মনের জটটা কাটতে পারে। হয়তো সমস্যাটা বলবে।
‘‘কোথায় যাই বল তো!’’
‘‘আমি কী বলব! মায়ের সঙ্গে কথা বলো।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘তোর মা যে মুডে আছে, সে কী কিছু বলবে...।’’
আহিরী বলল, ‘‘এক কাজ করো। বাগডোগরার টিকিট কেটে প্লেনে চেপে বসো। এয়ারপোর্টে নেমে ঠিক করবে কোন পাহাড়ে উঠবে। দার্জিলিং
না সিকিম।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘ মন্দ বলিসনি।’’
আহিরী আড়মোড়া ভেঙে বলেছিল, ‘‘আমার আইডিয়া সব সময়েই ভাল হয়।’’
কোনও পাহাড়ে নয়, বাগডোগরা থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা ডুয়ার্স চলে গিয়েছিলেন কমলেশ। চালসায় মূর্তি নদীর পাশে এক চমৎকার রিসর্টে উঠলেন। চতুর্থ দিনটি ছিল পূর্ণিমার। রাতে গিয়ে নদীর পাশে বসেছিলেন দু’জনে। রিসর্ট থেকে বলে দিয়েছিল, বেশি দূরে যাবেন না। দু’দিন ধরে হাতি বেরোচ্ছে, আলোর কাছাকাছি থাকবেন। কমলেশ শোনেননি। আলোর কাছে থাকলে জ্যোৎস্না দেখা যায় না। তারা খানিকটা সরে গিয়ে বসলেন। মূর্তি নুড়ি পাথরের নদী। এই নদীর জলে টুংটাং করে বাজনা বাজে। খানিক ক্ষণ চুপ করে শুনলে মনে হয়, বাজনার তালে জল বইছে। জ্যোৎস্নার রাতে এই নদী জলের থাকে না, রুপোর হয়ে যায়। রুপোর কণা নুড়ি পাথর ছঁুয়ে ছঁুয়ে যায়। চার পাশে এক ধরনের ঘোর-লাগা মায়াবী জগৎ তৈরি হয়।
কমলেশ স্ত্রীর হাত ধরে নরম গলায় বলেছিলেন, ‘‘এ বার আমাকে বলো।’’
নবনী দূরে তাকিয়ে ছিলেন। যেখানে নদী শেষ বাঁক নিয়ে আড়ালে চলে গেছে।
‘‘কী বলব?’’
কমলেশ ফিসফিস করে বলেন, ‘‘যা বলতে পারছ না!’’
নবনী নিচু গলায় বলেছিল, ‘‘তোমার ভাল লাগবে না।’’
‘‘তাও বলো।’’
নবনী বললেন, ‘‘তুমি কি এই কথা শোনার জন্য এখানে এসেছ?’’
কমলেশ এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘‘তুমি ভারমুক্ত হবে।’’
নবনী স্বামীর দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘‘তুমি প্রেম করতে?’’
নবনী যে এই কথাটা বলবেন, ভাবতেও পারেননি কমলেশ। তাও আবার দাম্পত্য জীবনের এতটা পথ পেরিয়ে আসার পর! প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে হেসে বলেন, ‘‘হ্যঁা করতাম। তোমাকে তো গল্প বলেছি।’’
নবনী বললেন, ‘‘হালকা করছ?’’
কমলেশ বললেন, ‘‘এই বুড়ো বয়সে প্রেমের কথা বললে কি সিরিয়াস হব?’’ আওয়াজ করে হাসলেন কমলেশ। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘‘ছাত্র বয়সে কত প্রেম করেছি তা কি মনে আছে?’’
নবনী বললেন, ‘‘ও সব ছেলেখেলা নয়, আমি তোমার কোন প্রেমের কথা বলছি তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।’’
কমলেশ এ বার খানিক বিরক্ত গলায় বললেন, ‘‘তোমার কি মাথা খারাপ হল নবনী? এই বয়সে এ সব ছেলেমানুষের মতো কথা আমাদের মানায়?’’
নবনী বললেন, ‘‘আমি তো তোমাকে কিছু বলতে চাইনি, তুমিই জোর করে শুনতে চাইছ।’’
রাগতে গিয়েও কমলেশ নিজেকে সামলে নিলেন। স্ত্রীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘‘নিশ্চয়ই তোমাকে কেউ কিছু বলেছে। আর তাই নিয়ে তুমি মন খারাপ করে বসে আছ।’’
নবনী কেটে কেটে বললেন, ‘‘মন খারাপ করিনি। ধাক্কা খেয়েছি।’’
‘‘ধাক্কা খেয়েছ! কোন কালে আমার কার সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল তাই নিয়ে ধাক্কা খেয়েছ! এটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? কাম অন নবনী। সিলি বিষয় নিয়ে মন খারাপ কোরো না।’’
নবনী বললেন, ‘‘তোমার প্রেমের গল্প শুনে ধাক্কা খাওয়ার মতো মন বা বয়স কোনওটাই আমার আর নেই। তা তুমি জানো।’’
কমলেশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘‘দেন হোয়াটস দ্য প্রবলেম? এত দিন পরে কে কী বলেছে তাই নিয়ে মাথা গরম করছ কেন?’’
নবনী কাঁধ থেকে স্বামীর হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘প্রেম নয়, তোমার বিশ্বাসঘাতকতার গল্প আমাকে হার্ট করেছে। আমি মেনে নিতে পারছি না। তোমার মতো মানুষ একটা মেয়ের সঙ্গে এমন কাজ করতে পেরেছিল! এটা আমি মেলাতে পারছি না।’’
কমলেশ গলা চড়িয়ে বললেন, ‘‘বিশ্বাসঘাতকতা! কার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি? কোন স্কাউন্ড্রেল তোমাকে এ সব বলেছে! মিথ্যে কথা। অল লাইস। ড্যাম লাইস।’’
কমলেশ রায়ের চিৎকারে চার পাশের নিস্তব্ধতাও যেন থমকে গেল। নবনী শান্ত ভাবে বললেন, ‘‘মিথ্যে হলে এত রাগ করছ কেন?’’
কমলেশ উত্তেজিত গলায় বললেন, ‘‘আমার ভাবতে অবাক লাগছে নবনী, তুমি এক জন অচেনা অজানা লোকের মুখে গসিপ শুনে, কেচ্ছা শুনে আমাকে দোষারোপ করছ! তোমাকে এটা মানায় না। তাও যদি বিশ বছর আগে হত। নতুন বিয়ে করছি, আমার রিলেশনের কথা শুনে ইউ আর ফিলিং ব্যাড। সে সব তো নয়। অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি আমরা।’’
নবনী শান্ত ভাবে বললেন, ‘‘বিশ বছর আগে তো ঘটনা শুনিনি। তুমি খুব ভাল করেই জানো, এটা কোনও গসিপ নয়, কেচ্ছাও নয়। এটা বিশ্বাসঘাতকতা। আর যার মুখ থেকে আমি এই গল্প শুনেছি, তিনি জানেনও না, আমার হাজব্যান্ডের নামও কমলেশ রায়, সেও চার্টার্ড পড়েছে, সেও বিদেশ থেকে ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি নিয়ে এসেছে, সেও বড় কোম্পানিতে কাজ করছে। সুখী সংসারে তারও একটা মেয়ে আছে। সে শুধু জানে, তার বান্ধবীকে বিট্রে করা লোকটা জীবনে এ রকমই এসট্যাবলিশড হয়েছে। আমিও কিছু বলিনি। গল্প শুনেছি মাত্র।’’
কমলেশ খানিক ক্ষণ চুপ করে রইলেন, ‘‘মেয়েটির নাম কী?’’
চঁাদ অনেকটা ওপরে উঠে গিয়েছিল। নুড়ি পাথরের নদী জায়গায় জায়গায় ঝকঝক করছিল।
‘‘নাম জানি না, জিজ্ঞেস করিনি।’’
কমলেশ রাগ কমিয়ে খানিকটা অসহায় ভাবে বললেন, ‘‘আমি এ রকম কিছু মনে করতে পারছি না। কত মেয়ের সঙ্গেই তো আলাপ হয়েছে।’’
নবনী ঠোঁটের কোণে হেসে বললেন, ‘‘আমি তো তোমাকে মনে করতে বলিনি। কিছুই বলিনি। ঘটনাটা সামলাতে একটু টাইম নিচ্ছিলাম।’’
কমলেশ স্ত্রীর দিকে ঘুরে বসলেন। তার দু’টো হাত ধরে নরম গলায় বললেন, ‘‘আচ্ছা তর্কের খাতিরে নাহয় মেনে নিলাম এ রকম কোনও ঘটনা ঘটেছিল। তাতেই বা কী? প্রেমে ব্রেক আপ হতে পারে না? কত জনের তো ডিভোর্স হয়। সেটাও কি বিশ্বাসঘাতকতা?’’
নবনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘রিলেশনে ব্রেক আপ বা ডিভোর্সের কথা যে হচ্ছে না সেটা তুমি ভাল করেই বুঝতে পারছ কমলেশ। ‘আমি আসছি, তুমি অপেক্ষা করো’ বলে হারিয়ে যাওয়াটাকে কি বলে? বিশ্বাসভঙ্গ? নাকি পালিয়ে যাওয়া? যাক, আমি এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। আমি তোমার কাছ থেকে কোনও কৈফিয়ত চাইনি। তুমি যা করেছ, তার উলটো ঘটলে তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটাই হত না। আমার বাবা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে কি তোমাকে খুঁজে পেত? পেত না। তোমার মতো এক জন কম্পিটেন্ট, ডিপেন্ডেবল, লয়্যাল হাজব্যান্ডই পাওয়া হত না আমার। আহির মতো মেয়ে? ভাগ্যিস সে দিন তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে। আমি লাকি। তার পরেও ঘটনাটা জানার পর মনটা কেমন খচখচ করছে। ঠিকই বলেছ, ছেলেমানুষি। আশা করি ঠিক হয়ে যাবে।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘নবনী, বিলিভ মি, আই কান্ট ট্রেস দ্য লেডি... তুমি একতরফা শুনে আমার সম্পর্কে ধারণা খারাপ করছ।’’
নবনী জোর করে হেসে বললেন, ‘‘তুমি যা শোনার জন্য এখানে আমাকে টেনে নিয়ে এসেছিলে তা তো শুনলে, আমিও খানিকটা হালকা হলাম। চলো উঠি, কাল সকালে ফেরা। গোছগাছ আছে।’’
কমলেশ বললেন, ‘‘আর একটু বোসো।’’
‘‘আচ্ছা বসছি, কিন্তু ও সব কথা আর নয়।’’
কমলেশ কিছু একটা বলতে গেলেন, রিসর্টের দিক থেকে এক জন হন্তদন্ত হয়ে এসে দঁাড়াল। হাতে জোরালো টর্চ। ধমকের ঢঙে বলল, ‘‘এ কী! আপনারা এখানে কেন? আপনাদের না আলোতে বসতে বলা হয়েছিল? তাড়াতাড়ি রিসর্টে চলুন। খবর এসেছে, হাতি বেরিয়েছে।’’
সে দিন গভীর রাতে নদীর ও পারে যখন দলছুট হাতি আকাশ কঁাপিয়ে ডেকে ওঠে, কমলেশ নবনীকে বুকে চেপে ধরেছিলেন। ভরসা দিতে চেয়েছিলেন। ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘‘ভয় নেই। আমি আছি।’’
আজ এতগুলো বছর কেটে গেল, কমলেশ বুঝতে পারেন, নবনীর সঙ্গে সম্পর্কে কোথাও একটা চিড় রয়েই গেল। সেই চিড় কোথায়? ভরসা, বিশ্বাস না কি শ্রদ্ধায়? আজও স্পষ্ট নয়।
৬
নবনী স্টাডির দরজায় এসে দাঁড়ালেন।
‘‘মেয়ের কোনও খবর নেবে না?’’
কনলেশ একটা বিজনেস ম্যাগাজিন দেখছিলেন। জিএসটি নিয়ে একটা ভাল লেখা বেরিয়েছে। মুখ তুলে বললেন, ‘‘খবর নিয়েছি। টিচাররা সবাই সেফ আছে। চিন্তার কিছু নেই। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে টিভি দেখতে পারো।’’
ক্রমশ