ছবি: পিয়ালী বালা
পূর্বানুবৃত্তি: সেবন্তী রেগে গিয়ে মলয়কে বলে, নীহার সরখেলের বাড়ির মিটিংয়ে সে মলয়কে যেতে দেবে না। রৌনকের ফ্ল্যাটে চা খেতে খেতে হৃষিতা জানতে পারে রৌনকের মায়ের কথা, কেন রৌনককে এই ফ্ল্যাটে থাকতে হয়। হৃষিতা আর রৌনক গিটার বাজিয়ে গান গাইতে থাকে। মায়ের চিৎকারে অভিমন্যুর ঘুম ভাঙে, তার মনে পড়ে যায় আজ বাড়িতে পুজো, আর আজই একটা অনুষ্ঠানে ঋদ্ধিমাকে আংটি পরিয়ে দিতে হবে।
এই শান্তিটা হয়তো সময়ের অপেক্ষা ছিল। বাড়ির থেকে নেওয়া একতরফা সিদ্ধান্ত। ঋদ্ধিমাদের পরিবারের সঙ্গে আলাপটা বেশ কয়েক বছরের। তবে দু’টো পরিবারের মধ্যে সে রকম ঘনিষ্ঠতা ছিল না। অভিমন্যুর সঙ্গে ঋদ্ধিমার কোনও মেলামেশা নেই। এক বারই ওদের বাড়িতে গিয়েছিল। বিয়ের সম্পর্ক তৈরির উসখুসানিটাও মাস তিনেক আগে শুরু হয়েছিল। তার পর পুজোর আগে বাবা আর মা দুম করে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল। অভিমন্যু সবচেয়ে অবাক হয়েছে ঋদ্ধিমাও তাতে রাজি হয়ে যাওয়ায়।
অভিমন্যুর সঙ্গে নয়নিকার সম্পর্কটা তো আরও পুরনো। বছরখানেকের। কিন্তু সেটাকে সম্পর্ক বলা যায় কি? তমালের দাদার বিয়ের বাসরে নয়নিকাকে প্রথম দেখেছিল। তার পর ফেসবুকে বন্ধুত্ব। রাতের পর রাত নয়নিকার টাইমলাইন খুলে চাতকের মত চেয়ে থাকা। কবে ওর আর একটা ছবি পোস্ট হবে। সম্পর্ক বলতে এইটুকুই। একতরফা। নীরব অতন্দ্র প্রহরী হয়ে থাকা ছাড়া ফেসবুকে কিছু লিখতে পারে না অভিমন্যু। একটা নিরুচ্চার লাইক দিতেও আঙুল ভারী হয়। ফেসবুকে সবাই কত নিজেদের সেলফি পোস্ট করে। সেটুকু করতেও আড়ষ্টতা হয়। ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো ক্যামেরার চিপেই বন্দি হয়ে থাকে, মুক্ত পৃথিবীতে লাইক কুড়নোর জন্য ছড়িয়ে পড়তে পারে না। ফেসবুকে অ্যাক্টিভিটি বলতে নয়নিকার নতুন ছবি এলে লাইক দেওয়া। সেটাও মেয়েটা খেয়াল করে কি না জানা নেই।
তবে মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে। তমালের বউদি বুঝতে পেরেছিল। চোখ মটকে এক দিন জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেছিল, আমার বোনটাকে তোমার ভারী পছন্দ তাই না? কান লাল করে অভিমন্যু পালিয়ে বেঁচেছিল। আবার মেয়েরা বোধহয় অনেক কিছু বুঝতে পারে না। যেমন মা। মা আজও বুঝতে পারেনি, অভিমন্যুর মনের মধ্যে কে বাসা বেঁধে আছে।
অদ্ভুত একটা মনের অবস্থা অভিমন্যুর। ভেবেছিল, জল বেশি দূর গড়ানোর আগে মা’কে সব খুলে বলবে। মনে মনে অনেক প্রস্তুতি, অনেক মহড়া। কিন্তু ওই। দিন গড়াল, শেষ পর্যন্ত বলাটুকু আর হয়ে উঠল না। সেই মুখের ওপর অদৃশ্য থাবা। সেই থাবাটা আর উঠল না। চোখের সামনে একটু একটু করে ঋদ্ধিমা মায়ের খুব প্রিয় হয়ে উঠল। সব কিছুতেই বড্ড দেরি হয়ে হাতের বাইরে চলে গেল।
টুইটি দাদাইয়ের মনটা অল্প হলেও বোঝে। নয়নিকা বলে একটা মেয়ে যে দাদাইয়ের মন জুড়ে রয়েছে সেটাও ঘুরপথে শুনেছে। তবে দাদাইকে সেটা বুঝতে দেয়নি। মেয়েটার ছবি দেখেছে, ফেসবুকে। দাদাইকে ইচ্ছে করে নিজের ফ্রেন্ড লিস্টে রাখেনি। কিন্তু তমালদা আছে। তমালদার টাইমলাইনেই মেয়েটাকে দেখেছিল। কায়দা করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করিয়ে নিয়ে বন্ধুত্ব পাকিয়ে রেখেছে। সেই সূত্রে মেয়েটার বন্ধু-তালিকায় খুঁজে পেয়েছে দাদাইকেও। কিন্তু ঘুরপথে গোয়েন্দাগিরি ওই পর্যন্তই। মেয়েটাকে চোখের দেখা কখনও দেখেনি।
তবে টুইটিই মা’কে এক বার ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেছিল। ফেসবুকে ছবিটাও দেখিয়েছিল। ওপর-ওপর মা পাত্তাই দেয়নি। বলেছিল, কম বয়সে বিয়েবাড়িতে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ হওয়া সবারই একটু-আধটু হয়। দাদাইয়ের ম্যাচিয়োরিটিই নেই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মা বেশ টলেছিল। কায়দা করে নয়নিকার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিল। টুইটির ধারণা, মা সেই ভুয়ো ফেসবুক প্রোফাইল দিয়ে নয়নিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে রেখেছে নজরদারির জন্য।
মোবাইলে কথা বলতে বলতে দাদাইয়ের ঘরে ঢুকে, দাদাইকে খাটে থম মেরে বসে থাকতে দেখে, মোবাইলের ও প্রান্তে টিটানকে চাপা গলায় টুইটি বলল, ‘‘ছাড়ছি এখন। পরে করছি।’’ তার পর অভিমন্যুর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘‘দাদাই ওঠ। মা বলল বিছানাটা তুলে দিয়ে নতুন বেড কভার পাততে। ঋদ্ধিদিকে এই ঘরে বসিয়েই তো তোরা গল্প করবি, না কি?’’
অভিমন্যু শূন্যদৃষ্টিতে টুইটির দিকে তাকাল। টুইটি দাদাইয়ের মনটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে ভাল করার জন্য বলল, ‘‘বাবা বলল বাপ্পাদাকে বলতে, আমপোড়ার শরবতের সঙ্গে জলজিরারও শরবত রাখতে। শুনে বাপ্পাদা কী বলল জানিস?’’
বাপ্পা বাড়ির পুরনো কেটারার। শেষবেলাতে বললেও অনেক কিছু সামলে দেয়। সে দিন রাতে মা আজকের জন্য চার রকম মাছ বলার পরও আরও কী করা যায় জিজ্ঞেস করতে ইয়ার্কি করে বলেছিল, ‘‘বউদি, কারও সঙ্গে শত্রুতা করছেন না কি?’’ অভিমন্যুর মনে হয়েছিল, সবাই মিলে শত্রুতা এক জনের সঙ্গেই করছে। ওর সঙ্গে।
অভিমন্যুকে নিরুত্তর থাকতে দেখে টুইটি একটু পিছনে লাগার চেষ্টা করল, ‘‘দাদাই, ঋদ্ধিদির ফেভারিট কালার ভায়োলেট। তোর ভায়োলেট শার্ট আছে তো?’’
অভিমন্যুর মনে হল, আজকের রবিবারটা নিয়ে ওর যে কোনও তাপ-উত্তাপ নেই, সেটা কেউ খেয়ালই করছে না। মনে মনে নিজেকে বলল, জীবনটা তো তোমার অভিমন্যু। তোমার বাবার, মায়ের বা বোনের নয়। আর কত দিন কাওয়ার্ড থাকবে তুমি?’’
‘‘দাদাই, ঋদ্ধিদি কিন্তু খুব ভালো মেয়ে, মজার মেয়ে। সে রকম সুন্দরীও।’’
‘‘অভি, অভি...’’
বসার ঘর থেকে বাবার ডাকটা শুনে বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরের ঘরে এল অভিমন্যু। বাবা একটা বারমুডা আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে সোফায় বসে আছে। সামনে খবরের কাগজগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। তার ওপর চায়ের কাপ। বাবা পা’টা দ্রুত নাচিয়ে চলেছে। বাবার এই পা নাচানোর মানে জানে অভিমন্যু। মাথায় কিছু একটা চলছে।
‘‘বোস।’ ছেলেকে উলটো দিকের সোফাটা দেখিয়ে ইঙ্গিত করলেন তীর্থময় গঙ্গোপাধ্যায়। বাধ্য ছেলের মতো অভিমন্যু সোফায় বসল।
‘‘শোন, আমাদের ফ্যামিলির একটা ইয়ে আছে, বুঝেছিস।’’
কথায় কথায় ‘ইয়ে’ বলাটা বাবার মুদ্রাদোষ। এই মুহূর্তে বলা ইয়ের মানেটা জানে অভিমন্যু। আভিজাত্য। যদিও সফল ব্যবসাদার হয়ে বাবা অনেক টাকাপয়সা করেছে, কিন্তু তিন পুরুষ ধরে বাবারা আদপে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার। অভিমন্যু খেয়াল করেছে, যত দিন যাচ্ছে, ব্যবসা যত ফুলেফেঁপে উঠছে, বাবার এই গাঙ্গুলি-পরিবারের আভিজাত্যের ব্যাপারটা প্রকাশ করার ঝোঁক ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। মায়ের সঙ্গে এই ব্যাপারটা নিয়ে মাঝে মাঝেই তুলকালাম লাগে। অভিমন্যু জানে, বাবার এই মেকি আভিজাত্যের খোলসটা যত দিন গায়ে থাকবে, নয়নিকাকে কিছুতেই মেনে নিতে
পারবে না।
‘‘তুই কী ভাবছিস বল তো অভি?’’
অভিমন্যু ম্লান হাসার চেষ্টা করল। ও কী ভাবছে তা বাবা না বুঝতে পারলেও, সে নিজে অনুমান করতে পারল, বাবা এ বার কী বলতে চলেছে। বাবার নিজের রচনা করা এক পারিবারিক ইতিহাস। দাদু স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। এক বার মহাত্মা গাঁধীর অনশন মঞ্চের কাছে আধ বেলা উপোস করেছিলেন। বর্ধমানে প্রচুর জমিজমা ছিল। ওখানে প্রাইমারি স্কুলের বাড়িটা গাঙ্গুলি পরিবারের দান করা জমিতে হয়েছে। হালফিল বাবা ব্যবসার জন্য চেম্বার অব কমার্স থেকে একটা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ইত্যাদি। ইতিহাস থেকে বর্তমান, সব কিছু পরীক্ষার পড়ার মতো এক বার ঝালিয়ে নিতে চাইছে। বাবার এই মেকি আভিজাত্যটাই অভিমন্যুর জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তীর্থময় একদৃষ্টিতে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। গলাটা ঝেড়ে বললেন, ‘‘তোর এই খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো পরিষ্কার করে শেভ করে নে তো!’’
একটু দূরে অঞ্জলি পুজোর জোগাড় করছিলেন। কানে গেল কথাটা। বললেন, ‘‘হঠাৎ ছেলের দাড়ি নিয়ে পড়লে কেন?’’
‘‘আরে ওর হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে সবাই আসছে। একটু ঠিকঠাক...’’
‘‘এত দিন তো তোমার চোখে পড়েনি। ওদের বাড়ি যখন গিয়েছিলাম, এ রকম দাড়ি নিয়েই গিয়েছিল। এটাই এখনকার স্টাইল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি নয়, ওটাকে ‘স্টাবল’ বলে, বুঝেছ? ছেলেটাকে ওর মতো ছেড়ে দাও।’’
অভিমন্যু লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্যি ওকে যদি ওর মতো ছেড়ে দেওয়া হত, এই গ্রহটা তা হলে অন্য রকম হত।
অঞ্জলি আবার তীর্থময়ের উপর চেঁচামেচি শুরু করলেন, ‘‘আর তুমি আবার খবরের কাগজগুলো ছড়িয়ে বসেছ? আমি একটু আগেই সব গুছিয়ে রাখলাম। যতই ইন্টিরিয়র ডেকরেটরকে দিয়ে ফিটফাট বাড়ি করো না কেন, আসলে যে তুমি কী, সেটা থেকে-থেকেই বেরিয়ে পড়ে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানার ওপর সেই ভিজে তোয়ালেটা রেখে এসেছ। যেখানে সেখানে প্লাস্টিকের ব্যাগ গুঁজে রাখো। চায়ে ডুবিয়ে বিস্কুট খাও, আবার বড়াই করো অ্যারিস্টোক্রেসির!’’
তীর্থময় একটু মিইয়ে গেলেন। অঞ্জলি ছেলেকে তাড়া দিলেন, ‘‘বাথরুমে গিয়ে একেবারে স্নানটা সেরে ফেল। কী পরবি মনে আছে তো?’’
অঞ্জলি আজ বেজায় ব্যস্ত। নির্দেশগুলো দিয়ে সময় নষ্ট না করে পুজোর জোগাড়ে মন দিলেন। তীর্থময় খবরের কাগজগুলো গোছাতে গোছাতে নিচু গলায় বলতে লাগলেন, ‘‘তোর মা কিছুতেই বোঝে না। অ্যারিস্টোক্রেসি হচ্ছে একটা ইয়ে যেটা পয়সা দিয়ে কেনা যায় না। ক্লাসি ব্যাপারটা ব্লাডে থাকতে হয় বুঝেছিস, ব্লাডে।’’
টুইটি যে কখন সোফার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে, অভিমন্যু খেয়াল করেনি। স্বভাবে টুইটি অভিমন্যুর ঠিক উলটো। যা ইচ্ছে তা-ই বাবা-মা’কে বলতে পারে। ফিক করে হেসে বলল, ‘‘বাবা, তোমার নীল কনট্যাক্ট লেন্সটা কবে কিনবে? তোমাকে হেব্বি লাগবে। ইস! আজ যদি পরতে, ব্লু ব্লাড, ব্লু আইজ।’’
স্ত্রীর সামনে যে মেজাজটা দেখাতে পারেননি তীর্থময়, সেটা মেয়ের কাছে দেখালেন, ‘‘তোরা এ সব বুঝিসটা কী? যারা বোঝার ঠিক বোঝে। এই কমপ্লেক্সে আমরা কত দিন এসেছি বল? তিনটে টাওয়ার মিলে দুশো চল্লিশটা ফ্ল্যাট আছে। একটা সোসাইটি কমিটি হচ্ছে। প্রোমোটার নিজে বলেছে, আপনি চেয়ারম্যান হোন। আপনার কুছ অলগ হি পার্সোনালিটি আছে। ব্যাটা ঠিক বুঝতে পেরেছে, গাঙ্গুলি ফ্যামিলির একটা আলাদা ইয়ে আছে। আচ্ছা, শোন। দু’জনেই এখানে আছিস। সুমনবাবুরা প্রথম এই বাড়ির একটা অনুষ্ঠানে আসছেন। আমাদের বাঙালিয়ানার ইয়েটা খেয়াল রাখবি। তুই সুন্দর একটা শাড়ি পরবি, আর তুই ধুতি-পাঞ্জাবি।’’
তীর্থময় একে একে মেয়ে আর ছেলের দিকে তাকালেন। অভিমন্যু চুপ করে বসে আছে। তবে টুইটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, ‘‘ভুলে যাও। আমার নতুন লহেঙ্গা-চোলি কেনা আছে। আজ আমি ওটা পরব।’’
অভিমন্যু অসহায় গলায় বলল, ‘‘বাবা আমি ধুতি পরতে পারি না।’’
‘‘ছোটকাকা আসছে তো। ও জানে। তোকে আমাকে দু’জনকেই পরিয়ে দেবে। আমি কোঁচানো কোরা ধুতি এনেছি।’’
অঞ্জলির আবার কথাটা কানে গেল। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘‘ধুতি? কে ধুতি এনেছে? ওই যে কাল ওয়াড্রোবের মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যাগ গুঁজে রেখেছ, ওটায় বাপ-ছেলের ধুতি আছে বুঝি?’’
এমন সময় টুইটির হাতের মোবাইলটা বেজে উঠল। সিএলআই-তে নামটা দেখে টুইটি ছটফট করে উঠল। অঞ্জলি স্বভাবমত জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কার ফোন?’’
ধুতির থেকে অঞ্জলির মনটা ঘুরল। তীর্থময় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। টুইটি লুকিয়ে একটা ঢোক গিলে বলল, ‘‘মেঘনা।’’
টিটান ফোনের ও প্রান্ত থেকে বলল, ‘‘টুইটি, আজকে একটু ক্ষণের জন্য ছাদে আয় প্লিজ। প্লিইইইজ।’
টুইটি চট করে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘‘না রে মেঘনা। আজ কিছুতেই হবে না। তোকে বললাম না, বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে।’’
১৩
সোম মঙ্গল বুধ এরা সব আসে তাড়াতাড়ি,
এদের ঘরে আছে বুঝি মস্ত হাওয়াগাড়ি?
রবিবার সে কেন, মা গো, এমন দেরি করে?
ধীরে ধীরে পৌঁছয় সে সকল বারের পরে।
নিচু গলায় আবৃত্তি করলেন প্রিয়তোষ। তবে একটুও আটকাল না। সেই কোন ছোটবেলায় পড়া কবিতা। একটার পর একটা শব্দ ঠিক মনে পড়ে গেল। আবৃত্তিটা কেমন হল জানেন না, তবে ফোনে যাকে শোনালেন, সে অবশ্য প্রিয়তোষের সব কথায় মুগ্ধ হয়।
ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে কস্তুরী বলল, ‘‘রবীন্দ্রনাথের শিশু ভোলানাথ, তাই না?’’
‘‘একেবারে ঠিক ধরেছ। রবিঠাকুরও বোধহয় রবিবার আসার দিকে সারা সপ্তাহ চেয়ে থাকতেন।’’
‘‘আপনিও বুঝি রবিবার আসার দিকে এ ভাবে চেয়ে থাকেন?’’
গভীর প্রশ্ন। প্রিয়তোষ নিজেকে একটু সামলে নিলেন। এই আপাত-সাধারণ প্রশ্নটার কি অন্য কোনও মানে আছে? কস্তুরী কি বুঝতে পেরে গিয়েছে, রবিবার সকালগুলোয় একটা ফোন আসার জন্য প্রিয়তোষ এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন? একাকী জীবনে কস্তুরীর উপর একটা মানসিক নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। ঘণ্টার কাঁটা ঘুরে যায় ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে। সোমবার সকাল থেকে সত্যি মনে হয়, রবিবার কেন এমন দেরি করে? ঝর্না পর্যন্ত ঘর ঝাঁট দিতে দিতে মাঝে মাঝে সন্দেহের চোখে তাকায়, কার সঙ্গে উনি কথা বলছেন বুঝতে।
সুতপা যাওয়ার আগে সাবধান করে গিয়েছিল, অচেনা কারও সঙ্গে বেশি আলাপ না করতে। অথচ সতর্কতার শক্ত পাঁচিলটা নিজের অজান্তেই কখন যেন খসে গিয়েছে। মুক্তারামবাবু স্ট্রিট, শিবরাম চক্রবর্তীর মেস, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির গণ্ডি ছাড়িয়ে একটু একটু করে জীবনের গভীরে ডুব দিয়ে প্রিয়তোষ অনেক কথাই বলে ফেলেছেন কস্তুরীকে। বলার পর খেয়াল করে দেখেছেন, সে সবই জীবনের অপ্রাপ্তির, অধরা স্বপ্নের গল্প। একটা আশ্চর্য গুণ আছে মেয়েটার। সাহিত্যচর্চার বাইরে নিজের জীবন সম্পর্কে প্রিয়তোষ যেটুকু বলেন, মন দিয়ে শোনে। সেটুকু নিয়েই কথা বলে। অকারণ অনুসন্ধিৎসা একেবারেই নেই।
ক্রমশ