স্বাধীনতা তুমি...

প্র থমে তো চিনতেই পারেনি মা-বাবা। বাড়িটা না থাকলে সেও চিনতে পারত না। বাবার চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। মায়ের শরীর একেবারে ভেঙে গেছে।কাকিমা মারা গিয়েছেন অনেক দিন। নবদা এ বাড়িতে আর থাকে না, দিল্লিতে জরির কাজ করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

প্র থমে তো চিনতেই পারেনি মা-বাবা। বাড়িটা না থাকলে সেও চিনতে পারত না। বাবার চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। মায়ের শরীর একেবারে ভেঙে গেছে।

Advertisement

কাকিমা মারা গিয়েছেন অনেক দিন। নবদা এ বাড়িতে আর থাকে না, দিল্লিতে জরির কাজ করে। বকুল, পুতুল— দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। যে ছোট্ট গুবলুকে সে দেখে গিয়েছিল, সে চোদ্দো বছরের কিশোর। গুবলুই এখন থাকে বৃদ্ধ মা-বাবার সাথে। ইস্কুলে যায়। বাবার কাছে মাটির কাজও শিখছে।

সালঙ্কারা, সুন্দরী এক যুবতী। পোশাক-আশাক, চলাফেরা, কথা বলার ভঙ্গিতে রুচিসম্পন্না নারীর ছাপ। মেঘলা রঙের ঢাকাই জামদানি। বিদেশি পারফিউম। ভারী জড়োয়ার সেট। চিনতে না পারাই স্বাভাবিক। ঝামেলাই হয়েছিল বোঝাতে, যে কিশোরের গায়ে গরম ফ্যান ঢেলে দিয়েছিল মা, সে-ই ফিরে এসেছে। চিনতে পারার পরেও চিনতে না চাওয়া। পাপবোধ-জর্জরিত দ্বিধা।

Advertisement

নানা ছোটখাটো স্মৃতির উল্লেখে যখন একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার পরিচয়, তখন তাকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল মা। ‘আমায় ক্ষমা করিস, ক্ষমা করিস।’

ঠিক সেই মুহূর্তে নিজের মনের আয়নায় নিজেকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল রত্না। বাবার মাটির পুতুলগুলোর মতোই তত দিনে সে যে পোড় খেয়ে গেছে। ক্রন্দনরতা বৃদ্ধা আঁকড়ে ধরে আছেন তাকে। আর তার কেবলই মনে হচ্ছে, এটা কি সত্যিই স্মৃতি-সিঞ্চিত অনুতাপ, নাকি অর্থপ্রাপ্তির প্রলোভনে নিকৃষ্ট অশ্রুপাত? সে পনেরো হাজার টাকা নিয়ে এসেছিল। একটু আগেই মায়ের হাতে তুলে দিয়েছে।

তার পর থেকে বেশ কয়েক বারই বাড়ি গেছে রত্না। প্রতি বারই হাসিমুখে মায়ের হাতে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে দিয়েছে। তার অবস্থা এখন কতটা তরতরে, সেটা বুঝতে পারার পর থেকে বাড়িতে তার কদর অনেক। কিন্তু প্রতি বারই সে বাড়িতে ঢুকেছে, বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, রাত্রির অন্ধকারে। কেউ তাকে বাড়িতে এক রাতও থেকে যেতে বলেনি। গত কয়েক বছর ধরে গুবলুও যাওয়া-আসা শুরু করেছে বনগাঁর এই বাড়িতে। এখন তার একুশ বছর বয়স। কলকাতার আইটিআই’তে প্রশিক্ষণরত যুবক সে। প্রায়ই এসে দিদির কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। তার লেখাপড়ার খরচ দেয় রত্নাই। কৃষ্ণনগরে বাবা-মায়ের সংসারও এখন চলে তার টাকাতেই।

এ সবের কোনও কিছুই হত না, বুলাকিদা না থাকলে! ‘রত্না তুই এখানে? কী হয়েছে রে? এদিকে নীচে, বৈঠকখানায় তো গুবলু এসে বসে আছে!’

পল্টনের গলা শুনে সম্বিৎ ফিরল রত্নার। পল্টন গত কাল কলকাতা গিয়েছিল, এই ফিরল। সে কিছুই জানে না।

‘কী হয়েছে? শুনবি? বুলাকিদা মারা গেছে!’

‘কী বললি? কী বললি তুই?’ পল্টনের প্রশ্নটা আর্তনাদের মতো শোনাল।

সিলেট এখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।

ঠিক তখনই বিদ্যুতের মতো কথাটা মনে হল রত্নার! গুবলু কেন এসেছে হঠাৎ? আজ তো আসার কথা না! মা বা বাবার কিছু হয়নি তো?

কথাটা মনে হতেই উঠে দাঁড়াল রত্না।

‘পল্টন, তুই সিলেটের কাছে শোন সব কিছু, আমি গুবলুর সাথে কথা বলে আসছি।’

রত্না সঙ্গে করে নিয়ে না এলে তিনতলায় ওঠার অনুমতি নেই গুবলুর। তাকে বসানো হয়েছে একতলার বৈঠকখানা ঘরে। তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে রত্নার মনে হল বুলাকিদা কত শখ করে সিঁড়িতে শ্বেতপাথর বসিয়েছিল, মেঝের লাল সিমেন্টের সাথে কন্ট্রাস্ট হবে বলে। যেটুকু ইংরিজি সে জানে, তা তো বুলাকিদারই কল্যাণে।

কে মারল বুলাকিদাকে? আন্ডারওয়ার্ল্ড-এর কেউ? বুলাকিদার শত্রু ছিল না তা নয়, কিন্তু খুব সাবধানী ছিল লোকটা।

কখনও টাকাপয়সার ঠাট দেখাত না। পটনা থেকে ফিরছিল ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্টে!

যেই মেরে থাক, তাকে ছাড়বে না রত্না। দেখে নেবে। কালই এক বার পল্টনকে চিত্তরঞ্জন পাঠাতে হবে। বুলাকিদার বডি ছাড়ানো দরকার। সে নিজেই যেত, কিন্তু পাসপোর্টের তদবির না করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কাজ বন্ধ হয়ে গেলে তো সব কিছুই বন্ধ হয়ে যাবে। হিজড়ের কোনও পেনশন নেই। প্রচুর টাকা আয় করতে হবে বয়স চলে যাবার আগেই, বুলাকিদাই বলত।

আবার রাগ হচ্ছে রত্নার। ট্রেনের মধ্যে কে গুলি করল বুলাকিদাকে? কী করে করল? কামরায় নাকি ঠাসাঠাসি ভিড় ছিল, অথচ কেউ কিছু দেখেনি! মামদোবাজি নাকি?

যে করে হোক, বার সে করবেই বুলাকিদার খুনিকে। ছাড়বে না। সবার আগে রঘুনন্দনজিকে ফোন করতে হবে।

‘দিদি!’ নানা কথা ভাবতে ভাবতেই নীচে চলে এসেছে রত্না। সোফায় বসে ছিল গুবলু। দাঁড়াল।

‘বোস। কী ব্যাপার রে? বাবা-মা ভাল আছে?’

‘হ্যাঁ, মা-বাবা তো ভালই আছে!’

‘তবে?’

‘না... মানে... কিছু টাকার দরকার ছিল।’

‘টাকা? কেন রে? গত বুধবারই তো নিয়ে গেলি এ মাসের টাকা!’

‘না...আসলে... এ বার আমাদের কলেজে বড় করে স্বাধীনতা দিবস হবে। হাজার চারেক ডোনেশান চাইছে। স্বাধীনতার ষাট বছর তো!’

ধিকিধিকি করে যে রাগটা পুড়ছিল রত্নার, হঠাৎ সেটা তুষের আগুনের মতো দাউদাউ জ্বলে উঠল।

ভাই এসেছে তার! একটা কুশল প্রশ্ন নেই, প্রণাম নেই, নমস্কার নেই, এমনকী একটু চক্ষুলজ্জার ভনিতাটুকুও নেই। ঘরে ঢোকামাত্রই সরাসরি টাকা চাইছে! তাও এক বারে চার হাজার টাকা!

দু’চোখ জ্বলছে রত্নার। চিৎকার করে উঠল সে।

‘স্বাধীনতা দিবস? অ্যাঁ, স্বাধীনতা দিবস? তোর কলেজের মাস্টাররা জানে, তুই হিজড়ের টাকায় স্বাধীনতা দিবস করবি? হিজড়েকে ঢুকতে দেবে সেখানে? বলতে পারবি তো হিজড়ের আয় করা পয়সায় হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান?’

অন্ধকারের আশ্রয়

‘স্বাধীনতা? তুই শালার স্বাধীনতা চাস? বিলাদসা তোকে বলেছে স্বাধীনতা মানে বন্দুক নিয়ে ক্যারদানি করা?’

ঘাড়ের কাছে প্রচণ্ড ঝাপটাটা এত জোরে এসে পড়ল, যে ঘরের এক কোনায় আছড়ে পড়ল বুধুয়ার ছোট্ট শরীরটা।

‘বল, কেন বন্দুকে হাত দিয়েছিলি? বল! আজ শালা মেরেই ফেলব তোকে।’

বুধুয়ার খুব লাগছে। চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে তাকে আবার ঘরের মাঝখানে টেনে আনছে বাবা। কিন্তু কাঁদবে না আজ বুধুয়া। কিছুতেই না।

এই প্রচণ্ড প্রহারটা চলছে গত আধ ঘণ্টা ধরে!

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মা আর ঠাকুমা। দাদার অবস্থা দেখে ঠাকুমার আঁচলে মুখ লুকিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে ছোটন। কথাটা সে ঠাকুমাকে বলেছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে দাদাকে যে এতটা মার খেতে হবে, বুঝতে পারেনি সে।

‘কোথায় গিয়েছিল বন্দুক নিয়ে? শালা বলিয়ে ছাড়ব আজ আমি তোকে!’

বাঁ হাতের একটা প্রকাণ্ড থাপ্পড় এসে পড়ল বুধুয়ার গালে। ডান হাতে তখনও চুলের মুঠি ধরে আছে বাবা।

কয়েক দিন ধরে ঠিক এই ভয়টাই করছিল বুধুয়া। বন্দুকটা সে ফেরত এনেছিল সকলের নজর এড়িয়ে, রেখেও দিয়েছিল খাটের তলার গর্তে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও ভারী ট্রাঙ্কটাকে যথাস্থানে ফেরাতে পারেনি। আর একটা দিন হলেই করে ফেলত। টেনে টেনে প্রায় জায়গামত এনে ফেলেছিল, গত কয়েক দিন ধরে। আর বড়জোর একটা বা দুটো দুপুরের মামলা! তার মধ্যেই নিখুঁত ভাবে ট্রাঙ্কটাকে তার নিজের জায়গায় ফিরিয়ে দিত বুধুয়া। কিন্তু সে সময়টা পায়নি সে।

আজ ইস্কুল থেকে ফিরে এসেই দেখে, বাড়ির পরিবেশ থমথমে। তাকে দেখামাত্রই ঠাকুমা বলে ওঠে, ‘আবার তুই যা-না-তাই করিছিস?’

‘কী করলাম আবার?’

‘কী করিছো তুমি জানো না? ধোয়া তুলসীপাতা সাজতিছো? বাবার বন্দুক ধরিছিলি কেন? বাবা আইসে আজ দেখাবানে তোমারে। বায়ড়োয়ে শেষ করে দেবেনে।’

ঠাকুমাই বলেছিল বিকেলে খেলাধুলো করার পরে সন্ধেটা পাড়ায় কারও বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে থাকতে। ছিলও তাই। কিন্তু রাত্রে তো বাড়িতে ফিরতেই হবে। ঠাকুমা আজ আলুপোস্ত রেঁধেছিল। আলুপোস্ত ভারী ভাল লাগে বুধুয়ার। সারা দিনের খিদে নিয়ে গোগ্রাসে খাচ্ছিল। হঠাৎই খাওয়া থেকে মুখ তুলে দেখে, যমদূতের মতো রান্নাঘরের মুখে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। চোখের দিকে এক বার তাকিয়েই বুধুয়া বুঝতে পেরেছিল, বাবা জেনে গেছে! খাওয়া আর হয়নি বুধুয়ার।

তার পর থেকে ক্রমাগত চলছে প্রহার। সঙ্গে বিকট গালাগালি।

‘আজ তোকে আমি শেষ করে দেব!’

ঘরের কোনায় অনেক দিন ধরেই পড়ে ছিল চেয়ারের ভাঙা হাতলটা। বাঁকানো, ভারী কাঠের একটা হাতল। এক দিকে একটা ছোট্ট লোহার পাত এখনও লেগে আছে।

বাবা সেটা হাতে তুলে নেওয়ামাত্রই হাঁ হাঁ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঠাকুমা।

‘করিস কী? করিস কী তুই? ছেলেডারে কী মাইরেই ফেলবি নাকি?’

বুধুয়াকে জড়িয়ে ধরেছে ঠাকুমা। বুধুয়ার চোখে, মুখে ঠাকুমার সাদা থান কাপড়ের মোলায়েম স্পর্শ। পান খায় ঠাকুমা। ঠাকুমার কোলে মুখ ঘষলেই একটা মিঠে গন্ধ কুয়াশার মতো আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে। গোপাল জর্দা আর লবঙ্গ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

বাবা তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য! মুহূর্তের মধ্যে বিকট একটা শব্দ করে চেয়ারের ভারী হাতলটা নেমে এসেছে ঠাকুমার মাথায়!

‘মরে গেলাম!’ বলে ব্যথায় ককিয়ে উঠেছে ঠাকুমা। ঠাকুমা না থাকলে আঘাতটা পড়ত বুধুয়ার ঘাড়ে বা মাথায়!

ঘটনাটা ঘটে গেল এক লহমায়। ঠাকুমার সাদা থানে সরু একটা লাল রঙের ধারা। মাথার এক দিকটা চেপে বসে পড়েছে ঠাকুমা।

হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠেছে মা। ছোটন চিৎকার করে কাঁদছে। গোলমাল শুনে পাশের বাড়ি থেকে ছুটে এসেছে ঝন্টুকাকা।

‘কী হল গৌরাঙ্গদা? কী হল?’ বলতে বলতেই বাবাকে সপাটে জড়িয়ে ধরেছে ঝন্টুকাকা।

বুধুয়া ঠিক করেছিল কাঁদবে না। ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে সে বুঝতে পারল তার দু’চোখে জলের ধারা। জিভে এসে লাগছে নোনতা জল।

তাকে, ছোটনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে ঠাকুমা। ‘আমার কিছু হয় নাই দাদুভাই। কাইন্দো না দাদুভাই, কানতিছো কেন?’

‘এটা কী করছ গৌরাঙ্গদা? মাসিমার মাথা ফেটে গেছে! মা’কে মারছ তুমি?’

ঝন্টুর অবাক প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরল গৌরাঙ্গর।

ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement