চুয়ান্ন
পূর্বানুবৃত্তি: লামাদাদুর বাড়ির কাছে একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে অনেক খাবার বেঁচে যাওয়ায় লামাদাদু সাবুকে খবর দেয়। সেখানে পৌঁছে সব খাবার প্যাক করে রাসবিহারীর কাছে সর্দার শঙ্কর রোডে এসে পৌঁছয় সাবু। লামাদাদুও সঙ্গে আসে। এখানে আগেও খাবার দিয়েছে সাবু। এখানে টুলু নামে একটা ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে সাবুর খুব ভাব। এর আগে একদিন পুঁটির বাড়ি গিয়েছিল ও। পুঁটির মা-র কাছ থেকে জেনেছে, পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছে পুঁটি। ওকে কিছু না জানিয়েই।
পাহাড়ে!” আমি অবাক হয়েছিলাম, “আমি জানি না তো কিছু! কোথায় গিয়েছে?”
“দার্জিলিং!” কাকিমা কেঁদে বলেছিল, “কী জানি সন্ন্যাসী হয়ে যাবে কি না!” আমি থতমত খেয়ে বসে ছিলাম। দার্জিলিং গিয়েছে! কেন? মুখে বলেছিলাম, “কাকিমা কেঁদো না। সন্ন্যাসী হতে কেউ দার্জিলিং যায় না।”
“ঠিক বলছিস? ওখান থেকে এভারেস্ট কাছে না?” জিজ্ঞেস করেছিল কাকিমা।
আমি বলেছিলাম, “ওটা নেপালে। যাক গে শোনো, তুমি কষ্ট পেয়ো না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব, ও ফিরে আসুক।”
কাকিমা বলেছিল, “তুই কেন ওর সঙ্গে প্রেম করিস না রে? স্কুল লাইফে ও তো তোকে প্রোপোজ় করেছিল, তুই কেন না বললি? সেই নিয়ে কত কষ্ট পেয়েছিল। আর এখন... এখন কার সঙ্গে কী করছে বল তো!” আমি মাথা নামিয়ে নিয়েছিলাম। সেই বিদিশাদের বাড়ির ব্যালকনি মনে পড়ে গিয়েছিল। আফটার শেভের গন্ধ। ওর গলার সোনার চেন। আমি কেন না বলেছিলাম ওকে? কেন? কেন? কেন?
আমার মাঝে মাঝে নিজের গালেই ঠাস ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করে! সেই স্কুল লাইফে কী যে ভূত ঢুকেছিল মাথায়! আমার তো ভাল লাগত ওকে! কিন্তু বান্ধবীদের কথায় কেন যে নেচেছিলাম! কেন যে ‘কুল’ হতে চেয়েছিলাম!
ওরা বলেছিল, “তুই পাগল! প্রেম! পুঁটির সঙ্গে! চুমু খেয়েছিস তো কী হয়েছে! গ্রো আপ সাবু! অপশন ওপেন রাখ। যার তার সঙ্গে এমন কেউ ইনভলভ্ড হয়! আর এখনকার দিনে প্রেম! এত রিগ্রেসিভ কেন তুই! ন্যাকা কেন!”
ন্যাকা! রিগ্রেসিভ! আমি অমন হতেই পারি না! পুঁটিকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম তাই। কিন্তু আমার গাট ফিলিং বলছিল, “ভুল হচ্ছে সাবু! ভুল হচ্ছে! অন্যের কথায় নাচা ঠিক নয়। যা মন চাইছে, তা-ই কর। না হলে পরে ভুগবি!”
তা-ই এখন ভুগছি!
লামাদাদু বলল, “কী রে বল, কী হল?”
আমি বললাম, “আমি ঠিক জানি না গো।”
আমার বলার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল, যাতে কথাটা শুনে লামাদাদু আমার মাথায় হাত দিল। তার পর বলল, “তোর ক’টা জীবন?”
“একটাই। কেন?” আমি অবাক হলাম।
“তা হলে বলে দে,” বলল লামাদাদু।
“কী বলে দেব!” আমি লামাদাদুর কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
লামাদাদু মোবাইল বার করে ক্যাব বুক করতে করতে বলল, “এই যে পুঁটির জন্য তোর কষ্ট হয়, সেটা পুঁটিকে বলে দে। বুঝলি!”
নুরভাই আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিল। অফিসে আজ আর যাব না। বিকেল হয়ে গিয়েছে। আমি নুরভাইকে বলে দিলাম যে, আমার মোবাইল খোলা থাকবে, দরকার হলে যেন আমায় খবর দেয়।
নুরভাই চলে যাওয়ার পরে আমি মোবাইলটা বার করলাম। গাড়িতে থাকার সময় কয়েক বার রিং হয়েছিল। কিন্তু তুলিনি। ইচ্ছে করেনি। এখন মনে হল, পুঁটিও তো হতে পারে!
না, পুঁটি নয়। এনা। ওর আবার কী দরকার! ঠোঁট কামড়ে ভাবলাম, পুঁটি কি আমার পাঠানো ছবিটা দেখেছে! কাজটা হুট করে করে ফেলার পর আমার খুব গিল্ট ফিলিং হচ্ছে! যদি পুঁটির ই মেলের পাসওয়ার্ড জানতাম, তবে নিজেই ওর ইমেলে ঢুকে ডিলিট করে দিতাম ছবিটা! তবে হয়তো একটাই রক্ষে, অফিসের ইমেল বাদে ও এখন নিজের কোনও ইলেক্ট্রনিক মেসেজিং সার্ভিসই ব্যবহার করছে না। ও ছবিটা দেখলে কী যে করবে! তবে হ্যাঁ, আমি যে পাঠিয়েছি সেটা বুঝতে পারবে না।
ফোনটা আবার বেজে উঠল। এনা! আবার!
“হ্যাঁ বল,” আমি কানে লাগালাম মোবাইলটা, মিথ্যে করে বললাম, “আমি শুনতে পাইনি আগে!”
এনা বলল, “আমার জিনিসগুলো?”
আমার বিরক্তি লাগল। মেয়েটা এমন ভাব করছে, যেন আমায় ও দিয়েছিল সব কিছু।
আমি বললাম, “দেখ, আমি বলেছি। প্লিজ় তেমন তাড়া থাকলে, ওকে নিজে ফোন করে নে। আমায় কেন টানছিস তোদের মাঝে?”
এনা থমকাল। তার পর বলল, “আমি ওকে ফোন করব! পাগল না কি! তুই এনে দিস প্লিজ়। আর আমার বাড়িতে দিস না। আমি আমার নতুন অ্যাড্রেস তোকে মেসেজ করে দিচ্ছি।”
“নতুন ঠিকানা! মানে?” আমি অবাক হলাম।
এনা হাসল, “আমি লিভ-ইন করছি। সাত দিন হল। এখানে দিয়ে যাস।”
“লিভ-ইন!” আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।
“হ্যাঁ। হি ইজ় আ ডার্লিং! একদম ন্যাগ করে না। দারুণ। বাঘাযতীনের কাছে আছি আমরা। এখানেই দিয়ে যাস, কেমন? চল বাই।”
আমি ফোনটা নিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এনা লিভ-ইন করছে! তা করতেই পারে। কিন্তু এটা যদি পুঁটি শোনে তা হলেই শেষ! ছেলেটা যে কী করবে! আমি চাবি বার করে দরজা খুলে বাড়ি ঢুকলাম। আমাদের সবার কাছে একটা করে চাবি থাকে। বেল বাজিয়ে কাউকে বিরক্ত করতে হয় না।
আমি জুতোটা বাইরে খুলে ঘরে ঢুকলাম। আর ঢুকেই থমকে গেলাম। দেখলাম বাবা-মা, দিদিকে মাঝখানে রেখে বসে রয়েছে। দিদির চুল এলোমেলো। চোখ লাল। নাকের মাথাও লাল। দেখেই বুঝলাম খুব কান্নাকাটি করেছে। এই সেরেছে, কী হল আবার! আমাদের বাড়িতে যেন নাটকের শেষ নেই!
আমায় দেখে মা বলে উঠল, “জানিস কী হয়েছে! জানোয়ারটা কী করেছে জানিস?”
“কে? কোন জানোয়ার!” আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
“দীপ্য!” মা ফুঁসে উঠল আবার।
“কী করেছে?” আমি অবাক হলাম।
“জানিস আজ মেসেজ করেছে ছেলেটা!” মা আবার তড়বড় করে উঠল।
“সে তো রোজ করে। কোটি কোটি লোক করছে। প্রবলেমটা কী?” আমি অবাক হলাম।
মা বলল, “মেসেজে ও মলির সঙ্গে ব্রেকআপ করে নিয়েছে জানিস! বলেছে গুড লাক।”
আমি অবাক হলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার সিগারেট আর পুরনো পেতলের গন্ধ মনে পড়ে গেল। গা গুলিয়ে উঠল। আমি চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করলাম।
মা বলল, “অসভ্য জানোয়ার! সামনে পেলে জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দিতাম! নিশ্চিত কোনও ডাইনির খপ্পরে পড়েছে! আমি শিয়োর! তুমি কী বলো?”
মা বাবাকে ঠেলল। বাবা কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, “উইচহান্ট করবে না কি?”
মা বিরক্ত হল, “মেয়েটা কাঁদছে আর তুমি ইয়ার্কি মারছ! তুমি বাবা না রাক্ষস!”
বাবা মাথা নাড়ল, “যে লোক আমার মেয়েকে ভালবাসে না বলে দিয়েছে, তার সঙ্গে আমার মেয়ে থাকলে কষ্ট পাবে। তা ছাড়া ছেলেটা বড্ড মেটিরিয়ালিস্টিক। আমার ভাল লাগে না।”
মা বলল, “একটা বাজে ছেলে! পয়সা ছাড়া কিছু নেই! অশিক্ষিত! ছি ছি!”
আমি বললাম, “তোমরা এমন করছ কেন? দিদি তো নিজেই ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছিল! সেখানে ও নিজে গেছে। বাঁচা গেছে।”
দিদি এ বার তাকাল আমার দিকে। বাপ রে! কী দৃষ্টি! সত্যযুগ হলে ভস্ম হয়ে যেতাম নির্ঘাত!
দিদি হিসহিসে গলায় বলল, “ও নিশ্চয়ই অন্য কারও চক্করে পড়েছে। আমি নিশ্চিত। মা খারাপ বলেনি। নিশ্চয়ই কেউ একটা আছে যার জন্য এমন করছে। তাকে এক বার পেলে না...”
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে ঢোঁক গিললাম! দিদি যে তাকে হাতের গোড়াতেই পাচ্ছে, সে কী আর দিদি জানে!
১৩
পুঁটি (দিন : বিয়াল্লিশ)
এনাকে ছাড়া আজ আমার জীবনের বিয়াল্লিশতম দিন!
কাল রাতে একটা এমন স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, ঘুম ভেঙে গিয়েছিল হঠাৎ। খাটের পাশের ছোট টেবিল থেকে ঘড়িটা তুলে দেখেছিলাম ভোর চারটে দশ। কেমন একটা ঘোর ছিল তখনও। কিন্তু তাও মনে হয়েছিল, এনাকে ছাড়া আজ বিয়াল্লিশ দিন। এর মধ্যেই এমন একটা স্বপ্ন দেখলাম! কিন্তু তাতে তো খুব কিছু কষ্ট আমার হচ্ছে না! এটা কেন!
আমি আবার শুয়ে পড়েছিলাম। চোখ বন্ধ করে ঘুমোনোর চেষ্টা করছিলাম। আর চোখ বন্ধ করলেই কেমন যেন সামনে ভেসে উঠছিল স্বপ্নের দৃশ্যটা। একটা ছেলে এনাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ের কাছে মুখ গুঁজে আদর করছে!
আগে হলে আমি এই স্বপ্ন দেখে কেঁদেকেটে নাকের জলে চোখের জলে করে দিতাম একদম। নালে-ঝোলে অবস্থা হত আমার। কিন্তু ওই ভোররাতে আমার কিছুই হয়নি! বরং কেমন একটা নিঃস্পৃহ দূরত্ব থেকে যেন দেখছিলাম এনাকে। যেন ও অন্য কারও প্রেমিকা। অন্য কারও সঙ্গে আছে। শুধু মনে হয়েছিল এনা যে জামাটা পরেছিল, সেটা আমিই ওকে কিনে দিয়েছিলাম গত বারের পুজোয়।
আবার যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেই বুঝতে পারিনি। তবে না, আর এনাকে নিয়ে কিছু স্বপ্ন দেখিনি। বরং ফুটবল খেলা নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম। দেখেছিলাম আমার বাবা বল নিয়ে রাইট আউট বরাবর দৌড়চ্ছে।
বাবা এক সময় ফুটবল খেলত। কলকাতা মাঠেও খেলেছে। শুনেছি, ভাল খেলত বাবা। অনেক প্রাইজ়ও নাকি পেয়েছিল। কিন্তু সে-সব আর নেই। কে জানে কেন নেই। বাবার কাছে শুধু একটা শিল্ড রয়ে গিয়েছে। বেস্ট প্লেয়ার প্রাইজ়। সুন্দর শিল্ডটা। তাতে একটা রুপোর বাঘের মাথা লাগানো।
আমি ছোটবেলায় বাড়ির বারান্দায় ক্যাম্বিসের ছোট বল দিয়ে একা একা ফুটবল খেলে নিজেই অনেকগুলো করে গোল দিতাম। তার পর দৌড়ে গিয়ে ওই শিল্ডটাই নিজেকে পুরস্কার স্বরূপ দিয়ে দিতাম। বড়রা হাসত আমায় দেখে। ছোটকা শুধু বলত, “আরে, তোমরা হাসছ কেন? ও কী এমন ভুল করেছে! গোল দিলে প্রাইজ় পাবে না!”
ছোটকা আমায় সারা জীবন সাপোর্ট করে গিয়েছে। আমায় এমন ঘোষিত ভাবে ভাল আর কেউ বাসেনি কোনও দিন। সেই লোকটা ও ভাবে সবাইকে লুকিয়ে নিজের নামে সম্পত্তি করেছে।
আমি কালীঘাট মেট্রো থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে বাঁক নিলাম। সামনেই ফুটপাতের উপর বড় একটা জুতোর দোকান। তার সামনে সার দিয়ে দাঁড় করানো আছে অটো।
এখন দুপুর। জুলাইয়ের তিরিশ তারিখ। আকাশে মেঘ আছে। তবে হাওয়া না থাকায় কলকাতা প্রেশার কুকারের মতো হয়ে আছে একদম। ঘামে আমার পৈতে ভিজে গিয়েছে। মেট্রোতেও আজ এসি রেক পাইনি। ফলে গরমে কষ্ট হয়েছে খুব।
আমি ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে তিনটে বাজে। আজ বাবা অফিসে এসেছে। তবে রেগুলার অফিস করার মতো নয়। নানা টেস্ট করার ছিল। সেটা করার পথে জেদ করেই এসেছে। এখন নাকি শরীর অনেক ভাল। জোর করে কেন বাড়িতে বসে থাকবে।
বাগালের অফিসের ল্যান্ড লাইন থেকে ফোন করেছিলাম জেঠুকে। তখন ফোনেই সব খবর পেয়েছি। জেঠুই বলেছিল আমায়। বলেছিল, আমি এসে যেন বাবাকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যাই।
ক্রমশ