স্বনির্ভর: ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিয়ায় শালগম চাষে ব্যস্ত মহিলারা, কাজের সুবিধের জন্য পরনে পুরুষের পোশাক। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স
আলতো হাওয়ায় মাথা নাড়ছে সদ্য-ফোটা সূর্যমুখী। ও পাশের টবে টমেটোরা আবার লজ্জায় রাঙা টুকটুক। বারান্দায় পা রাখতেই ঝাপটে এল কারিপাতা গাছের সৌরভ, তাতে ঈষৎ বাদামি রঙের ফল ধরেছে। মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাটের এক চিলতে বারান্দায় এখন শুধুই রঙের খেলা।
ছাদের ধার ঘেঁষে, বারান্দার টবে-পটে, ঘরের কোণে গাছ বসানোর শখ মধ্যবিত্তের বহু কালের। পুজোর টগর, জুঁই, সরষে, ঝালের কাঁচালঙ্কা বা মিঠে চাটনির টমেটোরা হামেশাই রসুই-বাগান থেকে সরাসরি ঠাকুরঘরে বা গরম কড়ায় এন্ট্রি নেয়। জানলা দিয়ে হাত বাড়ালে ডালের পাতে গন্ধরাজ বা পাতিলেবুও কখনও-সখনও জুটে যায় বইকি। কিন্তু অ্যাদ্দিন সে-সব ছিল নেহাতই শখ-আহ্লাদ, অবসর যাপন। আহা, বাজারের ক্ষতিকর রং করা নধরকান্তি বেগুনের চেয়ে বেঁচে থাক নিজের হাতে তৈরি চিমসে বেগুন, ঢেঁড়সরা। কিন্তু এই শখটাকেই পাকাপোক্ত প্রয়োজন বানিয়ে ছাড়ল কোভিড-১৯। আচমকাই দেশ-বিদেশে তালাবন্দি হওয়ার সরকারি নির্দেশ এল। শুরু হল গৃহস্থের ভাঁড়ার ভর্তির পালা। অস্ট্রেলিয়ার সুপারমার্কেটগুলোর তাক থেকে উধাও হল ময়দা, ইটালিতে এল পাস্তার আকাল, প্রায় ডিমশূন্য হয়ে পড়ল ব্রিটেন। ভারতের অবস্থাও করুণ। দু’বেলা ভাত-রুটির বন্দোবস্ত না হয় সরকারি উদ্যোগে করা গেল, কিন্তু আনাজপাতি? বাজারে গেলে সংক্রমণের ভয়, বাজার বাড়ির দরজায় না এলে শুধুই সেদ্ধ-ভাত আর খিচুড়ি খেয়ে দিন কাটানোর ভয়। এই সব ভয়ের মিলিজুলি ফল— গেরস্তের হাতে খুরপি, ছাদ-বারান্দায় টবের সারি। কোনও একটি দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই। জনৈক ব্রিটিশ লিখলেন, মার্চ মাসে ব্রিটেনে লকডাউন ঘোষণার সময়ই তিনি একখানি চারা তৈরির ট্রে আর কিছু শাকপাতার বীজ অর্ডার দিয়েছিলেন। তার পর দু্’মাস পেরিয়েছে। জীবন স্বাভাবিক হয়নি। কিন্তু তাঁর সতেজ লেটুস পাতারা দিব্যি মাথা তুলেছে। বিলিতি পত্রিকায়ও রিপোর্ট বেরোল, লকডাউনে লাফিয়ে বেড়েছে বীজ কেনার চাহিদা। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে, আলু।
প্রয়োজন মেটানোর চরম তাগিদ থেকে নিজের বাড়ির চৌহদ্দিটাকেই চাষের জমি বানিয়ে ফেলার এই যে ইচ্ছে, এ অবশ্য করোনার আমদানি নয়। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ যখন তোলপাড় করছে গোটা দুনিয়া, তখন বিদেশে, বিশেষ করে আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে সাধারণ মানুষের ভিতর এক অদ্ভুত অভ্যেস তৈরি হল। ফাঁকা এক চিলতে জমি পেলেই সেখানে বাগান করার অভ্যেস। ঘরের লাগোয়া এক ফালি চত্বর, খেলার মাঠ, পরিত্যক্ত জমি, পার্ক, স্কুল বা চার্চ-লাগোয়া জমিতে আনাজপাতি লাগানো শুরু হল। বাদ পড়ল না চওড়া জানলার সামনের অংশ বা সিঁড়ির পাশটিও।
যুদ্ধের বাজারে বহু দেশে তখন খাদ্যসঙ্কট তুঙ্গে। সেই আকালের দিনে অনেকের বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়েছিল এই বাগানগুলো। সরকার থেকেও জনগণকে ডাক দেওয়া হয়, মহাযুদ্ধ চলাকালীন দেশকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার কাজে যোগ দেওয়ার জন্য। দুর্দিনে মাটিকে ফলনশীল করে তোলাই তো প্রকৃত দেশসেবা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের কৃষি দফতর থেকে স্লোগান তোলা হল— জিততে হলে মাটি কোপাও। এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই সাধারণ মানুষের হাতে তৈরি বাগানের নাম দেওয়া হল, ‘ভিকট্রি গার্ডেন’। যে ‘ভিকট্রি গার্ডেন’-এর প্রসঙ্গ অতিমারির দিনগুলোয় ফের উঠে আসছে সমাজমাধ্যমে। এও তো এক অনিশ্চিত সময়। কেউ জানে না, কাল কী হবে। তাই খাবারটুকুর ব্যবস্থা নিজেরাই যতটা সম্ভব করে নেওয়া যাক।
বিশ শতকের দুটো বিশ্বযুদ্ধের সময়ই ছিল আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সময়। পশ্চিমের দেশগুলোতে সরকার মাথাপিছু বরাদ্দ বেঁধে দিয়েছিল চিনি, মাখন, দুধ, চিজ়, ডিম, কফি আর মাংসের। সক্ষম পুরুষরা নাম লিখিয়েছে সেনাবাহিনীতে। তাই আনাজ, ফল চাষই বা করবে কে আর সে সব জিনিস বাজারেই বা পৌঁছে দেবে কে? ইতিহাস বলছে, ১৯১৭ সালের মার্চে, আমেরিকা যুদ্ধে নাম লেখানোর কয়েক সপ্তাহ আগে সেখানে তৈরি হয়েছিল ‘ন্যাশনাল ওয়র গার্ডেন কমিশন’, যাদের কাজই ছিল আমেরিকানদের গাছ লাগানো, সার দেওয়া, চাষ করা আর নিজেদের তৈরি ফল, আনাজকে ঠিকঠাক উপায়ে জমিয়ে রাখার ব্যাপারে লাগাতার উৎসাহ দিয়ে চলা। লক্ষ্য, দেশের ভিতরের খাদ্যসঙ্কট যাতে কোনও ভাবেই মাথাচাড়া না দিতে পারে। আর দেশের চাহিদা মিটিয়ে যাতে এই বাড়তি ফসল অন্যান্য বন্ধুভাবাপন্ন দেশে রফতানি করা যায়। ওই বছরই কানাডার কৃষি দফতরের পক্ষ থেকে প্রচার করা হতে লাগল, “প্রত্যেক বাড়িতে চাই সবজি বাগান।’’ সে ফসল বাড়ির রান্নাঘরেও কাজে আসবে, যুদ্ধে সেনাবাহিনীকে রসদও জোগাবে। ফলে সেই সময় জোয়ার এল আলু, বিট, বাঁধাকপির মতো হরেক সবজির ফলনে।
বাগান করার এই আন্দোলনের কথা তখন লোকের মুখে মুখে। নেহাতই আনাড়ি বাগান-করিয়েদের মধ্যে বিলি করা হয়েছিল বাগান করতে শেখার সহজ-পাঠ— কখন, কোথায়, কী ভাবে বীজ বোনা যায়, গাছের নানা অসুখ, পোকার আক্রমণ থেকে কী ভাবে তাকে রক্ষা করা যায়, সেরা ফসলই বা পাওয়া যায় কী ভাবে। এই প্রচারে যে সাড়া মিলেছিল, তা অভূতপূর্ব। এক সময় আমেরিকায় মোট উৎপন্ন তাজা আনাজপাতির চল্লিশ শতাংশের জোগানই আসত স্কুল, বাড়ি বা সমবায় বাগিচাগুলি থেকে। এ ক্ষেত্রে মেয়েরা এক অসাধারণ ভূমিকা নিয়েছিল। পুরুষরা যে লড়াইটা লড়তে গিয়েছিল যুদ্ধের মাঠে, মেয়েরা সেই লড়াইটাই লড়েছিল দেশের ভিতর, বাড়ির মধ্যে থেকে। এই লড়াই পাল্টে দেওয়ার লড়াই। প্রমাণ করার লড়াই— চাষের খেতে শুধু পুরুষরাই ঘাম ঝরায় না, মেয়েরাও সেই কাজের অংশী হতে পারে, অনায়াসে।
ভূমিকা বদলের শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকেই। চাষবাসের জন্য আমেরিকায় তৈরি হল মেয়েদের বাহিনী। নাম, ‘উইমেনস ল্যান্ড আর্মি অব আমেরিকা’, ব্রিটেনে ‘ব্রিটিশ উইমেনস ল্যান্ড আর্মি’। সেখানে মেয়েরা যোগ দিল গ্রাম-শহর নির্বিশেষে। কানাডার এক তরুণী লিখলেন, “আমি আমার কাজে পরে যাওয়ার জুতো, মোজা, রবারের বুট, বাবার পুরনো শার্ট, খড়ের টুপি আর ব্যান্ডানা জড়ো করলাম। ব্যস, আমি চাষের কাজে হাত লাগাতে তৈরি।”
এই মেয়েদের বেশির ভাগেরই চাষবাসের কাজে কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না। কিন্তু শিখে নেওয়ার আশ্চর্য সহজাত গুণটিকে কাজে লাগিয়ে দেখা গেল, কিছু দিনের মধ্যেই তাঁরা দিব্যি সেই কাজে পটু হয়ে উঠেছেন। প্রতি দিন প্রায় আট ঘণ্টা পরিশ্রম করতেন তাঁরা, বিনিময়ে মজুরি পেতেন পুরুষদের সমান। খুব শীঘ্রই চাষি পরিবারের মেয়েরা আজানুলম্বিত গাউন পরার অভ্যেস ছেড়ে মাঠের কাজের উপযোগী প্যান্ট পরা শুরু করলেন। সে কালের পোস্টারগুলোয় মাথায় ফেট্টি বাঁধা, শার্টের হাতা গোটানো, হাতে শাবল নেওয়া মেয়েদের ছবি হামেশাই দেখা যেত। কানাডার এক মায়ের কথা জানা যায়, যাঁর নয় ছেলেই হয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, বা দূরের কারখানায় কাজ করতে চলে গিয়েছিল। তিনি একা হাতেই সামলাতেন তাঁর প্রকাণ্ড ফার্ম। চালাতেন ট্র্যাক্টর, চষতেন জমি। সঙ্গে পুষতেন মুরগি, টার্কি, শুয়োর। শ’য়ে শ’য়ে বয়াম ভরে ফল, আনাজ সংরক্ষণও করতেন তিনি। এও তো এক লড়াই। এই লড়াই যেমন খিদের বিরুদ্ধেও, তেমনই আবার সমানাধিকার ছিনিয়ে নেওয়ারও। আর সব কিছু পেরিয়ে আসলে ‘আত্মনির্ভর’ হয়ে ওঠার লড়াই।
এমন আত্মনির্ভরতার গল্প কিন্তু মোটেই আগাগোড়া বিলিতি বা বিদেশি নয়। এ দেশের গ্রামবাংলাতেও এমন ছবি চির পরিচিত।
গ্রামের মেয়েরা আবার কবে বাজার বসার ভরসায় বসে থাকেন? চাষি পরিবারের পুরুষ আর মেয়েরা চাষের ঋতুতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জমিতে ঘাম ঝরান। আর সারা বছর তাঁদের বাড়ির মাচায় লকলকিয়ে বাড়ে কুমড়ো, লাউ, ঝিঙে, শসা। এক ফালি জমি পেলেই নিপুণ হাতের আদরে সেখানে ফলে ওঠে বেগুন, ঢেঁড়স, পুঁইশাক, ফুলকপি, পেঁপে, কলা। মাঠের ধান কেটে নেওয়ার আগেই জমিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সরষে। গ্রামের মেয়েদের এ সম্বৎসরের অভ্যেস।
আত্মনির্ভরশীলতার মন্ত্র গ্রামবাংলার মেয়েদের জন্মগত। অন্যে তাঁদের কী শেখাবে!
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে নিবন্ধ পাঠান। শব্দসংখ্যা ৬০০-১২০০। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। পিডিএফ-এ নয়, ওয়ার্ড ফাইল ইমেল করুন।
ইমেল: rabi.article@abp.in
সাবজেক্ট: Rabibasariya Nibandha
পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর ও সম্পূর্ণ ঠিকানা দেবেন।