ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
• (গত সংখ্যার পর) •
২
অপাপবিদ্ধ?
ধা ক্কাটা যে এত জোরে আসবে, সেটা ঠিক বুঝতে পারেনি বুধুয়া। তাই সে প্রস্তুত ছিল না। কী হচ্ছে ঠিকমত বুঝে ওঠার আগেই আরও এক বার প্রবল একটা ধাক্কা। কাঁধের কাছটাতে কেউ যেন জোরে একটা লাথি মারল হঠাৎ। কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেল বুধুয়া!
বন্দুক নিয়ে তো সে আগেও কত খেলা করেছে। কিন্তু এই অস্ত্রটা অন্য রকম। বাবা এনেই খাটের তলায় লুকিয়ে ফেলেছিল। আর তখন থেকেই বুধুয়ার ওটার উপর লোভ! হাতে নিয়ে দেখতেই হবে। দেখতে পেলে বাবা অবশ্য প্রচণ্ড বকবে। এক বার ঠাকুমা দেখে ফেলেছিল। সেদিন বকুনি তো জুটেইছিল কপালে, তার উপর বাবা ফিরে এসে প্রচণ্ড মেরেছিল। ঠাকুমা বাবাকে বলে দিয়েছিল যে! বাবার ওই এক দোষ! এমনিতে ভালই বাসে বুধুয়াকে, ছোটনকেও। কিন্তু রেগে গেলে প্রচণ্ড মারে। আর মদ খেলেও। বাবা কিন্তু মদ বলে না কখনও! বলে ‘মাল’। মা’ও তাই বলে। মাল টানা নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হয় মা-বাবার মধ্যে। চুলোচুলি ঝগড়া। মদ শব্দটা শুধু ঠাকুমার মুখেই শোনে বুধুয়া।
‘আবার মদ খায়ে আইছে। এখন তোর ও ঘরে যাতি হবে না। মেজাজ চড়ে গেলিই মারব্যানে তোরে। তুই আমার কাছে শো।
ঠাকুমার নাকি দেশ ছিল খুলনায়। তাই ঠাকুমা আজও খুলনার ভাষা বলে। বুধুয়া কিন্তু জন্ম থেকে ঠাকুমাকে এই বাড়িতেই দেখেছে। শিউলিবাড়ির এই অপরিসর, আড়াইখানা ঘরের বাড়িতেই বড় হয়েছে বুধুয়া। অবশ্য বড় হওয়া এখনও শেষ হয়নি তার। ঠাকুমা তাকে মাঝে মাঝেই বলে, ‘বড় হলি বো-Z-বা!’ ঠাকুমাকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করলেই ওই এক উত্তর!
‘মা আর বাবা অত ঝগড়া করে কেন ঠাকুমা?’
‘বড় হলি বো-Z-বা।’
‘আচ্ছা ঠাকুমা, সেই যে এক বার বাড়িতে পুলিশ এল, বাবাকে ধরে নিয়ে গেল, তার পর বাবা কত দিন পরে ফিরল! কেন নিয়ে গেছিল গো?
‘অইন্যায় করিছিল, তোর বাপ।’
‘কী অন্যায়?’
‘বড় হলি বো-Z-বা।’
‘বাবা অত মদ খায় কেন?’
‘বড় হলি বো-Z-বা।’ এ কথাটা বলার পরেই কেমন যেন চুপ হয়ে যায় ঠাকুমা। একটু পরে বলে, ‘তোমরা বড় হলি ওই সব ছাইপাঁশ খায়ো না কিন্তু, দাদুভাই। ও সব খাতি হয় না।’ তার পরেই সাদা থান-কাপড়ের আঁচল দিয়ে বুধুয়া চোখ মুছতে দেখেছে ঠাকুমাকে। আর কখনও ঠাকুমাকে ও কথা জিজ্ঞেস করেনি সে। ঠাকুমা কষ্ট পেলে তারও কষ্ট হয় খুব!
বাবা যে কেন অত মদ খায়!
শুধু বাবা নয়, দুলিয়াকাকু, ঝন্টুকাকু, বিলাসজ্যাঠা তাদের পিজি কলোনির অনেকেই ‘মাল’ খায়। পাড়ার বড় ছেলেরা বলে মালখোর। কলোনির কাছেই তো মালের ঠেক। পিজি কলোনির থেকে চিত্তরঞ্জনের দিকে চলে গেছে যে সরু পিচের রাস্তাটা, সেই রাস্তার বাঁকটা পেরিয়ে মিনিট দশেক হাঁটলেই দু’দিকে বিরাট বিরাট ঝাঁকড়া গাছের সারি শুরু হয়ে যায়। ওটাকে বলে হাইওয়ে। ওখানে রাস্তাটাও অনেক চওড়া। তাদের সরু, পিচঢালা পথটা ওইখানে গিয়ে হাইওয়েতে মিশে গেছে। ওখানকার ছোট্ট মতন মোড়টাকে লোকে বলে শিউলিবাড়ির মোড়। আর সেই মোড়ের মুখেই একটা অতিকায় ছাতার মতো ছড়িয়ে থাকা বিশাল গাছের তলায়, মালের ঠেক। নান্টু চিনিয়ে দিয়েছে তাকে।
দিনের বেলা বন্ধ পড়ে থাকে! দেখলে মনে হবে কেউ কোথাও নেই। ঝাঁপি বন্ধ, সামনে একটা অ্যাসবেস্টসের দরজা মতো, দড়ি দিয়ে বাঁধা, টিনের চালে শুকনো পাতার খড়খড়। কোথাও, কোনও একটা গাছের ফাঁকে বোধহয় ডাহুকের বাসা। দূর থেকে ভেসে আসছে ডাহুকের ডাক। বন্ধ দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে মনখারাপ হয়ে যাচ্ছিল বুধুয়ার। রাগও হচ্ছিল খুব। এই দোকানটা এখানে না থাকলেই তো বাবা আর এখানে মদ খেতে আসত না। কী দরকার ছিল এই মদেশিয়াদের এখানে দোকান দেওয়ার?
‘ওরা এখানেই থাকে, জানিস তো!’ ফিসফিস করেছিল নান্টু।
‘কারা?’
‘ওই মদেশিয়ারা। এখনও বোধহয় ভিতরেই আছে। দিনের বেলা ওরা চোলাই তৈরি করে। বাবা রুখুজ্যাঠাকে বলছিল সে দিন।’
‘তোর বাবাও এখানে আসে?’
‘আসবে না? কলোনির সবাই আসে তো। আমিও আসব! আর একটু বড় হই!’
‘তুই এখানে আসবি?’
‘কেন আসব না? বড় হব, মাল খাব না! তখন কি আর মা পেটাতে পারবে? তোকেও নিয়ে আসব।’
‘না।’
‘না মানে?’
‘আমি কক্ষনও আসব না এখানে।’
ঠাকুমার মুখটা মনে পড়ে গেছিল বুধুয়ার। ওই ডাহুকের ভেসে আসা ডাকটার সাথে ঠাকুমার মুখের কী যেন মিল আছে! কীসের মিল? আর ভাবতে পারেনি বুধুয়া। দৌড়ে চলে এসেছিল জায়গাটা থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিল, তিরবেগে ছুটে যাওয়া তার ছোট্ট শরীরটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নান্টু।
সে ছোটখাটো হলে কী হবে, এই দুটো ক্ষমতার জন্য পিজি কলোনির বড় ছেলেরাও তাকে একটু সমীহ করে চলে। অসম্ভব জোরে দৌড়তে পারে বুধুয়া। ইস্কুলে দু’ক্লাস উঁচুতে পড়া ছেলেদেরও দৌড়ে হারিয়ে দেয়। অ্যানুয়াল স্পোর্টসে একশো বা দু’শো মিটারে তার কাছাকাছি বয়সের কেউ কোনও দিন তাকে হারাতে পারেনি।
তবে যে জিনিসটা সে আরও ভাল পারে সেটা অবশ্য কখনও তাদের স্পোর্টসে হয় না। কিন্তু কলোনির ছেলেরা সবাই জানে। তার হাতের টিপ অসাধারণ। স্থির লক্ষ্য। বহু দূরের ডালে ঝুলে থাকা আম সে এক ঢিলে নামিয়ে আনতে পারে। গুলতি দিয়ে অনেক উঁচু ডালে বসে থাকা চড়াই বা শালিকের মতো ছোট পাখিকেও এমন দক্ষ হাতে নিশানা করতে পারে বুধুয়া যে পাখিটার গায়ে লাগবে না, কিন্তু যে ডালটাতে বসে আছে পাখিটা, সেই ডালটা দুলে উঠবে। ভয় পেয়ে পাখিটা উড়ে যাবে ডানা ঝটপটিয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে এক-আধ বার সে উড়ন্ত পাখি লক্ষ্য করেও গুলতি চালিয়েছে। পাখিগুলো মরেনি যদিও, কিন্তু ডানা ঝটপটিয়ে পড়ে গেছে। সে দৃশ্য ভাল লাগেনি বুধুয়ার। এক বার একটা চড়াইপাখির দিকে গুলতি তাক করে, ছুটে গিয়ে পাখিটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে গায়ে হাত বুলিয়েছিল, যত ক্ষণে পাখিটা আবার চাঙ্গা হয়ে উড়ে না যায়। তার ছোট্ট হাতের তালুতে টের পেয়েছিল চড়াইপাখির নরম বুকের ধুকপুক!
গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা। কলোনিপাড়ায় কোনও কথাই কারও অজানা থাকে না। অল্প ক’দিনের মধ্যেই তার অব্যর্থ নিশানার গল্প পৌঁছে গেছিল বাড়িতে। বাবা হেসেছিল শুনে। কিন্তু ঠাকুমা যে আদৌ খুশি হয়নি, বুঝতে পেরেছিল বুধুয়া। বাবাকে ধমকে উঠেছিল ঠাকুমা, ‘হাসতিছিস কেন? এ তোদের রক্তের দোষ। কী লোকের ছেলে তুই, কী হয়ে গিছিস! ছেলে দুডোরে মানুষ করতিছিস এই বস্তিতে!’
ফ্যাকফ্যাক করে হেসেছিল বাবা।
রেগে গেলে তাদের এই পিজি কলোনিটাকে বস্তি বলে ঠাকুমা। বুধুয়া আগেও শুনেছে। বস্তি কী, জানে না বুধুয়া। তার এই কলোনিটাকে ভালই লাগে। যদিও নামটা কী রকম অদ্ভুত। পিজি কলোনি। অনেক দিন আগে নাকি এখানে রেলের একটা গুদাম হওয়ার কথা ছিল। পার্টস গোডাউন, ছোট করে পিজি। গোডাউন হয়নি, কিন্তু নামটা সেই থেকে চলে আসছে।
গায়ে গা ঠেকিয়ে দেড়শো পরিবারের বাস। সরু সরু গলি। খোলা নর্দমা। গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দু’দিকে হাত ছড়িয়ে দিলে দুটো বাড়ির দেওয়াল ছুঁয়ে ফেলা যায়। বুধুয়া অবশ্য পারে না। তার হাত পৌঁছয় না, কিন্তু সে বিল্টুদাকে অনেক বার করতে দেখেছে। বিল্টুদা তার থেকে অনেক বড়। গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছিল। ফেল করেছে। তাদের ঠিক উলটো দিকের বাড়িতে থাকে বিল্টুদা। মাঝে মাঝেই নিজেদের বাড়ির ছাদের আলসের উপর উঠে, একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে তাদের বাড়ির ছাদে এসে পড়ে। বুধুয়া লক্ষ করে দেখেছে, বাবা যখন বাড়ি থাকে না, ঠিক সেই সব সময়েই বেশি আসে বিল্টুদা। বিল্টুদা মায়ের খুব বন্ধু। বাবা যখন থাকে না তখন মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে কথা বলে। মা’ও বলে। এত আস্তে কথা বলে দুজনে যে ঘরে থাকলেও সে-সব কথা ঠিক বুঝতে পারে না বুধুয়া।
এক বার বিল্টুদা’দের ছাদে তাদের বল পড়েছিল। তখন তাদের গলির ক্রিকেট ম্যাচটার খুব টানটান অবস্থা। শেষ ওভারে পাঁচ রান করতে পারলেই লকেটরা জিতে যাবে। না হলে বুধুয়ারা। বলটা আনতে এক দৌড়ে বিল্টুদার বাড়ির ছাদে উঠে গেছিল বুধুয়া। সে ওই বাড়িতে প্রায়ই যায়। কেউ কিছু বলেনি। তখন বিকেল শেষ হয়ে এসেছে। শীতের সন্ধ্যা দ্রুত গ্রাস করে নিচ্ছে পিজি কলোনির সরু সরু গলিপথ। সে তখন ঊর্ধ্বশ্বাস। আর একটু হলেই বল আর দেখা যাবে না। ম্যাচ ড্র। সেই মুহূর্তে এক বার নিজেদের বাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে থ হয়ে গিয়েছিল বুধুয়া। মা আর বিল্টুদা কী যেন করছে. দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে জোরে। কিন্তু সেখানে তখন দাঁড়াবার সময় নেই তার! সে দিন ম্যাচটা তারা জিতেছিল। আর সেই জেতার উত্তেজনায় ছাদের কথাটা ভুলে গিয়েছিল বুধুয়া। পরের দিন যখন আবার মনে পড়ল কথাটা, তখন কেন যেন মনে হয়েছিল সেটা কাউকে বলা যাবে না! ঠাকুমাকে কথাটা বলতে গিয়েও বলেনি বুধুয়া। কাউকেই বলেনি আর।
বিল্টুদাকে ভালই লাগে বুধুয়ার। তাকে লজেন্স কিনে দেয় মাঝে মাঝেই। ছোটকেও। দু’একবার ঘুড়িও কিনে দিয়েছে। তা ছাড়া মায়েরও অনেক কাজ করে দেয় বিল্টুদা। অবশ্য বাড়ি থাকলে। যা কিনা আজকাল প্রায়ই থাকে না বিল্টুদা। আজকাল বাবার সঙ্গেও ফিসফিস করে কী সব আলোচনা করে। বাবা আর ঝন্টুকাকা যখন ধান্দায় বেরোয়, কখনও-সখনও বিল্টুদাও যায় তাদের সঙ্গে। এক বার চুলোচুলি ঝগড়ার সময় মা বাবাকে বলছিল, তুমি বিল্টুকেও বিপথে নিয়ে যাচ্ছ! সাপের মতো ফুঁসে উঠেছিল বাবা।
‘ওঃ। তোমার বিল্টু একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা! তোমাদের মধ্যে কী চলে আমি জানি না ভেবেছ? আমার মুখ খুলিও না আর। তাতে ভাল হবে না!’
মা কিছু বলেনি। চুপ করে গিয়েছিল। বলবে কী করে? বিল্টুদা না থাকলে মা’কে কলতলা থেকে বিকেলের জল তুলে দেবে কে?
কলোনিতে অতগুলো লোকের জন্য সাকুল্যে তিনটে কলতলা। জল আসে রোজ ভোরে আর বেলা তিনটেয়। জলের লাইনে রোজই কারও না কারও মধ্যে চিৎকার করে ঝগড়া হয়। মাঝে মাঝে হাতাহাতিও বেধে যায়। তখন পুরো কলতলাটা যেন দু’ভাগ হয়ে যায়। এক দল এর দিকে, এক দল ওর দিকে। চিৎকার চেঁচামেচি চলে অনেক ক্ষণ। তার মধ্যেই আবার লাইন দিয়ে জল তোলাও চলতে থাকে। অনেকের জল তোলা হয়ে গেলে, ভিড় যখন পাতলা হয়ে আসে, তখন ঝগড়া থামে সে দিনের মতো। কিন্তু বিল্টুদা বেশ লম্বা-চওড়া। তা ছাড়া পাড়ায় বিল্টুদা’দের গ্যাং আছে। তাই কলতলায় বিল্টুদাকে কেউ ঘাঁটায় না।
পায়খানার লাইনেও না। ওই আর একটা গেরো। তাদের অত বড় কলোনির জন্য এ দিকে সাতটা পায়খানা। ও দিকে সাতটা। সকাল সন্ধ্যায় লম্বা লম্বা লাইন পায়খানার সামনে। বিশেষ করে ভোরবেলা। ছোটদের তো লাইন দেওয়ার নিয়মই নেই। তারা বসে কলোনির পিছন দিকের বড় নর্দমাটার উপর, সারি দিয়ে। মেয়েরা যখন পায়খানার সামনে লাইন দেয়, তখন বোঝা যায় তারা বড় হয়ে গেছে। ফুলকি, মতিয়া, চম্পারা এখন আর নর্দমায় বসে না তাদের সঙ্গে। কয়েক দিন আগেও যেত। এখন ওরা পায়খানার সামনে লাইন দেয়। ওরা বোধহয় বড় হয়ে গেছে!
এই বড় হওয়ার ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বুধুয়া। ইস্কুলের মাস্টারমশাই তো বলছিলেন সে দিন, ‘তোমরা স্বাধীন দেশে জন্মেছ, পরে বুঝতে পারবে এটা কত বড় পাওয়া। স্বাধীনতার মুখ দেখে বড় হয়ে উঠছ তোমরা।’
বড় হয়ে উঠলে স্বাধীনতার মুখ দেখা যায়? এ কথাটা বেশ ভাবিয়েছে বুধুয়াকে। স্বাধীনতাকে কী রকম দেখতে? কোথায় গেলে দেখা যায় তার মুখ?
• (ক্রমশ) •