যুদ্ধ মানে কি শুধু ট্যাঙ্ক আর গোলাগুলি? ইউক্রেনের সরকারি টুইটারে হিটলার পুতিনের গালে হাত বুলিয়ে দেন। ঠান্ডা যুদ্ধের সময়, স্তালিনের সোভিয়েট রাশিয়ায় জোক বলার দায়ে কারাদণ্ড হয়, জোক সংগ্রহের জন্য আমেরিকা রাখে গুপ্তচর। যুগে যুগে যুদ্ধের বিরোধিতায় সাধারণ মানুষের কৌতুকী কটাক্ষ তবু রয়ে যায়।
রণকৌতুক: ভ্লাদিমির পুতিনের গালে হিটলারের স্নেহস্পর্শ (ছবি সৌজন্য: টুইটার), ডান দিকে, বেন লিউইসের বিখ্যাত বই ‘হ্যামার অ্যান্ড টিকল’।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ সৈন্য ইউক্রেন আক্রমণ করার কিছু পরেই ইউক্রেনের সরকারি টুইটারে একটি কার্টুন পোস্ট করা হয়। কার্টুনটিতে দেখা যায় হিটলার পুতিনের গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই কার্টুনটি অনেককে অবাক করে দেয়। একটি দেশ যখন তার অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছে, তখন তার সরকার কার্টুন এঁকে সময় নষ্ট করছে কেন? সে প্রশ্নের জবাব আপাতত মুলতুবি রাখলেও, এটুকু বলাই যায় যে, যুদ্ধ শুরুর আগের কয়েক মাস ধরেই আন্তর্জালে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়ে ঠাট্টা, ইয়ার্কি, জোক এবং মিম আন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়েছিল। হয়তো কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই এ সব জোক যতই নজরে এসেছে, ততই আমার মন ফিরে গেছে আশির দশকে... আমার স্কুলজীবনে।
সে সময় এক ধরনের জোক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল। জোকগুলোর মূল ছক ছিল একটি করে রুশ, আমেরিকান এবং ভারতীয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনও এক বিষয়ে একটি প্রতিযোগিতা। যেমন ধরুন এই জোকটি— এক বার বিশ্বের নানা দেশের মধ্যে তাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নিয়ে একটি প্রতিযোগিতা হচ্ছিল। আমেরিকান বিজ্ঞানীরা বললেন তাঁরা এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেছেন, যার এক পাশ থেকে একটি জ্যান্ত পাঁঠা ঢুকিয়ে দিলে অন্য দিক থেকে গরমাগরম পাঁঠার মাংসের ঝোল তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসবে। অবজ্ঞার স্বরে উপস্থিত রুশ বিজ্ঞানী বললেন, “এ আর এমন কী! আমরা এমন একটা যন্ত্র তৈরি করেছি, যাতে এক বাটি পাঁঠার মাংসের ঝোল ঢুকিয়ে দিলে অন্য দিক দিয়ে একটা জ্যান্ত পাঁঠা বেরিয়ে পড়বে।” এর পর ভারতের পালা। ভারতীয় বিজ্ঞানী নির্ভীক চিত্তে গটগট করে হেঁটে গিয়ে দুটি যন্ত্রের গায়েই ছোট্ট করে একটা ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ লেবেল সেঁটে দিলেন!
আর একটি জোক ছিল এই রকম— এক বার বিভিন্ন দেশের গুপ্তচর বিভাগ একটি প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ঠিক হল, এক গভীর অরণ্যে একটি ছোট খরগোশ ছেড়ে দেওয়া হবে। এর পর যে গুপ্তচর বিভাগ সবচেয়ে তাড়াতাড়ি খরগোশটি খুঁজে আনতে পারবে, তারাই প্রতিযোগিতায় জয়ী হবে। প্রথমেই অগ্রসর হলো রুশ কেজিবি। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর তারা খরগোশটিকে গভীর অরণ্যের ভিতর থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে এলেন। এর পর পালা আমেরিকান সিআইএ-র। তাঁরা আধঘণ্টা হতে না হতেই খরগোশটিকে কান ধরে বার করে আনলেন। এর পর পালা আমাদের সিআইডি-র। আশির দশকের স্কুলপড়ুয়ারা, যত দূর মনে পড়ে, ‘র’-এর নাম তেমন জানত না। তাই কেজিবি আর সিআইএ-র পাশে দাঁড় করাতে হত সিআইডি-কে। সে যা-ই হোক, সিআইডি জঙ্গলে ঢুকেছে তো ঢুকেছে, বেরনোর আর নামগন্ধ নেই। প্রায় ঘণ্টাপাঁচেক কেটে যাওয়ার পর অনুষ্ঠানের আয়োজকরা ঠিক করলেন যে এ বার সকলের জঙ্গলে ঢুকে দেখা দরকার। দুরুদুরু বক্ষে সকলে গভীর বনের মাঝামাঝি পৌঁছেছেন, হঠাৎ ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ করে এক কাতর আর্তনাদ তাদের কানে এল। শব্দের দিক অনুসরণ করে ছুটে গিয়ে দেখেন ভারতীয় গুপ্তচররা একটি বাঁদরকে ধরে গাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক পেটাচ্ছে আর বলছে “স্বীকার কর যে, তুই-ই খরগোশ!”
এ সব জোক আজ আর নিশ্চয়ই কেউ স্কুল প্রাঙ্গণে বলে না। তার অন্যতম কারণ, এই জোকগুলোর মূল প্রেক্ষাপটই ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের আন্তর্জাতিক রাজনীতি। দেশে দেশে প্রতিযোগিতা, গুপ্তচর, রুশ-মার্কিন দ্বন্দ্ব, ভারতের দ্বিমাত্রিক দুনিয়ায় দিক-নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা ইত্যাদি ছিল এই সব জোকের রসদ। এখন ভাবলে অদ্ভুত লাগে, তখন ছেলেবেলায় এ সব আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের খুব কমই বুঝতাম, তবুও এই জোকগুলো বুঝতে একটুও অসুবিধে হয়নি। এবং এর মধ্য দিয়েই আমরা তখনকার বিশ্ব-রাজনীতির মূল ছকটা শিখে ফেলেছিলাম।
ব্যাপারটা আজকের দৃষ্টিতে কিছুটা অদ্ভুত ঠেকলেও, বিশ শতকের মাঝের দশকগুলোয়, যখন ঠান্ডা যুদ্ধ চরমে, তখন কিন্তু এ রকম রাজনৈতিক মশলায় ভরা জোক প্রায় সারা বিশ্বেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এমনকি সোভিয়েট রাষ্ট্রপতি স্তালিন নাকি ২,০০,০০০ মানুষকে জোক বলার দায়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন। কিছু দিন আগে সিআইএ-র পুরনো দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটতে গিয়ে গবেষকরা আবিষ্কার করেন যে, এক সময় সিআইএ আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁদের গুপ্তচর বাহিনীর সাহায্যে জোক সংগ্রহ করতেন। তাঁদের ধারণা ছিল যে, এই সব জোকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জনগণের আসল রাজনৈতিক মনোভাব। সিআইএ-র ফাইলে পাওয়া একটা সোভিয়েট জোক এ রকম— এক বার সব সোভিয়েট রাষ্ট্রপতি এক সঙ্গে ট্রেনে করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ট্রেন অচল হয়ে পড়ল। ট্র্যাক ভাঙা। লেনিন সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ে বললেন, “আমি এগোচ্ছি। আশপাশের গ্রামে যত কর্মঠ মানুষ আছেন সবাইকে একত্রিত করে এক্ষুনি ট্র্যাক মেরামত করে ফেলব।” স্তালিন বললেন, “আমি আগে ট্রেন কর্মচারীদের সকলকে গুলি করব।” ক্রুশ্চেভ সকল নিহত ট্রেন কর্মচারীকে বাঁচিয়ে তুলে বললেন, “কিছু মনে কোরো না। পিছনের ট্র্যাকটাই উপড়ে নিয়ে সামনে লাগিয়ে দাও।” ব্রেজনেভ তো কিছুতেই ট্রেন থেকে নামলেন না— এক আরামকেদারায় বসে মৃদু মৃদু দুলতে লাগলেন আর চোখ বুজে মনে মনে ভেবে নিলেন যে, ট্রেন চালু হয়ে গিয়েছে। এ দিকে মিখাইল গর্বাচেভ নাগাড়ে “ট্র্যাক নেই! ট্র্যাক নেই!” বলে চিৎকার করে চললেন।
সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের একেবারে মুখে এসে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি গর্বাচেভ এক পশ্চিমি সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের সম্বন্ধে এমন একটি জোক বলে চমকে দেন। গর্বাচেভের বলা সেই জোকটি এই রকম— দু’জন সোভিয়েট নাগরিক অনেক ক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন এক পাউন্ড রুটি কিনবেন বলে। শেষে এক ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, “আর পারা যায় না মশাই। আমি চললুম রাষ্ট্রপতিকে খুন করতে।” খানিক বাদে আবার ভদ্রলোকটিকে ফিরে আসতে দেখে অন্য জন জিজ্ঞেস করলেন, “কি দাদা, খুন না করেই চলে এলেন যে!” প্রথম জন বিরস মুখে বললেন, “কী আর করি! ওখানে যে লাইনটা আরও লম্বা!”
রুশ ভাষায় এই ধরনের রাজনৈতিক জোকের একটি আলাদা নাম পর্যন্ত হয়েছে। তাকে বলা হয় ‘আনেকডোটি’। সোভিয়েট রাশিয়া নিয়ে গবেষণারত ইতিহাসবিদরা অনেকেই এই সমস্ত জোককে গবেষণার আকর হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তবে শুধু সোভিয়েট রাশিয়া নয়। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আরও অনেক দেশেই এ রকম রসিকতার চল হয়েছিল। কালিন বোগদান স্তেফানেস্কু নামক এক মামুলি কেরানি দশ বছর ধরে রোমানিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি চাউসেস্কুর সম্বন্ধে প্রায় ৯০০ জোক সংগ্রহ করেছিলেন। প্রতিটি জোককে তিনি সন-তারিখসহ একটি খাতায় লিখে রাখতেন। পরে তিনি এই ৯০০টি জোকের পরিসংখ্যান ভিত্তিক বিশ্লেষণ করে দেখতে চেষ্টা করেন যে, এ সব জোকের সংখ্যা যত বেড়ে যায়, সরকার ততই নড়বড়ে হয়ে যায়। সেই কারণেই তো ইংরেজ ঔপন্যাসিক এরিক আর্থার ব্লেয়ার— যাঁকে আমরা জর্জ অরওয়েল নামে বেশি চিনি— তাঁর বিখ্যাত উদ্ধৃতিটিই হল “এভরি জোক ইজ় আ টাইনি রেভলিউশন”— প্রতিটি জোকই একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিপ্লব। এই উদ্ধৃতিটি দিয়েই শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বেন লিউইসের ডকুমেন্টারি ‘হ্যামার অ্যান্ড টিক্ল: দ্য কমিউনিস্ট জোক বুক’। এতে দেখানো হয়েছিল সোভিয়েট রাশিয়ার কড়া দমনমূলক কমিউনিস্ট শাসনকালেও কেমন ভাবে সে দেশের জনগণ তাদের শাসকদের নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে পিছপা হয়নি।
তবে এই ধরনের একমাত্রিক বিশ্লেষণ দিয়ে জোকসের রাজনৈতিক মূল্যায়ন করা সম্ভব কি না, তা সন্দেহের বিষয়। যখন সোভিয়েট রাষ্ট্রপতি স্বয়ং বিদেশি সাংবাদিককে নিজের সম্বন্ধে জোক শোনান, তখন এটুকু তো সপ্রমাণ যে, জোক মাত্রই বৈপ্লবিক চেতনার পরিচায়ক বলে ধরে নেওয়া যায় না। তার চেয়ে জোকের মধ্যে আমরা দেখতে পাই জটিল এবং বহুমাত্রিক এক ধরনের রাজনৈতিক আলোচনার পরিসর। যাঁরা এ সব জোক বলেন বা শুনে হাসেন, তাঁরা যে সবাই একই রকম রাজনৈতিক মতবাদ পোষণ করেন এমন ভাবার মোটেই কোনও কারণ নেই। তবে এটুকু নিশ্চয়ই ধরে নেওয়া যায় যে, এঁরা সবাই মূল চরিত্রগুলিকে চেনেন এবং জোকের বুনিয়াদি ছকটাকে মোটামুটি গ্রহণ করেন। যেমন ধরুন ছাগলের মেশিন সংক্রান্ত আমার ছেলেবেলার জোকটি। আমাদের কারওই তখন তেমন কোনও রাজনৈতিক মতবাদ দূরে থাক, বিশেষ চৈতন্যও ছিল না। তবে সোভিয়েট রাশিয়া আর আমেরিকা যে আন্তর্জাতিক মহলে দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি, তাদের প্রতিযোগিতার একটি মূল বিষয় যে নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং ভারত যে এদের সঙ্গে তখন পেরে না উঠলেও টেক্কা দেওয়ার স্বপ্ন দেখে, এই বুনিয়াদি ছকটুকু আমরা সকলেই শিখে ফেলেছিলাম।
কিছু গবেষকের ধারণা যে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতি ছিল এই ধরনের রাজনৈতিক জ্ঞাপনের পক্ষে সব চেয়ে অনুকূল। তাঁরা মনে করেন যে, সরকারি অবদমন যখন চরমে ওঠে, যেমন ধরুন নাৎসিদের রাজত্বে, তখন এই ধরনের জ্ঞাপনের আর তেমন স্থান থাকে না। আবার সরকারের ডিসক্রিশনারি বা সেন্সরি বোর্ড যখন তাঁদের বজ্রমুষ্টি কিছুটা শিথিল করে দেন, তখন জোকসও বিরল হয়ে পড়ে। জোক সবচেয়ে বেশি শোনা যায় এমন রাজত্বে, যেখানে সেন্সরি বোর্ড মুঠো শক্ত করছে, কিন্তু তখন অবদমন এমন চরমে পৌঁছয়নি, যেখানে মানুষ আর হাসতে কিংবা হাসাতে সাহস পায় না।
জোকের একটা মৌলিক গুণ হল এই যে, এগুলো সবই সর্বজনীন উক্তি। ছেলে-ভোলানো ছড়া কিংবা লৌকিক সাহিত্যের মতো এর কোনও জনক, জননী বা বার্থ সার্টিফিকেট থাকে না। তাই এগুলো যে কী করে তৈরি হয়, কে বাজারে ছাড়ে বা কেনই বা জনপ্রিয় হয় এ সব কিছুই বলা যায় না। এগুলো সকলের মুখে মুখে ঘোরে এবং সময়ের উপযোগিতা ফুরোলে আবার স্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। রোমানিয়ার স্তেফানেস্কু চেষ্টা করেছিলেন কোনও বিশেষ ঘটনা এবং সেই সম্বন্ধীয় জোকের উৎপত্তির মধ্যে সময়সীমার একটি পরিসংখ্যান ভিত্তিক নিয়ম তৈরি করতে। কিন্তু তাঁর সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। ব্যাপারটা এতটাই খামখেয়ালি যে, তাকে ঠিক মতো পরিসংখ্যানের ছকে বাঁধা যায়নি।
আমাদের দেশেও রাজনীতিকে হাস্যরসে সিঞ্চিত করার উদ্যোগ নতুন নয়। তবে সে প্রচেষ্টা যুগে যুগে বিবর্তিত হয়েছে। পাল্টেছে তার অবয়ব, মাধ্যম এবং বিষয়। সংস্কৃত সাহিত্যে প্রহসন ছিল বিস্তৃত এবং লিখিত। নাট্যধর্মী। হুতোমের নকশা ছিল খণ্ডাকৃতি কিন্তু ছাপার অক্ষরে খচিত। গোপাল ভাঁড়ের ভাঁড়ামো ছিল বটতলার বইয়ের পাতায় মোড়া। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুক ছিল সংলাপধর্মী এবং রেডিয়ো আর ক্যাসেটে সংরক্ষিত। রেবতীভূষণের ‘বিশ্বসংবাদ পরিক্রমা’ ছিল খবরের কাগজের পাতায় চিত্রিত। প্রতিটিতেই আমরা রাজনীতির হাস্যরূপের দেখা পাই, কিন্তু সে রূপ, তার স্বাদ এবং তার দেখা পাওয়ার স্থান, সবই আলাদা। গোপাল ভাঁড়ের ইতিহাস তল্লাশ করতে গিয়ে গৌতম ভদ্র তো দেখিয়েই দিয়েছেন যে, উনিশ শতকের মুদ্রণ শিল্প এবং পণ্য হিসেবে সস্তা বইয়ের বাজার— এই দুইয়ের যোগসূত্রেই বাঙালির সব থেকে প্রিয় ভাঁড়টির জন্ম। তবে এ সকল রাজনৈতিক কৌতুকের ধারার মধ্যে জোক-ই বোধ হয় সব থেকে ক্ষণস্থায়ী, ক্ষীণজীবী এবং বেনামি। এর উৎস সন্ধান করা সবচেয়ে কঠিন। দু’-চারটে বই যে এ বিষয়ে প্রকাশিত হয়নি, তা নয়। তবে আমরা সকলেই এমন অনেক অনেক জোক শুনেছি এবং শুনিয়েছি, যা আজ আর কোনও বইয়েই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
১৯৮৭ সালে লিখিত একটি জোকসের সংগ্রহ সম্পাদনা করতে গিয়ে তুষারকান্তি পাণ্ডে দাবি করেন যে তাঁর বইটিই বাংলা ভাষায় এই সংক্রান্ত সর্বপ্রথম বই। দাবিটির সত্যাসত্য গবেষণা-সাপেক্ষ। কিন্তু তুষারবাবুর বইটি থেকে যে দু’টি জিনিস নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় তা হল, আশির দশকে কিছু লোক অন্তত জোক ব্যাপারটিকে বাংলা সাহিত্যের একটি প্রান্তিক এবং নতুন ধারা হিসেবেই চিহ্নিত করছিলেন। তুষারবাবুও সরাসরিই বলেন যে, জোকের সঙ্গে বিগত যুগের প্রহসন, নকশা, ব্যঙ্গ ইত্যাদির ধারাগত সাদৃশ্য থাকলেও এগুলোকে কখনও অবিকল সমগোত্রীয় বলা চলে না। দ্বিতীয়ত, তুষারবাবুর সম্পাদিত বইগুলি (আমি তাঁর সম্পাদিত দু’টি বই দেখেছি) এবং তাতে স্থান পাওয়া এক হাজারের উপর জোক দেখে এটুকু বোঝা যায় যে, জোকের ধারাটি একেবারেই আন্তর্জাতিক। এর মধ্যে দেখা পাওয়া চরিত্র এবং ঘটনা দুইয়ের মধ্যেই রয়েছে বৃহত্তর জগতের হাতছানি। গোপাল ভাঁড়ের জগৎ ছিল বৃহৎ বঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ। হুতোমের জগৎ কলকাতা। কিন্তু জোকের জগৎ, কিছুটা রেবতীভূষণের কার্টুনের মতো আন্তর্জাতিক।
রুশ-ইউক্রেন থেকে আমরা অনেক দূরে চলে এসেছি। তবে এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে হয়তো প্রবন্ধের শুরুতে করা প্রশ্নটির একটি উত্তর উঠে এসেছে। সামরিক আগ্রাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কেনই বা ইউক্রেনের সরকার পুতিনকে নিয়ে কার্টুন আঁকতে গেলেন? ঠান্ডা যুদ্ধের স্মৃতি তো তাঁদেরও আছে। তাঁদের নেতারাও তো সত্তর কিংবা আশির দশকে স্কুলে ‘আনেকডোটি’ বলে হেসে গড়াগড়ি গিয়েছেন। হয়তো সে কারণেই তাঁরা ভেবেছিলেন যে, চিরাচরিত রাজনৈতিক জ্ঞাপনের ধারাটিকেই আশ্রয় করে তাঁরা আবার একটি আলোচনার পরিসর তৈরি করতে পারবেন। কিন্তু তা আর হল না। কিন্তু প্রচেষ্টাটি মনে করিয়ে দিল স্তালিনের মৃত্যুর পরেই ক্রুশ্চেভের বলা একটি জোক। বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেসে তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতায় ক্রুশ্চেভ ঠাট্টা করে বলেছিলেন, “স্তালিন তো ঠিকই করে ফেলেছিলেন যে সমস্ত ইউক্রেনকে নির্বাসিত করবেন। খালি কোথায় পাঠাবেন সেটাই আর ঠিক করে উঠতে পারেননি।” অধিবেশনের অনুলিপিটি পড়লে দেখা যায়, জোকটির পরে স্টেনোগ্রাফার নিয়মমাফিক কেজো ভঙ্গিতে লিখেছেন, “সদস্যরা চেয়ারম্যানের জোক শুনে হাসলেন।”