পরিবেশবন্ধু: সুন্দরলাল বহুগুণা। সঙ্গে, সমস্ত আন্দোলন ও কাজকর্মের চিরসঙ্গী স্ত্রী বিমলা দেবী।
কয়েক শতক আগের কথা। বাংলা থেকে তিন ভাই হিমালয়ে চলেছেন তীর্থ করতে। তিন জনেই বন্দ্যবংশীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত— এক জন কবিরাজ, এক জন কাব্যশাস্ত্রবিদ আর এক জন জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ। তাঁরা এসে উঠলেন গঢ়বাল শ্রীনগরের এক ধর্মশালায়। তখন শ্রীনগরের রাজা খুব অসুস্থ। কোনও চিকিৎসাতেই কাজ হচ্ছিল না। তিন পণ্ডিতের কথা শুনে তাদের প্রাসাদে ডেকে নিয়ে আসা হল। তাঁদের পরামর্শ আর চিকিৎসায় অল্প দিনে সুস্থ হয়ে উঠলেন রাজা। রাজার অনুরোধে তিন জন সেখানেই রয়ে গেলেন। তাদের প্রত্যেককে তিনখানা করে গ্রাম উপহার দেওয়া হল। তাঁরা ছিলেন বহু গুণের অধিকারী, তাই রাজা তাঁদের উপাধি দিলেন ‘বহুগুণা’। তিন ভাইয়ের আসল পদবি ছিল ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’। ধীরে ধীরে পুরনো পদবি মুছে গিয়ে বহুগুণা পদবিতেই তাঁরা পরিচিতি পেলেন।
এই বহুগুণা পরিবারেরই এক উজ্জ্বল সন্তান ভারতের পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের পথিকৃৎ। তিনি সুন্দরলাল বহুগুণা। জন্ম গঢ়বালের মারোরা গ্রামে (৯ জানুয়ারি ১৯২৭)। গ্রামের পাশ দিয়েই বহতা গঙ্গা। তাই আশৈশব গঙ্গার প্রতি তাঁর গভীর প্রেম। গ্রামের স্কুলে পড়াশুনো। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে লাহোরের সনাতন ধর্ম (এস ডি) কলেজ থেকে বি এ পাশ করলেন।
তখন দেশ জুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৭ বছরের তরুণ সুন্দরলাল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন গাঁধীজির সত্যাগ্রহ আন্দোলনে। পুলিশের কাছে গোপন রইল না সে খবর। ধরা পড়ে গেলেন সুন্দরলাল। বিচারে পাঁচ মাস জেল।
স্বাধীনতার পর পুরোপুরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক হলেন। সেই সময় গঢ়বালের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল প্রবল জাতপাত আর ছোঁয়াছুঁয়ির বিধিনিষেধ। অনেক মন্দিরে নিচু জাতের মানুষদের প্রবেশের অধিকার ছিল না। সুন্দরলালের মনে হল, বিভেদের এই বেড়াজাল মুছে ফেলতে হবে। শুরু হল অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই। এই কাজের সূত্রেই সাক্ষাৎ হল গাঁধীজির ইংরেজ-শিষ্যা মীরা বেন-এর সঙ্গে। মীরা তাঁকে রাস্তা দেখালেন, বললেন, ‘গ্রামের মানুষের সেবায় নিজেকে সমর্পণ করো। গ্রামের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবে না।’
মীরার সঙ্গিনী ছিলেন তরুণী বিমলা। গাঁধীজির সেবার আদর্শ ছিল তাঁর জীবনসাধনা। তাঁকে ভাল লেগে গেল সুন্দরলালের। দু’জনে একই পথের যাত্রী। এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়ে গেলেন বিমলা আর সুন্দরলাল। এ যেন শুধু দুই নারী-পুরুষের মিলন নয়, এ এক আদর্শ আর লক্ষ্যের যাত্রাপথে এগিয়ে চলার জন্য গ্রন্থি বেঁধে নিয়ে জোড় মজবুত করা।
অনেকেই ভেবেছিলেন, বহু রাজনৈতিক নেতার মতো সুন্দরলাল আর বিমলা সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেবেন। কিন্তু দু’জনেই বিশ্বাস করতেন, একমাত্র গাঁধীজির আদর্শেই দেশ ও সমাজ-সংসারের কল্যাণ হতে পারে। বাড়ির কাছে সিলিয়ার গ্রামে গড়ে তুললেন ‘নবজীবন আশ্রম’। গ্রামের মানুষদের সঙ্গে পরিশ্রম করতেন, তাদের শিক্ষা দিতেন, অসুস্থ হলে সেবা করতেন। সামান্য উপার্জনেই মানিয়ে নিতেন দু’জন। কর্মযোগের পথেই ছিল তাঁদের সাধনা।
এই সময় তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয় আচার্য বিনোবা ভাবে-র। সুন্দরলালের মনে হল, ইনি যেন গাঁধীজির জীবন্ত প্রতিরূপ। বিনোবাজিরও ভাল লেগেছিল সুন্দরলালকে। তাঁর মনে হল, এই মানুষটিকে সঙ্গী করেই প্রচার করবেন গাঁধীজির আদর্শ। অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যে নয়, নিজেদের প্রচেষ্টাতেই গড়ে তুলতে হবে স্বনির্ভর ভারত। এবং তা শুরু হবে গ্রাম থেকে। এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন দু’জন। যেখানে যেতেন, সেখানকার কোনও গৃহে আশ্রয় নিতেন। মন দিয়ে শুনতেন গ্রামের মানুষদের অভাব-অভিযোগ দুঃখ-কষ্টের কথা। তাদের বোঝাতেন কেমন করে তারা সব প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে যাবে।
একটি বিষয় খুব ভাবিয়ে তুলেছিল সুন্দরলালকে। গ্রামের পুরুষরা যা আয় করে, তার বেশির ভাগটাই নেশার পিছনে ব্যয় করে। ফলে সংসারে অভাব-অনটন, অশান্তি। সব যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় মেয়েদের। গ্রামের মেয়েদের নিয়ে শুরু হল নেশাবিরোধী আন্দোলন। এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রাম। কয়েক মাসেই বন্ধ হল পাঁচ জেলার সব মদের দোকান। এই জয় সুন্দরলালের জীবনে নতুন আলো নিয়ে এল। অনুভব করলেন অহিংস সত্যাগ্রহের শক্তি।
এই সময়ের একটি ঘটনা সুন্দরলালের জীবনকে ভিন্ন পথে চালিত করল। হিমালয় জুড়ে কত ধরনের অসংখ্য গাছ, তার কোনও হিসেব নেই। এই গাছ কাটা শুরু ইংরেজ আমলে। তখন এই সব জঙ্গল নিলাম ডাকা হত। সাহেবরা গাছ কেটে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করতেন। দেশ স্বাধীন হল, তবু গাছ কাটা বন্ধ হল না। জঙ্গল কেটে পাহাড়ের গায়ে ঘর-বাড়ি তৈরি হতে শুরু করল। সুন্দরলাল বুঝতে পারছিলেন, এই ভাবে যদি গাছ কাটা চলতে থাকে, ভয়ঙ্কর বিপদ ঘটবে। আর হলও তাই। ১৯৭০ সালে হঠাৎ অলকানন্দার জল বেড়ে গেল ৬০ ফুট। বহু গ্রাম ভেসে গেল। মানুষের প্রভূত পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হল। যথেচ্ছ গাছ কাটাই এর কারণ।
এর পর স্থানীয় কিছু সাধারণ মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে স্থির করলেন, আর জঙ্গলের কাঠ কাটতে দেবেন না। বন দফতরের কাছে আবেদন করা হল আর যেন কেউ গাছ না কাটে। এই কাজে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে গঢ়বালের মেয়েরা। তখন ১৯৭৪ সালের শেষ। সে দিন শহরে সভা করতে গিয়েছিল গাঁয়ের সব পুরুষরা। একটি ছোট মেয়ে জঙ্গলে গিয়েছিল কাঠ কুড়োতে। সে দেখতে পেল, কয়েকজন লোক কুড়ুল নিয়ে জঙ্গলের দিকে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে ছুটে এসে খবর দিল গৌরা দেবীর কাছে।
চামোলি জেলার রেনি গ্রামের গৌরা দেবী বাইশ বছর বয়সে বিধবা হন। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটত, তবু তার মধ্যেই গাঁয়ের মেয়েদের উন্নতির কথা চিন্তা করতেন। যখন তিনি খবর পেলেন কোম্পানির লোকেরা গাছ কাটতে এসেছে, তিনি সারা গাঁয়ের মেয়েদের জড়ো করে জঙ্গলের দিকে রওনা হলেন। উদ্দেশ্য, সবাই জীবন দেব তবু গাছ কাটতে দেব না।
কোম্পানির লোকেরা জঙ্গলের যেখানে গাছ কাটতে জমায়েত হয়েছে, গৌরাদেবী সেখানে এসে বললেন, ‘তোমরা ফিরে যাও। কেউ এই জঙ্গলের গাছ কাটবে না।’
কোম্পানির এক জন অফিসার চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমরা গাছ কাটব। কারও ক্ষমতা নেই আমাদের আটকায়।’
কোম্পানির লোকেরা কুড়ুল নিয়ে এগিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে গৌরাদেবী চিৎকার করে উঠলেন— চিপ কো পেড়। চিপ কো পেড়। অর্থাৎ, তোমরা গাছকে জড়িয়ে ধরো।
মেয়েরা সকলে এগিয়ে যায়। এ তাদের কাছে অস্তিত্বের লড়াই। বাঁচার জন্য, বাঁচানোর জন্য লড়াই। শক্তিমানের বিরুদ্ধে দুর্বলের লড়াই। মা যেমন সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বিপদ থেকে আগলায়, তেমনই মেয়েরা প্রত্যেকে এক-একটা গাছকে জড়িয়ে ধরে, কোম্পানির লোকেরা সব শক্তি দিয়েও মেয়েদের ছাড়াতে পারে না। কোম্পানির লোকেরা রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের হাতের লাঠি এসে পড়ে মেয়েদের গায়ে। তবু কেউ পিছু হটে না। এত সহজে কি কোম্পানির লোক পিছু হটবে! তাদের সঙ্গে রয়েছে বনবিভাগের লোকজন, কর্মকর্তা। কম অত্যাচার হয়নি গাঁয়ের লোকেদের উপর।
এই সময় এগিয়ে এলেন সুন্দরলাল বহুগুণা। তিনি চেয়েছিলেন এই চিপকো আন্দোলনের কথা শুধু কয়েকটা গ্রামে নয়, সমস্ত হিমালয়ের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে। হিমালয়ের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে পৌঁছে দিতে হবে অরণ্যকে বাঁচানোর কথা। সকলকে বুঝতে হবে, জঙ্গল না বাঁচলে হিমালয় বাঁচবে না। হিমালয় না বাঁচলে ভারত বাঁচবে না। হিমালয় এক পবিত্রভূমি। হিমালয় এই সভ্যতার পিতা। তার কোলেপিঠে বেড়ে উঠেছে ভারতভূমি। হিমালয় প্রাণহীন হলে সমগ্র ভারতের প্রাণসত্তা ধ্বংস হবে।
চিপকো আন্দোলনের কথা হিমালয়ের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ৫০০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন সুন্দরলাল। তাঁর প্রচেষ্টায় এই আন্দোলনের খবর দেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। শেষ পর্যন্ত সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া হিমালয়ের এক হাজার মিটার উচ্চতার ওপরে গাছ কাটা নিষিদ্ধ। চিপকো আন্দোলনের সাফল্যের মধ্য দিয়ে সুন্দরলাল হয়ে উঠলেন, পরিবেশরক্ষা আন্দোলনের পুরোধা। এ বার শুরু হল ৫০০০ কিলোমিটার পদযাত্রা, কোহিমা থেকে কাশ্মীর। হাতে লাঠি, কাঁধে ঝোলা, বড় বড় চুল। অল্প কয়েকজন সঙ্গী। সর্বত্রই এক কথা— জঙ্গল বাঁচাও, তবেই তুমি অক্সিজেন পাবে, জ্বালানির কাঠ পাতা পাবে, বন্ধ হবে ভূমিক্ষয়, রোধ হবে বন্যা। শুধু হিমালয় নয়, সুন্দরলাল গিয়েছেন কেরল, কর্নাটক, তামিলনাড়ু-সহ ভারতের নানা প্রান্তে। প্রকৃতপক্ষে তাঁরই প্রচেষ্টায় বহু জায়গায় শুরু হয়েছিল বনসৃজন।
অরণ্য-প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য এক দিকে সুন্দরলাল যখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের প্রান্তে প্রান্তে, সেই সময় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে শুরু হল আর এক কর্মকাণ্ড। গোমুখ, গঙ্গোত্রী, উত্তরকাশী হয়ে নেমে আসা গঙ্গা বয়ে গিয়েছে তেহ্রির বুকের উপর দিয়ে। এক সময় এখানে ছিল গঢ়বাল রাজা সুদর্শন শাহের রাজধানী। চার দিকে পাহাড়, মাঝখানে এই রাজধানীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল জনপদ।
স্থির হল, এখানে নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হবে তেহ্রি ড্যাম। উৎপাদন হবে জলবিদ্যুৎ। গঢ়বালের গ্রাম থেকে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে রাজধানী দিল্লির জনপদে। প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন তেহ্রির জনগণ। এই বাঁধ তৈরি হলে জলের তলায় হারিয়ে যাবে গোটা জনপদ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হল, পাহাড়ের ওপর তৈরি হবে নতুন শহর। যারা গৃহহারা হবেন, তাঁদের দেওয়া হবে ঘর। তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান।
তবু সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে মুখর। সামান্য কিছু মানুষের প্রতিবাদে রাষ্ট্রনেতাদের কী এসে যায়! বাঁধ মানে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। ১৯৭৮ সালে শুরু হল বাঁধের কাজ। অর্থনৈতিক কারণে অল্প দিন পরে কাজ বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৮৬ সালে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সাহায্য দিতে এগিয়ে এল রাশিয়া।
দুই রাষ্ট্রশক্তি সম্মিলিত হয়ে যখন বাঁধ তৈরির প্রকল্প শুরু করল, এগিয়ে এলেন সুন্দরলাল। প্রাচীনকালের মুনি ঋষিদের মতো গঙ্গাতীরে তৈরি করলেন কুঠিয়া। জীবন দেব, তবু বাঁধ হতে দেব না। এই বাঁধ হলে শুধু প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে তা-ই নয়, ক্ষতি হবে যুগ-যুগান্ত ধরে বয়ে চলা গঙ্গার। গতি হারিয়ে গঙ্গা পরিণত হবে ঝিলে। পলি জমতে জমতে এক সময় এই বাঁধ হারিয়ে ফেলবে তার কর্মক্ষমতা। সাময়িক কিছু পাওয়ার জন্য চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে বহু কিছু। যার ফল ভোগ করতে হবে উত্তরকালের মানুষদের।
সুন্দরলাল শুরু করলেন অনশন। হিংসা নয়। অহিংসাই তাঁর পথ। সারা দিন মানুষ আসে। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন বহুগুণা। উপদেশ দেন, এই আন্দোলনের কথা ছড়িয়ে দাও দিকে দিকে। নিঃস্বার্থ ভাবে সকলের পরির্চযা করেন বিমলা। স্বামীর এই মহাযজ্ঞে তিনিও তো হোতা। সরকারের পক্ষ থেকে লোকজন আসে অনশন ভাঙার অনুরোধ নিয়ে। উত্তরে শুধু একটি কথাই বলেন সুন্দরলাল, ‘বন্ধ হোক এই সর্বনাশা বাঁধ।’ কয়েকমাস পর অবশেষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া লিখিত ভাবে প্রতিশ্রুতি দিলেন, নতুন করে এই বাঁধ নিয়ে তাঁরা ভাবনাচিন্তা করবেন। ৭৪ দিন পর অনশন ভঙ্গ করলেন সুন্দরলাল।
তিনি ভেবেছিলেন বন্ধ হবে বাঁধ তৈরির কাজ, কিন্তু বাস্তব ছবিটা ছিল অন্য রকম। এই প্রকল্পে যারা কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে, তারা কি এত সহজে সব কিছু ছেড়ে দেবে! শুরু হল গোপন ষড়যন্ত্র। আন্দোলনকারী মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হল বিভেদের বীজ। প্রবল হয়ে উঠল অর্থশক্তি আর পেশিশক্তি।
আন্দোলনকারী লোকজনদের নিয়ে কোনও একটি সভায় যাচ্ছিল বাস। পাহাড়ি পথ। আচমকা বাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল ড্রাইভার। যান্ত্রিক ত্রুটি অথবা অন্য কিছু। কয়েক হাজার ফুট নীচে গড়িয়ে পড়ল বাস। মারা গেলেন বহু মানুষ। নিজের জীবনের কথা ভাবেন না বহুগুণা, কিন্তু এত জন সঙ্গীর মৃত্যু! তাঁর মনে হল কে জানে, এই হয়তো শুরু। মানসিক যন্ত্রণায় ভেঙে পড়লেন বহুগুণা। বুঝতে পারছিলেন মানুষের সর্বগ্রাসী লোভ প্রকৃতিকে বাঁচতে দেবে না, নিজেরাও এ ভাবেই শেষ হয়ে যাবে। গাঁধীজির কথা মনে পড়ে, পৃথিবীর সম্পদ আছে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট, কিন্তু লোভের কাছে তা নেহাতই ক্ষুদ্র।
যে গঙ্গার তীরে জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন, সেই মুক্ত প্রকৃতির কোল ছেড়ে ফিরে এলেন দেহরাদূন শহরের কোলাহলে। শুরু হল আর এক জীবন। একেবারে শ্বেতশুভ্র মূর্তি। সাদা কাপড়, সাদা জামা, সাদা চুল-দাড়ি। সৌম্যকান্তি। আত্মমগ্ন। কেউ এলে আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন। জীবনে বহু পুরস্কার, সম্মান পেয়েছেন, কিন্তু সেগুলো তাঁর কাছে গুরুত্ব পায়নি কোনও দিনই। বলেছেন, “কোনও কিছু পাওয়ার জন্য আমি কাজ করিনি। কাজ করেছি এই দেশের নদী, গাছপালা, মানুষ, ভূমি, প্রকৃতিকে ভালবেসে। জীবনের প্রান্তবেলায় এসে যখন দেখি মানুষ কী নির্মম ভাবে হিমালয় আর প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে, খুব কষ্ট হয়। আজ আর কোনও কিছু করার নেই আমার। শুধু অপেক্ষা আগামী দিনের। এক দিন মানুষ নিশ্চয়ই বুঝবে... তত দিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।”