বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সত্যজিৎ রায়ের অবস্থান নির্দিষ্ট। মূলত ছোটদের জন্যই তিনি লিখেছেন। তবে বিষয়ের বৈচিত্রে, ভাষার ঋজু স্বচ্ছতায় তাঁর লেখা সব বয়সি পাঠকেরই প্রিয়।
সত্যজিতের সাহিত্যে প্রকাশিত তাঁর চলচ্চিত্রভাবনা নিয়েই এই প্রতিবেদন। চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর ভাবনার নানা প্রকাশ আমরা পেয়েছি তাঁর লেখা নানা প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে। কিন্তু গল্পকার সত্যজিৎও যে চলচ্চিত্র নিয়ে নানা তাৎপর্যপূর্ণ মতামত জানিয়েছেন তাঁর লেখায়, সচেতন পাঠকের কাছে এটি একটি দুর্মূল্য অভিজ্ঞতা। তাঁর গল্প-উপন্যাসে বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র সংক্রান্ত বহু বিষয়ে কথা বলেছেন, মতামত দিয়েছেন। বিশ্ববরেণ্য পরিচালক যখন তাঁর সাহিত্যে চলচ্চিত্রের নানা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, তখন তার একটা অতিরিক্ত মূল্য তৈরি হয় বইকি। সত্যজিতের কয়েকটি কাহিনি ধরে আমরা তাঁর চলচ্চিত্রচর্চা সন্ধান করব।
‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’ গল্পে পটলবাবুর ফিল্মে অভিনয়ের সুযোগ হল। তা নিয়ে যে গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পাই, তা সম্ভব হয়েছে এই গল্পের লেখক দক্ষ চলচ্চিত্রকার বলেই। গোটা একটি গল্পে পটলবাবুর বরাদ্দ মাত্র এক শব্দের সংলাপ। হতাশার মধ্যেই পটলবাবুর মনে পড়ল তাঁর নাট্যগুরু গগন পাকড়াশীর কথা— ‘যত ছোট পার্টই তোমাকে দেওয়া হোক, তুমি জেনে রেখো তাতে কোনো অপমান নেই। শিল্পী হিসেবে তোমার কৃতিত্ব হবে সেই ছোট্ট পার্টটি থেকেও শেষ রসটুকু নিংড়ে বার করে তাকে সার্থক করে তোলা।’ তার পর গল্পে ‘আঃ’ কথাটি অনুভবের নানা স্তর থেকে উচ্চারণের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হয়েছে— ‘চিমটি খেলে মানুষে যেভাবে আঃ বলে, গরমে ঠান্ডা শরবত খেয়ে মোটেই সেভাবে আঃ বলে না’ ইত্যাদি। তার পরেই পটলবাবুর উচ্ছ্বাস: ‘একটা কথা যে একেবারে সোনার খনি। তেমন তেমন অভিনেতা তো এই একটা কথাতেই বাজিমাত করে দিতে পারে।’
‘টলিউডে তারিণীখুড়ো’ গল্পে আবার আর এক অভিনেতার বিব্রত অসহায়তা। মাত্র একটি বাক্য তিন বার তিন রকম বলেন আলমগীর বাদশা, চতুর্থ বার মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজই বেরোয় না। এর সুচারু ব্যাখ্যাও দেওয়া আছে— ‘শট নেবার ঠিক আগে যে মুখের সামনে খটাস করে ক্ল্যাপস্টিক মারা হয়, তাতে অনেক পাকা অভিনেতাও টসকে যায়। এখানেও তাই হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’ মনে পড়ে, ‘দার্জিলিং জমজমাট’-এ হিরো রাজেন্দ্র রায়না একটা শট নিতে পাঁচ বার ভুল করেন। সে কথা শুনে ফেলুদা বলেছিল, ‘সেরা অভিনেতারও হঠাৎ হঠাৎ নার্ভ ফেল করতে পারে’। এটা আসলে সত্যজিৎ রায়েরই কথা। কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল। মোহনভোগ-এর জায়গায় আটবার মোহনবাগান বলে শেষে ন’বারের বার ‘হরিহরের মুখ দিয়ে বেরুল মোহনভোগ’ (প্রবন্ধ: ‘দর্শকের অগোচরে’)।
‘টলিউডে তারিণীখুড়ো’ গল্পে তারিণীখুড়োর কথায়, ‘বাংলা ছবিতে তো আর অভিনয় হত না, হত রং তামাশা। আমি দেখি পৃথিবীর সব সেরা স্টারের অভিনয়, যাকে দেখে অভিনয় বলেই মনে হয় না।’ এই গল্পেই আছে বাংলা ছবির ‘যাত্রামার্কা মেক-আপ আর পোষাক’-এর কথা। ‘অতীতের বাংলা ছবি’ প্রবন্ধে নানা সময়ের বাংলা ছবি প্রসঙ্গে সত্যজিতের বিবেচনার অনেকটাই কিন্তু এই সব কাহিনিতে বলা আছে। সেই প্রবন্ধেও অকপট সত্যজিৎ, ‘…বাস্তবতার অভাব, চিত্রনাট্যের শৈথিল্য এবং সংলাপের আড়ষ্টতা’ বাংলা ছবিকে নষ্ট করেছে।
অভিনয় সম্পর্কে আমবাঙালির নেতিবাচক মনোভাবের প্রতিফলন মেলে ‘প্রসন্ন স্যার’ গল্পে, অর্ধেন্দুকে অনেক দিন পর দেখে স্যার বলেন, ‘ইস্কুলে তোর হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল যে বায়োস্কোপে অ্যাকটিং করা ছাড়া তোর আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। যত গবেটগুলো সব ওই লাইনেই যায় তো!’
এই ‘ফিল্ম লাইন’ সম্পর্কে সমাজের উদ্বেগও ছিল। আবু সয়ীদ আইয়ুব, আধুনিক কবিতার পাঠক খুঁজে পাওয়া যায় না, এমত আক্ষেপ করে এর জন্য দায়ী করেছিলেন কবিতার প্রতিদ্বন্দ্বী সিনেমা, রেডিয়ো, খবরের কাগজ আর ছ’-পেনি উপন্যাসকে। এদের স্থূল উত্তেজনা আর লঘু চিত্তবিনোদনের সঙ্গে কাব্যের সূক্ষ্ম রস পরিবেশন পেরে উঠবে কেন— বক্তব্য ছিল তাঁর। বুদ্ধদেব বসুও চ্যাপলিন-প্রসঙ্গে তাঁর আলোচনায় আক্ষেপ জানিয়েছিলেন এই বলে যে, চ্যাপলিনের মতো প্রতিভা ব্যবহৃত হল ফিল্মের মতো একটি ভঙ্গুর মাধ্যমে।
কবিতার সঙ্গে, সাধারণ ভাবে সাহিত্যের সঙ্গে ফিল্মের নান্দনিক বিরোধের ধারণা বিচলিত করে তুলেছিল কবি-ভাবুকদের। কেউই তখন ‘চলচ্চিত্রকে জাত শিল্প বলে মনে করতেন না’— ‘অতীতের বাংলা ছবি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন সত্যজিৎ।
‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’ বা ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ রচনায় হিন্দি সিনেমার শুটিং থেকে শুরু করে নায়ক-নায়িকার মনস্তত্ত্ব, তাঁদের পারস্পরিক টানাপোড়েন-সহ নানা বিষয়ের তাৎপর্যপূর্ণ রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। এই সব রচনার বৈশিষ্ট্য হল লেখকের গভীর সচেতনতা। অভিজ্ঞতা আর অনুভবের সখ্য লেখাগুলিকে বরণীয় করেছে।
বাংলা সিনেমা হাউসগুলোর মানের অবনমন সম্পর্কে সত্যজিৎ-সাহিত্যের একাধিক চরিত্র আক্ষেপ জানিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে ভিডিয়ো ইত্যাদির স??????? ?????? ?????? ?????????? ??????? ????????? ??????ংক্রমণে সিনেমা হাউসের জনপ্রিয়তা হ্রাসের ইতিহাসকেও ধরেছেন সত্যজিৎ। যেমন, ‘দুই বন্ধু’ গল্পের মহিম ‘...হিন্দি ছবি দেখে না। আজকাল ভিডিও হওয়াতে সিনেমা দেখাটা একটা ঘরোয়া ব?????? ???? ??????? ্যাপার হয়ে গেছে।’ একই আক্ষেপ ‘সহযাত্রী’ গল্পের এক সংলাপে— ’
‘তা ছাড়া সিনেমা গেলেও, হাউসের যা দ??????, ?????? ????? ???? ?????????, ???????ুর্দশা, মাটিতে ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভ্যাপসা গরম...।’ ‘...অথচ ইয়াং বয়সের লাইটহাউস, মেট্রোর কথা ভেবে দেখুন।’
আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— ‘এখানে যেটার অভাব সেটা হল উপযুক্ত প্রেক্ষাগৃহ।’ ‘শতাব্দীর সিকি ভাগ’ রচনায় এমন সংশয়ও প্রকাশিত যে, ‘প্রেক্ষাগৃহগুলির দৈন্যদশা’ ও আরও কিছু কারণে ‘বাংলা ছবি আজ এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে এই পঁচিশ বছরে যা শিখলাম সেটা কাজে লাগানোর সুযোগ আর কতদিন থাকবে সে বিষয়ে সন্দেহ হয়।’
‘মানপত্র’ গল্পে চিত্রতারকাদের সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণার উন্মোচন হয়েছে ‘চিত্রতারকা-ফারকা’ কথাটিতে। এই গল্পেরই একটি অংশ, “নরেন গুঁই বলল, ‘আমি তো গোড়াতেই বলেছিলাম— ওসব চিত্রতারকা-ফারকা বাদ দে। ওদের কথার কোন ভ্যালু নেই।’ ”
‘চিত্রতারকা-ফারকা’ বলার মধ্যে যে অবজ্ঞার ইঙ্গিত প্রকাশিত, তা স্পষ্টতর হয়েছে ‘ওদের কথার কোন ভ্যালু নেই’ উচ্চারণে।
‘স্পটলাইট’ গল্পে ‘পশ্চিমবাংলার সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিল্মস্টার’ অংশুমান চ্যাটার্জিকে নিয়ে নানা বয়সের মানুষের মুগ্ধতার কথা মজা-মেশানো হালকা ব্যঙ্গে বোঝানো হয়েছে। বারো বছরের শর্মি তার একটা পুরো বঙ্গলিপি খাতা ভরিয়ে ফেলেছে ফিল্ম-পত্রিকা থেকে কাটা অংশুমান চ্যাটার্জির ছবি দিয়ে। তার ক্লাসের বন্ধুরা অংশুমানের চুলের স্টাইল নকল করে, ওর মতো ভারী গলায় ভুরু তুলে কথা বলার চেষ্টা করে, ইত্যাদি। ছোটমামা ছবি দেখেন না, তাঁর শখ হল পামিস্ট্রির, তিনিও ছেলেটার যশের রেখাটা এক বার দেখে আসতে আগ্রহী। মা-র ইচ্ছে অংশুমানকে এক দিন নেমন্তন্ন খাওয়ানোর। সাংবাদিক ছেনিদার ভাবনা, এই ফাঁকে অংশুমানের একটা সাক্ষাৎকারের সুযোগ নেওয়ার। শুধু ছোটদার তাপ-উত্তাপ নেই, সে প্রেসিডেন্সিতে পড়া সিরিয়াস ছেলে, ফিল্ম সোসাইটির মেম্বার এবং জার্মান সুইডিশ ফরাসি কিউবান ব্রেজিলিয়ান ছবি দেখে। বোঝা যায়, কী প্রখর সচেতনতায় সত্যজিৎ বাঙালি দর্শকদের মধ্যে চলচ্চিত্রের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ উপন্যাসে ফেলুদা হিন্দি ছবির সাফল্যের অসামান্য একটি ফর্মুলা শুনিয়েছিলেন জটায়ুকে। একটু উদ্ধার করছি: ‘লিখুন— স্মাগলিং চাই— সোনা হিরে গাঁজা চরস, যা হোক; পাঁচটি গানের সিচুয়েশন চাই, তার মধ্যে একটি ভক্তিমূলক হলে ভাল, দুটি নাচ চাই; খান দু’তিন পশ্চাদ্ধাবন দৃশ্য বা চেজ-সিকুয়েন্স চাই— তাতে অন্তত একটি দামি মোটরগাড়ি পাহাড় থেকে গড়িয়ে ফেলতে পারলে ভাল হয়; অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য চাই, ... আর সব শেষে— এটা একেবারে মাস্ট — চাই হ্যাপি এন্ডিং। তার আগে অবিশ্যি বার কয়েক কান্নার স্রোত বইয়ে দিতে পারলে শেষটা জমে ভাল।’ ‘ছবির জন্য গল্প’ প্রবন্ধে ‘বোম্বাইয়ের বাজারি ছবি’র যে-গতির কথা বলেছিলেন সত্যজিৎ, তারই ফর্মুলা এটি।
একই প্রসঙ্গ এই লেখাতে আছে অন্যত্রও। একটি হিন্দি ছবি দেখার প্রতিক্রিয়া: ‘ইন্টারভ্যালের আগেই বুঝতে পারলাম যে ‘তীরন্দাজ’ হচ্ছে একেবারে সেন্ট পার্সেন্ট কোডোপাইরিন-মার্কা ছবি’। লালমোহনবাবুর বক্তব্য ছিল: ‘..বোম্বাইতে যদি তীরন্দাজ হিট হতে পারে তো সবই হতে পারে।’ মুম্বইয়ের সাংস্কৃতিক চরিত্র সম্পর্কে ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’-তেই বলছেন সত্যজিৎ: ‘গল্পলেখক হিসেবে নাম যদি আশা করেন, তাহলে বম্বে আপনার জায়গা নয়। এখানে গল্প লেখা হয় না, গল্প তৈরি হয়, ম্যানুফ্যাকচার হয়…’।
শুধু হিন্দি নয় অবশ্য, ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ দেখে ফেলুদার কুং-ফু-র ঢঙে হাত পা ছুড়ে অভ্যেসের কথাও আছে ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’-তেই। তবে হিন্দি ছবির নানা প্রসঙ্গ বিভিন্ন লেখায় অবধারিত ভাবে এনেছেন সত্যজিৎ। দেব আনন্দের ‘জুয়েল থিফ’-এর ধাঁচের টুপি, ধর্মেন্দ্রর নাসপাতি-মার্কা চেহারা-সহ আরও নানা উল্লেখ থেকে এই বিষয়ে তাঁর মনোভাবের পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।
‘গোরস্থানে সাবধান’-এ লালমোহনবাবু গাড়ি কিনে ফেলুদার বাড়িতে এসেছেন, ফেলুদা বললেন: ‘আপনার উপর হিন্দি ফিল্মের প্রভাব এতটা ঝটিতি পড়বে সেটা ভাবতে পারিনি। আর রংটাও ইকুয়্যালি পীড়াদায়ক। মাদ্রাজি ফিল্ম-মার্কা।’ একই লেখায় লালমোহনবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছেন, ‘পুলক ছোকরার জন্য একটা ভালো প্লট ফেঁদেছিলুম। নির্ঘাৎ আবার হিট হত— তা সে আজ লিখেছে হিন্দি ছবিতে নাকি থ্রিল আর ফাইটিং-এর বাজার মন্দা। সবাই নাকি ভক্তিমূলক ছবি চায়। জয় সন্তোষী মা সুপার হিট হবার ফলে নাকি এই হাল’। ‘দেশ’ পত্রিকায় এম এস সথ্যু পরিচালিত ‘গরম হাওয়া’ ছবির আলোচনা পড়ে পত্রিকা-সম্পাদককে পাঠানো চিঠিতে সত্যজিৎ লিখেছিলেন, ‘… হিন্দি তথা বাংলা ভাষায় তোলা সাম্প্রতিককালের শতকরা আশিভাগ ছবিরই কোনও প্রয়োজন ছিল না কারণ তাতে না আছে শিল্পগুণ, না আছে বিষয়বস্তুর বৈশিষ্ট্য বা বলিষ্ঠতা’।
‘দার্জিলিং জমজমাট’-এ সত্যজিৎ রায় তোপসের বয়ানে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হিন্দি ছবির এক ভিলেনের সঙ্গে— ‘আমার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লাগল মহাদেব ভার্মাকে। ইনি হলেন যাকে ইংরেজিতে বলে পালিশ করা ভিলেন। চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, নাকের নীচে সরু চাড়া-দেওয়া গোঁফ, দেখে মনে হয় প্রয়োজনে খুন করতে কিছুমাত্র দ্বিধা করবেন না।’
গত শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছায়াছবির ভিলেন এ রকমই, কিন্তু লক্ষণীয়, তোপসের ‘সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং’ লাগল ভিলেনকেই। সত্যজিৎ রায়ও অন্যত্র বলেছিলেন, বাণিজ্যিক ফিল্মে ভিলেনের দায় সবচেয়ে বেশি। কারণ তাকে গোটা ছবিতে নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে এগোতে হয়।
স্টান্টম্যানদের কথাও আছে তাঁর লেখায়। তাঁদের জীবনের প্রচারহীনতা নিয়ে সত্যজিতের অন্যতম গল্প ‘মাস্টার অংশুমান’। স্টান্টম্যান জানেন, ‘...একাজে নাম হয় না। ফাইটিং-এর ছবি দেখে কেউ জিজ্ঞেসও করে না কে স্টান্টম্যান ছিল। তবে পেট চলে যায়, কারণ কাজের অভাব নেই। যত দিন যাচ্ছে, ছবিতে স্টান্ট ততই বেড়ে যাচ্ছে।’ স্টান্টম্যান নিয়ে সত্যজিতের নিজের অভিজ্ঞতা খুব ভাল ছিল না। ‘জলসাঘর’ ছবিতে ছবি বিশ্বাসের এক জন ‘ডাবল’ নিতে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর ‘অপূর্ব কৃতিত্ব’ দেখে সত্যজিৎ ‘ভবিষ্যতের কোনও ছবিতে বাংলা দেশের স্টান্টম্যান ব্যবহার করার বাসনায় জলাঞ্জলি’ দিয়েছিলেন (প্রবন্ধ : ‘একথা সেকথা’)। এই সূত্রেই ‘মাস্টার অংশুমান’-এর ‘বম্বেতে বাঙালি স্টান্টম্যানকে কেউ পাত্তা দেয় না...’ কথাটি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
সত্যজিৎ একটি সাক্ষাৎকারে স্বদেশের ‘আনসফিস্টিকেটেড অডিয়েন্স’ সম্পর্কে বিরক্তি, হতাশা জানিয়েছিলেন সরবেই। ‘দেবী’ প্রসঙ্গে অকারণে ধর্মীয় কুযুক্তি-সহ প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন কেউ কেউ। সে সব তাঁর পছন্দ হয়নি, সে কথা বলেছিলেন, আর সেই সূত্রেই ধরা পড়েছিল ফিল্মের ভারতীয় দর্শকদের মান সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া।
‘রবার্টসনের রুবি’ গল্পে সত্যজিৎ মামা-ভাগ্নে পাহাড়ের প্রসঙ্গে নিরীহ ভাবে ছুঁয়েছেন তাঁর নিজের ছবি ‘অভিযান’কেও। ‘লখনৌর ডুয়েল’-এ আছে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর কথা, ডুয়েল রোল-এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে, সন্তোষ দত্তের নাম উল্লেখ করেই।
চলচ্চিত্র যে একটা ‘যৌথশিল্প’ (প্রবন্ধ: ‘বাংলা চলচ্চিত্রের আর্টের দিক’) সে কথা সত্যজিৎ রায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে জোর দিয়ে বলেছেন। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’তে ছবি তৈরির মহাব্যস্ততা সামনে থেকে দেখে লালমোহনবাবুও বুঝেছিলেন, ‘না মশাই, শুধু টাকা দিয়ে ছবি হয় না...’
এ ভাবেই গল্পে-উপন্যাসে চলচ্চিত্রের নানা মহলে আলো ফেলেছেন সত্যজিৎ। তাঁর নানা গদ্য আর বক্তব্যের প্রচ্ছন্ন সম্প্রসারণ হিসেবেই তা গ্রহণ করা উচিত।