গদ্যশিল্পী: হাসান আজিজুল হক। ডান দিকে, যবগ্রামের সেই পাকুড়গাছের নীচে তিনি
হাসান আজিজুল হক অসুস্থ, এই খবর দুই বাংলাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল গত অগস্টে। উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত হল, যখন শুনলাম তাঁর বাসগৃহ রাজশাহী থেকে এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে করে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে তাঁর চিকিৎসা করাচ্ছেন বাংলাদেশ সরকার। বাজার-সফল লেখক বলতে যা বোঝায়, তা তো তিনি ছিলেন না। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীর এই যত্নটুকুর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ বোধ করলাম। তার পর নানা গুজবকে মিথ্যে প্রমাণ করে হাসান আজিজুল কিছুটা সুস্থ হয়ে রাজশাহীতে তাঁর ‘উজান’ বাড়িতে ফিরে গেলেন। অপেক্ষা করছিলাম আরও একটু সুস্থতার, বাংলা ভাষাও অপেক্ষা করছিল আরও একটু সম্পন্ন হবে বলে। যদিও জানি এই সময় প্রিয়-বিয়োগের, পনেরোই নভেম্বরের রাত ন’টা পনেরোয় তাঁর প্রয়াণের সংবাদের প্রস্তুতি ছিল না আমার। স্তব্ধতা গ্রাস করেছিল। বড় ভালবাসতাম তাঁকে।
আশির দশকের মাঝামাঝি আধুনিক সাহিত্যের পাঠক হিসেবে যখন সদ্য ডানা গজাচ্ছে আমার, গল্পকার হিসেবে তখনও বনফুল, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সুবোধ ঘোষ, এমনকি সন্দীপন প্রমুখেরও নাম উচ্চারণ করি বন্ধুমহলে, নামই শুনিনি হাসান আজিজুল হকের। একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের অনীহা ছিল। এতে এই বঙ্গের পাঠক ও লেখকের খুব কিছু লাভ হয়েছে, তা মনে হয় না। যত দূর মনে পড়ে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে পড়ে ফেললাম হাসান আজিজুল হকের গল্প ‘শকুন’। রাঢ় বাংলার রুক্ষ পরিবেশে দুরন্ত শিশুর হাতে ঘৃণ্য অশক্ত শকুনের করুণ পরিণতি, মৃত শকুনের পাশে বেওয়ারিশ শিশুর লাশের দিকে শবভুক হিংস্র শকুনের পালের ছুটে আসার মধ্যে ভুয়ো মানবিকতার প্রতি বিদ্রুপ যে ভাষায় লেখক শোনালেন, তা আমাকে আচ্ছন্ন করল। ভূতে পাওয়ার মতো ঘোর নিয়ে হাতে নিলাম ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। কী এক আশ্চর্য মায়াবী শীতসন্ধ্যার বর্ণনায় শুরু হচ্ছে গল্প: ‘...চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়।’ বুক দেখায় পিঠ দেখায়! কলাপাতার এই ছন্দ থেকে কখনও মুক্ত হবে কি পাঠক? কিন্তু ক্রমে গল্প এগোলে আমরা জানতে পারি কেন অসহায় কন্যার পিতা বাড়ির উঠোনে করবীগাছ পোঁতে। কামার্ত পুরুষকে সে জানায়, ‘চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে।’ তার পর একে একে ‘আমৃত্যু আজীবন’ মহাকাব্যিক ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘আমরা অপেক্ষা করছি’, ‘বিধবাদের কথা’ এবং আরও যা পেয়েছি। কোনও সন্দেহ নেই হাসানভাই গল্পই বলতে চেয়েছেন, আঙ্গিক নিয়ে চমক দেওয়ার লোভ ওঁর ছিল না। কিন্তু ভাষার এক নিজস্বতা ছিল তাঁর অনায়াস বৈশিষ্ট্য। হাসানের গল্পে যে সমাজ-সচেতনতা, প্রকৃতিকে প্রতীকের মতো ব্যবহার, শকুন, উটপাখি, করবী গাছ, ষাঁড় বা গোখরোর মানুষেরই কোনও না কোনও শ্রেণির প্রতিনিধি হয়ে ওঠা, এ সব যে তিনি সচেতন ভাবে জোর করে করেছেন তা নয়। জোর করে আর যা-ই হোক, শিল্প হয় না। এই প্রসঙ্গে তিনি জানাচ্ছেন, “লিখতে লিখতে লেখা হয়ে যায়। ...তুমি পড়ার সময়ে ভাবছো প্রত্যেকটি থিংকিং অত্যন্ত সচেতনভাবে লেখা। আমি কিন্তু কিছুই এভাবে করি নি।” আসলে দু’চোখ দিয়ে জীবনকে যখন দেখেছেন তিনি, কোনও কিছুই অবহেলা করেননি। আড্ডাপ্রিয় মানুষটিকে দেখেছি সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত কী ভাবে চেটেপুটে আস্বাদ করেন তিনি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি। ফলে তাঁর অভিজ্ঞতা ও সহজাত ক্ষমতার বলে গল্পগুলো আপনিই হয়ে উঠেছিল জীবনঘনিষ্ঠ ও শিল্পোত্তীর্ণ। অনেকেই তাঁর বাংলায় বর্ধমান অঞ্চলের ভাষার প্রভাব খুঁজে পান, সেটা স্বাভাবিকও। কিন্তু দুই বাংলার প্রতিটি অঞ্চলের পাঠকই হাসান আজিজুল হকের ভাষাটিকে নিজের বুকের ভাষার মতোই পাঠ করেন, এমনই সে ভাষার আবেদন। এই ভাষাটি তাঁর নিজস্ব সৃজন। খুব বেশি যে তিনি লিখেছেন তা কিন্তু নয়, কিন্তু পঞ্চাশটি বা ষাটটি গল্পের জন্যেই যদি বিশ্বসাহিত্যে কেউ অমরত্ব পেতে পারেন, হাসান আজিজুল হক তেমনই এক জন।
ভারতে এলে হাসানভাই সাধারণত হৃদয়পুরে দুই বাংলার সাঁকো-স্বরূপ সুশীল সাহার ‘আনন্দধারা’তেই উঠতেন। ওঁকে প্রথম দেখি উঠোনে গামছা পরে স্নানার্থে টিউবওয়েল পাম্প করে বালতিতে জল ভরছেন। ‘জীবন ঘষে আগুন’-এর লেখকের এই ছায়া সুনিবিড় গ্রাম্য রূপটি তৃষ্ণার জলের মতো উপশম যেন। এর পরে যত বারই মানুষটার কাছে বসেছি, এই ব্যাপারটা টের পেয়েছি। ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছি আরও যে সূত্রে, আমরা উভয়েই দর্শনের ছাত্র ও শিক্ষক। তিন দশকেরও বেশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাশ্চাত্য দর্শনেই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। একটি চিঠিতে আমাকে লিখেছিলেন, “দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আজও দর্শন বিভাগ নামে একটি বিভাগ থাকে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন যেরকম দাঁড়িয়েছে, তাতে মনে হয় এই বিভাগটাই বেখাপ্পা। ব্যবহারিক জীবনে এক ফোঁটা কাজ দেয় না...।” শিক্ষাব্যবস্থায় দর্শনশাস্ত্রের ভূমিকা নিয়ে তাঁর চিন্তার অন্ত ছিল না। বাংলা ভাষায় দর্শনের জনপ্রিয় বই লেখার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ সব সময় পেয়েছি। দর্শনের কঠিন তত্ত্বগুলি বাঙালির ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের ভাষাতেই পড়ে মর্মোদ্ধার করুক, এ তিনি সব সময়েই চেয়েছেন। সেই কারণেই ষাটের দশকে প্রকাশিত, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেবের ‘তত্ত্ববিদ্যা-সার’ গ্রন্থটির পুনঃপ্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। কঠিন বিষয়ের সরল উপস্থাপনায় বইটির জুড়ি নেই— এই মর্মে তিনি বইটির একটি ভূমিকাও লিখে দেন। তিনি নিজেও ‘সক্রেটিস’ নামে ছোট ও চমৎকার একটি বই লিখেছিলেন। অত্যন্ত সুলিখিত এই বইটির বহু সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে, সে খবর তাঁর কাছে পৌঁছেছিল কি না জানি না অবশ্য। কিন্তু একটু অবাক হই দেখে, একাধারে ক্ষমতাধর কথাশিল্পী ও দর্শনের কৃতী এই অধ্যাপক দর্শন বিষয়ক আর কোনও বই লেখেননি। শিক্ষকতার বাইরে নিজেকে দার্শনিক গ্রন্থের লেখক হিসেবে দেখতে চাননি হয়তো। কিন্তু দর্শনবিষয়ক একমাত্র গ্রন্থটি লেখার জন্য সক্রেটিসকেই যে বেছে নিলেন, এই বিষয়টি লক্ষণীয়। দার্শনিক কে— এ বিষয়ে হাসানের সুনির্দিষ্ট মত আছে। বলাই বাহুল্য, প্রথমত তাকে চিন্তক হতে হবে। প্রথাকে, প্রচলিতকে মেনে নেওয়া চিন্তকের ধর্ম নয়। চিন্তক জানেন প্রশ্ন ছাড়া জীবন নেই। দ্বিতীয়ত, চিন্তার প্রথম শর্তই সাহসিকতা। দুর্বল মেরুদণ্ডের বুদ্ধিজীবী, যাঁরা হয়তো ‘নলেজেবল’ কিন্তু ‘ওয়াইজ়’ নন, তাঁরা হাসানভাইয়ের অপছন্দের পাত্র। কারণ এই সব বুদ্ধিজীবী সঙ্কীর্ণ স্বার্থে রাষ্ট্র বা ধর্মের অন্যায় কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করতে ভয় পায়। দার্শনিকের চরিত্র বিষয়ে হাসান আজিজুল হকের এই কথাগুলি আমি তুলে এনেছি ওঁরই লেখা ‘কাণ্ডজ্ঞানের দর্শন: আরজ আলী মাতুব্বর’ প্রবন্ধটি থেকে। এটাও লক্ষণীয় যে এই উপমহাদেশে বসে যে দু’জন দার্শনিককে নিয়ে হাসান আজিজুল হক কলম ধরেছেন, তাঁরা হলেন সক্রেটিস এবং আরজ আলী— দু’জনেই ছিলেন রাষ্ট্র ও ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ অপছন্দের মানুষ। হাসানভাইয়ের জীবন ও কর্মে এই দু’টি মানুষের প্রভাব স্পষ্ট।
এই যে কাঁটাতার পেরিয়ে ও পার থেকে মানুষ এখনও এ পারে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন, এ নিয়ে হাসানভাইয়ের দুঃখের অন্ত ছিল না। ভারত তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ আর বাংলাদেশের চেয়েও এ দেশে মুসলমানের সংখ্যা অনেক বেশি— এই প্রসঙ্গ উঠলে ক্ষুব্ধ কথাশিল্পী সজোরে টেবিলটা চাপড়ে বলে উঠলেন, “তা হলে দেশটা ভাগ হবার দরকারটা কী ছিলো!” এই ক্ষোভ, এই বিস্ময়, এই আর্তি তাঁর ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে ঘুরেফিরে এসেছে। দেশত্যাগে অনিচ্ছুক মায়ের কাছে মেজোখোকা এসে জানতে চায়— কেন তিনি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? মা জবাব দিচ্ছেন, “সত্যি বলছি বাবা, আমি ক্যানে দেশান্তরী হব এই কথাটি কেউ আমাকে বুঝুইতে পারে নাই। ...একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একই রকম কথা, শুধু ধম্মো আলেদা সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়?” এই প্রশ্ন নিছক উপন্যাসের একটি চরিত্রের নয়, এই প্রশ্ন আমার মাতৃভূমির। এক দ্বিধান্বিত নাগরিকতা হাসানভাইকেও কুরে কুরে খেত বলে আমার বিশ্বাস। প্রথম প্রথম তো দুই দেশের মধ্যে যেতে আসতে পাসপোর্ট ভিসাও লাগত না। বালক হাসানও সেই ভাবেই যাওয়া আসা করেছেন। তার পর হঠাৎ এক দিন সরকারি নির্দেশনামায় দু’দেশের মাঝখানে নেমে এল দুর্লঙ্ঘ্য কাঁটাতার, যা কখনও মেনে নিতে পারেননি তিনি। হাসান আজিজুল হকের পৈতৃক বাড়ি ছিল বর্ধমানের যবগ্রাম। ২০১৬ সালের মে মাসে হাসানভাই যবগ্রাম যাচ্ছিলেন, সে যাত্রায় আরও অনেকেরই সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। শক্তিগড়ে নেমে ল্যাংচার দোকানের মালিকের ঠিকুজি-কুষ্ঠির খোঁজ নিতে শুরু করলেন, দেশের মানুষ বলে কথা। কথায় কথায় কিছু পরিচিত নাম উঠে এল টের পেলাম। দোকানদার এক রকম নিশ্চিত হয়েই জানতে চাইলেন, আপনি তো ব্রাহ্মণ। হাসানভাই বললেন— না, আমি মুসলমান। তাতে অবশ্য পারস্পরিক শ্রদ্ধার তারতম্য কিছু ঘটেনি, মানুষটি যে সরস্বতীর বরপুত্র সে কথা বুঝতে উপস্থিত কারওই অসুবিধে হয়নি। মিষ্টির প্যাকেট সমেত যত্ন করে হাসানভাইকে গাড়িতে তুলে দিলেন স্থানীয় মানুষেরা। দেশের মানুষের এই সব টুকরো আন্তরিক ব্যবহারে কী খুশিই না হচ্ছিলেন সংবেদনশীল মানুষটা। পথে এক বার তাল গাছের সারি দেখে বললেন গাড়ি থামাতে। বললেন, “ছবি তুলে দাও, ওদের আমি নিয়ে যাব।” তার পর বড় রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে গাড়ি গ্রামের পথ ধরলে হাসানভাই শিশু হয়ে গেলেন। ছেলেবেলার পাকুড়গাছটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, এর কথা আমরা ওঁর লেখায় পেয়েছি। গাছের নীচে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন আবার। এ দিক-ও দিক তাকিয়ে বোধহয় দেখতে পাচ্ছিলেন ছেলেবেলার খেলার সঙ্গীরা সব দৌড়ে আসছে ওঁর দিকে। গ্রামে ঢোকার মুখে পুরনো বন্ধুদের নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন, যেন সব আগের মতোই আছে। কিন্তু সত্যিই কি তা আছে? গলি থেকে কেবল বেরিয়ে এলেন দিনমজুর বৃদ্ধ সমরেশ। কত যুগ পরে দুই বন্ধু মুখোমুখি, অপলক চেয়ে আছে পরস্পরের দিকে। চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে দু’জনের। খবর পেয়ে বাড়ির লোকেরা বেরিয়ে এল, গাঁয়ের মেয়েরা জল নিয়ে এল কাঁসার পাত্রে, যুবকেরা পিতৃপুরুষের মুখে শোনা গল্পগুলি বলতে শুরু করল, অনেক দিন পরে কে এক গাঁয়ের ছেলে বড় মানুষ হয়ে ফিরে এসেছে খবর পেয়ে বালকেরা সার সার দাঁড়িয়ে পড়ল দেখতে। কিন্তু আমরা থাকতে আসিনি, উৎসুক জনতাকে পিছনে ফেলে হাসানভাইয়ের আত্মীয়ের বাড়ির দাওয়ায় বিশ্রামের জন্য কিছু ক্ষণ বসলাম। আজিজুলদের পৈতৃক বাড়ি আর নেই। কুশল বিনিময়, এ কথা-সে কথা কিছু ক্ষণ চলল বটে, কিন্তু একটা অদৃশ্য দেওয়াল আমরা টের পাচ্ছিলাম। আমাদের হাসান যে আগের মতো নেই, সে এখন বিরাট এক মানুষ, কাগজে তার ছবি ছাপে, গ্রামে এলে তার সঙ্গে ক্যামেরা হাতে সাংবাদিকেরাও চলে আসে পিছু পিছু— এই অভিজ্ঞতা একটা সম্ভ্রমের বেড়া পেরিয়ে আগের সেই ঘনিষ্ঠতা ফিরিয়ে দিচ্ছে না যেন। সন্ধে নামার আগে হাসান আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে রাঢ় দেশ ত্যাগ করে আমরা রওনা দিলাম কলকাতার দিকে।
আমার তুলে দেওয়া রাঢ়দেশের তালগাছের সারি আর পাকুড়গাছের নীচে লাঠি হাতে দাঁড়ানো হাসানভাইয়ের ছবিদু’টি তাঁর রাজশাহীর শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে বাঁধিয়ে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁরই ইচ্ছেয়। আমাকে ফোনে সে কথা জানিয়েছিলেন। হাসান আজিজুল হক যে বাংলাদেশেই থেকে গেলেন, এ নিয়ে তাঁর কোনও আফসোস ছিল না। নিজের শহর রাজশাহীকে, নিজের দেশ বাংলাদেশকে তিনি প্রাণাধিক ভালবাসতেন। অন্য দিকে এটাও তিনি মেনে নিতে পারতেন না, শুধু মাত্র ধর্মের কারণেই ভারতটাও তাঁর দেশ নয়। মৃত্যুর পূর্বেও কি তিনি বিছানায় শুয়ে ছবিদু’টির দিকে চেয়ে নিজের দ্বিধান্বিত নাগরিকতার কথা ভাবছিলেন? শেষ মুহূর্তে কি তিনি ক্ষোভে আরও এক বার বলে ওঠেননি— “কিন্তু দেশটা তাহলে ভাগ হলো কেন?”
আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেলেও, শুধু নজরুলকেই নয়, হাসান আজিজুল হককেও ভাগ করা যায়নি বিলকুল। তাঁর মতো মানুষের ব্যাপ্তিকে কাঁটাতারে ঘেরা যায় না কি?