ছবি: কুনাল বর্মণ
সে দিন সংস্কৃত কলেজে পরীক্ষা। সকাল দশটা বাজতেই ছাত্ররা একে একে ক্লাসে এসে লিখতে শুরু করেছে। তারই মাঝে বেঁটেখাটো পণ্ডিতমশায়ের কৌতূহলী চোখ ঘরের এ দিক ও দিক কাকে যেন বারবার খুঁজছিল। ছাত্রদের মধ্যে এক জন বাদে সকলেই সেখানে উপস্থিত। বিশেষ এই ছাত্রটিকে পণ্ডিতমশাই অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সে জন্যেই তাকে নিয়ে ভাবনা!
ক্লাসে না এলেও ইতিমধ্যেই ছাত্রটি কলেজের অন্য একটি ফাঁকা ঘরে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। অবিলম্বে তিনি ছাত্রটিকে রচনা লেখার পরীক্ষায় বসাতে চাইলেন। কিন্তু জেদি ছেলেটি বেঁকে বসল। সে কিছুতেই পরীক্ষা দেবে না। পণ্ডিতমশাই যতই বোঝানোর চেষ্টা করেন, তার জেদও ততটাই বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে পণ্ডিতমশাই কলেজের অধ্যক্ষ মার্শাল সাহেবের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনাটি জানালেন। তার পর ছাত্রটিকে চ্যাংদোলা করে তুলে আনলেন ক্লাসে!
সেই ছাত্রটি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আর পণ্ডিতমশাই অলঙ্কারশাস্ত্রের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ। পরীক্ষায় বসলেও ঈশ্বরচন্দ্র এ বার বিরক্ত হয়েই পণ্ডিতমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন শুধু শুধু তাকে এই পরীক্ষায় বসালেন তিনি? এর উত্তরে প্রেমচন্দ্র একটু হেসে বললেন, ‘‘যা পারো তাই লেখো, না হলে সাহেব অসন্তুষ্ট হবেন।’’ আসলে সাহেবের নাম করে তিনি নিজের ইচ্ছের কথাই বললেন।
প্রেমচন্দ্র ভাল করেই জানতেন ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতিভার কথা। আর এও জানতেন যে সে কিছু লিখলে সেটা ব্যতিক্রমী হবেই। ঈশ্বরচন্দ্র সে সময় স্মৃতিশ্রেণির ছাত্র হলেও, তখনও অলঙ্কারশ্রেণিতে আসেননি। পণ্ডিতমশাই চেয়েছিলেন কলেজে সকলের সামনে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতিভা তুলে ধরতে। তবে তাঁর আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছুটা নিরুপায় হয়েই ঈশ্বরচন্দ্রকে পরীক্ষায় রচনা লিখতে বসতে হল। ইতিমধ্যে এগারোটা বেজে গিয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র প্রেমচন্দ্রকে বললেন, সকলে দশটায় লিখতে শুরু করেছে, এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কী-ই বা লিখবেন। বিরক্ত প্রেমচন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রচনার বিষয় ছিল ‘সত্যকথনের মহিমা’। পণ্ডিতমশাই চলে যাওয়ার এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, ঈশ্বরচন্দ্র চুপচাপ বসে আকাশকুসুম ভাবতে লাগলেন। একটি অক্ষরও লিখলেন না। দেখতে দেখতে বারোটা বেজে গেল। প্রেমচন্দ্র সেখানে এসে অবস্থা দেখে প্রচণ্ড রেগে গেলেন। তর্কবাগীশকে দেখে ঈশ্বরচন্দ্র অজুহাত দিলেন, তিনি কী লিখবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। মনে মনে রাগ সংবরণ করে প্রেমচন্দ্র শান্ত ভাবে ছাত্রকে বললেন ‘সত্যং হি নাম’ এই বিষয়ে গদ্য লিখতে শুরু করতে। ঈশ্বরচন্দ্র এ বার ভালমতই বুঝলেন, রচনা না লিখলে সে দিন পণ্ডিতমশায়ের হাত থেকে নিস্তার নেই। দেরি না করে লিখতে শুরু করলেন, এক ঘণ্টার মধ্যে রচনা শেষও করলেন।
সে দিন ঈশ্বরচন্দ্র ভেবেছিলেন, পরীক্ষকরা বুঝি তাঁর রচনা পড়ে পরিহাস করবেন। কিন্তু ঘটনা এই, এই রচনা লিখেই তিনি কলেজে একশো টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রেমচন্দ্রের এত কিছু করার উদ্দেশ্য ছিল— ঈশ্বরচন্দ্রের মন থেকে রচনা লেখার ভয় এবং পরীক্ষার ভীতি কাটানো। আপাতদৃষ্টিতে সামান্য মনে হলেও ঘটনাটিতে ঈশ্বরচন্দ্র এক দিকে যেমন উৎসাহিত হয়েছিলেন, ঠিক তেমনই তাঁর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরের বছরও কলেজের পরীক্ষায় পদ্য লিখে পুরস্কার পেয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র।
এমনই এক শিক্ষকের কাছে ঈশ্বরচন্দ্র পেয়েছিলেন অনুপ্রেরণা, জীবনের মূল্যবোধ আর কুসংস্কারমুক্ত চিন্তাধারা। বিদ্যাসাগরের মানসিকতা এবং চারিত্রিক ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার নেপথ্যেও প্রেমচন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অলঙ্কারশ্রেণিতে ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র এক বছর পড়েছিলেন। তার মধ্যেই গুরু-শিষ্যের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
তখনও এ দেশে বেশ কিছু পাঠ্য বিষয় বই আকারে ছাপা হয়নি। প্রেমচন্দ্রের হাতে লেখা ‘সাহিত্যদর্পণ’-এর একটি পুঁথি ছিল। ব্যবহারের জন্য সেটি তিনি কলেজেই রেখে দিতেন। ছাত্ররা প্রয়োজন মতো এক-একটি পাতা খুলে বাড়ি নিয়ে যেত। আবার রেখেও দিত। এক দিন পুঁথির পাতা মেলাতে গিয়ে প্রেমচন্দ্র দেখেন, কয়েকটি পাতা নেই। এর পর পরই তিনি পুঁথির পাতা ছাত্রদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া বন্ধ করার নির্দেশ দেন।
কয়েক দিন পরে বিশেষ প্রয়োজনে ঈশ্বরচন্দ্র পুঁথির কয়েকটি পাতা খুলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন কাজ মিটে গেলে আবার সেগুলি যথাস্থানে রেখে দেবেন। কেউ বুঝতেই পারবে না। সে দিন কলেজ থেকে বেরনোর ঠিক আগেই এক পশলা বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট বেশ পিচ্ছিল হয়ে উঠেছিল। রাস্তায় যেতে যেতে আচমকা পা পিছলে ঈশ্বরচন্দ্র কাদায় পড়ে গেলেন। জামাকাপড় তো বটেই, পুঁথির পাতাগুলিও জলে ভিজে গেল। এমন অবস্থায় একটি দোকানে উনুনের পাশে নিজের ভিজে চাদরখানা বিছিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র ভিজে পুঁথির পাতাগুলি শুকোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।
ঘটনাচক্রে ঠিক সেই সময় প্রেমচন্দ্র ওই জায়গা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। প্রিয় ছাত্রের এমন দশা দেখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন কী হয়েছে। এমন পরিস্থিতির জন্য ঈশ্বরচন্দ্র মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে পুরো ঘটনা অকপটে পণ্ডিতমশাইকে জানালেন। সব শুনে প্রেমচন্দ্র নিজের গায়ের চাদরটি ঈশ্বরচন্দ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আগে কাপড় বদলাতে, পরে দুঃখ করতে! ঈশ্বরচন্দ্র ইতস্তত করছেন দেখে তিনি একটি ঘোড়ার গাড়ি ডেকে সে দিন তাঁর ছাত্রটিকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। এমন শিক্ষকের সান্নিধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রের জীবনদর্শন আলোকিত হয়েছিল বলেই পরবর্তী কালে তিনি নিজেও এক জন ছাত্রদরদি শিক্ষক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
এক দিন যে ঈশ্বরচন্দ্রকে তিনি জোর করে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষায় রচনা লিখতে বসিয়েছিলেন, সেই ঈশ্বরচন্দ্র পরবর্তী কালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তবু দু’জনের কখনও ঘটেনি ব্যক্তিত্বের সংঘাত। ঈশ্বরচন্দ্রের বন্ধু গিরীশ বিদ্যারত্নের পুত্র হরিশ্চন্দ্র কবিরত্ন প্রেমচন্দ্রের ছাত্র ছিলেন। এক বার অলঙ্কারশাস্ত্রের কোনও একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি লিখেছিলেন ‘কাশীস্থিতগবাম্’। যা ব্যাকরণগত ভাবে প্রেমচন্দ্রের ভুল মনে হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত রেগে গিয়ে অধ্যক্ষ ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর, তুমি বাপু এই সব ছেলেপিলের মাথা খাচ্ছ। বাংলায় সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা লিখে যে কী সর্বনাশ করবে, তা বুঝতে পারছ না। এরা কিছু শিখছে না।’’
মাস্টারমশাইয়ের মুখে সে দিন এমন অভিযোগ শুনে, ঈশ্বরচন্দ্র এতটুকুও রাগ করেননি। বরং তাঁকে শান্ত করে বলেছিলেন, ‘‘আর ভাবনা নেই, পণ্ডিতমশাই! আমি এ বার ব্যাকরণ কৌমুদী লিখেছি, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ এর উত্তরে প্রেমচন্দ্র আরও রেগে গিয়ে বলেছিলেন ‘‘ছাই হবে।’’ ঈশ্বরচন্দ্র সে দিন এতটুকুও বিরক্ত হননি। কারণ তিনি জানতেন, প্রেমচন্দ্রের এমন উক্তি শিক্ষাপ্রণালী সম্পর্কে তাঁর কঠোরতার প্রকাশ মাত্র। ব্যাকরণগত ভাবে কিছু ভুল বললে প্রেমচন্দ্র যেমন রেগে যেতেন, ঠিক তেমনই কারও মধ্যে প্রতিভার আভাস পেলে প্রশংসাও করতেন।
বরাবরই প্রেমচন্দ্র ছিলেন প্রতিবাদী চরিত্রের। লর্ড মেকলে যখন এ দেশে সংস্কৃত শিক্ষা বন্ধ করতে সংস্কৃত কলেজ বন্ধের দাবি করেন, প্রেমচন্দ্র তার প্রতিবাদ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রও জীবনের বিভিন্ন সময়ে পেয়েছিলেন প্রেমচন্দ্রের সাহচর্য। বিদ্যাসাগর আয়োজিত প্রথম বিধবাবিবাহ সভায় তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকদের মধ্যে প্রেমচন্দ্রও উপস্থিত ছিলেন।
প্রেমচন্দ্রের জন্ম ১৮০৬-এ বর্ধমান জেলার রায়না থানার অন্তর্গত শাকনাড়া গ্রামের এক প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বংশে। পূর্বপুরুষদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন খ্যাতনামা পণ্ডিত। ছেলেবেলায় তাঁর শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের পাঠশালাতে। পরে বাবার ইচ্ছায় প্রেমচন্দ্র শাকনাড়া থেকে কিছুটা দূরে দুয়াড্ গ্রামে জয়গোপাল তর্কভূষণের টোলে ভর্তি হয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রেমচন্দ্র জয়গোপালের অন্যতম প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন এবং তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন সভায়, অনুষ্ঠানে যাতায়াত শুরু করেন। এর ফলে তাঁর পরিচিতি বৃদ্ধি পায়।
আরও পড়ুন:‘মেয়েদেরও এক টুকরো ছেলেবেলা থাকে বইকী’
কাব্যের প্রতি প্রেমচন্দ্রের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তেরো-চোদ্দো বছর বয়সেই সহজ সরল ভাষায় কবিতা-গান রচনা করতে পারতেন। এমনকী তিনি কবির দলে গানও বাঁধতেন। সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হওয়ার পরে নিজের বাড়িতে বিভিন্ন পার্বণ-উৎসব উপলক্ষে কবিগানের আয়োজন করতেন। শোনা যায়, প্রেমচন্দ্রের বাড়ির উৎসবে-অনুষ্ঠানে কবিগানের আসরে ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র সবান্ধব যোগ দিতেন। মাঝে মাঝে কলেজের ছুটিতে তিনি প্রেমচন্দ্রের বাড়িতে এসে পড়াশোনাও করতেন। পুকুরে ছিপ ফেলে মাছও ধরতেন!
১৮২৪-এ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় সংস্কৃত কলেজ। তার ঠিক দু’বছর পরে ১৮২৬-এ বাবার উৎসাহে প্রেমচন্দ্র কলেজে যোগ দেন। সে সময় হোরেস হেম্যান উইলসন কলেজের সেক্রেটারি ছিলেন। প্রথম দিন তিনি শাস্ত্র সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করে প্রেমচন্দ্রকে কবিতা লিখতে বলেন। অল্প সময়ের মধ্যে প্রেমচন্দ্র উইলসন সাহেবের সংস্কৃত ভাষায় অনুরাগ, তাঁর নানা গুণ সম্পর্কে শ্লোক রচনা করেছিলেন। ‘ভবান্ ধন্যঃ শ্রীহোরেস উইলসন সরস্বতী। লক্ষ্মীবাণী চিরদ্বন্দ্বং ভবতৈব নিরাকৃতং।।’ এর অর্থ, হোরেস উইলসন তুমি সরস্বতী, ধন্য তুমি, বুঝলাম আমি। লক্ষ্মী সরস্বতী, দুয়ে শত্রু বারো মাস, একত্র তোমারি গুণে, করিছেন বাস! রচনাটি দেখে উইলসন সাহেব অত্যন্ত খুশি হয়ে অবাক দৃষ্টিতে প্রেমচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
কলেজে কিছু দিনের মধ্যে কবি ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এঁরা দু’জনেই বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য উৎসাহী ছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে যখন ‘সংবাদ প্রভাকর’ সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হয়, ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে প্রেমচন্দ্র তার সম্পাদনা করতেন।
প্রেমচন্দ্র ‘পুরুষোত্তম-রাজাবলী’ নামক একটি কাব্য লেখার পাশাপাশি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের টীকা রচনা করেছিলেন। আগে কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’-এর সপ্তম সর্গ পর্যন্ত এ দেশে পাওয়া গেলেও অষ্টম সর্গ সহ সম্পূর্ণ গ্রন্থটি পাওয়া যেত না। কাপ্তেন মার্সেল ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় অষ্টম সর্গ সহ সম্পূর্ণ গ্রন্থটি পাওয়া গেলে প্রেমচন্দ্র এর টীকা রচনা করে ‘কুমারসম্ভব’-এর অষ্টম সর্গ প্রকাশ করেছিলেন। আগে এ দেশে সংস্কৃত নাটকগুলি ছাপা না হওয়ায় সাধারণ মানুষ সেগুলি পড়ার সুযোগ পেতেন না। ১৮৩৯-’৪০ নাগাদ প্রেমচন্দ্রই উদ্যোগী হয়ে মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ প্রথম বাংলা অক্ষরে ছাপিয়েছিলেন।
অধ্যাপনার পাশাপাশি প্রেমচন্দ্র প্রাচীন তাম্রশাসন এবং পাথরের ফলক পাঠোদ্ধার করতে পারতেন। এশিয়াটিক সোসাইটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেমস প্রিন্সেপ পূর্ববঙ্গ, ওডিশা এবং মগধ থেকে উদ্ধার হওয়া সংস্কৃত-মিশ্রিত পালি ভাষার তাম্রশাসন এবং পাথরের ফলক প্রেমচন্দ্রের সাহায্যে পাঠোদ্ধার করে বহু ঐতিহাসিক তথ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
শোনা যায়, রাজা রাধাকান্ত দেব কোনও জটিল শাস্ত্রের মীমাংসার সময়ে প্রেমচন্দ্রের মতামত না পেলে সন্তুষ্ট হতেন না। কলেজে প্রেমচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে প্রায় রোজই আসতেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। পাশ্চাত্য নাটক ও কাব্যের প্রতিও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। কলুটোলার শ্রীকৃষ্ণ মল্লিক তাঁর কাছে শ্রীমদ্ভাগবতের পাঠ ও ব্যাখ্যা শুনতে আসতেন। প্রেমচন্দ্রও তাঁর কাছে শেক্সপিয়রের কাব্যগুলির ব্যাখ্যা মন দিয়ে শুনতেন এবং দেশীয় নাটকের সঙ্গে তুলনা করতেন।
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ্য। সেই সময় মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। এমন সময় পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের একান্ত ইচ্ছায় নাটকটি এক বার প্রেমচন্দ্রকে পড়িয়ে নেওয়ার কথা ওঠে। মধুসূদন নাটকটির কয়েকটি ফর্মা এক বন্ধুর হাত দিয়ে প্রেমচন্দ্রের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। যথাসময়ে প্রেমচন্দ্র নাটকটি পড়ে মধুসূদনকে ফেরতও দেন। তবে নাটকটি পড়ে প্রেমচন্দ্র কোনও ভুলত্রুটির উল্লেখ না করায় মধুসূদন অবাক হয়ে সেই বন্ধুর কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। এই কথাটি যখন প্রেমচন্দ্রের কানে পৌঁছয় তিনি বলেছিলেন, কোনও চিহ্ন রাখতে গেলে, অনেক চিহ্ন থেকে যাবে, তার চেয়ে বরং যেমন আছে তাতে কোনও ক্ষতি নেই। বন্ধুর মুখে প্রেমচন্দ্রের এমন মতামত শুনে মধুসূদন তাঁকে অত্যন্ত দাম্ভিক মনে করেছিলেন। পরে মধুসূদনের সঙ্গে যখন প্রেমচন্দ্রের দেখা হয় তখন মধুসূদন নিজের ভুল বুঝতে পেরে স্বীকার করেছিলেন যে সংস্কৃত ভাষায় অলঙ্কার না পড়ে বাংলায় নাটক লেখায় ত্রুটি হয়েছে।
প্রেমচন্দ্র অহংকারী ছিলেন না। বরং সকলকে সম্মান করতেন। হারা নামে এক ধোপা তাঁর কাপড় কাচত। নিপুণ ভাবে কাজ করলেও কাপড় কেচে ফেরত দিতে সে বড় দেরি করত। আর সেই সঙ্গে দিত নানান অজুহাত। এমনটা বহু বছর ধরে চলতে থাকায় প্রেমচন্দ্র এক সময় বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। এক দিন প্রেমচন্দ্রের বাড়িতে এসে হারা কাপড়ের পুঁটলি সবেমাত্র নামিয়েছে, এমন সময় প্রেমচন্দ্র তাঁর কাজের লোকটিকে বললেন, কাচতে দেওয়া কাপড় গুনে নিয়ে হারাকে বিদায় করে দিতে। কথাটি হারা শুনতে পেয়ে বলেছিল, এ দুনিয়ায় ‘সর্বস্কন্দী’-র হাত থেকে কারও রেহাই নেই। আপন মনে আরও কথা বলছে নিজের মনে, এমন সময় প্রেমচন্দ্র সেখানে এসে হারাকে বললেন, তিনি এই ‘সর্বস্কন্দী’ কথাটির অর্থ বুঝতে পারলেন না।
হারা প্রেমচন্দ্রকে এক তৃষ্ণার্ত ব্রাহ্মণের এক চণ্ডালের সঙ্গে কথোপকথনের কাহিনি শোনাল। সেই চণ্ডাল নিজের পরিচয় দিয়েছিল ‘সর্বস্কন্দী’ বলে। কেননা ব্রাহ্মণ কিংবা দেবতা, সে সকলেরই কাঁধে চাপে। এ বার প্রেমচন্দ্র বুঝলেন, ‘সর্বস্কন্দী’-র অর্থ চণ্ডাল বা রাগ। যা কারও কাঁধে চড়লে মানুষ নিজের যুক্তি, বুদ্ধি, সব কিছু হারিয়ে ফেলে। হারার মুখে এমনটা শুনে প্রেমচন্দ্র এতটুকু রাগ করেননি। বরং হারার গভীর উপলব্ধি ও জ্ঞানের প্রশংসা করে বলেছিলেন, এখন থেকে তিনি হারার শাগরেদ হলেন। হারাকে তিনি ‘ওস্তাদজি’ বলে ডাকতেন।
কর্মসূত্রে প্রেমচন্দ্র দীর্ঘ ৩১ বছর ৯ মাস সংস্কৃত কলেজে অলঙ্কারশাস্ত্রের অধ্যাপনা করার পর অবসর নেন। এর পর কাশীতে চলে যান। সেখানে তিনি প্রায় চার বছর জীবিত ছিলেন। ১৮৬৭-তে কাশীতে প্রেমচন্দ্রের মৃত্যু হয়। জীবনের শেষ সময়ে প্রেমচন্দ্রের স্ত্রী ছাড়া আর কোনও আত্মীয় পাশে ছিল না। তবে ঈশ্বরচন্দ্রের বাবা ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় সে সময় কাশীতে, প্রেমচন্দ্রের শেষশয্যায় ও অন্ত্যেষ্টিতে তিনি উপস্থিত ছিলেন।
পুনশ্চ: প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের কোনও ছবি পাওয়া যায় না। তাঁর পঞ্চম পুরুষ বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের বাড়িতেও প্রেমচন্দ্রের কোনও ছবি নেই। শিক্ষক দিবসের আগে এ বারেও তাই ছবিহীন থেকে গেলেন বিদ্যাসাগরের মাস্টারমশাই।