সর্পভুক: খাওয়ার আগে। ছবি সৌজন্য:ভারতীয় সেনা
জাফনায় আসছেন ভারত সরকারের সচিব পর্যায়ের অফিসার। খবরটা পেয়েই সাজ-সাজ রব পড়ে গেল। উদ্বেগ দু’টি কারণে। তিনি কী বার্তা নিয়ে আসছেন ভাবনা তা নিয়ে। আবার তাঁর নিরাপত্তাও মাথাব্যথার বড় কারণ।
সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি। শ্রীলঙ্কায় তামিল জঙ্গি সংগঠন এলটিটিই ও শ্রীলঙ্কা সরকারের বিবাদে মধ্যস্থতা করতে গিয়ে তখন রীতিমত বিপাকে পড়েছে ভারত। পাঁচ এলটিটিই বন্দির আত্মহত্যার ফলে তখন ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনীর (আইপিকেএফ) সঙ্গেই মরণপণ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে তামিল জঙ্গিরা।
এলটিটিই-র গড় হিসেবে পরিচিত উত্তর শ্রীলঙ্কার জাফনায় তখন শ্রীলঙ্কা সরকারের কর্তৃত্ব কার্যত নিশ্চিহ্ন। জঙ্গিদের হুমকিতে বাড়িতে বসে থাকেন সরকারি কর্মীরা। কেবল নির্দিষ্ট দিনে অফিসে যান। বাড়িতে পৌঁছে যায় খাম-ভর্তি বেতন। ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনীর তরফে জাফনার প্রশাসন চালানোর ভার পড়ল কর্নেল কে কে গঙ্গোপাধ্যায়ের উপরে।
এখন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, কখনও কৌশলে, কখনও বলপ্রয়োগ করে জাফনার প্রশাসনের চাকা ফের কিছুটা হলেও চালু করতে পেরেছিলেন তিনি। অন্য রেজিমেন্টের সেনাদের পাশাপাশি তাঁর অধীনে ছিল প্যারা কম্যান্ডোদের একটি দল। মূলত জাফনা স্টেশন রক্ষা করার জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল তাঁদের। ভারতীয় বাহিনীর উদ্যোগে ফের চালু হয়েছিল কলম্বো-জাফনা ট্রেন চলাচল।
এমনই সময়ে দিল্লি থেকে সচিব স্তরের ওই অফিসারের আসার বার্তা পেলেন কে কে। জাফনা স্টেশনে গিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন সেই সচিব ও তাঁর সহযোগীদের।
স্টেশন থেকে বেরনোর সময়ে এক কর্তা চুপিচুপি বললেন, ‘‘গুলিগোলা চালিয়ে দিন না। তা হলে সকলে বুঝবে, আমরা সফরে এসে কেমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি। বলবেন, এলটিটিই হামলা চালিয়েছে।’’ মুহূর্তে কঠিন হয়ে উঠেছিল সেনা অফিসার কে কে-র মুখ, ‘‘এলটিটিই হামলা চালালে কেমন পরিস্থিতি হয়, তা আপনার জানা নেই। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন, যেন গোলাগুলি না চলে।’’
ভারত সরকারের সচিবকে পাশে বসিয়ে জিপ চালিয়ে জাফনার সদর দফতরে যাচ্ছিলেন কে কে। সামনে-পিছনে সেনার এসকর্ট-গাড়ি। কে কে-র জিপ ও অন্য গাড়িগুলিতে অতন্দ্র প্রহরায় প্যারা কম্যান্ডোরা। হঠাৎ পাশের জঙ্গল থেকে শুরু হল গুলিবৃষ্টি। নিমেষের মধ্যে কম্যান্ডোরাও জবাব দিতে শুরু করলেন। কে কে-র ইঙ্গিতে তাঁদের কয়েক জন লাফিয়ে নেমে পড়লেন জিপ থেকে। কম্যান্ডোদের প্রবল গুলিবৃষ্টিতে জঙ্গল থেকে বেরোতে পারল না আত্মগোপনকারী এলটিটিই জঙ্গিরা। কোনও রকমে সে যাত্রা সরকারি কর্তাদের প্রাণ বাঁচিয়ে জাফনার সদরে পৌঁছে গিয়েছিলেন কে কে। ঘটনার পরে সেই সরকারি কর্তা হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘‘আপনারাই গোলাগুলি চালাচ্ছিলেন বুঝি?’’ স্তম্ভিত কে কে বলেন, ‘‘আজ্ঞে না। ওটা এলটিটিই হামলা। বরাতজোরে বেঁচেছেন।’’
ওই এলাকার বিখ্যাত এক মন্দিরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কে কে-র অতিথি সেই সচিবের। সেখানে পৌঁছে পোশাক বদলে পুজো দিতে যান তিনি। তখনও মন্দিরের চার পাশে অতন্দ্র প্রহরায় ছিলেন প্যারা কম্যান্ডোরা।
প্যারা কম্যান্ডো। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সব চেয়ে দক্ষ বিশেষ বাহিনী। পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের ভিতরে ঢুকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক থেকে শুরু করে মায়ানমারের মধ্যে নাগা জঙ্গি সংগঠনের শিবির ধ্বংস, মারাত্মক সব অভিযানে ডাক পড়েছে যাঁদের।
ভারতীয় সেনার প্যারাশুট রেজিমেন্টের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এই বিশেষ বাহিনীর যাত্রা শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। ১৯৪৫ সালের ১ মার্চ তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতীয় বাহিনীতে তৈরি হয় ভারতীয় প্যারা রেজিমেন্ট। চারটি ব্যাটেলিয়ন ও চারটি স্বাধীন কোম্পানি ছিল ওই রেজিমেন্টে। তাতে সেনার নানা রেজিমেন্ট থেকে বাছাই করে সেনাদের নিয়োগ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ভেঙে দেওয়া হয় ওই রেজিমেন্ট। সেনারা ফিরে যান তাঁদের মূল রেজিমেন্টে। তবে প্যারাট্রুপস হিসেবে তাঁদের বিশেষ ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল তখনও। ‘এয়ারবোর্ন ডিভিশন’ বা আকাশপথে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত সেনাদলের অংশ ছিলেন তাঁরা।
স্বাধীনতা ও দেশভাগের পরে ভাগ হয়ে যায় ‘এয়ারবোর্ন ডিভিশন’। ভারতের হাতে থাকে ৫০ নম্বর ও ৭৭ নম্বর ব্রিগেড। তাতে ছিল ছ’টি প্যারা ব্যাটেলিয়ন। ১৯৫২ সালে তিনটি প্যারা ব্যাটেলিয়নকে নিয়ে নতুন ভাবে প্যারাশুট রেজিমেন্ট তৈরি হয়। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে প্যারা কম্যান্ডোর সংখ্যা আরও বাড়ানো হয়। বর্তমানে রেজিমেন্টে রয়েছে সাতটি বিশেষ প্যারা ব্যাটেলিয়ন (স্পেশ্যাল ফোর্স বা এসএফ)। তা ছাড়া আছে তিনটি ‘এয়ারবোর্ন ব্যাটেলিয়ন’।
১৯৬৩ সালে আগরায় প্যারাশুট রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি হয়। ১৯৬৫ সালে তা চলে যায় গ্বালিয়রের মোরার ক্যান্টনমেন্টে। এখন সেই কেন্দ্র রয়েছে বেঙ্গালুরুতে। সেনার পরিভাষায় সেটাই এখন রেজিমেন্টের ‘কি লোকেশন প্ল্যান’ বা মূল কেন্দ্র।
অসম ও কাশ্মীরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানে একাধিক বার প্যারা কম্যান্ডোদের ব্যবহার করেছেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডি বি শেখাতকর। তিনি জানালেন, প্যারা রেজিমেন্টের মধ্য থেকেই বাছাই করা সেনাদের দেওয়া হয় কম্যান্ডো প্রশিক্ষণ। বিমান বা হেলিকপ্টার থেকে প্যারাশুট নিয়ে ঝাঁপ দেওয়ার পাশাপাশি দড়ির সাহায্যে অত্যন্ত দ্রুত নামতে পারেন প্যারা কম্যান্ডোরা। সেনার পরিভাষায় যার নাম ‘স্লিদারিং’। মুম্বই হামলার সময়ে এ ভাবেই লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁরা। লেফটেন্যান্ট জেনারেল শেখাতকরের কথায়, ‘‘শত্রুপক্ষের লাইনের অনেক পিছনে গিয়ে কোনও লক্ষ্যবস্তুর উপরে হামলা চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ওই কম্যান্ডোদের।’’ তিনি জানাচ্ছেন, এই ধরনের রণক্ষেত্রে কম্যান্ডোদের পুরোপুরি স্বাবলম্বী হতে হয়। কারণ, যাওয়ার সময়ে হেলিকপ্টার থেকে নামার সুযোগ থাকলেও ফেরার সময়ে নাও থাকতে পারে। তখন পায়ে হেঁটেই ফিরতে হয়। খাওয়াদাওয়ার ঠিক নেই, প্রয়োজনে সাপ ধরে খেতেও হতে পারে। প্রশিক্ষণে সে কাণ্ডও করতে হয়। সুপরিকল্পিত অপারেশনেও অনেক সময়ে গোলমাল দেখা দেয়। শত্রুভূমিতে তখন কম্যান্ডোর সব চেয়ে ব়ড় বন্ধু সে নিজেই। নানা আধুনিক অস্ত্রের পাশাপাশি খালি হাতে লড়াইয়ের পুরোদস্তুর প্রশিক্ষণ থাকে প্যারা কম্যান্ডোদের। শত্রুর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে পারদর্শী এই সেনারা। তাই কাশ্মীরে সাম্প্রতিক অভিযানে অনেক ক্ষেত্রেই কোনও ভবনে জঙ্গিরা কোণঠাসা হয়ে পড়লে অন্য বাহিনীর বদলে ডাক পড়ছে প্যারা কম্যান্ডোদের।
নভেম্বর, ২০০৮। আচমকা জঙ্গিদের হামলায় কেঁপে উঠল মুম্বই। পরিস্থিতি সামলাতে তখন হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। কেন্দ্রের কাছে সাহায্য চেয়েছে মহারাষ্ট্র সরকার। মুম্বইয়ের কাছে ‘আইএনএস অভিমন্যু’ ঘাঁটি থেকে রওনা হল কম্যান্ডোদের একটি দল। তাজমহল হোটেলে জঙ্গিদের মুখোমুখি হলেন তাঁরা। সেনা ও এনএসজি-র কম্যান্ডোরা না পৌঁছনো পর্যন্ত ওঁরাই তাজের একটি অংশে আটকে রেখেছিলেন জঙ্গিদের। যে কথা এখনও জানেন না অনেকেই।
এই কম্যান্ডোরা নৌসেনার একটি বিশেষ বাহিনী। নাম মেরিন কম্যান্ডোজ, সংক্ষেপে মার্কোস। অবসরপ্রাপ্ত ভাইস অ্যাডমিরাল পি কে চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময়ে কিছু নৌসেনাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। পরে পুরোদস্তুর বিশেষ বাহিনী তৈরির দিকে নজর দেয় ভারতীয় নৌসেনা।’’ প্রথমে মার্কিন ‘নেভি সিল’ বাহিনীর সঙ্গে নৌসেনার কম্যান্ডোদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে এসেছিল যে সিল বাহিনী উঠে এসেছিল খবরের শিরোনামে। পরে ধীরে ধীরে মার্কোস বাহিনীর জন্য নানা বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে ভারতীয় নৌসেনাই।
অ্যাডমিরাল চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মার্কোস বাহিনী জল, স্থল, আকাশ— তিন ফ্রন্টেই কাজ করতে পারে। ওই কম্যান্ডোদের বিমান থেকেও প্যারাশুটের মাধ্যমে নামিয়ে দেওয়া যায়। আবার জলপথে অভিযানেও অত্যন্ত দক্ষ তাঁরা। ডুবুরি হিসেবে গিয়ে জলের মধ্যে থাকা কোনও লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করা থেকে শুরু করে জলপথে নজরদারি, সব কাজেই তাঁদের ব্যবহার করা হয়।’’ মুম্বইয়ে হামলাকারীরা এসেছিল সমুদ্রপথে। ফলে তার পরে জলপথের নিরাপত্তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করে সরকার। মেরিন পুলিশ ও উপকূলরক্ষী বাহিনীকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয় নৌসেনা। নানা মহড়ায় বারবার পুরোভাগে থেকেছেন মার্কোস কম্যান্ডোরা। জলদস্যুদের হানায় বিপন্ন জাহাজও উদ্ধার করেছেন এই কম্যান্ডোরা।
জম্মু-কাশ্মীরে সেনা অভিযানের কথা প্রায়ই সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে নৌসেনার কম্যান্ডোরাও যে পুরোদমে কাজ করছেন, তা অনেক সময় অজানাই থেকে যায়। উলার হ্রদে জঙ্গি দমনে সেনার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেন মার্কোস কম্যান্ডোরা। হ্রদের আশেপাশে মোতায়েন ‘দাড়িওয়ালা ফৌজ’কে সমীহ করে চলে জঙ্গিরা।
এলটিটিই-র হুমকির মধ্যেও জাফনার স্থানীয় নির্বাচন করিয়েছিলেন ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনীর কম্যান্ডান্ট কে কে গঙ্গোপাধ্যায়। ভোটের পালা মেটার পরেই পদোন্নতির জন্য তাঁকে ভারতে ফিরিয়ে আনে সেনা। ফেরার সময়ে বিমানে তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁরই অধীনে থাকা একাধিক আহত কম্যান্ডো ও সেনা। কে কে জাফনা ছাড়ার পরেই শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদরে হামলা চালিয়েছিল এলটিটিই। হতাহত হয়েছিলেন তাঁর বহু সহকর্মী।
মার্কোসের মূল মন্ত্র ‘দ্য ফিউ, দ্য ফিয়ারলেস’। প্যারা কম্যান্ডোরা ‘শত্রুজিৎ’। দেশের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনে আপাত-অসাধ্য সাধন করতেও এগিয়ে যান।