রিপ ভ্যান উইঙ্কলের সেই ঘুম থেকে উঠে সব কিছু পাল্টে যেতে দেখার মতো। পুরো গ্রামটা কী করে এমন আমূল বদলে গেল! তবে যে ঘুমোতে যাওয়ার আগে দেখেছিলাম, ভারতীয় ফুটবলের জনক এক বাঙালি! প্রথম ফুটবলে লাথি মারার জন্য যাঁর নাম ইতিহাসে খোদাই হয়ে রয়েছে! এই কলকাতা ময়দানেই তো ঘটেছিল ভারতীয় ফুটবলের সেই ‘ইউরেকা-মুহূর্ত’!
তা হলে এখন কী করে দেখছি, অবাঙালি মালিকদের হাতে চলে গেল বাঙালির দুই গর্বের ক্লাব মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল? বাংলা শুভ নববর্ষ যেমন চাপা পড়েছে হ্যাপি নিউ ইয়ারের হুল্লোড়ে, যেমন বিজয়া দশমীর রসগোল্লার হাঁড়ি আর নকুড়ের সন্দেশ হারিয়ে যেতে বসেছে ‘দিওয়ালি সুইট্স প্যাক’-এর রাংতায়, তেমনই বাঙালির চিরন্তন ফুটবল আবেগের সমুদ্রেও আছড়ে পড়েছে অবাঙালি স্রোতের সুনামি। আর তাতে ভেসে যাচ্ছে বাঙালির ফুটবল ঐতিহ্য ও গর্বের ইতিহাস।
শতাব্দীপ্রাচীন দুই ক্লাব, যারা ছিল ভারতীয় ফুটবলের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আর পেন্টাগন, একটা সময়ে সারা দেশের কাছে যারা ছিল উদাহরণ, যাদের জন্য বাংলাকে মনে করা হত ফুটবলের সেরা ইউনিভার্সিটি যেখান থেকে বেরোয় সব উজ্জ্বল স্নাতকেরা, সেই ফুটবলের আঁতুড়ঘরেই আজ বাঙালির অস্তিত্ব বিপন্ন।
কে বলবে, এই বাংলার ময়দানেই এক সেপ্টেম্বরের সকালে দশ বছরের এক বাঙালি বালকের পায়ে শুরু হয়েছিল ভারতীয় ফুটবলের পথ চলা! সালটা ১৮৭৭। ব্রিটিশ রাজের ভারতে রাজধানী তখনও কলকাতা। দশ বছরের ছেলেটি মায়ের সঙ্গে গঙ্গার দিকে যাচ্ছিল। তাদের গাড়ি যখন ক্যালকাটা এফসি মাঠের কাছে, অদ্ভুত এক খেলা চোখে পড়ল ছেলেটির। একটা গোলাকৃতি বস্তু নিয়ে ইউরোপীয়রা খেলছে, যেখানে পায়ের ব্যবহার খুব বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। খেলাটার মধ্যে অদ্ভুত এক উত্তেজনার ছোঁয়া। গোলাকৃতি বস্তুটির দখল নেওয়ার জন্য সকলের মধ্যে কী অস্বাভাবিক উন্মাদনা! মায়ের কাছে তাই সে আবদার করতে থাকে গাড়ি থামানোর জন্য। সে খেলা দেখতে চায়। ছোট্ট ছেলের বায়নায় গাড়ি থামাতেই হল মা-কে। ইউরোপীয় সৈন্যদের সেই খেলা যখন দাঁড়িয়ে দেখছে ছেলেটি, গোলাকৃতি বস্তুটি এক বার তার দিকে এল। শোনা যায়, তা হাতে ধরে নিয়ে যখন ছেলেটি দেখছে, সৈন্যদের এক জন এসে বলে ওঠেন, ‘‘কিক করে আমাকে বলটা ফেরত দাও।’’ এই সংলাপ সত্যিই ঘটেছিল কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকে গিয়েছে। তবে এ নিয়ে ইতিহাসবিদরা মোটামুটি একমত যে, লাথি মেরেই গোলাকৃতি বস্তুটিকে মাঠে ফেরত পাঠায় ছেলেটি।
কর্ণধার: এসসি ইস্টবেঙ্গলের মালিক হরিমোহন বাঙুর ও (ডান দিকে) এটিকে মোহনবাগানের মালিক সঞ্জীব গোয়েন্কা। মালিক বদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবের নামেও জুড়েছে নতুন উপসর্গ।
মনে করা হয়, সেটাই ছিল প্রথম কোনও ভারতীয়ের ফুটবলে পা ছোঁয়ানোর ঘটনা। আক্ষরিক অর্থেই ছিল ভারতে ফুটবলের ‘কিক-অফ’। আর সে দিনের সেই দশ বছরের ছেলেটি? নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। ফুটবলে লাথি মারার ‘অচেনার আনন্দ’ পেয়ে যে কি না হেয়ার স্কুলে সহপাঠীদের সঙ্গে সাবস্ক্রিপশন স্কিম চালু করে দেবে। সংগ্রহ করা সেই অর্থ দিয়ে সে যুগে কলকাতার বিখ্যাত ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকান ‘ম্যান্টন অ্যান্ড কোম্পানি’ থেকে সতীর্থদের সঙ্গে কিনে ফেলবে প্রথম ‘ফুটবল’। ভুলবশত তারা যে কিনে ফেলেছে রাগবি বল, বুঝতে পারেনি। হেয়ার স্কুলের মাঠে যখন সেই রাগবি বল নিয়ে তারা দাপাদাপি করছে, প্রতিবেশী প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রফেসর জি এ স্ট্যাক তা দেখে ফেললেন। এক ঝলক দেখেই ফুটবল-ভক্ত প্রফেসর বুঝে গেলেন, কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। নগেন্দ্রপ্রসাদ এবং দলবলের সঙ্গে কথা বলেই তিনি বুঝে যান, ফুটবল কিনতে গিয়ে রাগবি বল নিয়ে এসেছে তারা। নিজে উদ্যোগ নিয়ে এর পর একটি ফুটবল উপহার দেন সাহেব। এই সব তরুণ রক্তের হাতেই তৈরি হয় বয়েজ় ক্লাব। ভারতে প্রথম ভারতীয়দের ফুটবল ক্লাব। তার কিছু দিন আগেই ইংরেজদের হাত ধরে কলকাতার মাটিতেই জন্ম নিয়েছে ট্রেড্স ক্লাব। যাকে ধরে নেওয়া হয়, ভারতের প্রথম ফুটবল ক্লাব। যদিও সেখানে ইংরেজ খেলোয়াড়দের আধিপত্যই বেশি ছিল। পরবর্তী কালে যা বিখ্যাত হয়ে ওঠে ডালহৌসি অ্যাথলেটিক ক্লাব নামে। এখন যতই অবাঙালি মালিকদের শরণাপন্ন হতে হোক বাংলার ফুটবলকে, সেই যুগে বাংলার মাটি থেকে সারা দেশে ভারতীয় ফুটবলকে সফল ভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীই।
কারও কারও মতে, ভারতে প্রথম ফুটবল ম্যাচ হয় ১৮০২ সালে, মুম্বইয়ে (তখন বম্বে)। ‘মিলিটারি’ ও ‘আইল্যান্ড’ নামে দু’টি দলের ৩০ মিনিটের ম্যাচের বিবরণ কোথাও কোথাও পাওয়া যায়। কিন্তু সেই ম্যাচ ফুটবল ও রাগবির মিশ্রণ ছিল বলেও পাল্টা তথ্য রয়েছে। স্বীকৃত মতে, ১৮৩৮ নাগাদ কলকাতাতেই শুরু হয় ফুটবল ম্যাচ। তিনটি ম্যাচের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘ইটোনিয়ান্স’ বনাম ‘রেস্ট অব ইন্ডিয়া’। ‘ক্যালকাটা ক্লাব অব সিভিলিয়ান্স’ বনাম ‘জেন্টলমেন অব ব্যারাকপুর’। ‘ইটোনিয়ান্স বনাম রেস্ট অব ক্যালকাটা’। ভারতে ফুটবলকে প্রতিষ্ঠিত করার নেপথ্যে ছিল কলকাতার দুই ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। হেয়ার স্কুল এবং হিন্দু কলেজ (এখনকার প্রেসিডেন্সি)। নগেন্দ্রপ্রসাদের উদ্যোগে প্রেসিডেন্সি কলেজ, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সেন্ট জ়েভিয়ার্স, ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ একে একে ফুটবল দল গড়তে শুরু করে। তৈরি হয় আরও দু’টি ক্লাব— ওয়েলিংটন এবং শোভাবাজার। ধীরে ধীরে আবির্ভাব ঘটে কুমোরটুলি, এরিয়ান্স, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন-এর। ১৮৮৯-তে জন্ম নেয় মোহনবাগান। তার দু’বছর আগে হয়েছে জুবিলি ক্লাব, কয়েক বছরের মধ্যে যা পরিচিত হয়ে উঠবে মহমেডান স্পোর্টিং নামে। পুরো অভিযানটাই শুরু হয় এক দশ বছরের বাচ্চার ফুটবলে লাথি
মারা থেকে।
২০২১ সালের শুরুতে দাঁড়িয়ে কে বিশ্বাস করবে এ সব! ওই তো গঙ্গাপারের দুই ক্লাব। একটার রং সবুজ-মেরুন, অন্যটার লাল-হলুদ। একটায় জ্বলত মশাল, অন্যটা ছুটত পালতোলা নৌকা করে। একটা বিখ্যাত চিংড়ির উৎসবের জন্য, অন্যটা ইলিশের। কোথায় গেল সব ঐতিহ্যের বাঙালিয়ানা! মোহনবাগান হল এটিকে-মোহনবাগান। কিনলেন সঞ্জীব গোয়েন্কা। আইএসএলের খেলা শুরু হতেই বোঝা গেল, নতুন জোট-ক্লাবের গায়ে যতই সবুজ-মেরুন রং এখনও লেগে থাকুক, আসলে এই দল যতটা না মোহনবাগান, তার চেয়ে অনেক বেশি করে এটিকে। নমুনা? গত বারের আই লিগ চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান দল থেকে আইএসএলে খেলা জোট-দলে ঠাঁই পেয়েছেন মাত্র এক জন। ভুল নয়। এক জনই। তা-ও সেই তিনি— শেখ সাহিল— ক’টা ম্যাচে শুরু থেকে টিম লিস্টে জায়গা পেয়েছেন, মনে করা কঠিন। সবুজ-মেরুন জার্সিতে এখনও ফুল ফুটতে পারে কিন্তু বাগানে আজ আর বসন্ত নেই!
তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীরাই বা পিছিয়ে থাকে কেন? আইএসএলে খেলার জন্য একেবারে শেষ মুহূর্তে শ্রী সিমেন্টকে লগ্নিকারী হিসেবে নিয়ে এল ইস্টবেঙ্গল। হরিমোহন বাঙুর হলেন নতুন মালিক। ইস্টবেঙ্গল হয়ে গেল এসসি ইস্টবেঙ্গল। এটিকে-র মতো অন্য কোনও দলের নাম তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়নি ঠিকই, কিন্তু অংশীদারিত্বে বা ক্লাবের কর্তৃত্বে আইনি ভাবে কোনও তফাত নেই। প্রায় আশি শতাংশ মালিকানা চলে গিয়েছে নতুন হাতে। হৃদয় চলে গিয়েছে, পড়ে আছে শুধুই ধড়টি। বাগানে যেমন ফোটে না বাংলার পদ্ম, তেমনই লাল-হলুদে জ্বলে না দেশভাগের যন্ত্রণার সলতেয় তৈরি মশাল।
এখন ময়দানে দাঁড়িয়ে কার মনে পড়বে ১৯১১ সালের সেই স্বদেশি আবেগের মহাপ্রলয়! ঐতিহাসিক শিল্ড জয়ী মোহনবাগানের টিম লিস্টে এগারো বাঙালির নাম! যদিও ভুটি সুকুলকে নিয়ে একটা তর্ক রয়েছে যে, তিনি বাঙালি ছিলেন কি না। তবে শিবদাস ভাদুড়ির নেতৃত্বে ব্রিটিশ রাজে ইস্ট ইয়র্কশায়ারকে হারিয়ে শিল্ড জেতা সেই দলের দশ জন যে খালি পায়ে (রেভারেন্ড সুধীর চট্টোপাধ্যায় শুধু বুট পরেছিলেন) খেলেছিলেন, তা নিয়ে কোনও তর্ক নেই। তেমনই এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে অলিম্পিক্সের সেমিফাইনালে (মেলবোর্ন, ১৯৫৬) ওঠা ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন এক বাঙালি!
তার পরের বার ১৯৬০ রোম অলিম্পিক্সেও ভারতীয় ফুটবল দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এক বঙ্গসন্তান! ৬০-৬৪ বছর পরে ময়দানে দাঁড়িয়ে কেমন যেন মনে হয়, সমর ‘বদ্রু’ বন্দ্যোপাধ্যায়, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যিই কি এমন সব মাহেন্দ্রক্ষণ উপহার দিয়েছিলেন? না কি সে সবই ছিল শুধু এক মাঝদুপুরের বিভ্রম!
প্রবাদপ্রতিম: জ্যোতিষচন্দ্র গুহ (ইস্টবেঙ্গল) ও ধীরেন দে (মোহনবাগান)।
একটা সময়ে ইস্টবেঙ্গল যখন রোভার্স কাপ খেলতে মুম্বই যেত, কুপারেজে দু’টো সিট বুক করা থাকত শচীন দেব বর্মণের নামে। কুপারেজে প্রিয় দলের খেলায় কখনও অনুপস্থিত থাকেননি এই কিংবদন্তি সুরকার। এমনও হয়েছে যে, মাঠে পৌঁছনোর জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে ইস্টবেঙ্গলের। এসডি নিজে গাড়ি চালিয়ে লাল-হলুদ ফুটবলারদের কুপারেজে পৌঁছে দিয়েছেন। পিতা-পুত্র এস ডি ও আর ডি বর্মণ ইস্টবেঙ্গলের আজীবন সদস্য। শোনা যায়, মোহনবাগানকে যখন সেই বিখ্যাত ম্যাচে ৫-০ হারায় ইস্টবেঙ্গল, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শচীন দেব। পুত্র আর ডি গিয়ে খবর দিতেই চোখ খুলে তাকান তিনি। এসডি ছিলেন গোঁড়া ইস্টবেঙ্গল। তেমনই মান্না দে ছিলেন মোহনবাগান। ডার্বির দিনে দু’জনে মাঠে যেতেন এক সঙ্গে। ফিরতেন আলাদা-আলাদা। ফেরার সময়ে কাউকে যে একটা ধরতেই হত ‘পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে র্যায়েন বিতায়ি’! কে কার চোখে চোখ রেখে গাইবেন! বেঁচে থাকলে কী বলতেন ওঁরা? মান্না নিশ্চয়ই ধরতেন, কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই!
ঘটি-বাঙালের দ্বৈরথে দুই ডাগআউটে দুই অবাঙালি মালিক— এমন দৃশ্য যে দেখতে হবে, কে কবে ভাবতে পেরেছিল! কে ভেবেছিল, দুই প্রধানের জার্সিতে বুকের কাছে বাঙালির সেই চিরন্তন আবেগ আর গর্বের ফলক মুছে গিয়ে এক দিন জ্বলজ্বল করবে অবাঙালি মালিকদের সংস্থার লোগো! কে জানত, বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা খুঁজতে মাইক্রোস্কোপ লাগবে, বাঙালি ফুটবল প্রশাসক ফসিল হয়ে যাবে!
এখনকার বাংলা সিরিয়ালে যেমন প্রেমের দৃশ্যের নেপথ্যে বাজে সস্তা হিন্দি ছবির গান, তেমনই বাঙালির খেলা ফুটবলের ক্লাব চালাতে ধরে-ধরে আনতে হচ্ছে অবাঙালি প্রশাসকদের। কেন, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত তুমি বলো তো’ বাজানো যায় না? না কি বাংলায় প্রেমের গান হয়নি কখনও? সস্তার বাংলা সিরিয়াল স্রষ্টাদের কাছে শেষ হয়ে গিয়েছে উত্তম-সুচিত্রার প্রেমের পথ। তেমনই বাংলার ফুটবল কর্তাদের অভিধান থেকে মুছে গিয়েছে দু’টি শব্দ— গর্বের ফুটবল।
অতীতেও বাইরের রাজ্যের অনেক খেলোয়াড় এখানে খেলে গিয়েছেন। কিন্তু বাংলা হারায়নি তার ঐতিহ্য। বরং সারা দেশের ফুটবলাররা মনে করতেন, কলকাতা ময়দানে না খেললে ফুটবল-জীবন সম্পূর্ণ হয় না। ইস্টবেঙ্গলের বিখ্যাত পঞ্চপাণ্ডবের কেউ বাঙালি ছিলেন না। প্রত্যেকে এসেছিলেন দক্ষিণ ভারত থেকে। আউটসাইড-রাইট পি বেঙ্কটেশ (বেঙ্গালুরু), ইনসাইড-রাইট আপ্পা রাও (তখনকার মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি, এখন অন্ধ্র প্রদেশ), লেফ্ট উইঙ্গার পি বি সালে (কেরল), ইনসাইড লেফ্ট আমেদ খান (বেঙ্গালুরু) এবং সেন্টার-ফরোয়ার্ড কে পি ধনরাজ (হায়দরাবাদ ও বেঙ্গালুরু)। এই পঞ্চপাণ্ডবের প্রতাপে ১৯৪৯-১৯৫৩ দেশের সেরা ক্লাব ছিল ইস্টবেঙ্গল। এই সময়ে অবিশ্বাস্য ৩৮৬টি গোল করেছিল তারা। চিনের অলিম্পিক দলকে পর্যন্ত হারিয়ে দিয়েছিল ২-০ গোলে। তখনও ফুটবল কোহিনুর ছিল বাংলাতেই।
তখন ক্লাবের সচিব-মহাসচিবরা ছিলেন এক-এক জন চাণক্য। পঞ্চপাণ্ডবদের আনার নেপথ্যে ছিলেন বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রীড়া প্রশাসক জ্যোতিষচন্দ্র গুহ। সেই সময়ে তিনি ছিলেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সচিব। এখনকার সিইও বা ক্লাবের পদাধিকারীদের না আছে সেই আবেগ, না আছে রত্ন খোঁজার মতো জহুরির চোখ। আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে মালিকানা তো হারিয়েইছেন, সঙ্গে খুইয়েছেন ফুটবল ঐতিহ্য এবং পরম্পরাও। ইস্টবেঙ্গলকে শক্তিশালী দল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জে সি গুহ সর্বভারতীয় সব প্রতিযোগিতায় ঘুরে ঘুরে খেলা দেখতেন। সে ভাবেই তৈরি করেছিলেন পঞ্চপাণ্ডবের চক্রব্যূহ। এমন অর্কেস্ট্রা ভারতীয় ফুটবল আর কখনও দেখেনি। ১৯৫৬-তে রাম বাহাদুর, ১৯৬৫ সন্তোষ ট্রফি থেকে মহম্মদ হাবিবকে তুলে বাংলায় নিয়ে আসেন তিনি। হায়দরাবাদ থেকে সৈয়দ নইমুদ্দিনকে নিয়ে আসার জন্য তাঁদের বাড়ি গিয়ে সকলের সঙ্গে মাটিতে পাত পেড়ে খেতে বসে গিয়েছিলেন জে সি গুহ। শোনা যায়, নইমের পরিবারের সদস্যরা তাঁর ব্যবহারে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে, এর পরে মোহনবাগান কর্তারা তাঁর বাড়িতে হানা দিয়েও মানাতে পারেননি। খালি পায়ের সাহু মেওয়ালালকেও ‘স্পট’ করেছিলেন তিনি। কিন্তু মেওয়ালাল মোহনবাগানে খেলতে চেয়েছিলেন। সেই যুগেও ফিটনেসের উপর জোর দিয়েছিলেন জে সি গুহ, ফুটবলারদের ডায়েট সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করেছিলেন। শতবর্ষের ঐতিহাসিক লগ্নে ‘বাঙালদের ক্লাব’ অবাঙালির হাতে সমর্পণ করা দেখে কে বলবে, ইস্টবেঙ্গলের জন্মই হয়েছিল অপমানিতের রক্তাক্ত হৃদয় থেকে!
১৯২০-তে কোচবিহার কাপে মোহনবাগান বনাম জোড়াবাগান ক্লাবের ম্যাচে ঢাকার শৈলেশ বসুকে অজ্ঞাত কারণে প্রথম একাদশ থেকে বাদ দেওয়া হয়। জোড়াবাগানের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ময়মনসিংহ জেলার জমিদার সুরেশচন্দ্র চৌধুরী অনেক অনুরোধ করেও শৈলেশ বসুকে দলে ঢোকাতে পারেননি। রাগে-দুঃখে তিনি পদত্যাগ করেন জোড়াবাগান ক্লাব থেকে। এর পরে সন্তোষের প্রাক্তন মহারাজা মন্মথনাথ রায়চৌধুরী, ক্রিকেটার সারদারঞ্জন রায়দের সঙ্গে নতুন ক্লাব গড়লেন। সকলেই পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা ছিলেন বলে ক্লাবের নামকরণ করা হয় ইস্টবেঙ্গল। ঢাকার এক ফুটবলারকে বাদ দেওয়ার অপমান থেকে যে ক্লাবের জন্ম, যার সমর্থকদের চোখেমুখে ঠিকরে বেরোত দেশভাগের যন্ত্রণা, যার লাল-হলুদ উজ্জ্বল রঙে অসংখ্য মানুষ ঘর হারিয়ে খুঁজে পেতেন ঘর, বাঙালদের সেই চিরকালীন আবেগকে গঙ্গা-পদ্মায় ভাসিয়ে মালিকানা চলে গেল অবাঙালি হাতে!
তেমনই একটা সময়ে ভারতীয় ফুটবলে অলিখিত নিয়মই ছিল, দেশের অধিনায়ক মানে তিনি মোহনবাগানের ফুটবলার হবেন। ভারতীয় ফুটবল দলের প্রথম বিদেশ সফর ১৯৪৮-এর লন্ডন অলিম্পিক্স। অধিনায়ক ছিলেন মোহনবাগানের টি আও। পরের দু’টি অলিম্পিক্সেও (১৯৫২, হেলসিঙ্কি ও ১৯৫৬, মেলবোর্ন) অধিনায়ক ছিলেন মোহনবাগানের ফুটবলার শৈলেন মান্না এবং সমর ‘বদ্রু’ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৬০ রোম অলিম্পিক্সে অধিনায়ক মোহনবাগানের নয়, ইস্টার্ন রেলের। তবে বাঙালি অধিনায়কের আসন অটুট— প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৬২ এশিয়ান গেমসে জয় চুনী গোস্বামীর নেতৃত্বে। কী সব রূপকথা! আর এখন ভারতীয় দলে সাকুল্যে হয়তো জনা তিনেক বাঙালি ফুটবলারের স্থান হয়।
যেমন খেলার অবস্থা, তেমনই ধুঁকছে ধারাভাষ্য। ‘‘নমস্কার, ইডেন উদ্যান থেকে বলছি পুষ্পেন সরকার’’— অমর সেই কণ্ঠের সঙ্গে এক সময়ে রেডিয়োয় মহালয়া শোনার মতোই আবেগ জড়িত ছিল। অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার, কমল ভট্টাচার্যদের বংশধরেরা বাংলা ধারাভাষ্য থেকে বাংলাটাই তুলে দিয়েছেন। ফুটবলের ধারাভাষ্যে কী সব শব্দের ব্যবহার! ‘ডাউন দ্য রাইট’। ‘অ্যাটাকিং’। এত দূরও বলে ফেলছেন কেউ কেউ, ‘ভেরি ডিফিকাল্ট টু স্টপ’। বাংলা নয়, জগাখিচুড়ি ভাষা আমদানি করেছেন এখনকার ধারাভাষ্যকারেরা। আর ক্রিকেটে? নমুনা চাই? ‘বলটা নিচো হয়ে গেলো’। ‘স্টেপ আউট করে লিফ্ট করলেন’। শুনতে শুনতে প্রশ্ন জাগে, বাংলার অভাব পড়িয়াছে না কি বাঙালির?
আইএসএল-এ গোয়েন্কার এটিকে তিন বারের চ্যাম্পিয়ন হতে পারে। কিন্তু বয়স? মেরেকেটে সাত বছর। আর মোহনবাগান? ১৮৮৯ সালের ১৫ অগস্ট আবির্ভাব। কীর্তি মিত্রের মোহনবাগান ভিলায় ক্লাবের জন্ম বলে এমন নামকরণ। সেই সভার পৌরোহিত্য করেছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বসু। যিনি পরবর্তী কালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হন। ইয়র্কশায়ারের মতোই মোহনবাগান ছিল গোঁড়া। বিদেশি খেলোয়াড় সই করানো ছিল নীতিবিরুদ্ধ, কারণ ক্লাব প্রশাসকেরা মনে করতেন, দেশি তরুণদের তুলে ধরাই তাঁদের ধর্ম। এমনকি, শোনা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডেনিস কম্পটন যখন কলকাতায়, মোহনবাগানের হয়ে খেলার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন কর্তারা। ইয়র্কশায়ার যেমন নিয়ম ভেঙেছিল সচিন তেন্ডুলকরের জন্য, তেমনই মোহনবাগান বিদেশি বর্জন প্রথার অবসান ঘটায় চিমা ওকোরিকে সই করিয়ে। যে ক্লাবে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত বিদেশি ফুটবলার আনা নিয়ে এত নাক সিঁটকানো ছিল, তারাই অবলীলায় মালিকানা তুলে দিলেন অবাঙালিদের হাতে! এবং, নামকরণে দেখা গেল ১৩২ বছরের ক্লাব জায়গা পেল ৭ বছর বয়সি ক্লাবের জোড় হিসেবে! মোহনবাগান-এটিকে নয়, এটিকে-মোহনবাগান। কী বলা যায় এই হস্তান্তরকে? যে দিন ফুটবল আবেগ হেরেছিল ফুটবল বাণিজ্যের কাছে?
লাল-হলুদ ক্লাবে যেমন ছিলেন জে সি গুহ, তেমনই সবুজ-মেরুনে ছিলেন ধীরেন দে। মোহনবাগানের মখমলের মতো সবুজ মাঠ বানানো থেকে শুরু করে ১৯৬৪-তে প্লাটিনাম জুবিলি উপলক্ষে হাঙ্গেরির বিখ্যাত তাতাবানিয়াকে নিয়ে আসা, মনসুর আলি খান পটৌডির ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে গ্যারি সোবার্স, কলিন কাউড্রিদের এনে খেলানো— একটি ক্লাবের অনুষ্ঠানে এমন চাঁদের হাট আর কখনও দেখা যায়নি। বাংলার ক্রীড়াপ্রেমীদের জন্য ধীরেন দে-র সব চেয়ে বড় অবদান, পেলেকে কলকাতায় নিয়ে আসা। শোনা যায়, ম্যাচের দিন ইডেনের মাঠ ভেজা ছিল। পেলে খেলতে অস্বীকার করেন। কিন্তু ধীরেন দে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে ঠিক মানিয়ে নিয়েছিলেন ফুটবল সম্রাটকে। ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭— সেই ঐতিহাসিক দিনে আশি হাজার দর্শকের ইডেন পেলের ফুটবল জাদু দেখা থেকে বঞ্চিত হয়নি এক বাঙালি প্রশাসকের জন্য। পেলেকে মানানোর মতো মুনশিয়ানা তো অনেক দূরের কথা, বাঙালির ঐতিহ্য ও আবেগের দুই ক্লাবের পরম্পরা ধরে রাখতেও ব্যর্থ এখনকার কর্তারা।
কেউ কেউ সওয়াল করতে পারেন, আগে এক কোটি টাকায় দল গড়ে ফেলা যেত। উৎসাহী মানুষেরা এগিয়ে আসতেন সাহায্য করতে। এখন দেশের সর্বোচ্চ লিগ, আইএসএলে খেলতে গেলে প্রথমেই পনেরো কোটির পুঁজি দেখাতে হবে। পেশাদারি কাঠামোতে বিনিয়োগকারী না এনে উপায় কী? পাল্টা প্রশ্নও করা যেতেই পারে যে, বিনিয়োগকারী লাগবে, ঠিক আছে। তা বলে বাংলার প্রাণের স্পন্দন অবাঙালি পেসমেকারে বাঁচিয়ে রাখার দরকার পড়ল কেন? বাংলার আর এক গর্ব, মহমেডান স্পোর্টিং ধুঁকছে। আইএসএল-এ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে উঠতে পারেনি, এ বারেই আই লিগের মূল পর্বে খেলছে।
তাদের লগ্নিকারীও অবাঙালি বলে শোনা যাচ্ছে। যদিও বিনিয়োগকারী নিয়ে নতুন করে জটলা তৈরি হয়েছে বলে খবর। তাই চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কিন্তু প্রশ্ন উঠে পড়ছে, বাঙালিবাবুরা কি ফুটবলে আগ্রহ হারাইয়াছেন? বঙ্গ ফুটবলের কোনও বাজার আছে বলেই কি তাঁরা আর মনে করেন না?
সেই বিজয় মাল্যর কলকাতার দুই প্রধানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া দিয়ে বাইরের লগ্নিকারী নিয়ে আসার প্রবণতার শুরু। মাল্য ক্লাবের নামের আগে তাঁর মদ্যপানীয় ব্র্যান্ডের নাম যোগ করে দিয়েছিলেন। তখন কেউ প্রতিবাদ করে মনে করিয়ে দেয়নি, স্কুল-কলেজে আচরণের দিক থেকে খারাপ রেকর্ড থাকলে একটা সময়ে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলে খেলার সুযোগ পাওয়া যেত না। ফুটবল স্কিলের পাশাপাশি অলিখিত ‘ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট’ও দাখিল করতে হত। মাল্যর হাত ধরে ন্যায়নীতির মাথা খেয়ে বাণিজ্যকরণের খাল কাটা সেই শুরু। আর ২০২০-তে কুমির নিয়ে আসার কাজ সম্পন্ন।
মায়ের সঙ্গে ঘুরতে বেরনো নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী ১৪৪ বছর আগের সেই সকালে ইউরোপীয় সৈন্যদের দিকে ফুটবলটা ফেরত দিয়ে আসলে একটি ব্রিটিশ খেলার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতে। আর তাঁর উত্তরাধিকারী, বঙ্গের বর্তমান ফুটবল কর্তারা অবলীলায় এক ‘কিক’ মেরে বলটা পাঠিয়ে দিলেন অবাঙালি জিম্মায়। কোহিনুর চলে গিয়েছে। কবে ফিরবে কেউ জানে না।