এক চলমান মহোৎসবের নাম প্যারিস। যাঁর কলম থেকে এমন অমর লাইন বেরিয়েছিল, তিনি ভাল বক্সিংও লড়তেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর যে প্রজন্ম আমেরিকা ছেড়ে প্যারিসে ঘাঁটি গেড়েছিল, যাঁদের নামকরণ হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’, হেমিংওয়ে তাঁদের অন্যতম। বিশ্বের নানা প্রান্তের আরও অনেক লেখক, শিল্পী, কবির মতো তিনিও প্যারিসের সৌন্দর্যে মোহিত ছিলেন।
২০২৪ অলিম্পিক্সের জন্য প্যারিসে এসে বারবার হেমিংওয়ের সেই লাইন মনে পড়ে যাবেই। শুধু তো একটা গেমস আয়োজন করে ফেলা নয়। সংগঠকেরা যেন চলমান উৎসব উপহার দেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়েছেন। এমনিতেই যে কোনও ট্যুরিস্টের সেরা গন্তব্য প্যারিস। বলাই হয়, বাকিদের জন্য একটি দেশ, ভ্রমণপিপাসুদের দু’টি দেশ। একটি তাঁর নিজের, অন্যটি ফ্রান্স।
শহর জুড়ে এমন সব বিশ্ববিখ্যাত ইমারত। আবেগের লাভাস্রোত। ইতিহাস। রোম্যান্স। বলা হয়, বিশ্বের সব চেয়ে রোম্যান্টিক শহর প্যারিস। লুভ্র মিউজিয়াম যেখানে মোনালিসা-সহ বিখ্যাত সব শিল্পীর ছবি রয়েছে, সেখানে ঢুঁ মেরে আসতে পারেন কি কোনও অলিম্পিয়ান? এক-এক জন শিল্পীর ছবি ভাল করে দেখতেই গোটা একটা দিন লেগে যায়। ইতিহাসের সব চেয়ে রোম্যান্টিক অলিম্পিক্স হতে চলেছে বলে অনেকে পূর্বাভাস করেছেন। সেই পূর্বাভাস মিলবে কি না, ১১ অগস্ট গেমস শেষ হওয়ার পরেই বলা যাবে। কারণ, আশা-আশঙ্কার স্রোত স্যেন নদীর তীর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। দেশের নির্বাচন-উত্তর অশান্ত প্যারিস। অলিম্পিক্সের সময় স্থায়ী সরকার নেই। রাশিয়ার ইউক্রেন হামলা নিয়ে প্রতিবাদ। গাজ়া যুদ্ধের প্রভাব। জঙ্গি সংগঠনের হুমকি। প্যারিসের রাস্তায় এই মুহূর্তে কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে না। শুধু পুলিশের গাড়ির হর্ন কানে বাজবে।
তবু প্যারিস মরিয়া। মানুষের আবেগকে উস্কে দিয়ে ঐতিহাসিক সব জায়গায় অলিম্পিক্সের ইভেন্ট ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এক-এক সময় মনে হবে, সিটি ট্যুর নিয়ে নিলে ভাল হয়। কোনও না কোনও অলিম্পিক ইভেন্ট সব দর্শনীয় স্থানেই পাওয়া যাবে। আইফেল টাওয়ার। সারা বিশ্বে এত জনপ্রিয় মিনার আর নেই। গুস্তাভে আইফেলের তৈরি ৩৩০ মিটার লম্বা মিনারের পাশে হচ্ছে বিচ ভলিবল। আইফেল টাওয়ারের স্পর্শ সেখানেই শেষ হচ্ছে না। প্রতিযোগীরা যে পদক পাচ্ছেন, তাতে আইফেল টাওয়ারের ধাতব টুকরো থাকবে। ইভেন্টের স্থলে যেতে হলে টিকিট লাগবে, কিন্তু আইফেল টাওয়ার দর্শন করতে উঠে যদি কেউ বিচ ভলিবল দেখতে চান, কে আটকাবে? শ্যাম্প দে মার্সে হবে জুডো, কুস্তি। গ্রাঁ প্যালেস, যার ‘গ্লাসরুফ’ দেখতে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ট্যুরিস্টরা ছুটে আসেন, সেখানে বসে ছাদের দিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকানোর পাশাপাশি দেখা যাবে ফেন্সিং ইভেন্ট। ট্রোকাদেহোতে পুরুষ ও মহিলাদের রোড সাইক্লিং রেস। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কবরস্থানের কাছাকাছি শেষ হবে ম্যারাথন। প্লেস দে লা কনকর্ড। যেখানে গিলোটিন হত। ষোড়শ লুই ও রানি আন্তোনেয়াৎ, যিনি বলেছিলেন ‘‘ওরা রুটি পাচ্ছে না তো কী, কেক তো খেতে পারে’’ দু’জনেরই ফরাসি বিপ্লব-উত্তর গিলোটিন হয় এখানে। এ বারের অলিম্পিক্সে সেই মৃত্যু আর্তনাদ চাপা পড়তে চলেছে ব্রেকিং ইভেন্টের আনন্দ উৎসবে। ব্রেকিং অর্থাৎ ব্রেক ডান্স এ বারের অলিম্পিক্সে নতুন সংযোজন। ক্যান-ক্যান নাচের শহরে ব্রেকিং। বাস্কেটবলও দেখা যাবে গিলোটিনের ভূমিতে। একমাত্র নতরদাম গির্জায় ঢোকার উপায় নেই। ২০১৯-এর অগ্নিকাণ্ডের পরে এখনও যা বন্ধ। মেরামতির কাজ চলছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে খোলার কথা।
তবু প্যারিসে এসে একেবারে নতরদাম দর্শন হবে না, তা কী করে হয়? স্যেন নদী আছে। যেখানে উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়ে গেল। এই প্রথম অলিম্পিক্সের বোধন হল খোলা আকাশের নীচে, কোনও স্টেডিয়ামে নয়। স্যেন নদীর বিখ্যাত ক্রুজ় নিলে প্যারিসের সব সেরা দর্শনীয় ইমারত দেখে নেওয়া যায় এক ঘণ্টার মধ্যে। প্রতিযোগীরা নদীবক্ষে মার্চপাস্ট করতে করতে সে সব দেখে ফেলতে পারলেন। নদীটাই এমন ঐতিহাসিক যে, সারা পৃথিবীর লোকে ছুটে আসে তা দেখতে। তা সে যতই একশো বছর ধরে এই নদীতে স্নান করা নিষিদ্ধ থাকুক দূষিত জলের জন্য। নানা কবিতা, ছবিতে এর উল্লেখ রয়েছে। জোয়ান অব আর্কের চিতাভস্ম এই নদীতে ছড়ানো হয়েছিল। জোয়ান অব আর্ককে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল মেয়ে হয়েও ছেলেদের পোশাক পরার অপরাধে। যুদ্ধের কোনও পাঠ না থাকা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে চমকে দেওয়া কিশোরীর বিরুদ্ধে বিচারসভায় আর কোনও অপরাধ তো খুঁজে পাওয়া যায়নি। কী অদ্ভুত পরিহাস! সেই প্যারিসেই এই প্রথম সমসংখ্যক পুরুষ ও মহিলা প্রতিযোগী অংশ নিতে চলেছেন। সাম্য প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে অলিম্পিক্সে। শোনা যায় নতরদামে এমন ভয়াবহ আগুন লেগেছিল যে, সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারত। স্যেন নদীর জল পাম্প করে হোসপাইপ দিয়ে নেভায়
দমকল বাহিনী।
আইফেল টাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে কে না প্রেম নিবেদন করতে চায়? কিন্তু অলিম্পিক প্রতিযোগী হলে এর সঙ্গে আর একটি স্বপ্ন অবশ্যই জুড়বে। আইফেল টাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে সোনার পদকে কামড় দিচ্ছি। ভারতীয়দের মধ্যে কার সেই সৌভাগ্য হবে? পি ভি সিন্ধু? ব্যাডমিন্টন রানি ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে। পর-পর দু’টো গেমসে পদক জিতেছেন। রিয়োতে রুপো, টোকিয়োয় ব্রোঞ্জ। এ বারে দারুণ ছন্দ নিয়ে প্যারিসে আসেননি কিন্তু তবু তো সিন্ধু-সভ্যতা। বড় ম্যাচের খেলোয়াড়। বড় আসরের তারকা। আশা করাই যায়। শুটিংয়ে একাধিক পদক আসতে পারে বলে অনেকের পূর্বাভাস। হকিতে এক সময় টানা ছ’টি অলিম্পিক্সে সোনা জিতেছে ভারত। সেই সোনালি অতীত আজ আর নেই। তবু টোকিয়োয় ঝলক দেখিয়ে ব্রোঞ্জ এনেছেন সৃজেশ, হরমনপ্রীতরা। ব্যাডমিন্টনে সাত্ত্বিক-চিরাগ ডাবলস জুটির দিকে প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে অনেকে। আন্তর্জাতিক তারকাদের মধ্যে নজর থাকবে অ্যাডাম পেটির দিকে। ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে রিয়ো এবং টোকিয়ো, দু’বারই সোনা জিতেছেন পেটি। তিনি কি পারবেন সোনার হ্যাটট্রিক করতে? আজ পর্যন্ত মাইকেল ফেল্পস ছাড়া সাঁতারে ব্যক্তিগত কোনও ইভেন্টে টানা তিনটি অলিম্পিক্সে কেউ সোনা জিততে পারেননি। ডাইভিংয়ে টম ডালে আছেন। ২০০৮ বেজিংয়ে যাঁর আবির্ভাব। ১৬ বছর ধরে আলোচনার কেন্দ্রে। জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস। মানসিক অবসাদ ও বিপর্যয় ঘটে টোকিয়ো থেকে যাঁকে বিদায় নিতে হয়েছিল। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চিরতরে হারিয়ে যেতেই পারতেন। কিন্তু তা হলে তো লড়াই ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া হবে। বাইলস তাই প্যারিসে ফিরছেন। এক বার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চান, মনের মধ্যে বাসা বাঁধা দৈত্যটাকে হারাতে পারেন কি না।
রাফায়েল নাদালের সঙ্গে জুটি বেঁধে টেনিসে নামছেন কার্লোস আলকারাস। রাফা ও নতুন রাফা। রোলঁ গ্যারোজের অবিসংবাদী রাজা ও তাঁর উত্তরসূরি। অলিম্পিক্সের কোর্টে আর প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্পেনের জন্য পদক অভিযানে ব্যস্ত। অলিম্পিক্স মানেই এমন সব অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা। প্রথম দিন মেন প্রেস সেন্টারে গিয়ে যেমন হঠাৎ দেখা গেল নোভাক জোকোভিচ আসছেন। ভারতের এ বারের শ্যেফ দ্য মিশন গগন নারাং তখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে যাচ্ছেন। একটু আগে তিনি পাল্টে যাওয়া ভারতীয় মানিসকতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। ‘‘আগে ভারতীয় দল আসত অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণ করতে। এখন আসে জিততে।’’ জোকোভিচ কেন এখানে? জানা গেল, টিম সার্বিয়ার সাংবাদিক সম্মেলন রয়েছে। সেখানে তিনি আসবেন। ভারতীয় ক্রিকেটের মতো নয় যে, মহাতারকা মানে তোমার মর্জি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবে কি না। আরও অদ্ভুত হচ্ছে, মহাতারকা বলে আলাদা কোনও রেড কার্পেট তাঁর জন্য বিছানো নেই। যেখানে গাড়ি পার্ক করতে হয়, সেখানেই দাঁড়াতে হল টেনিসের ইতিহাসে সব চেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ী পুরুষকে।
শেষবার প্যারিসে যখন অলিম্পিক্স হয়েছিল, হেমিংওয়েদের ‘লস্ট জেনারেশন’ বেঁচে রয়েছে। হয়তো গার্টরুড স্টেনের সঙ্গে হেমিংওয়ে বসে আছেন কোনও কাফেতে। পাবলো পিকাসো বেঁচে। প্যারিসের রাস্তা ধরে হাঁটলে কোথাও দেখা হয়ে যেতে পারে চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে। ফরাসি কবি গিয়ম আপোলিনেয়ার, যাঁর কবিতায় শকুন্তলার উল্লেখ ছিল বলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ থেকে জানা যায়, মার্গারিট যাঁর ভক্ত ছিল, তিনি মারা গিয়েছেন মাত্র ছ’বছর হয়েছে। প্যারিস তখন বিশ্বযুদ্ধের রক্তের দাগ মুছে শান্তি ফেরানোর অভিযানে নেমেছে। রোমহর্ষক সব চরিত্র ও কাহিনির জন্ম দিয়ে যায় ১৯২৪-এর অলিম্পিক্স। পাঁচটি সোনা জেতা ফ্লাইং ফিন পাভো নুরমি। তিরিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় যখন অন্যরা ট্র্যাকে শুয়ে পড়ার মতো অবস্থা, নুরমি ক্রস কান্ট্রিও জেতেন। ১০০ মিটার বিজয়ী হ্যারল্ড আব্রাহাম ও ৪০০ মিটার জেতা এরিক লিডেল। যাঁদের নিয়ে অস্কারজয়ী হলিউড ছবি ‘চ্যারিয়ট্স অব ফায়ার’ তৈরি হয়েছিল। সুইমিং পুলে ঝড় তুলে তিনটি সোনা জেতা জনি ওয়েসমুলার। যিনি পরে টারজান হিসেবে পর্দায় ঝড় তুলে আরও বিখ্যাত হবেন।
প্রথম গেমস যেখানে অলিম্পিক ভিলেজ তৈরি হল। ‘সিটিয়াস, অল্টিয়াস, ফোর্টিয়াস’— অলিম্পিকের মোটো তৈরি হল সেই প্রথম বার। বিপ্লবের দেশে এক ফরাসির হাত ধরে পরিবর্তনের হাওয়া উঠল অলিম্পিক্সে। ব্যারন ডি কুবার্তিনকে নিয়ে যদিও পরে অনেক তর্ক উঠে এসেছে যে, ভিক্টোরীয় আদর্শের বেড়িতে অহেতুক প্রতিযোগীদের বাঁধতে গিয়েছিলেন। বাণিজ্যিকরণে বাধা দিয়েছিলেন। অনেকের মতে, কুবার্তিন ভালর চেয়ে গেমসের খারাপই ডেকে এনেছিলেন। তাঁকে কটাক্ষ করে একাধিক লেখা রয়েছে। সেই সময় ‘দ্য লন্ডন টাইম্স’ লিখে দিয়েছিল, ‘‘ফিউচার অব গেমস ইজ় ডেড’’। অর্থাৎ কি না, গেমস মৃত। তাদের সেই প্রতিবেদন নিয়ে একাধিক চিঠি চালাচালি হয়। কে জানত, ভয়ঙ্কর সঙ্কটের মধ্যেও গেমসের পুতাগ্নি জ্বলতে থাকবে এবং একশো বছর পরে তা ফিরে আসবে প্যারিসে।
স্যেন নদীর পারে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে বসে আবার মনে হচ্ছিল, প্যারিসে নিরাপত্তা নিয়ে এত চর্চা চলছে। কটাক্ষ করে বলা হচ্ছে ‘কিউআর কোড গেমস’। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে বড় প্রশ্ন, গেমসের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তো? একশো বছর আগে প্যারিস গেমস নিয়ে যে রকম লেখালেখি হয়েছিল, তা ফিরে আসবে না তো? উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বৃষ্টি পড়ছে, মাথার উপরে ছাদ নেই দেখেও উপস্থিত দর্শকেরা ধৈর্য হারাননি। পিছনেই দৃশ্যমান আইফেল টাওয়ার। যত ক্ষণ না বোধন শুরু হয়, দেখলাম সকলে সেদিকেই চেয়ে আছে। কিন্তু গেমসের স্বাস্থ্যরক্ষা হবে কী ভাবে? প্যারিস জুড়ে জোরাল চর্চা, এত বিশাল খরচা হচ্ছে গেমসকে ঘিরে। যার বেশির ভাগটাই নিরাপত্তা আর স্যেন নদীর দূষিত জল পরিশোধনের প্রকল্পে। সেই টাকা উঠবে কী ভাবে?
কুবার্তিনকে আধুনিক গেমসের জনক আখ্যা দেওয়া হলেও অনেকে তা মানেন না। এই অংশের মত, কুবার্তিন নয়, এই তকমা পাওয়া উচিত পিটার উবেররথের। বলা যেতে পারে ইনিই অলিম্পিক্সের কেরি প্যাকার। যিনি প্রথম টিভি স্বত্বের মর্ম বুঝে পেশাদারিত্বের মোড়ক দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। উবেররথ বুঝেছিলেন, গেমসকে ঘিরে যতই আবেগের বলয় তৈরি হোক, ব্যবসা করা কঠিন। অ্যামেচার ভাবনা নিয়ে বসে থাকলে কিছুই হবে না।
১৯৭৬ মন্ট্রিয়ল অলিম্পিক্স দেনায় ডুবে গিয়েছিল। গেমসের আদর্শ ‘পিস অ্যান্ড ইউনিটি’ তত দিনে ভেঙে পড়েছে। জঙ্গিরা ১৯৭২ মিউনিখ অলিম্পিক্সে আক্রমণ করে। ১১ জন ইজ়রায়েলি অ্যাথলিট ও কোচ প্রাণ হারান। ঠিক যেমন প্যারিস অলিম্পিক্স নিয়ে নানা রকম হুমকি আর আতঙ্কের বন্যা বইছে। ১৯৮৪ অলিম্পিক্স কেউ করতেই চাইছিল না দেনার ভয়ে। আমেরিকা শুধু গেমসের খরচাই তুলল না, ২৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লাভ দিল। উবেররথ খেলাধুলো নিয়ে কিছুই জানতেন না। সেই সময় ৪২ বছর বয়স। কলেজে ওয়াটারপোলো খেলার বাইরে আর কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রথম দিনেই তাঁর হাতে কার্ডবোর্ডের বাক্সে একটা বিল ধরানো হল। ৩০০,০০০ মার্কিন ডলারের। নিজের পকেট থেকে ১০০ মার্কিন ডলার দিয়ে তিনি অর্গানাইজিং কমিটির অ্যাকাউন্ট খুললেন। সেই সময় তিনি বুঝে যান, গেমসের বাণিজ্যিকরণ করতে না পারলে শেষ। প্রথমেই তাঁরা টিভি স্বত্বকে টার্গেট করলেন। ১৯৭৬-এ এবিসি মন্ট্রিয়ল গেমসের জন্য মাত্র ২৫ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল। উবেররথ ‘বিডিং’ যুদ্ধ চালু করলেন তিন-চারটি সংস্থার মধ্যে। ৭৫০,০০০ ডলার করে জমা দিতে হবে বিডিংয়ে আসন পাওয়ার জন্য। ধুরন্ধর উবেররথ হিসাব করে নিয়েছিলেন, এই টাকায় প্রায় দৈনিক ১০০০ ডলার করে সুদ পাওয়া যাচ্ছিল। পুরো এক বছর ধরে ১৯৮৩ পর্যন্ত সুদ পাওয়া গেল আর তা দিয়েই গেমসের প্রস্ততি এগিয়ে চলল। এবিসি ২২৫ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিয়েছিল অলিম্পিক্সের টিভি স্বত্ব পাওয়ার জন্য। আরও ১০০ মিলিয়ন বাইরের সব দেশে প্রোডাকশন করার জন্য। ইন্টারন্যাশানল অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) ধারণাই করতে পারেনি এত টাকা আসতে পারে টিভি স্বত্ব থেকে। তারা খুব অল্প টাকা নিয়ে আমেরিকাকে বাকি টাকা ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে যায়। উবেররথের বিশ্বাস ছিল, হাফ বিলিয়ন ডলার লাগবে আমেরিকায় অলিম্পিক্স করতে। সেই কারণে তিনি কর্পোরেট আমেরিকার দিকে তাকিয়েছিলেন। সেই সময় অলিম্পিক্সের জন্য ছোট ছোট অনেক সংস্থার সঙ্গে সঙ্গে চুক্তি হত নামমাত্র টাকায়। একই ধরনের একাধিক ব্র্যান্ড স্পনসর হতে পারত। উবেররথ-রাই প্রথম চালু করেন এক্সক্লুসিভ স্বত্ব। বেশি টাকা নেব কিন্তু শুধুই তুমিই একচেটিয়া অধিকার পাবে। কোডাক যারা বহুকাল ধরে অলিম্পিক্সের সঙ্গে যুক্ত ছিল মাত্র ২ মিলিয়ন দিতে চেয়েছিল। উবেররথ জাপানি প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থা ফুজিকে তুলে আনলেন। তাদের বললেন, তিনদিন সময় দিচ্ছি। দ্যাখো স্পনসরশিপ নিতে চাও কি না। বেশি টাকা দিতে হবে। ফুজি ৭ মিলিয়নে স্পনসরশিপ ছিনিয়ে নিয়ে গেল কোডাকের থেকে। শোনা যায়, আইওসি-কে একদিন দেরিতে তিনি প্রাপ্য টাকা দেন ৯০০০ ডলার সুদ কামাতে পারবেন বলে। কুবার্তিন যা হতে দেননি, সেই উদারনীতির দরজা খুলে দেন উবেররথ। অ্যাথলিটদের ব্যক্তিগত স্পনসরশিপ আনার ব্যাপারেও উৎসাহিত করেন। যা তখন পর্যন্ত অলিম্পিক কমিটি করতেই চায়নি। এমনকি, টর্চ রিলেও বিক্রি করে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৮১-তে আইওসি প্রেসিডেন্ট হন জুয়ান আন্তোনিয়ো সামারাঞ্চ। তিনি আমেরিকার কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক। উবেররথ পরবর্তী জমানার জন্য নকশা তৈরি করে দিয়ে গেলেন। সামারাঞ্চ দ্রুতই বুঝে যান কী করতে হবে। এর পরেই তিনি আয়োজক দেশের হাত থেকে টিভি স্বত্ব ছিনিয়ে নিয়ে আইওসি-র আওতাভুক্ত করে দেন। ১৯৮৮ অলিম্পিকের টিভি স্বত্ব বিক্রির কাজ তিনি শুরু করে দেন লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক শুরুর আগেই। এবং কর্পোরেট স্পনসরশিপ আনতেও উদ্যোগী হন।
প্যারিসে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, কুবার্তিনেরও আগে খোঁজ করা উচিত উবেররথের। সোচিতে উইন্টার গেমসে প্রচুর খরচ হয়েছে, তোলা যায়নি। রিয়ো অলিম্পিক্সে বিশাল ক্ষতি হয়। বাধ্য হয়ে আবার আমেরিকামুখী গেমস। পরের অলিম্পিক হবে সেখানে এবং নিশ্চিত থাকা যায়, উবেররথের ব্লু প্রিন্ট মেনে ইতিমধ্যেই অলিম্পিক্সের বাণিজ্যিকরণ শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্রিকেটকে অলিম্পিক গেমসের আওতায় আনা হয়েছে, ২০২৮-এ যার আত্মপ্রকাশ ঘটছে। তার আগে আমেরিকায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও করে ফেলা হল যাতে ক্রিকেটের জমি তৈরি করে রাখা যায়।
যা পরিস্থিতি, আগামী কয়েক দিন ধরে শুধু প্যারিসকে জিতলেই তো হবে না, অলিম্পিক্সকেও জিততে হবে।