বিজয়িনী: ১৯২০ সালে ডাইভিং চ্যাম্পিয়ন আইলিন রিগিন। (ছবি: গেটি ইমেজেস) ডান দিকে, এ বারে রুপোজয়ী মীরাবাই চানু সাইখম ।
আইলিন রিগিন। অলিম্পিক্সের প্রথম মহিলা ডাইভিং চ্যাম্পিয়ন। ১৯২০ সালে বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্প শহরে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক্সে ৩ মিটার স্প্রিংবোর্ড ইভেন্টে সোনা জেতেন চোদ্দো বছরের এই মার্কিন কিশোরী। তার পর ১৯২৪-এর প্যারিস অলিম্পিক্সেও একই ইভেন্টে রুপো আর ১০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোক সাঁতারে ব্রোঞ্জ। ক্রীড়া-নৈপুণ্যের বিচারে ১৯২০ সালের অলিম্পিক্স মনে করায় ফরাসি টেনিস-ঈশ্বরী সুজান লাংলেন-কে। মেয়েদের সিঙ্গলস ও মিক্সড ডাবলসে সোনা, মেয়েদের ডাবলসে ব্রোঞ্জ জেতেন তিনি। আজ ফরাসি ওপেনে মেয়েদের প্রতিযোগিতায় বিজয়ীর ট্রফি ও দ্বিতীয় বৃহত্তম কোর্ট সুজানেরই নামে। অ্যান্টওয়ার্প অলিম্পিক্সেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় আত্মপ্রকাশ ঘটে ফিনল্যান্ডের এক তেইশ বছরের অ্যাথলিটের। তিনটি সোনা, একটি রুপো দিয়ে শুরু, পরের দু’টো অলিম্পিক্সে আরও ছ’টা সোনা আর দু’টো রুপো জেতেন এই কিংবদন্তি দৌড়বিদ। তিনি পাভো নুরমি, আদর করে ডাকা হত ‘উড়ন্ত ফিন’।
আজকের টোকিয়ো অলিম্পিক্সের সময় থেকে একশো বছর আগের অ্যান্টওয়ার্প অলিম্পিক্স নিয়ে ভাবতে বসলে দুইয়ের মধ্যে তুলনা আসতে বাধ্য। টোকিয়োর ২০২১-এর অলিম্পিক্সের আসর যেমন চূড়ান্ত ব্যতিক্রমী, এ শতকের ভয়ঙ্করতম অতিমারির মেঘে ঢাকা, এক বছর বিলম্বিত, অনেকটা তেমনই ছিল ১৯২০-র অ্যান্টওয়ার্প অলিম্পিক্স। তবে তা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সময়মতোই। স্প্যানিশ ফ্লু দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছে ১৯১৮ থেকে ১৯২০-র শুরু পর্যন্ত সময়ে। কোভিড অতিমারির সময়কালে গত দেড় বছরে সেই স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে চর্চা হয়েছে বিস্তর। আমরা জেনেছি, আনুমানিক পাঁচ কোটি মানুষ মারা যান একশো বছর আগের সেই দুনিয়া-কাঁপানো অতিমারিতে। মার্কিন অলিম্পিক্স-সংক্রান্ত ইতিহাসবিদ বিল ম্যারনের তথ্য অনুসারে, স্প্যানিশ ফ্লু-তে মারা গিয়েছিলেন সাত জন অ্যাথলিট, যাঁদের মধ্যে ছিলেন অলিম্পিক্সে পাঁচ বার সোনাজয়ী কিংবদন্তি মার্টিন শেরিডান। দুই মহাযুদ্ধ মিলিয়ে যত মানুষের প্রাণ গেছে, তার চাইতে বেশি মানুষ মারা গেছেন স্প্যানিশ ফ্লু-তে। অ্যান্টওয়ার্প অলিম্পিক্সের আগে মোটামুটি স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু-র ঢেউ। ১৯২০-র অলিম্পিক্স তাই প্রধানত ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে মুক্তির প্রতীক। মহাযুদ্ধ আর অতিমারি মিলেমিশে প্রভাব ফেলেছে অ্যান্টওয়ার্প অলিম্পিকের উপর।
আর এ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতেই আইলিন রিগিন যেন অ্যান্টওয়ার্পের যুদ্ধোত্তর এবং অতিমারি-বিধ্বস্ত অলিম্পিকের প্রতিলিপি। নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা আইলিনের স্বাস্থ্য এমনিতেই ছিল নড়বড়ে। স্প্যানিশ ফ্লু-র প্রথম দিকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে বছর এগারোর আইলিন। ডাক্তার পরামর্শ দেন সাঁতার কাটার। কিন্তু নিউ ইয়র্কের প্রবল ঠান্ডায় গ্রীষ্মকাল ছাড়া অন্য সময় সাঁতারের উপযুক্ত পুল খুঁজে পাওয়া কঠিন। অবশেষে ব্রুকলিন হাইটস-এর এক হোটেলে খুঁজে পাওয়া গেল এক ছোট্ট পুল। আর সৌভাগ্যবশত আইলিন পেয়ে গেল লুইস হ্যান্ডলে নামের এক অসাধারণ কোচকে, যিনি ১৯০৪-এর সেন্ট লুই অলিম্পিক্সে অংশ নিয়েছিলেন ওয়াটার পোলো ইভেন্টে। এখান থেকেই প্রতিযোগিতামূলক সাঁতার শুরু করেন আইলিন।
১৯১২-র স্টকহোম অলিম্পিক্সের পর কেটে গিয়েছে আট বছর। ১৯১৬-তে বার্লিনে বসতে পারেনি অলিম্পিক্সের আসর, যুদ্ধের জন্যই। তাই ১৯২০-র আসরটা অলিম্পিক্সের এক নতুন লড়াই, ফিরে আসার। অলিম্পিক্স অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, এই খবর পেয়ে আইলিনরা উল্লসিত হয়ে উঠলেন অন্য কারণে, মহিলাদের সাঁতার অলিম্পিক্সের অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে সেই প্রথম। মাস তিনেক আগে থেকে শুরু হল প্রস্তুতি। ও দিকে মার্কিন অলিম্পিক্স কমিটির কর্তাব্যক্তিরা তখন যেন গ্রিসের প্রাচীন অলিম্পিক্সের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ। তাঁরা মহিলা প্রতিযোগীদের অলিম্পিক্সে যেতে দিতে নারাজ। অনেক প্রচেষ্টার পরে বরফ গলল। আইলিন এবং তাঁরই সমবয়সি হেলেন ওয়েনরাইটের মতো দু’জন আটলান্টিকের ও পারে সুদূর ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ব্যক্তিগত ভাবে নিলেন দলের ম্যানেজার। আমেরিকায় মহিলারা তখনও ভোটাধিকার পাননি। মার্কিন সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীতে তাঁরা ভোটাধিকার পান ১৮ অগস্ট, ১৯২০। হ্যাঁ, অ্যান্টওয়ার্প অলিম্পিক্স তখন চলছে।
জাহাজে চেপে ১৩ দিন ধরে ইউরোপে যান মার্কিন অ্যাথলিটরা। রোনাল্ড রেনসনের বইতে বলা আছে, আমেরিকান অ্যাথলিটদের একটি বড় অংশ অ্যান্টওয়ার্পে যান এমন একটি জাহাজে, যা কিছু দিন আগেই ব্যবহৃত হয়েছিল মার্কিন সৈন্যদের মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে। অ্যাথলিটরা অভিযোগ করেছিলেন জাহাজে ফরমালিনের তীব্র গন্ধ নিয়ে।
মহাযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। অলিম্পিক্স শেষ হওয়ার পর যুদ্ধক্ষেত্র দেখতে যান আইলিনরা। বেলজিয়ামের শহর ইপ্রা-র যুদ্ধক্ষেত্র দেখার বর্ণনা দিয়েছেন আইলিন। সেখানে কুড়িয়ে নেন একটা জার্মান হেলমেট, বেশ কিছু বুলেট, স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। একটা জার্মান বুটও মেলে, তার মধ্যে তখনও রয়েছে বুটের মালিকের পচাগলা পা। তড়িঘড়ি ফেলে দেন সেটা। অতিমারি আর যুদ্ধ একাকার হয়ে যায় আইলিনের অভিজ্ঞতায়। স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারিই হয়তো সৃষ্টি করেছে আইলিন রিগিনের মতো এক অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নকে। সেই অতিমারি না হলে, তাতে অসুস্থ হয়ে না পড়লে, আইলিনের জীবন হয়তো বইত অন্য খাতে।
অন্তত তিনটে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সূত্রপাত হয় অ্যান্টওয়ার্পে। অলিম্পিক্সের শপথ, পতাকা এবং পায়রা ওড়ানোর রীতি। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটির প্রতিষ্ঠাতা ব্যারন পিয়ের দ্য কুবের্তা জোর দিয়েছিলেন যাতে অ্যান্টওয়ার্পের ১৯২০ সালের অলিম্পিক্সটা ইতিহাসে যুদ্ধজয়ীদের বিরুদ্ধে পরাজিতের লড়াই হিসেবে চিহ্নিত না হয়, যদিও যুদ্ধে হেরে যাওয়া জার্মানির আমন্ত্রণ ছিল
না অ্যান্টওয়ার্পে।
দুই মহাযুদ্ধের জন্য তিনটে অলিম্পিক্স বাতিল হলেও কোনও অলিম্পিক্স কিন্তু পিছিয়ে গিয়ে অনুষ্ঠিত হয়নি এত দিন। গত বছর নজিরবিহীন ভাবে টোকিয়ো অলিম্পিক্স পিছিয়ে দেওয়া হয় এক বছরের জন্য, আশা ছিল পরিস্থিতি অনেকটাই অনুকূল হবে ২০২১-এ। টোকিয়ো অলিম্পিক হয়তো ইতিহাসের সব চেয়ে অবাঞ্ছিত অলিম্পিক্সগুলির একটা। জাপানের ৭০-৮০ শতাংশ মানুষই চাইছিলেন হয় অলিম্পিক্স বাতিল হোক, নতুবা পিছিয়ে যাক আরও।
ইতিহাস সাক্ষী, অলিম্পিক্স আয়োজন টোকিয়োর ক্ষেত্রে আগেও খুব সুখের হয়নি। টোকিয়ো প্রথম অলিম্পিক্স আয়োজনের সুযোগ পায় ১৯৪০-এ। সে নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিলই সংশ্লিষ্ট মহলে। যুদ্ধের আবহে অবশ্য অলিম্পিক্সের স্থান বদলায়, অলিম্পিক্স সরে যায় হেলসিঙ্কিতে। যদিও শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণে হতে পারেনি ১৯৪০ আর ’৪৪-এর অলিম্পিক্স দু’টো। টোকিয়ো অলিম্পিক্স সংগঠন করে ১৯৬৪-তে। ১৯৪০-এর আট দশক পরে আবার এক ভয়ানক যুদ্ধ মেঘলা করে তুলেছিল আর এক টোকিয়ো অলিম্পিক্সের প্রেক্ষাপট— এই যুদ্ধটা সমগ্র মানবজাতির সঙ্গে এক অদৃশ্য ভাইরাসের!
অতিমারি নয়, মহাযুদ্ধের চিতাভস্মের মধ্য থেকে ফিনিক্সের মতো অলিম্পিক্সের পুনরুত্থানই ছিল বেলজিয়ামে ১৯২০-র অলিম্পিক্সের মূল মন্ত্র, যাকে বলা হয়েছে ‘গেমস রিবর্ন’। জৈব-বুদ্বুদের সুরক্ষার আস্তরণে দর্শকশূন্য আজকের টোকিয়ো অলিম্পিক্স তাই শতকপ্রাচীন অ্যান্টওয়ার্প গেমস-এর চেয়ে প্রচারে, আয়োজনে, ঔজ্জ্বল্যে, সুরক্ষায় অনেকটাই স্বতন্ত্র। অ্যান্টওয়ার্পে আইলিনরা খেলা শেষে ভ্রমণ করেছিলেন, টোকিয়োতে কিন্তু অ্যাথলিটদের সাইট সিইংয়েও ছিল নিষেধাজ্ঞা। অলিম্পিকের আদর্শবাণী ‘সিটিয়াস, অল্টিয়াস, ফর্টিয়াস’। বাংলা হতে পারে ‘তুরীয়ান, তুঙ্গীয়ান, বলীয়ান’। অতিমারির দাপটে বদলে যাওয়া দুনিয়ার প্রেক্ষিতে এই আদর্শকেও নতুন ছাঁচে ফেলতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স সংস্থা। যোগ করেছে এক নতুন শব্দ— ‘কমুনিস’ বা ‘টুগেদার’। ‘একতা’-উদ্দীপ্ত এই নতুন অলিম্পিক্স-মন্ত্র আন্তর্জাতিক স্তরে টোকিয়ো অলিম্পিকের ঐতিহ্য হয়ে উঠতে পারবে কি না, সে তো সময়ই বলবে। তবু, জৈব-বুদ্বুদের নিবিড় আশ্রয়ে এই দ্বিতীয় অতিমারি-ধ্বস্ত অলিম্পিক্স হয়তো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের বিজয় নির্দেশ করতে না পারলেও নিশান ওড়ায় মানুষের অদম্য মানসিকতার প্রতীক হিসেবে।
অ্যান্টওয়ার্পে ভারত ছিল না। টোকিয়োতে ভারতের ১২৭ জনের মস্ত দল। তিন কন্যার মেডেল। আরও বেশ কিছু ভাল পারফরম্যান্স। আসলে অলিম্পিক্স একটা প্রজন্মের খেলোয়াড়দের আত্মপ্রকাশের, তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রাখার প্ল্যাটফর্ম। ছেলেদের সাঁতারে আমেরিকার খেলেব ড্রাসেল পেয়েছেন পাঁচটি সোনা, মেয়েদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার এমা ম্যাককিয়ন জল থেকে তুলে নিলেন চারটে সোনা-সহ সাতটি পদক। তবুও টোকিয়ো অলিম্পিক্সে যে কোনও জয়ীর চেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন কিংবদন্তি মার্কিন জিমন্যাস্ট সিমোনে বাইলস। মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে একের পর এক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ না করেই। এবং বাইলসের ছেড়ে দেওয়া সিংহাসনে আপাত-প্রতিষ্ঠা পেলেন আর এক মার্কিন জিমন্যাস্ট সুনিসা লি। অতিমারির বিভীষিকার মধ্যেই টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভবিষ্যতের কোনও সুজান লাংলেন বা পাভো নুরমির মতো মহাতারকা অঙ্কুরিত হলেন কি না, তা বুঝতে গেলে অবশ্য পেরোতে হবে আরও অনেকটা সময়!