ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক।
সহজাত রিফ্লেক্সে মুহূর্তের মধ্যে বুলেটটাকে এড়িয়ে বাঁ দিকে হেলে গেল রুদ্র। আর হেলে পড়তে পড়তেই নিখুঁত নিশানায় গুলি চালাল হানিফের কব্জি লক্ষ করে। কব্জি চেপে ধরে কাতরে উঠল হানিফ। মনে মনে এ রকমটাই চাইছিল টিড্ডি ফরিদ। সুযোগ বুঝেই সে “মৎ মারিয়ে সাব!” বলে বেজায় ভয় পাওয়ার ভান করে পিস্তলটা জলে ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল দু’হাত তুলে।
গজবিশেক দূরে ঘন হয়ে গায়ে গায়ে লাগা কয়েকটা গাছের আড়াল থেকে পুরো ব্যাপারটার দিকে নজর রাখছিল ইন্সপেক্টর তাওড়ে। উসমানরা ধরা পড়ে গেলে ওর যে সর্বনাশ হয়ে যাবে, সেটা জলের মতো পরিষ্কার। সে বুঝল, ‘আভি খালাস কর দেনা হোগা ওহ তিন হারামিকো!’ বলতে হবে ওই বাঙালি অফিসারকে বাঁচাতেই এনকাউন্টার করতে বাধ্য হয়েছে। দক্ষ হাতে পিস্তল আনলক করল তাওড়ে। তার পর নিশানা লাগাল কালিয়া উসমানের মাথা লক্ষ করে। হঠাৎ কানের পিছনে ঠান্ডা ধাতব স্পর্শ!
‘ক্লিক!’ আর একটা পিস্তল আনলক করার আওয়াজ। শিকারি বেড়ালের মতো নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন মজিদসাহেব! সার্ভিস পিস্তলের নল ঠেকানো তাওড়ের কানের রগে। মজিদসাহেব, হাড় হিম করে দেওয়া একটা হাসি ঠোঁটের কোণে।
“আপনি যে এ রকম একটা কিছু ট্রাই করবেন, সেটা মিটিংয়ের শেষে আপনাকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যেতে দেখেই মনে হয়েছিল আমার। আভি শরিফ আদমি কা তরহা আর্মস ফেককে শির কা উপর হাত উঠাইয়ে।”
এরই মধ্যে গুলির আওয়াজ শুনে চার দিক থেকে এগিয়ে আসছে অনেক পায়ের শব্দ। এ সি পি শিন্ডের গলা, “মিস্টার ব্যানার্জি, মিস্টার আলি, হোয়ার আর ইউ?”
“আই অ্যাম হিয়ার মিস্টার শিন্ডে! প্লিজ় কাম শার্প!” রুদ্রর গলা শোনা গেল। পিস্তলের নলটা তাওড়ের রগে ঠেকিয়ে রেখেই লম্বা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন মজিদসাহেব।
পুরো ডোংরি মহল্লা ঘিরে ফেলে তল্লাশি চালাচ্ছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী। উসমানের ডেরার পিছনে একটা পরিত্যক্ত গোডাউন থেকে উদ্ধার হওয়া সাতটা নাবালিকা নেপালি মেয়ে। চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি। তার মধ্যে এক জন ফুল্লি। তীক্ষ্ণ চিৎকারে কেঁদে উঠল চারপাশ কাঁপিয়ে! ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরল সন্তোষী। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সান্ত্বনা দিতে লাগল নিজের ভাষায়। সেটা দেখামাত্র বাকি মেয়েগুলোও এসে জড়িয়ে ধরল সন্তোষীকে। অতঃপর চোখের জল আর একে অপরকে আঁকড়ে ধরে ভেসে যাওয়া মুক্ত হওয়ার আনন্দে! পাশে দাঁড়ানো মুম্বই পুলিশের অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং সেকশনের এক মহিলা কনস্টেবল।
“সামহালিয়ে ইন সবকো,” কনস্টেবলের জিম্মায় মেয়েগুলোকে রেখে একটু দূরে পার্ক করা পুলিশ ভ্যানটার আড়ালে এসে দাঁড়াল সন্তোষী। চোখের জলটা মুছে ফেলা দরকার এ বার।
লোকে লোকারণ্য কর্পোরেটর বাবুরাও পাটিলের বাইকুল্লার দলীয় দফতরের সামনে। কড়া পুলিশি-প্রহরায় অফিস থেকে বার করে আনা হচ্ছিল বাবুরাওকে। দু’পাশে রুদ্র আর এ সি পি শিন্ডে। সামনে অপেক্ষমাণ একাধিক মিডিয়া চ্যানেলের প্রতিনিধিরা। বাবুরাওকে বেরোতে দেখেই ছুটে এসে ছেঁকে ধরল চার পাশ থেকে।
“বাবুরাওজি, খতরনাক গ্যাংস্টার কালিয়া উসমানকো নাবালিক নেপালিলোগোঁকা ট্র্যাফিকিং অওর ইল্লিগ্যাল স্কিন গ্র্যাফটিং কেস মে গিরফতার কিয়া গয়া। পোলিস কা কহনা হ্যায় কে আপকা সাথ উসমানকা বহোত ক্লোজ় রিলেশন হ্যায়?”
প্রশ্নটা ছুড়ে দিল সর্বভারতীয় একটি চ্যানেলের এক তরুণী সাংবাদিক। প্রশ্নের জবাবে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল বাবুরাও, “দেখিয়ে, মেরে খিলাফ ইয়ে ইলজ়াম সরাসর ঝুট হায়। ম্যায় জনতা কা সেবক হুঁ। জনতা হি হামকো ইস কেস সে মুক্ত করেগা। জয় মহারাষ্ট্র! ”
“জনতা কা নেতা বাবুরাও পাটিল জিন্দাবাদ!” পিছন থেকে হুঙ্কার দিয়ে উঠল বাবুরাওয়ের দলের সমর্থকেরা। মিডিয়া আর সমর্থকদের ভিড় ঠেলে বাবুরাওকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল রুদ্র আর এ সি পি শিন্ডে। পেছন পেছন মজিদসাহেব, সুনীল, সন্তোষী আর বিশাল পুলিশ বাহিনী।
দাদারে নিজের নার্সিংহোমে বসে একটা মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখছিলেন ডক্টর সমর্থ। এমন সময় চার জন লোক এসে ঢুকল চেম্বারে। সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন ভেতর থেকে ডক্টর সমর্থকে বলে দিল এরা কারা এবং কী প্রয়োজনে এসেছে।
“আপকো পোলিস স্টেশন চলনা পড়েগা ডক্টরসাহাব,” বলল ওদের মধ্যে থেকে এক জন।
“চলিয়ে...” দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর সমর্থ।
পরদিন সকালবেলা। বান্দ্রায় নিজের বিশাল সি ফেস বাংলোর মখমলি বিছানায় শুয়ে বেড-টিতে সবে প্রথম চুমুক দিয়েছে রিচা মিরচন্দানি, পরিচারিকা এসে খবর দিল, “এক নেপালি টাইপ অওরত আপসে মিলনে আয়ে হ্যাঁয় মেমসাব।”
বিরক্ত চোখে মেয়েটির দিকে তাকাল রিচা, “আভি মুলাকাত নেহি হোগি। বোল দো উসে।”
“উয়ো ম্যাডাম নে ইয়ে কার্ড দিয়া আপকো।”
একটা ভিজ়িটিং কার্ড রিচার দিকে এগিয়ে ধরল পরিচারিকা। কার্ডটায় চোখ বুলিয়েই প্লাক করা ভুরুজোড়া ধনুকের মতো বেঁকে গেল রিচার। সাদার ওপর কালো লেটারহেডে লেখা, সন্তোষী তামাং, সাব ইন্সপেক্টর, কলকাতা পুলিশ।
“তুম যাও। হাম আ রহেঁ হ্যাঁয়...” বলে বিছানার এক পাশে রাখা ফোনটা তুলে নিল রিচা। মনুকে ফোন করা দরকার এক্ষুনি। মনুর নম্বর ডায়াল করল রিচা। অনেক ক্ষণ ধরে বেজে গেল ফোনটা কিন্তু ও প্রান্তে কোনও সাড়াশব্দ নেই। বিরক্ত হয়ে বিছানায় ফোনটা ছুড়ে ফেলে ড্রেসিংগাউনটা গায়ে গলিয়ে গজগজ করতে করতে নীচে নেমে গেল রিচা।
বিশাল ড্রইংরুমটার মাঝখানে একটা বেলজিয়ান সোফাসেটে বসে ছিল সন্তোষী। পাশে মুম্বই পুলিশের এক জন মহিলা সাব ইনস্পেক্টর। পিছনে জনাচারেক সাদা পোশাকের কনস্টেবল। রিচাকে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়াল সন্তোষী।
“গুড মর্নিং ম্যাম, আয়্যাম সন্তোষী তামাং। সাব ইনস্পেক্টর অব কলকাতা পোলিস। আপকো এক বার পোলিস স্টেশন চলনা পড়েগা মেরে সাথ।”
“কিঁউ!” শোনামাত্র ভয়ঙ্কর ক্রোধে ফেটে পড়ল রিচা, “হাউ ডেয়ার ইউ টু সে লাইক দিস!” জবাবে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্টের কাগজটা রিচার দিকে এগিয়ে দিল সন্তোষী। চরম বিরক্তিতে এক বার কাগজটায় চোখ বোলাল রিচা, তার পর বলল, “লিসন ইনস্পেক্টর, আপ হামকো অ্যায়সে নেহি লে যা সকতে। ইউ ডোন্ট নো মি। আয়্যাম রিচা মিরচন্দানি, সুপারমডেল। হায়েস্ট লেভেল তক কনট্যাক্টস হ্যায় মেরা। আপকা লাইফ হেল কর দেঙ্গে হাম।”
শান্ত চোখে রিচার দিকে তাকাল সন্তোষী। একটা মৃদু হাসি ঠোঁটের কোণে, “ওহ সব তো বাদ মে দেখা যায়গা। পহলে আপ থানেমে চলিয়ে। নেহি তো হামকো ফোর্স অ্যাপ্লাই করনা পড়েগা।”
সন্তোষীর চোখের ইশারায় এগিয়ে এল দুজন মহিলা কনস্টেবল।
“জবরদস্তি করনে কি কোই জরুরত নহি। হাম খুদ চলেঙ্গে আপকে সাথ। লেকিন…” জ্বলন্ত চোখে সন্তোষীর দিকে তাকাল রিচা, “টেলিং এগেন, আই উইল মেক ইওর লাইফ হেল, আই প্রমিস ইউ।”
তার পর নিজেই হেঁটে গিয়ে উঠে বসল বাংলোর দরজার সামনে অপেক্ষমাণ মুম্বই পুলিশের লোগো আঁকা নীল-হলুদ বর্ডারওয়ালা কোয়ালিসে।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ইওরোপের একটা সাত তারা হোটেলের প্রিমিয়াম স্যুটে সকাল এগারোটায় ঘুম ভাঙল মনুভাইয়ের। গতকাল গভীর রাত অবধি মিটিং ছিল ডারবান আর কেপটাউনের তিন জন ডায়মন্ড মাইন ওনারদের সঙ্গে। ফলে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। গায়ের চাদর সরিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়েই কপালের রেখায় ভাঁজ পড়ল মনুর। পাঁচটা মিস্ড কল। তিনটে রিচার। বাকি দুটো ওর পার্সোনাল সেক্রেটারির। রাতে কেউ যাতে ফোন করে বিরক্ত না করে তাই সাইলেন্ট রেখেছিলেন ফোনটা। এখন পাল্টা রিংব্যাক করলেন মনু। অনেক ক্ষণ ধরে রিং হয়ে গেল। কেউ ফোন ধরল না। বারকয়েক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ডায়াল করলেন মায়ার নম্বরে। মায়া রাও। রিচার পার্সোনাল সেক্রেটারি। ফোন তুলেই প্রায় আর্তনাদ করে উঠল মায়া, “ম্যাডাম কো আজ সুবহ পোলিস উঠাকে লে গয়া, স্যর! আই ট্রায়েড টু কন্ট্যাক্ট ইউ, বাট…” বাকি কথাগুলো আর কানে ঢুকছিল না মনুভাইয়ের। যেন ৪৪০ ভোল্টের একটা বিদ্যুৎবাহী তার কেউ ছুঁইয়ে দিয়েছে শরীরে। সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর অনুভূতি একেবারে অবশ হয়ে গেছে সেই আঘাতে। বেশ কিছু ক্ষণ লাগল মনুর নিজেকে সামলাতে।
“আর ইউ ওকে স্যর?” লাইনের ও ধার থেকে প্রশ্ন করল মায়া।
“আয়্যাম অল রাইট। লেকিন ক্যা হুয়া রিচা কা? কিঁউ অ্যারেস্ট কিয়া গয়া উনকো?” নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলেন মনু, “ম্যাডাম নে উয়ো যো স্কিন গ্রাফটিং করায়ি থি, কুছ দিন পহলে, উসিকো লেকে কুছ প্রবলেম হুয়া। আ লেডি ইন্সপেক্টর ফ্রম কলকাতা ওয়াজ় টকিং লাইক দিস।”
শোনামাত্র ছ্যাঁত করে উঠল মনুর বুক!
“ওকে মায়া, লেট মি সি,” বলে লাইনটা কেটেই ফোন করলেন মুম্বইয়ে, যে রাজনৈতিক দলটাকে প্রতি মাসে মোটা টাকা ফান্ডিং করেন সেই দলের সর্বোচ্চ স্তরের এক নেতার ব্যক্তিগত লাইনে।
ফোনে খুব শীতল শোনাল নেতাজির গলা, “বোলিয়ে মনুভাই।” মনুর কানে ঠক করে বাজল সেটা।
“আপলোগোঁকে রহতে হুয়ে, মেরে লিয়ে ভেরি স্পেশাল কিসিকো ইস তরহা উঠাকে লে গয়া, অর আপ সব খাড়ে খাড়ে তামাশা দেখতে রহে গয়ে!”
রাগে থরথর করে কাঁপছিলেন মনু।