ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
লেবুদা আমার ভুরু কুঁচকে যাওয়া দেখে থতমত খেল একটু। তার পর বলল, “মানে, ইয়ে, লামাদাদুর ওখানে যাস না অনেক দিন। কেন রে? লামাদাদুর থেকে টাকা মেরেছিস?”
“টাকা মারব কেন?” আমি অবাক হলাম।
লেবুদা বলল, “কবে সেই পাখির বসার জায়গাগুলো চোর এসে ভেঙে দিয়ে গিয়েছে। তুই তৈরি করে দিয়েছিলি। লামাদাদু আর ঠিক করাল না। বলে, পুঁটি এসে করবে।”
আমি দেখলাম বৃষ্টি বাড়ল। আমি সরে গিয়ে রাস্তার পাশে খাটানো একটা প্লাস্টিকের তলায় দাঁড়ালাম। লেবুদাও সরে এল। আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। মাথা নিচু করে নিলাম।
লেবুদা বলল, “বল, লামাদাদুর ওখানে যাস না কেন? লামাদাদু কত ভালবাসে তোকে! আর জিনিসটা ঠিক করে দিতে পারিস তো! বচ্চন হলে কবে ঠিক করে দিত! আর সাবুর কী খবর রে? তোরা বিয়ে করছিস কবে!”
বিয়ে! আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম! কিসের থেকে কী! আমার সত্যি কিছু বলার নেই। আমি কেন যাই না তার কোনও সঠিক ব্যাখ্যা নেই। আমার আসলে আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু বুঝি যে, পৃথিবী সেটা মানতে চায় না।
আমি বললাম, “যাব।”
লেবুদা ঘড়ি দেখল, “অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। বড্ড বাজে কথায় দেরি করিয়ে দিলি। শোন লামাদাদুর কথা না ভাবিস, পাখিদের কথাটা তো ভাববি! পাখিদের কথা আর সাবুর কথা, ভাবিস।”
অফিসে ঢুকলাম কিছুটা ভিজেই। বৃষ্টি জোরে শুরু হয়েছে। আমি বাইরের ম্যাটে পা মুছে দ্রুত ওপরে গেলাম। বাবাকে নিয়ে বাড়ি যেতে হবে। অফিসে ঢোকার মুখে দেখেছি বাবার গাড়িটা রাখা আছে। কী দরকার এই আবহাওয়ায়, এই শরীরে অফিসে আসার!
বাবার ঘরে ঢোকার আগে আমি নিজের ঘরে গেলাম। রিজু নেই। বেরিয়েছে কোথাও। আমি সব কাগজপত্র ড্রয়ারে রেখে চাবি দিলাম। তার পর বাবার ঘরের দিকে গেলাম।
বাবা একাই বসেছিল। সামনে একটা বই খোলা।
বাবাকে বেশ কিছু দিন পরে এই বড় চেয়ারটায় বসে থাকতে দেখে বুঝলাম, বাবা বেশ রোগা হয়ে গেছে। কেমন যেন সামান্য কুঁজোও। ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে চোখমুখ।
বাবা আমায় দেখে মুখ তুলল। বলল, “কী রে, কথা হল?”
আমি উত্তর না দিয়ে বলল, “তুমি বাড়ি চলো আমার সঙ্গে!”
বাবা একটু থমকাল। ভুরু কুঁচকে বলল, “বাগালে কী বলল, বল।”
আমি চোয়াল শক্ত করলাম। তার পর সংক্ষেপে বললাম সবটা।
বাবা বলল, “ঠিক আছে। তুই ছোটকে দিয়ে দে পেপারগুলো। ও ঠিক করে দেবে কে যাবে।”
আমি তাকালাম বাবার দিকে। বললাম, “না, আমি ব্যবস্থা করব।”
“কেন?” বাবা আবার ভুরু কুঁচকে তাকাল।
আমি শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বললাম, “কেন এই শরীরে অফিসে এসেছ তুমি? যে যার ধান্দায় তো ভালই আছে। তুমি বেকার কেন আমাকে আর মাকে বিপদে ফেলছ নিজের শরীর খারাপ করে!”
বাবা সামান্য চমকে গেল। স্বাভাবিক। যে কোনও দিন আরশোলা মারেনি, সে বাঘ মেরে, তার লেজ ধরে দোলাতে দোলাতে এসে সামনে ফেলে দিলে লোকজন অবাক হবে না?
বাবা বলল, “কী হয়েছে বাবু? কী হয়েছে তোর? কী বলছিস?”
আমি মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
বাবা বলল, “বল আমায়।”
বাবার এই গলার স্বর আমি চিনি। ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে এর মানে। বাবা এই দুটো শব্দের মধ্যে দিয়ে আমায় বলছে, এ বার বলে দে, আমায় যেন আর না বলতে হয়। কারণ বলতে হলে ব্যাপারটা তোর কাছে খুব একটা প্রীতিপ্রদ হবে না।
আমি মাথা নিচু করে নিজেকে গোছালাম। তার পর দার্জিলিঙে আমায় যা যা বলেছিল চন্দন সিং, সব বলে দিলাম।
বাবা সব শুনে হাসল। তার পর বলল, “লোকটার টেনাসিটি আছে। পিয়োর ইভিল! অত অবধি গিয়েছে তোকে ফলো করে! আর অত টাকা দেবে! এই কাজে কম কোট করলে লাভ হবে তো অত! এ সব লোক যা খুশি তা-ই বলে। কাজ করে দিলে দেখবি এক টাকাও ঠেকাচ্ছে না। আর একটা কথা শোন, এর সবটা আমি জানি। কারণ কোনওটাই দাদার বা ছোটর একার প্রপার্টি নয়। আমাদের সবার সমান ভাগ আছে এতে।”
“মা জানে?” আমি অবাক হলাম।
“হ্যাঁ। তোদের জেনারেশনের কেউ জানে না! সময়ে তো জেনে যাবেই। অত তাড়া কিসের!”
আমি লজ্জায় মরে গেলাম যেন! ছিঃ ছিঃ, জেঠুকে ছোটকাকে আমি একটা বাজে লোকের কথায় সন্দেহ করলাম! মনে হল নিজের জুতো খুলে নিজেকেই পেটাই।
বাবা বুঝল হয়তো আমার মুখ দেখে। স্বাভাবিক। আমার বাবা তো!
বাবা বলল, “ঠিক আছে। কনফিউশন থাকলে ক্লিয়ার করে নেওয়া ভাল। এতে চন্দন কেমন লোক সেটা বুঝলি, আর ইন ফিউচার নিজের লোকদের ওপর সন্দেহ করবি না।”
আমি অস্ফুটে ‘সরি’ বললাম। আমার সত্যি মাথার ঠিক নেই এখন। এ সব কী করছি আমি!
বাবা বলল, “শোন, তোর মায়ের এক বান্ধবী বিদেশ থেকে কিছু ছবি ইমেল করেছে। তোর মায়ের তো ইমেল অ্যাকাউন্ট নেই, তাই তোরটা দিয়েছিল। পেনড্রাইভ করে ছবিগুলো বাড়ি নিয়ে যাবি। পনেরো মিনিট পরে বেরোব আমি। আমার সঙ্গেই যাবি। বুঝলি! যা এখন, ছবিগুলো নিয়ে নে।”
আমি বাবার ঘরের বাইরে বেরলাম। দেখলাম ছোটকা আসছে করিডর দিয়ে। আমার কী মনে হল, এগিয়ে গিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম মানুষটাকে। আচমকা জল এল চোখে।
“আরে কী হল!” ছোটকা হেসে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, “বাবা বকেছে?”
আমি সেই ছেলেবেলার মতো গন্ধ পেলাম ছোটকার গায়ের থেকে। ঠাসা আলমারি খুললে যে ভাবে জিনিস হুড়মুড়িয়ে পড়ে যায়, সেভাবে কত স্মৃতি যে ঝরে পড়ল মনের ভেতর।
আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, “না এমনি। কত দিন তোমায় এ ভাবে ধরিনি!”
ছোটকা বলল, “পাগলা! মোবাইল ইউজ় কর আবার। অন্যের অফিস থেকে ফোন করছে! কী যে শুরু করেছিস!”
আমি বললাম, “বাগালে কিছু পেপার দিয়েছে। আমি কাল বলব সব তোমায়।”
ছোটকা আমার চুল ঘেঁটে দিয়ে হেসে বলল, “বলিস। পাগলা!”
আমি নিজের ঘরে এসে কম্পিউটার অন করে মেল খুললাম। কত দিন পরে যে নিজের মেল খুললাম! বেশ কিছু মেল জমেছে। তবে সবার ওপরে মায়ের বান্ধবীর ইমেল। অ্যাটাচমেন্ট যে আছে সেটা মেল-এর পাশে জেমস ক্লিপের চিহ্ন দেখেই বুঝেছি। কিন্তু সেটা খুলতে গিয়েও কী যে মনে হল আমি স্ক্রল করে এমনি এক বার নীচের মেলগুলোয় চোখ বোলালাম। আর তখনই আমার চোখ আটকে গেল আর একটা মেল-এ।
কী রকম নাম এটা! ‘আমার নিজের চিঠি’! এমন ইমেল আইডি থেকে কে মেল করল আমায়! আর এটাতেও সেই জেমস ক্লিপের চিহ্ন!
আমি কৌতূহলবশত ক্লিক করলাম মেলটায়। খুলে গেল। চারটে ছবি। কিসের ছবি? ভাইরাস নয় তো! কিন্তু তাও ক্লিক করলাম প্রথম ছবিটার ওপর।
খুলে গেল ছবি, আর আমি থমকে গেলাম একদম। এটা কী!
আমার চট করে মনে পড়ে গেল সেই ভোররাতের স্বপ্ন! এনা! অন্য একটা ছেলে! তা হলে কি ভোররাতের স্বপ্ন সত্যি হয়?
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম হ্যাঁ, ছবিতে এনা যে জামাটা পরে রয়েছে সেটা আমিই ওকে কিনে দিয়েছিলাম গত বারের পুজোয়।
১৪
সাবু স্কুটিটা যে এ ভাবে উলটে যাবে, বুঝতে পারিনি। আসলে আমাদের এখানে রাস্তা আর ফুটপাতের মধ্যে কোনও তফাত নেই। বাইরে বেরোলে আমি তো অনেক সময় বুঝতে পারি না রাস্তায় হাঁটব, না ফুটপাত দিয়ে হাঁটব। অধিকাংশ ফুটপাতে হকাররা বসে রয়েছে। তাদের দোকান নিশ্চয় নামকরা হেল্থ ড্রিঙ্ক খায়, না হলে ক্রমাগত অমন বাড়ত না। আর হকার ছাড়াও আছে মানুষ। হ্যাঁ, ফুটপাতে সংসার করা হাজার হাজার মানুষ। তারা উনুন জ্বেলে, তরকারির খোসা, মাছের আঁশ, মুরগির ছাল-চামড়া ছড়িয়ে সব কিছু কেমন যেন নরক করে রাখে। গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে। তাদের ছড়ানো-ছিটোনো সাংসারিক বিষয়-আশয়ে হাঁটাই দায় হয়ে পড়ে!
আবার অন্য দিকে ভাবি, আমি এদের মধ্যে এসেই আমাদের ‘ফুড ব্যান্ডিট’-এর খাবার দিই। তাই আরও কাছ থেকে দেখে বুঝি যে কতটা কষ্টে এরাও থাকে! মানুষ হিসেবে যে ন্যূনতম সম্মান আমাদের পাওয়া উচিত, সেটুকুও এরা কেউ পায় না।
এর পর আর-এক রকমের ঝামেলা হল প্রোমোটারি কাজের জন্য ডাঁই করে রাখা বালি আর স্টোন চিপের পাহাড়। সাধারণ লোকজনের হাঁটার কোনও ব্যবস্থাই যেন আর অবশিষ্ট নেই।
আরও মজা হল সিগনাল এড়াবার জন্য ফুটপাতের ওপর দিয়ে বাইক বা স্কুটার নিয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাওয়া। সবার কিসের যে এত তাড়া কে জানে! এমনই একটা ফুটপাত থেকে আচমকা নেমে আসা একটা বাইকের ধাক্কায় আমি স্কুটি সমেত উলটে পড়েছিলাম।
যে লোকটা ধাক্কা দিয়েছিল সে মাঝবয়সি। আমায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে নিজেই প্রথমে চোটপাট করছিল। কেন আমি দেখিনি যে, ও বাঁ দিকের ফুটপাত দিয়ে এসে রাস্তায় নামবে। আমি রাগ করব কী, খানিক ক্ষণ তাকিয়ে লোকটার উত্তেজিত নাচনকোঁদন দেখে হেসেই ফেলেছিলাম। ডান পায়ে খুব লেগেছিল আমার। মনে হচ্ছিল, ভেঙে গেল না কি! তাও আমি হেসেছিলাম খুব। লোকটা আমার অবস্থা দেখে কী করবে বুঝতে পারছিল না। মানে এমন করে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েও যে কেউ হাসতে পারে, সেটা বোধহয় জীবনে প্রথম বার দেখল!
বিকেল শেষ হয়ে আসছিল তখন। রাস্তায় গাড়ির ভিড় ছিল ভালই। আমি পড়ে যাওয়ায় বেশ জ্যাম লেগে গিয়েছিল চারিদিকে। আমায় সাহায্য করতে এক জন সার্জেন্ট আর এক জন সিভিক পুলিশ এগিয়ে এসেছিল। লোকজনও জড়ো হচ্ছিল। পাবলিক আমার হয়েই লোকটাকে ঝেড়েছিল খুব। ব্যাপারটা মারামারি অবধি গড়াতেই পারত, কিন্তু পুলিশ থাকায় আর গড়ায়নি।
আমার স্কুটিটার সামনের হ্যান্ডেল বেঁকে গিয়েছিল। আমি রাস্তার পাশে বসেই বাবাকে ফোন করে দিয়েছিলাম।
বাবার আসতে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট মতো লেগেছিল। পুলিশ আর পাবলিক মিলে ওই লোকটাকে ধরে রেখেছিল বাবা না আসা অবধি। মানুষজন বলছিল, লোকটাকে আমার চিকিৎসার খরচ আর স্কুটি রিপেয়ারের খরচ দিতে হবে।
কিন্তু বাবা এসে প্রথমেই লোকটাকে ছেড়ে দিতে বলেছিল। তার পর একটা টো-ট্রাকের ব্যবস্থা করে স্কুটিটাকে গারাজে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল।