ছবি: কুনাল বর্মণ।
আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, আপনার বান্ধবী হলেও টিকবে না। আপনি যদি গলা ব্যথা নিরাময়ের জন্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের নিদান দেন, তা হলে কে টিকবে বলুন তো!”
“টোটকাটা কিন্তু কার্যকর!”
“মা গো মা! আচ্ছা, এ রকম আরও কয়েকটা টোটকার কথা বলুন তো শুনি।”
“সত্যি শুনতে চাইছেন?”
“সত্যি আপনার সঞ্চয়ে এ রকম আরও আছে? মা গো! কী যাচ্ছেতাই মানুষ! বলুন, বলুন, শুনি!”
“এটা আমার কলেজে পড়ার সময়কার গল্প। আমি ছেলেদের স্কুলে দিন কাটিয়ে তখন এসে পড়েছি কলেজের মহাসমুদ্রে। এসেই দেখি টকাটক প্রেমে পড়ছে লোকে। সৈনিকরা যেমন টকাটক গুলি চালায়, তেমনি ঝপাঝপ সব প্রেমে পড়ছে। প্রেমে পড়ছে, আবার প্রেম ভাঙছে। ভাঙছে, আবার জোড়া লাগছে। তখন একটা মেয়েকে দেখি এক দিন মুখ ভার করে লাইব্রেরির সামনে বসে আছে। আমার সঙ্গে তো সকলেরই ভাব। আমি জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। সে তো বলতেই চায় না। তার পর অনেক সাধ্যসাধনার পর বলল, তার নতুন প্রেমিক আর তার সঙ্গে কথা বলছে না! আমি শুনে বললাম, উপযুক্ত শিক্ষা দে। রোজ সাদা থান পরে কলেজে আয়। আর কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলবি...”
“ইশশ! জঘন্য! আমি ভাবলাম আপনি বোধহয় আপনার সঙ্গে প্রেম করতে বলবেন! সত্যি, এটা সবচেয়ে খারাপ টোটকা।”
“খারাপ?”
“ভয়ঙ্কর খারাপ। দেওয়াল থেকে বিরক্তি ঝরে পড়ার মতো!”
“দেখলেন তো, আমি বলেছিলাম আপনাকে।”
“আপনি কিন্তু খুব গোলমেলে লোক! আপনি বিরক্তিকর, জঘন্য ঘটনাগুলোও এমন ভাবে সাজিয়ে তোলেন যে বার বার মনে পড়ে। রাগও হয়, হাসিও পায়, আবার গা-ও রি রি করে।”
“কেন, তা বলে গোলমেলে লোক কেন আমি?”
“গোলমেলে নন? আপনাকে চিনি না, এই সপ্তাহের আগে আপনার নাম শুনিনি, মুখ দেখিনি, আর আজ মুন্সিয়ারির কোলে বসে আপনার সঙ্গে প্রাণের মনের গল্প করছি!”
“তমা ম্যাডাম, এটা নিয়ে কোনও টিপ্স দেব?”
“এটা নিয়েও টিপ্স? না! গরিমা ফিরে বুঝতেই পারবে না, কে সুরা টেনেছে, জীবেশ না আমি! তা বলুন, কী টীকা-টিপ্পনী আছে, শুনে নিই!”
“যখন এ রকম হবে যে, মন বলছে পেটের কথা সব উপুড় করে দিই, যখন অচেনা লোকের কাছেও মনে হয় সব গোপন কথা বলে ফেলি, তখন টুক করে তার সঙ্গে আড়ি করে দেবেন! তার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেবেন। গম্ভীর হয়ে যাবেন ততটাই, যাতে লোকে আপনাকে প্রশ্ন করতেও সমীহ করে!”
“কী হল আপনার, বল্লালবাবু?”
“না না, কিছু হয়নি, একটু মজা করলাম।”
“আপনি এত গম্ভীরই বা হয়ে গেলেন কেন!”
“কোথায় গম্ভীর? এই তো হাসছি।”
“মোটেই হাসছেন না। হাসিটা লুকিয়ে ফেলেছেন কোথাও। বের করুন মশাই, বের করুন। আপনাকে গম্ভীর হলে মানায় না।”
“আমায় তো এ সপ্তাহের আগে চিনতেন না।”
“চেনার দরকার নেই, আপনি হাসুন প্লিজ়।”
“আসছে, আসছে। দাঁড়ান, আসছে। অর্ডার করেছি, চলে এল বলে।”
“আপনার সঙ্গে এ রকম ঘটনা ঘটেছিল, না?”
“এই যে এসে গেছে বিশুদ্ধ হাসি, নিন, দাঁত বের করে প্রাণখোলা হাসি এখন আপনার দরবারে!”
“সেটাও কি কলেজ জীবনে? হঠাৎ করে আড়ি?”
“নিন, এত ক্ষণে কফি এল। দাও ভাই, দাও।”
“আপনার মতো মানুষের সঙ্গে এটাই হয় জানেন, যারা সহজ তারা নিজেদের দাম পায় না। আর যারা দাম দেখায়, তারা তাদের যোগ্যতার থেকে বেশি দাম পেয়ে যায়।”
“কফিটা নিন, তমা দেবী! উষ্ণ! ধূমায়মান।”
“আচ্ছা, এটা কি সত্যিই আপনার নাম, না কি ছদ্মনাম নিয়েছেন?”
“আপনার গরিমা কিন্তু আজ আর আসবে না।”
“না, না, আসবে। আপনার ভবিষ্যদ্বাণী মিলবে না। এতগুলো ছেলেমেয়ের দায়িত্ব আছে না!”
“আমরা তা হলে পুনরায় প্রশ্নে ফিরি? কিছু একঘেয়ে ও বিরক্তিকর প্রশ্নে!”
“ঠিক, ঠিক, সেটাই ভাল। উপভোগ করা যাবে।”
“এক বার দেখে আসবেন, জীবেশবাবুকে?”
“ও বাবা! এখন কি ও আর ওর মধ্যে আছে?”
“তাই তো বলছি! আপনি গেলে ও হয়তো ভাববে বর্ণালী ফিরে এসেছে ভুল বুঝতে পেরে!”
“ঠিক বলেছেন! হয়তো কেঁদে বলবে... দাঁড়ান, দাঁড়ান! আপনি জীবেশের জীবনের ঘটনা জানেন?”
“ওই, ওইটুকুই!”
“কিন্তু ওইটুকুও তো জানার কথা নয়। আপনি ওর বন্ধু নন। ও আবার নিজের জীবনের কথা কাউকে বলে না। আমরা এক সঙ্গে চাকরি করি বলে সামান্য কিছু জানি। কিন্তু আপনি?”
“আমি কিছুই জানি না। আপনাদের কথাবার্তাই জুড়ে অনুমান করেছি, সেটা মিলে গেল। তার বেশি কিছু নয়।”
“আপনি লোকটা যে কেমন, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না! আপনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, আপনি অনুমান করেন, আপনি কথাবার্তা মন দিয়ে শোনেন, আবার জুড়তেও পারেন।”
“কিছুই পারি না, ম্যাডাম। আমার ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ করে আপনার বান্ধবী এখনই ফিরে আসছেন!”
“আপনি বুঝলেন কী করে? আপনি তো এখানেই বসে রয়েছেন!”
“নীচে ছেলেমেয়েদের গলা শুনতে পেলেন না, ‘হাই ম্যাম, হাই ম্যাম!’ কাকে বলল ওরা? দেখবেন, এখনই সিঁড়ি ভেঙে উনি উঠে আসবেন। কফি অফার করে দেখতে পারেন, উনি খাবেন না।”
“আশ্চর্য! আপনি কথা বলছেন আমার সঙ্গে আর লক্ষ রাখছেন সর্বত্র। আপনি কি গোয়েন্দা?”
অতঃপর
ব্যস্ত পায়ে ডাইনিংয়ে ঢুকে বল্লাল আর তমাকে দেখে ধপাস করে তমার পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়ল গরিমা। শীতের দেশেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বেড়াতে এসেও তার হাবভাবে ব্যস্ততা। অবসরের পর্বেও তার চোখে-মুখে শঙ্কার ছাপ। কেন কে জানে শৈলশহরে রাত দ্রুত ঘন হয়। এখন তো নৈশাহারের সময় প্রায় হয়ে এল। তাও কফি খাওয়ার জন্য প্রস্তাব করল বল্লাল। বল্লাল: আমরা অনেক ক্ষণ আপনার সঙ্গে কফি খাব বলে অপেক্ষা করছি।
গরিমা: না না, এখন আর কফি খাওয়ার সময় হবে না। কাল বেরোবার আগে বরং এক সঙ্গে কফি খাওয়া যাবে। হ্যাঁ রে তমা, এ দিকের খবর কী? সব ঠিক আছে?
তমা: এ দিকে আর কী হবে? বসে বসে সময় কাটছিল না। ছেলেমেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে। আমরা কফি খেয়ে আর ঘড়ি দেখে সময় কাটাচ্ছি।
গরিমা: হ্যাঁ রে, জীবেশের খবর কী? আমি বেরোবার সময় তো দরজায় নক করে দেখলাম ভেতর থেকে বন্ধ। দরজা খুলল না। কিছু বলেছে?
তমা: আমি তো ওকে বেরোতেও দেখিনি। কী বলবে সেই ভয়ে আমি আর দরজায় নকও করিনি।
গরিমা: যাক, ভালই হয়েছে। ও জানল, আমি বেরোইনি। শোন, ওকে কিছু বলতে যাস না।
তমা: আমার বয়ে গেছে ওর কাছে গিয়ে তোর কথা বলতে। ওর তোকে নিয়ে খেয়ালও নেই। কেমন হল তোর ঘোরা?
গরিমা: আর বলিস না, কথা তো শেষ হয়ই না আমার দিদি-জামাইবাবুর।
তমা: তোর দিদি? কবে হল?
গরিমা: নিজের দিদি নয়, তুতো। কিন্তু নিজের থেকেও বেশি। আমায় তো আসতেই দিতে চাইছিল না। বলছে, থেকে যা। কাল সকালে যাস। আমি তো দোলাচলে পড়ে গিয়েছিলাম! শেষে বলে এলাম, আচ্ছা দেখি, ওদের বলে, যদি কাল ম্যানেজ করা যায়। হ্যাঁ রে, শোন না, কাল এখানে ডুব দেব বাবু? ধর, সারা দিনের কাজ সেরে এসে আজকের মতোই চলে যাব। তার পর... কী রে, পারবি না সামলাতে?”
তমা: চাপ নিচ্ছিস কেন? এখানে বসে থেকেই বা কী করবি! যাবি! এখন তো আগে চেঞ্জ কর। সবাই এক সঙ্গে গল্প করতে করতে ডিনার করব!
গরিমা: আজ আমায় বাদ দে, তমা! আসলে দিদির কথা ফেলতে পারলাম না, ওর হোটেলেই ডিনারটা করে ফেললাম! আজ তোরা খেয়ে নে। আমি চেঞ্জ করে ঘরে তোর জন্য অপেক্ষা করি সোনা? আর এই যে মশাই রাজাবাবু, আজ আপনার সঙ্গে আলাপ হল না, তোলা থাকল!”
তমা: রাজাবাবু? ওঁর নাম রাজা না কি?
গরিমা: রাজা ছাড়া কী... বল্লাল, কণিষ্ক এ সব নাম কি সাধারণ মানুষের হয়? গুড নাইট, রাজাবাবু!
পর্বান্তর
সব পরিস্থিতিরই আলাদা আলাদা ঘ্রাণ, ভাল লাগা, খারাপ লাগা থাকে। দু’জনের কথা বলা, কথা শোনার মায়াবী সন্ধ্যা তৃতীয় জনের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বদলে হয়েছিল আনুষ্ঠানিক। ওদের মাঝখানে গরিমা এসে বসল যেন নিজের কথাটুকু শোনানোর জন্য। আর বলা হতেই উঠে পড়ল সে। চলে যাওয়ার সময় তার শরীর থেকে উগ্র সুগন্ধীর উপস্থিতি নাকে এল তমা, বল্লালের। হয়তো একটু খটকাও লাগল।
একই রকম দ্রুতপায়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল গরিমা। সে দিকেই এত ক্ষণ তাকিয়েছিল তমা। দরজা বন্ধ হতে তার দৃষ্টি ফিরে এল সামনে বসা বল্লালবাবুর দিকে। লোকটা প্রায় তারই বয়সি। সামান্য ছোটও হতে পারে। একমাথা কোঁকড়া চুল। চোখে চশমা। তার পিছনের চোখদুটো খুব উজ্জ্বল নয়। সপ্রতিভ তো নয়ই। যেন সরোবরের জলে অনুজ্জ্বল শাপলা ফুলের মতো ভাসছে চোখদুটো। ছেলেটা এই প্রথম এত কথা বলল। এই ক’দিন মনে হত সে কথা কম বলে। ছেলেটা গায়েপড়া নয়, দাম্ভিকও নয়। বেশি কথা বলেনি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে, কিন্তু মিশে থেকেছে সহজে। জ্ঞান বিতরণ করেনি, কিন্তু কাজের কথা বলেছে। উৎসাহ দেওয়ার মতো প্রসঙ্গও আছে তাতে। এখন তমার মনে হল, লোকটা কেমন তা সে এক বর্ণও বুঝতে পারছে না। তার ভাবনার সূত্র ছিঁড়ল বল্লালের কথাতেই...
“এখন খাবেন না কি আর এক বার কফি?”
“কে বলল আপনার ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ?”
তমার প্রশ্ন শুনে সরাসরি কোনও উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলেন বল্লাল। তাঁর দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তমা বলল, “গত চার বছর ধরে আমরা এক কলেজে পড়াচ্ছি। পেশাগত জায়গা ছাড়িয়েও আমরা দু’জন ভাল বন্ধু। আমি জানি না, আপনি ওকে আগে থেকে চিনতেন কি না! কিন্তু এ ভাবে কী করে মেলাতে পারলেন বলুন তো? আপনি গোয়েন্দা না জ্যোতিষী? আমি কিন্তু বুঝতে পারছি না আপনাকে।”
“আমি কিছুই করিনি ম্যাডাম, আমি ঠাট্টাইয়ার্কি একটু পছন্দ করি। সেটা যদি মিলে যায় তো আমি কী করব বলুন! আমি কলেজে পড়ার সময়ও এরকমই করতাম৷ একবার কী হয়েছিল জানেন তো?”
“কোন কলেজ ছিল আপনার? কোন বিষয়? আচ্ছা থাক, সেসব পরে হবে। গল্পের ছন্দ কেটে যাবে। বলুন, কী হয়েছিল?”