বিচিত্র: দাড়ি-গোঁফওলা মোনালিসা। শিল্পী মার্সেল দুশাম্প
ছবি আঁকা চলছে। সামনে বসে থাকা মাদাম লিসার মুখে কিন্তু হাসি নেই। বছর কয়েক আগে তিনি তাঁর কন্যাসন্তানকে হারিয়েছেন। এখন তাঁর একটা নতুন বাড়ি হচ্ছে বটে, এবং সম্ভবত তিনি সন্তানসম্ভবা, তবু এই সুন্দরীকে দেখে মনে হচ্ছে যেন এক বিষাদপ্রতিমা। শিল্পী লেয়োনার্দোর ফ্লোরেন্সের এই স্টুডিয়োতে বাজনদার এল, এমনকী এক জোকারও— যদি তাতে মাদামের মনটা একটু চাঙ্গা হয়, অধরোষ্ঠে ধরা পড়ে আনন্দের মৃদু কম্পন। ক্ষণিকের সেই হাসি শিল্পী দ্রুত বন্দি করে নেবেন তাঁর ছবির ভিতরে। হেসেছিলেন তিনি নিশ্চয়ই। আর সারা দুনিয়াকে অদ্যাবধি বিস্মিত করে রেখেছে মোনালিসার সেই অনন্যসাধারণ হাসি।
ভুবনমোহিনী এই হাসি নিয়ে পরে পরে হয়েছে বিস্তর চর্চা। তবে সবচেয়ে উত্তেজকটি হল, হাসিটি আদৌ ‘লা জ্যকোন্দা’ ওরফে মাদাম লিসা গেরাদিনিরই নয়। সালাই—শিল্পী লেয়োনার্দো দা ভিন্চি-র ছাত্র ও সমকামী সঙ্গীই নাকি বিখ্যাত ‘মোনালিসা’ ছবির হাসি ও মুখের নীচের চোয়ালের মডেল। যদিও এ তথ্যকে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম তেমন মান্যতা দিতে রাজি নয়।
বস্তুত, দুষ্পাঠ্য শিলালিপির মতো এই উদ্যাপিত রহস্যের পিছনে রয়েছে শিল্পীর এক সূক্ষ্ম করণকৌশল। একটু খুলেই বলা যাক। যদি মোনালিসার ঠোঁটকে আলাদা করে দেখা হয়, তবে সেই হাসি তাঁর মাধুর্য হারায়। মোনালিসার হাসি তখনই বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে, যখন দর্শক ছবিটির চোখের দিকে একটু বেশি মনোযোগী হন। দু’চোখের প্রান্তের ঊর্ধ্বমুখী অন্ধকার মোনালিসার হাসির সঙ্গে মিলেমিশে তাকে নিয়ে যায় এক রহস্যের পূর্ণতায়। এক কথায়, দর্শকের ‘ইনডায়রেক্ট ভিউয়িং’-য়েই লুকিয়ে আছে এর আসল আকর্ষণ। এ যেন এক মরীচিকা। ‘ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না’ গোছের এক অনন্ত বিভ্রম।
ফ্লোরেন্সের ব্যবসায়ী ভদ্রলোকটির পছন্দ হয়নি বুঝি তাঁর স্ত্রীর ছবিটি? তাই কি লেয়োনার্দো তাকে পালটে দিতে বাধ্য হলেন? হতেই পারে। কারণ মোনালিসার নীচের স্তরে আবিষ্কৃত হয়েছে আর এক মোনালিসা। নীচের স্তরের মোনালিসা আমাদের দেখা উপরিতলের মোনালিসার থেকে বেশ কিছুটা আলাদা।
কিন্তু শেষরক্ষা তো হল না। অর্ডারি ছবি নইলে কি আর শিল্পীর কাছেই থেকে যায়?
গত দুই শতক জুড়ে মোনালিসা একটি নির্দিষ্ট ছবির গণ্ডিকে অতিক্রম করে ধীরে ধীরে একটি বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়ে ওঠে। বইয়ের অলঙ্করণ, বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে রাস্তার দেওয়ালের গ্রাফিতি— সর্বত্রই সেই চেনা মুখ।
১৯১৯ সালে আমেরিকান শিল্পী মার্সেল দুশাম্প সস্তা পোস্টকার্ডে ছাপা মোনালিসার ছবির ওপর পেনসিলে দাড়ি-গোঁফ এঁকে তাকে শিল্পকর্মে পরিণত করে ফেললেন। দীর্ঘ কাল ধরে জনমনে গড়ে ওঠা মোনালিসার মোহাবিষ্ট চেতনাকে আক্রমণ করাই হয়তো উদ্দেশ্য ছিল তাঁর। না কি একই সঙ্গে মোনালিসার অন্তর্গত এক পুরুষের অস্তিত্বের প্রতিও ইঙ্গিত ছিল শিল্পীর? এই ছবির নিচের অংশে তিনি লিখলেন L.H.O.O.Q— ফরাসিতে পর পর উচ্চারণ করলে এটি একটি অশ্লীল বাক্য হয়, যার অর্থ— ‘এর নীচে আগুন রয়েছে’। সালভাদোর দালি মোনালিসার মুখের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন নিজের মুখ আর তার পুরুষালি হাতে ধরিয়ে দিলেন অসংখ্য মুদ্রা। আমেরিকান গ্রাফিতি-শিল্পী ব্যাঙ্কসি দেওয়ালে আঁকলেন সশস্ত্র মুজাহিদিন মোনালিসা। কত শিল্পীই যে মোনালিসাকে কত ভাবে হাজির করেছেন, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। পপ শিল্পী অ্যান্ডি ওয়ারহল থেকে কিউবিস্ট ফারনান্দ লেজে, রবার্ট রশেনবার্গ থেকে স্যুরিয়ালিস্ট রেনে মাগ্রিত— তালিকা দীর্ঘ। ১৯৭৭ সালে শিল্পী যোগেন চৌধুরী আঁকলেন ‘মোনালিসা ইন মাই ড্রিম’। তাঁর চিরাচরিত স্টাইলে প্যাস্টেল আর কলমের কাটাকুটিতে ধর্মান্তরিত করলেন লা জ্যকোন্দা-কে। পরনে তার ঢাকাই শাড়ি হয়তো নেই, কিন্তু কপালে, থুড়ি সিঁথিতে সিঁদুরের উজ্জ্বল উপস্থিতি।