Mahisbathan Jamidarbari

ভেড়ির জল থেকে লবণ তৈরি করে শুরু সত্যাগ্রহ

কলকাতায় সেই প্রথম। রাস্তা দেখিয়েছিলেন গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত মহিষবাথানের জমিদার। এখনও রয়েছে সেই জমিদারের অট্টালিকা, লবণ তৈরির মাঠ। রয়েছে জাতীয় শিক্ষালয়, যার উঠোনে চলত চরকায় সুতো কাটা। এখন ভেড়িগুলোর অধিকাংশই বুজিয়ে ফ্ল্যাট উঠে গিয়েছে। জমিদারবাড়ির দিকেও শ্যেনদৃষ্টি প্রোমোটারদের। কালের গর্ভে অবলুপ্তিই কি এই ইতিহাসের ভবিতব্য?

Advertisement

আর্যভট্ট খান

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:২৫
Share:

ঐতিহ্যবাহী: মহিষবাথানের জমিদারবাড়ি

তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামছে। সূর্যের শেষ ছটা ভেড়ির জলে পড়ে ভেসে যাচ্ছে দূরে কোথাও। স্থানীয় লোকজন মাছ ধরার জাল গুটিয়ে বাড়ির পথে রওনা দেওয়ার তোড়জোড় করছেন।

Advertisement

মহিষবাথান গ্রামে ভেড়ি সংলগ্ন বড় মাঠে বসানো রয়েছে বিশাল সব মাটির হাঁড়ি। হাঁড়িতে ভেড়িরই জল। ওই হাঁড়ির নীচে জ্বালানির মাধ্যমে জল ফোটানো হচ্ছে। এই জল মিষ্টি নয়। নোনতা। নোনতা জল থেকেই গ্রামবাসীরা পাতন প্রক্রিয়ায় তৈরি করছেন নুন।

কেমন করে তৈরি হচ্ছে লবণ?

Advertisement

জলকে অনেক ক্ষণ ফোটানোর পর হাঁড়ির নীচে পড়ে থাকা কাদামাটির সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে লবণও। মাটিযুক্ত লবণ থেকে পাতন প্রক্রিয়ায় লবণ আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। এর পর সেই লবণ পুঁটলি করে ছাইয়ের মধ্যে রাখলেই হয়ে যাচ্ছে ধবধবে সাদা নুন।

এই দৃশ্য প্রায় নয় দশকেরও বেশি আগের। তখন ১৯৩০ সাল। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধী ১২ মার্চ ৭৮ জন সত্যাগ্রহীকে নিয়ে শুরু করেছিলেন আইন অমান্য এবং লবণ সত্যাগ্রহ। মহাত্মা গান্ধী আমদাবাদের কাছে সাবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি পদযাত্রা শুরু করেন। তার পর ২৪ দিনে ৩৯০ কিলোমিটার হেঁটে ডান্ডি গ্রামে এসে আরব সমুদ্রের জল থেকে করমুক্ত লবণ প্রস্তুত করেন। অনেক ভারতীয়ও তাঁর সঙ্গে ডান্ডিতে এসেছেন। ১৯৩০ সালের ৬ এপ্রিল ভোর সাড়ে ছ’টার সময় গান্ধীজি লবণ আইন ভেঙে প্রথম লবণ প্রস্তুত করলেন। সেই সঙ্গে তার লক্ষাধিক অনুগামীও লবণ আইন ভেঙে ভারতে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করলেন।

সারা দেশ জুড়ে গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহের ঝড় উঠল। তার ঝাপটা এসে পড়ল বাংলায়, মেদিনীপুরে কাঁথিতে। সেখানেও লবণ সত্যাগ্রহ শুরু হল। কাঁথিতে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু কলকাতার উপকণ্ঠে মহিষবাথান ও তার আশপাশের গ্রামের মানুষরাও যে ভেড়ির লবণাক্ত জল থেকে লবণ তৈরি করে গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহে শামিল হয়েছিলেন, সে ঘটনা ইতিহাসে উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছেন সেই সব মানুষ, যাঁরা লবণ সত্যাগ্রহের সময় গান্ধীজির আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মহিষবাথানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কালের নিয়মে মুছে যেতে বসেছে সেই আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্নও।

মহিষবাথান, সল্টলেকের ভেড়ির জল নোনতা হল কী করে? মহিষবাথান এলাকায় সমুদ্র কোথায়? আজ থেকে একশো বছর বা তারও কয়েক বছর আগে তখনকার মহিষবাথান ও তার সংলগ্ন এলাকা ছিল এখনকার থেকে অনেকটাই আলাদা। সল্টলেক, নিউটাউন, রাজারহাট, মহিষবাথানের আজকের বহুতল আবাসনে বসে দূরে যে কয়েকটা ভেড়ি চোখে পড়ে, সেখানে তাকিয়ে আজ আন্দাজও করা যায় না যে, এই এলাকাই ছিল অধুনালুপ্ত বিদ্যাধরী নদী। একশো বছর আগেও কিছুটা বেঁচে ছিল বিদ্যাধরী। সুন্দরবনের সঙ্গে যুক্ত বিদ্যাধরীর অববাহিকা প্লাবিত হয়ে তৈরি হয়েছিল ভেড়ি ও হ্রদ। আর বিদ্যাধরীর নোনতা জলে ভেড়ির জলের স্বাদও নোনতা হয়ে গিয়েছে।

১৯৩০ সালে মহিষবাথানে যখন লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, তখন সেটা ছিল তৎকালীন বারাসত সাবডিভিশন এবং রাজারহাট থানার অধীন। বর্তমানের সল্টলেক এবং রাজারহাট নিউটাউনের মধ্যবর্তী গ্রাম ছিল মহিষবাথান। বিদ্যাধরী নদীর অববাহিকার এই মহিষবাথান ও সংলগ্ন গ্রামের মানুষজন ভেড়িতে মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁরা মাছ চাষের মাধ্যমে বিপুল আর্থিক কর্মকাণ্ডও শুরু করেছিলেন। পাশাপাশি এই গ্রামের মানুষ জড়িয়ে পড়েছিলেন বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে, সামাজিক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও।

এগুলির মধ্যে একটা ছিল গ্রামের ভেড়ির নোনা জল থেকে দেশীয় পদ্ধতিতে লবণ তৈরি করে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে শামিল হওয়া। আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন মহিষবাথানের প্রামাণিক বাড়ির মেজো ছেলে, জমিদার লক্ষ্মীকান্ত প্রামাণিক। পাতন প্রক্রিয়ায় লবণ তৈরি করে লবণ সত্যাগ্রহে শামিল হয়েছিলেন যে অসংখ্য গ্রামবাসী, তার অনেকটা কৃতিত্ব লক্ষ্মীকান্তের। মহিষবাথানে তাঁদের বিশাল ইমারতের নাম ছিল ‘লাল বাড়ি’। যা এখনও রয়েছে সেখানেই।

*****

খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেলাম নিউটাউনের আধুনিক শহরচিত্রের মধ্যে বেমানান বিশাল লাল অট্টালিকার সামনে। সামনে দিয়ে চলে গেছে নিউটাউন রোড। বাড়ির ঠিক সামনে বিশাল পুকুরে লাল বাড়ির প্রতিবিম্ব। চার দিকে বহুতল আর আইটি-র অফিসের মাঝে ওই বড় লাল বাড়িটা যেন এক টুকরো ইতিহাস, অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষ্য।

লোহার গেট দিয়ে ঢুকলে সামনে বড় মাঠ আর এক দিকে টানা এল আকৃতির বাড়ি। বাড়ির কাছে গেলে আর পাঁচটা পুরনো জমিদারবাড়ির মতোই অযত্নের ছাপ চোখে পড়ে। বিশাল বাড়ির বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়েছে। কিন্তু কোথায় গেলেন এখনকার শরিকরা? লক্ষ্মীকান্ত প্রামাণিকের বংশধররাই বা কোথায়?

ইতিউতি কয়েকটা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। বারান্দায় রাখা লম্বা টানা বসার জায়গায় দু’-একটা কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। বাড়ির ভাঙা অংশের এক দিকে একটা ঘরে আলো জ্বলছে। কিন্তু উঁকি মেরে দেখা গেল কেউ নেই। এমন সময় বারান্দার পিছন থেকে দু’জন মধ্যবয়স্ক পুরুষের এক জন বলে উঠলেন, “কাউকে খুঁজছেন?”

পরিচয় দিতেই বারান্দার একটা ঘর খুলে চেয়ারে বসতে বলে জানালেন, তাঁর নাম জয়ন্ত প্রামাণিক। তিনি লক্ষ্মীকান্তবাবুর নাতি।

একটা ঘরের তালা খুলে বসতে দিয়ে জয়ন্তবাবু বলেন, “আমার দাদু লক্ষ্মীকান্তরা ছিলেন চার ভাই। লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে বেশি নাম শোনা যায় শুধু আমার দাদুর। কিন্তু লক্ষ্মীকান্তর চার ভাই-ই লবণ সত্যাগ্রহর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আসলে লক্ষ্মীকান্ত মহিষবাথানের কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছিলেন বলেই বোধহয় ওঁর নামটা বেশি প্রচার পায়।”

আলমারিতে রাখা বংশতালিকা খুলে দেখান জয়ন্ত। তার পর বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালেন। বাইরের বারান্দা পেরিয়ে ওই লাল বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই যেন আবহ পাল্টে যায়। লম্বা বারান্দার ভিতরে ঢুকলেই দেখা যায় ঘরের বেশ কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। জানলা, বারান্দা আর ছাদে ফাটল। একটা ভাঙা ঘরের সামনে এসে জয়ন্ত বলেন, “এটাই ছিল আমাদের ঠাকুরঘর।” পুরো বাড়িতেই বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন তাঁদের পরিবারের শরিকরা। কিন্তু এত বড় বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ সহজ কাজ নয়।

ঘুরতে ঘুরতে তাঁদের বংশের উজ্জ্বল অধ্যায়ের কথা বলছিলেন প্রৌঢ় জয়ন্ত। ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন আড়াই একর জমির উপর পুকুর ও মাঠ নিয়ে বিশাল এলাকা। জয়ন্ত বলেন, “এক সময় এই বাড়ির জমিদার ও তাঁদের বাড়ির প্রায় সবাই এই শহরে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। দাদুর ডাকে গ্রামের প্রচুর মানুষ ব্রিটিশদের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে লবণ তৈরি করতে শুরু করেন। গান্ধীর ভাবধারায় যে বাড়ির মানুষজন উজ্জীবিত হয়ে গোটা গ্রামকে জাগিয়ে তুলেছিল, সেই বাড়ি এখন বিস্মৃত উপেক্ষিত। এখন নিয়মিত প্রোমোটাররা আসেন বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট তোলার জন্য। এখনও ফেরাচ্ছি সবাইকে। কিন্তু কত দিন পারব, জানি না।”

জয়ন্তবাবু বিস্তারিত ভাবে তাঁদের পরিবারের লবণ সত্যাগ্রহের কথা জানেন। বলেন, “আমার পূর্বপুরুষদের কাছে গল্প শুনেছি, তা ছাড়া কিছু পারিবারিক লেখা ও চিঠি ছিল। সে সব পড়েই জানতে পেরেছি মহিষবাথান গ্রামের লবণ সত্যাগ্রহের কথা।”

আমাদের সঙ্গে ছিলেন সল্টলেক দমদমের ইতিহাসের দুই গবেষক, মৌমিতা সাহা এবং শ্যামল ঘোষ। মহিষবাথানের লাল বাড়ি এবং লবণ সত্যাগ্রহ নিয়ে তাঁরা জানান, এই প্রামাণিক পরিবারের লক্ষ্মীকান্তের এক বংশধর ভূপেশচন্দ্র প্রামাণিক তাঁর বংশের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে গেছেন। সেই বই পড়ে অনেক কথা জানা যায়।

মৌমিতা এবং শ্যামলের থেকে জানা যায়, গান্ধীবাদী প্রামাণিক পরিবার কংগ্রেস জাতীয়বাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রথম থেকে। তখনকার এই লবণহ্রদ ও ভেড়ি সংলগ্ন এলাকার গ্রামগুলো মূল কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। বসবাস ছিল মহিষবাথান এলাকা এবং আজকের দত্তাবাদে। মহিষবাথানের জঙ্গল কেটে এখানে বসবাস শুরু করে প্রামাণিক পরিবার। ধীরে ধীরে তারা জমিদার হয়ে ওঠে। প্রামাণিক পরিবারের লক্ষ্মীকান্ত প্রামাণিক তৎকালীন কংগ্রেস রাজনীতির মূল স্রোতে মিশে গিয়েছিলেন।

জমিদার লক্ষ্মীকান্ত প্রামাণিক আর পাঁচ জন জমিদারের মতো ছিলেন না। স্বাধীনতা আন্দোলন ছাড়াও অস্পৃশ্যতা, বাল্যবিবাহের মতো কুপ্রথার বিরুদ্ধেও রুখে দাড়িয়েছিলেন। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজো ছিলেন বলে, তাঁকে সকলে মেজোবাবু বলেও ডাকতেন। ১৯২১ সালে লক্ষ্মীকান্ত জাতীয় কংগ্রেসের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। তবে শুধু কলকাতার রাজনীতি-সচেতন মানুষদের সঙ্গে মেলামেশাই নয়, তাঁর মন পড়ে থাকত তাঁর গ্রাম, ভেড়ি আর মহিষবাথানের মানুষগুলোর জন্য। তিনি ভাবতেন, তাঁর গ্রামের মানুষদের কী ভাবে এই স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত করা যায়, কী ভাবে গান্ধীর ভাবধারায় তাঁদের প্রভাবিত করা যায়, কী ভাবে তাঁদের কুসংস্কারমুক্ত করা যায়, কী ভাবে গ্রামের মহিলাদেরও আন্দোলনে শামিল করা যায়।

তিনি ছিলেন মহিষবাথান এলাকার কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট। গান্ধীর ভাবধারা প্রচার করার জন্য গ্রামে ছোট ছোট কমিটি তৈরি করেন। তবে লক্ষ্মীকান্ত বুঝেছিলেন, গান্ধীর ভাবধারায় তিনি একা গ্রামবাসীদের প্রভাবিত করতে পারবেন না। তিনি সেই ছোট ছোট কমিটির মাথা করে দেন গ্রামের কিছু প্রভাবশালী মানুষকে, যাঁদের তখন মোড়ল বলা হত। গ্রামের মোড়লরাও ফেলতে পারতেন না লক্ষ্মীকান্তের কথা। কারণ তিনি জমিদার হলেও সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যেই থাকতেন, গ্রামের মানুষদের সুখদুঃখে অংশ নিতেন, তাঁকে সহজে মনের কথা বলা যেত। তাঁর নির্দেশ কেউ উপেক্ষা করতে পারতেন না।

লবণ সত্যগ্রহের আগে ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই এই লবণহ্রদের গ্রামগুলোয় শুরু হয়েছিল গান্ধীবাদী আন্দোলন। লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ভিত তৈরি হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই। এই আন্দোলনের ভিত তৈরি করতে লক্ষ্মীকান্ত তৈরি করেছিলেন একটি বাচ্চাদের স্কুল। স্কুলের নাম ছিল ‘জাতীয় পাঠশালা’।

১৯২০ সাল নাগাদ মহিষবাথানের বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য তৈরি হয়েছিল জাতীয় পাঠশালা। সকালে ছোটদের পড়াশোনা হত, তার পর স্কুলেই সূত্রপাত হল অসহযোগ আন্দোলনের। স্বদেশি বস্ত্র তৈরি করতে এই পাঠশালায় ঘর ও উঠোনে শুরু হয়েছিল চরকায় সুতো কাটার কর্মযজ্ঞ। এই স্কুলেই গ্রামের মেয়েদের চরকা কাটার প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়। পরে লবণ সত্যাগ্রহের সময় যে বড় বড় হাঁড়িতে লবণ তৈরি হত, সেই লবণও তৈরি হত এই স্কুল চত্বরের মাঠে। মৌমিতা ও শ্যামল জানান, লাল বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয় সেই জাতীয় পাঠশালা। এখন সেটা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রাথমিক স্কুল। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে দশটা। মনে হল, যাওয়া যাক সেই জাতীয় পাঠশালায়।

দূরত্ব বেশি নয়, তবে লাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা টোটো চেপেই রওনা দিলাম সেই স্কুলের পথে। স্কুলের পথে যেতে যেতে মনে হল, আজকের আধুনিক নিউটাউন, মহিষবাথানের মধ্যে যে আর একটা মহিষবাথান-নিউটাউন লুকিয়ে আছে, তা তো আগে জানতাম না!

*****

মহিষবাথান জাতীয় বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের পাশেই রয়েছে সেই সময়ের স্কুলবাড়িটিও। পুরনো ওই স্কুলবাড়ি তখনকার দিনের লাল ইট দিয়ে তৈরি। বিভিন্ন জায়গায় খসে পড়েছে পলস্তারা। তবু তার মধ্যেই দেখা যায় স্কুলের জীর্ণ দেওয়ালে লেখা রয়েছে কয়েকটা লাইন। স্কুলের পিছন দিকে দেওয়ালের গায়ে লেখা আছে, ‘স্বরাজ বিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষা আত্মশাসন’। তার পরে পর পর লেখা— ‘বিলাসিতা ত্যাগ করো, স্বদেশি ব্রত গ্রহণ করো’। ‘দেশের স্বার্থে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দাও’। ‘পশুর ন্যায় নিজের শরীরটি লইয়া ব্যস্ত থাকিও না’। ‘শারীরক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিকশক্তি সঞ্চয় কর এবং তাহা দেশের কার্যে নিয়োজিত করো’। সিমেন্টে খোদাই করা লেখাগুলো এতটাই মলিন যে সহজে পড়া যায় না। স্কুলশিক্ষকেরা জানালেন, নতুন ভবনের সঙ্গে পুরনো ভবনেও পড়াশোনা হয়। এখানে বসেই মিড-ডে মিল খায় খুদে পড়ুয়ারা। আমফানের ঝাপটায় পুরনো স্কুলবাড়ি আরও বেশি বিবর্ণ হয়ে গেছে।

স্কুল ঘরে ঢুকে দেখা গেল, স্কুলের হলঘরের বড় বড় জানলা অনেকটা নিচু। আমাদের আসার কথা জেনে স্কুলে চলে এসেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষক, নীহার মণ্ডল। জানালেন, তিনি শুনেছেন এক সঙ্গে অনেক মানুষ ঘরে বসে চরকা কাটতেন। সেই সময় হলঘরে হাওয়া-বাতাস এবং আলো যাতে বেশি করে ঢোকে, তাই এই নিচু জানলা তৈরি করা হয়েছিল। গান্ধীর ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামের মেয়েরাও চরকা কাটতে বসে পড়েছিলেন এই স্কুলঘরে। লবণ সত্যাগ্রহের সময় পুলিশ হানা দিত মাঠে। তাদের বুট ও লাঠির আঘাতে ভেঙে গুঁড়িয়ে যেত মাটির হাঁড়ি। ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত আন্দোলন। লবণ তৈরি করতেও গ্রামের মেয়েদের শামিল করতে পেরেছিলেন লক্ষ্মীকান্ত।

স্কুলভবনে বসেই শোনা গেল স্কুলকে কেন্দ্র করে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে স্থানীয় মানুষদের অংশগ্রহণের ঘটনা। লক্ষ্মীকান্তের উদ্যোগে মহিষবাথান গ্রামে অসহযোগ আন্দোলন তো চলছিলই। ১৯৩০ সাল নাগাদ শুরু হল লবণ সত্যাগ্রহ। এই আন্দোলনে যোগ দিতে গ্রামবাসীকে উদ্বুদ্ধ করলেন লক্ষ্মীকান্ত। এখানে বলতে হবে সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তর কথা। মহাত্মা গান্ধী যখন দেশ জুড়ে আইন অমান্য ও লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন করছেন, তখন অবিভক্ত বাংলায় তৈরি হল ‘বেঙ্গল কাউন্সিল অব সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স’।

ওই অফিসে বসেই লবণ সত্যাগ্রহের রূপরেখা তৈরি হয়। এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, বেঙ্গল কেমিক্যাল-এর হেড কেমিস্ট, গান্ধীবাদী কংগ্রেস নেতা সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত। তিনি ছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল-এর প্রাণপুরুষ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রিয়পাত্র। কংগ্রেস নেতা সতীশের সঙ্গে গান্ধীর মোলাকাত হওয়ার পরে গান্ধীর ভাবধারায় তিনি এতটাই উদ্বুদ্ধ হন যে, বেঙ্গল কেমিক্যাল-এর চাকরি ছেড়ে দেন। সতীশচন্দ্র সোদপুরে সাবরমতী আশ্রমের অনুকরণে গান্ধী আশ্রম তৈরি করেন।

১৯৩০ সালে গান্ধী যখন লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন, তখন সতীশচন্দ্রও ভাবলেন এই বাংলায়, কলকাতায় কি লবণ সত্যাগ্রহ শুরু করা যায় না! কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন লবণাক্ত জল। কলকাতায় লবণ সত্যাগ্রহের প্রধান কার্যালয় হলেও, এখানে তো লবণাক্ত জল পাওয়া যাবে না। খোঁজ শুরু হল কলকাতার কাছাকাছি লবণাক্ত জলের।

মহিষবাথান এলাকার কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট লক্ষ্মীকান্ত তখন সতীশের অনুগামী। তাঁর নিয়মিত কলকাতায় যাতায়াত ছিল। সতীশচন্দ্র লক্ষ্মীকান্তকে বললেন, “লবণ সত্যাগ্রহ করছেন গান্ধীজি। দেশ জুড়ে এত বড় আন্দোলন হচ্ছে। আমরা তাতে শামিল হতে পারব না? এখানে কি কিছুই হবে না, লক্ষ্মীকান্ত?”

কলকাতা থেকে ফেরার সময় সতীশের কথাটা অনেক ক্ষণ ধরে ভাবছিলেন লক্ষ্মীকান্ত। ভেড়ির ধার দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ বড় বড় ভেড়ির দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল, এই ভেড়ির জলই তো নোনতা! তা হলে গুজরাতের ডান্ডিতে যদি লবণ তৈরি করে লবণ সত্যাগ্রহ শুরু করতে পারেন গান্ধীজি, তা হলে এখানেই বা তাঁরা পারবেন না কেন? তিনি সতীশবাবুকে সঙ্গে সঙ্গে জানালেন সেই কথা। লক্ষ্মীকান্তবাবু সতীশবাবুকে বললেন, “মহিষবাথানের কাছে লবণহ্রদের ভেড়ির জল থেকেই তো লবণ সত্যাগ্রহ করা যায়। এখান থেকেই শুরু করা হোক লবণ সত্যাগ্রহ।” সতীশচন্দ্র এক কথায় রাজি।

গান্ধীজির ডান্ডি অভিযানের অনুকরণে এই রাজ্যেও লবণ সত্যাগ্রহ যাত্রা শুরু হল। ২৫ জন সত্যাগ্রহীকে নিয়ে লবণ সত্যাগ্রহ মিছিল শুরু করলেন সতীশবাবু। মিছিলের অগ্রভাগে থাকলেন লক্ষ্মীকান্ত। ২৫ জন সত্যাগ্রহী লবণ সত্যাগ্রহ যাত্রা সোদপুর থেকে শুরু করেছিলেন। সোদপুর থেকে শুরু করে বি টি রোড, দমদম রোড, যশোর রোড, শ্যামনগর রোড, কেষ্টপুর রোড ধরে পৌঁছয় মহিষবাথানে। মিছিল শেষ হয়েছিল মহিষবাথানের স্কুলের কাছে এক ভেড়ির মাঠে। এই মাঠেই লবণহ্রদের ভেড়ি থেকে জল তুলে লবণ তৈরির কাজ শুরু হল। শুরু হল বাংলার লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন।

সারা দেশ জুড়ে যখন লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলছে, তখন মহিষবাথানের আশপাশের গ্রামেও এই আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিল। লবণহ্রদের ভেড়ির ধারে ধারে দেশীয় পদ্ধতিতে লবণ তৈরির কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে গেল। জাতীয় বিদ্যালয়ে বিপ্লবীদের আসা-যাওয়া থেকে শুরু করে গান্ধীজির আন্দোলন কোন পথে চলবে, সবই আলোচনা হত জাতীয় বিদ্যালয়ে।

দ্বিভুজ, নারায়ণতলা, জগৎপুর, চণ্ডীবেড়িয়া, কৃষ্ণপুর, মহিষগোট, মহিষবাথান, নয়াপট্টি, ঠাকুরদারি— এই ন’টি গ্রামের গ্রামবাসীরা জমিদার লক্ষ্মীকান্তের অনুপ্রেরণায় লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। মহিষবাথানের লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কথা তখনকার সংবাদপত্রে রোজ বেরোতে শুরু করে। তখনকার সময়ের দুই স্থানীয় সংবাদপত্র অমৃতবাজার পত্রিকা এবং আনন্দবাজার পত্রিকা এক দিকে যেমন গান্ধীজির লবণ সত্যাগ্রহ নিয়ে রিপোর্ট করত, সে রকমই মহিষবাথানের লবণ সত্যাগ্রহ নিয়েও খবর প্রকাশ করতে থাকে। ১৯৩০ সালের ৭ এপ্রিল অমৃতবাজার পত্রিকায় ‘সল্ট প্রিপারেশন অ্যাট মহিষবাথান’ শিরোনামে একাধিক ছবি দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে।

স্কুলের মাঠ ছাড়াও মহিষবাথানের যে মাঠে লবণ সত্যাগ্রহীদের পদযাত্রা এসে পৌঁছেছিল, যেখানে বড় বড় হাঁড়িতে লবণ তৈরি হত, সেই মাঠ এখন একটি ক্লাবের মাঠ। সেখানে দুর্গাপুজো হয়। মহিষবাথান জাতীয় বিদ্যালয় থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সেই মাঠে পৌঁছে দেখা গেল, আশপাশে কোনও ভেড়ি নেই। মাঠের চার দিকে শুধু বড় বড় বাড়ি আর ফ্ল্যাট। জানা গেল, একটা সময় ওই মাঠের কাছেই ছিল বড় ভেড়ি। সেই ভেড়ি বুজিয়েই বাড়ি তৈরি হয়েছে।

এই মাঠে যখন লবণ সত্যাগ্রহীরা লবণ তৈরি করত, সেখানে পুলিশের ধরপাকড়ও কম ছিল না। সে সব নিয়েও তখনকার সংবাদপত্র রিপোর্ট লিখতে শুরু করে। সন্ধেবেলা, মাঝরাতে লবণ তৈরির হাঁড়ি ভেঙে ফেলত পুলিশ। ভেড়ির ধারে মাঠে বড় বড় হাঁড়িতে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে লবণ তৈরির কাজ খুবই কঠিন। ঠিক কোনও না কোনও ভাবে পুলিশের কাছে খবর চলে যেত। ১৯৩০ সালে গোটা এপ্রিল মাস জুড়ে পুলিশের ব্যাপক ধরপাকড়ে গ্রামগুলো পুরুষশূন্য হয়ে যেতে শুরু করে। আন্দোলন দমন করার জন্য লবণ সত্যাগ্রহীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা শুরু হয়। খাবারের বাসনপত্রও বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। বাসন না থাকায় মাটিতে গাছের পাতা পেতেও গ্রামবাসীদের খেতে হত। এক দিকে পুলিশের অত্যাচার, সেই সঙ্গে চরম দারিদ্র। মহিষবাথানের লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে প্রথম কারাবরণ করেছিলেন জমিদার লক্ষ্মীকান্তই। কিন্তু গ্রামগুলো পুরুষশূন্য, সেই সঙ্গে সত্যাগ্রহীদের সব জিনিস বাজেয়াপ্ত হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে ওই আন্দোলন ম্লান হতে থাকে।

কলকাতার খুব কাছে লবণাক্ত ভেড়িগুলোকে কেন্দ্র করে লবণ সত্যাগ্রহের আন্দোলন হয়েছিল। এর মূল কেন্দ্র ছিল মহিষবাথান জাতীয় স্কুল এবং জমিদার লক্ষ্মীকান্তের লাল বাড়ি। এই বাড়ি এবং স্কুলকে কেন হেরিটেজ তকমা দেওয়া হবে না? প্রশ্ন তুলেছেন গবেষকদ্বয়, মৌমিতা ও শ্যামল। এই নিয়ে তাঁরা স্বাক্ষর সংগ্রহের অভিযানও শুরু করেছেন। তাঁদের দাবি, স্কুলের পুরনো ভবন সংস্কার করে সেখানে সংগ্রহশালা তৈরি হোক।

স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে চরিত্র বদলায় এই লবণহ্রদ এবং লবণাক্ত ভেড়িগুলো। বিদ্যাধরী শুকিয়ে যায়, কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি হলে নিকাশির বর্জ্য পড়তে থাকে লবণহ্রদে। ফলে জলের চরিত্র পাল্টে যায়। মৎস্যজীবীরা তবুও হাল না ছেড়ে বর্জ্যমিশ্রিত জলে মাছ চাষের চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে সল্টলেক বা লবণহ্রদ তৈরি হতে শুরু হলে, এই মৎস্যচাষীরা ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে যেতে থাকেন।

দেখতে দেখতে নতুন তৈরি হওয়া সল্টলেক, মহিষবাথান, রাজারহাট, নিউটাউনের নোনা জলের ভেড়ি চিরতরে হারিয়ে গেল। উপেক্ষিত থেকে গেল লাল বাড়ি, মহিষবাথান জাতীয় পাঠশালা, লবণ তৈরির মাঠ, লবণ সত্যাগ্রহের সঙ্গে জড়িত যাবতীয় সব স্মৃতিচিহ্ন। নিউটাউন, মহিষবাথানে গেলে এখনও কিছু ভেড়ি দেখতে পাওয়া যায়। তবে সেই ভেড়ির জলের স্বাদ এখন আর নোনতা নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement