যে বছর দক্ষিণের নারকেল গাছটা পড়ে গেল, ওই বছরই তুই জন্মেছিলি,’’ মা বলেছিল। পরে বড় হয়ে জেনেছি, সালটা ছিল ১৯৩৩।
এই ৮৫ বছরে এসে পূর্ববঙ্গের ছোটবেলাটা মনে পড়ে। হ্যাঁ, বাংলাদেশকে এখনও আমি পূর্ববঙ্গই বলি। তা-ই তো বলেছি বরাবরই। সেই পূর্ববঙ্গ অবশ্য একেবারে পালটে গিয়েছে এখন। আমাদের বাড়ির সামনেটায় ছোট্ট একটা নদী ছিল। সেটা যেমন নেই আর এখন।
ছোটবেলার সেই সময়টা ছিল একেবারে অন্য রকম। মায়ের মুখে শুনেছি, আমি হওয়ার সময় মা’র খুব কষ্ট হয়েছিল। আঁতুড়ঘরে ধাইমা ও অন্যরা মা’কে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, আমার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। সেই কারণেই আমার ডাক নাম ‘ভোলা’।
ফরিদপুর জেলায় ওই গ্রামের নাম ছিল হাটশিরুআইল। নদীটার নাম এক ফকিরের নামে—আড়িয়াল খাঁ। আমি পঞ্চম সন্তান, মা ঘরের মেঝেতে আমাকে শুইয়ে ঘর লেপা, বাসন মাজা, পুকুর থেকে জল আনার দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। দাদা-দিদিরাও ছোট, তারাই বা কত ক্ষণ আমাকে চোখে চোখে রাখবে? মা এসে নাকি দেখতেন, মাটি-মল-মূত্র মেখে আমি গভীর আনন্দে খেলা করছি। বাবার নাম শশীভূষণ দত্ত, শিয়ালদহের বৈঠকখানা বাজারে আসবাবপত্রের দোকান ছিল তাঁর। আঁতুড়ঘরে আমার জন্মের সময় তাই স্বাভাবিক কারণেই বাবা থাকতে পারেননি। পরে আমার এক জেঠিমা কলকাতায় চিঠি লিখে বাবাকে জানিয়েছিলেন, ‘তোমার একটা পোলা হইছে।’ মহাযুদ্ধের আগে গ্রামবাংলার দরিদ্র জীবনে ছেলেপুলে নিয়ে আজকের মতো আদিখ্যেতা ছিল না। বাবা যখন কলকাতা থেকে আমাকে প্রথম দেখতে এলেন, আমার বয়স তখন ছয় মাস।
হাতেখড়ি দিয়েছিলেন আমার জেঠতুতো দিদি। ভাইবোনেদের মধ্যে তিনিই সকলের বড়। এক দিন মা কয়েকটা তালপাতা নিয়ে এসে পুঁথির মতো কেটে সেটাকে সেদ্ধ করলেন। পরে সেটা মুছে দিদিকে বললেন, ‘‘আশা, তোর ভাইটার হাতেখড়ি দিয়া দে।’’ কোনও পুরুত ব্যতিরেকে দিদি ভাইকে হাতেখড়ি দিচ্ছে, এটা কি আধুনিকতা নয়?
আধুনিকতার বয়ান অবশ্য আমার জন্য নয়। খালি গায়ে, দড়ি-দেওয়া ইজের পরে খাগের দোয়াত-কলম আর কাটা তালপাতাগুলি নিয়ে পাঠশালায় যেতাম। যত না লিখতাম, সহপাঠীদের সঙ্গে গল্প করতাম তার চেয়ে বেশি। পাঠশালা থেকে ফিরেই পুকুরে উদ্দাম সাঁতার। বাড়ি ফিরে মেঝেতে বসে ভাত খাওয়া। পুকুরে এঁটো বাসন ধুয়ে এসে মা মেঝেতে শুয়ে পড়তেন। আমাদেরও শুয়ে পড়ার নির্দেশ দিতেন। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! মা ঘুমিয়ে পড়লেই আমরা চুপিচুপি বাগানে চলে যেতাম। সেখানে ডাংগুলি, কখনও বা বাতাবিলেবু দিয়ে ফুটবল খেলা।
এই সময়েই শুরু হল মন্বন্তর। গ্রাম থেকে সমস্ত চাল রাতের অন্ধকারে নৌকো বোঝাই করে রাতারাতি উধাও হয়ে যেতে শুরু করল। বাড়িতে নিত্য হা-ঘরে, নিরন্ন লোকেদের আনাগোনা, ‘‘একটু ফ্যান দাও মা।’’ পরে বুঝেছি, এই মন্বন্তর কৃত্রিম। সৈন্যদের জন্য চাল সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকার আমাদেরও ভাতে মারার ব্যবস্থা করেছিল। চারদিক জুড়ে তখন স্বদেশি গান চলছে। ব্রতচারী আন্দোলন চলছে। তার মধ্যেই এক দিন গান গাইতে গাইতে পুকুরের কচুরিপানা সাফ করছি আমরা ছোটরা। গানটা ছিল, ‘আয় কচুরি নাশি/এই রাক্ষুসি যে বাংলা দেশে দিচ্ছে গলায় ফাঁসি।’
যোগেশ দত্ত
হঠাৎ দেখি, জলের মধ্যে লোহার কিছু একটা। কী সেটা, ঠিক বুঝিনি তখন। বড়দের ডেকে দেখালাম। সবাই দেখি, তাড়াতাড়ি জিনিসটা নিয়ে কোথায় চলে গেল। এর মধ্যেই পর দিন গ্রামে সাদা পোশাক পরে এক ভদ্রলোক হাজির। ও রকম পোশাক পরা লোক তখন চট করে দেখা যেত না গ্রামে। নিমেষে ভিড় জমে গেল তাই। ভদ্রলোক ডেকে ডেকে সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কাল গ্রামে কোনও রিভলভার পাওয়া গিয়েছে কি না। বলে পকেট থেকে যেটা বার করলেন, দেখি ঠিক কালকের সেই জিনিসটার মতো। অমনি বললাম, ‘‘আমি দেখেছি তো! কাল পুকুরের জলে ভাসছিল।’’
বড়রা সব চুপ। ভদ্রলোক আমাকে খুব খাতির করতে লাগলেন। নিজের প্লেট থেকে রসগোল্লা তুলে খেতে দিলেন আমাকে। খানিক পরে আবার আসবেন বলে চলেও গেলেন। ব্যস! গ্রামের বড়রা সব আমাকে নিয়ে পড়ল! সবাই মিলে আমাকে ধরে ওই পুকুরের জলেই এক বার করে চোবাচ্ছে, আবার তুলছে। ফের চোবাচ্ছে। আর বলছে, ‘‘বল, আর বলবি এ ভাবে? আর বড়দের মাঝে কথা বলবি?’’
শিখে ফেললাম, কাউকে কিছু বলতে নেই। সে দিন থেকে আমার সত্যি কথা বলা বন্ধ হল।
গ্রামে ইতিমধ্যে তলে তলে অনেক কিছু ঘটতে শুরু করেছে। কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ মুসলিমদের ঘরে ঢুকতে দিত না। শুনতে পাচ্ছিলাম, আনসার বাহিনী নামে পাল্টা এক দল গঠিত হয়েছে। তারা বলতে লাগল, নমাজ পড়ার সময় স্কুল বন্ধ রাখতে হবে। শুনলাম, দেশ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এ দিকটা পূর্ব পাকিস্তান, আর লাহৌর, করাচির দিকে পশ্চিম পাকিস্তান। বাবা নীরব, গ্রামের সকলে কানে কানে চুপিসারে কী আলোচনা করে, বুঝতেও পারি না।
সেই রাত্তিরটা বুঝতে অবশ্য অসুবিধা হয়নি। মা নির্বাক, খালি দু’চোখ বেয়ে জল। বাড়িতে কাজ করত দেবুদা, তাকে ডেকে বাবা বললেন, ‘‘আজ থেকে এই ঘরে থাকবি।’’ কাঁদতে কাঁদতে মা তুলসীমঞ্চে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবুদাকে বললেন, ‘‘যত দিন পারিস, প্রদীপটা জ্বালিয়ে রাখিস। দেশ ভাগ হয়ে গিয়েছে।’’
প্রবল গন্ডগোলের মধ্যে সহৃদয় এক মুসলমান মাঝি আমাদের নিয়ে এলেন মাদারিপুর। সেখানে ভিড়ে ঠাসা জাহাজে উঠলাম। জাহাজটার দৈত্যের মতো দুই পাশে বড় বড় দু’টো চাকা লাগানো। বাবা বললেন, ‘‘এটা জাহাজ নয়। এর নাম স্টিমার।’’ বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর হতেই বাবা জাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘ওঠ, আমরা এসে গিয়েছি।’’
জায়গাটার নাম খুলনা। একটু এগিয়ে দেখি, লাইনের ওপর সারি দিয়ে বাক্সের মতো দেখতে লোহার ঘর। তার ছাদে কাতারে কাতারে মানুষ। জীবনে সেই প্রথম রেলগাড়ি দেখা। কোনওক্রমে একটা থালায় চি়ঁড়ে ভিজিয়ে গুড় মেখে আমরা সবাই খেলাম। পিছনে পড়ে থাকল ভিটেবাড়ি, ট্রেন চলতে শুরু করল অজানা দেশের উদ্দেশে। দর্শনা পেরিয়ে রানাঘাট, এখানে দেখলাম সবই অন্য রকম। স্বেচ্ছাসেবকরা এসে আমাদের পাউরুটি, চিঁড়ে, গুড়, কাপড় দিল। আর একটা কার্ড দিয়ে বলল, কলকাতায় গিয়ে এই কার্ড দেখালে সব পাবে। আমাদের নাম হল ছিন্নমূল।
কলকাতায় এসে নামলাম, স্টেশনটার নাম শিয়ালদহ। চারদিকে মানুষ আর মানুষ। ইতিমধ্যে বাবা আমাদের বসিয়ে রেখে কোথায় যেন চলে গেলেন হঠাৎ। খানিক পরে ফিরে এলেন, সঙ্গে একটা বাক্স মতো গাড়ি, ঘোড়ায় টানা। শুনলাম, ওকে নাকি ‘টমটম’ বলে।
সপরিবার যোগেশ দত্ত (একেবারে উপরের সারিতে বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)
সেই টমটমে চেপে সারপেন্টাইন লেনে খোলার চালের একটা বাড়িতে এসে উঠলাম আমরা। বারান্দায় দরমায় ছাওয়া রান্নাঘর, শোওয়ার ঘরে কোনওক্রমে একটাই তক্তপোশ আঁটে। বারোয়ারি পায়খানা, স্নানের চৌবাচ্চা। এক বৃদ্ধা মহিলা এসে বললেন, ‘‘ওদের কিছু খেতে দে।’’ আর এক জন বললেন, ‘‘কলঘরে গিয়ে মুখ ধুয়ে এস।’’ এত দিন গ্রামের নদীতে সাঁতার কেটেছি, আজ নতুন শব্দ শিখলাম— কলঘর। বাবা হাঁড়ি, কড়াই, বালতি, কলাই করা থালা নিয়ে এল। আর ছিল উনুন, ঘুঁটে, কয়লা, কেরোসিন তেল। এই রকম উনুন আমরা কোনও দিন দেখিনি। পাশের ঘরের ভদ্রমহিলা মা’কে সেই উনুন ধরানো শিখিয়ে দিলেন।
পুরসভার শশীভূষণ দে স্কুলে ভর্তি হলাম আমরা ভাইয়েরা। খেলতে যেতাম লেবুতলা পার্কে। স্কুলের পশ্চিম দিকে একটা ছ’তলা বাড়ি ছিল। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, সেখানে ছিল একটা ছোট্ট ঘর। তার ভিতরে সবাই ঢুকে পড়লে ঘরটা আপনি ওঠানামা করত। বাবা বলেছিলেন, ‘‘ওর নাম লিফট।’’
ইতিমধ্যে বৈঠকখানা বাজারে আরও একটা দোকান দিয়েছিল বাবা। তাতেই চলছিল আমাদের। ক’বছর পরে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অনেক চেষ্টায় তাঁকে যাদবপুরে যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি করা হল। আমাকে তখন জেঠিমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক দিন মামা সেখানে গিয়ে বললেন, ‘‘তোমার বাবা আর নেই।’’ গলায় সাদা উত্তরীয় নিয়ে চলে এলাম মায়ের কাছে। আমাদের সেই অশৌচ দশাতেই এক দিন গঙ্গাস্নান থেকে ফিরে এসে দেখলাম, মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন। জ্ঞান আর ফেরেনি।
বাবা-মা’কে হারিয়ে চলে এলাম সালকিয়ায়, মামার বাড়িতে। আমার বয়স তখন বারো। মামারা বড়লোক। সেখানে নানা ফাইফরমাশ খাটতাম। পড়াশোনা ভাল লাগত না। পেটে খিদে, চুরি করে খেতাম। এক বার ক্লাসের পরীক্ষায় টুকতে গিয়ে ধরা পড়লাম। শিক্ষক নরেশদা বললেন, ‘‘দাঁড়া, তোর মা-বাবাকে বলব।’’ বললাম, ‘‘আমার মা-বাবা নেই। মামাবাড়িতে থাকি।’’ কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তার পর বললেন, ‘‘যা পারো তাই লেখো।’’ এক দিন দুপুরে খেতে বসে দেখি, আমার থালায় ভাতের পাশে ছাই। ঠাকুর বলল, মামিমা বলেছেন। সেই দিনই বাড়ি থেকে পালালাম আমি।
হাতে মাত্র তিন টাকা। হাওড়া স্টেশনে এসে একটা ট্রেনে উঠে শুয়ে রইলাম রাতে। ঘুম ভাঙতে দেখি, ট্রেন চলছে। যাচ্ছে কোথায়? এক সহযাত্রী বললেন, এটা ভাগলপুর এক্সপ্রেস। সব শুনে তিনিই খেতে দিলেন আমায়। টাকাও দিলেন কিছু। এরই মধ্যে চেকার এসে হাজির। আমার তো টিকিট নেই। আমাকে গার্ড নামিয়ে দিল রামপুরহাটে।
খিদে পেয়েছে তখন। সহযাত্রীর দেওয়া সেই টাকা নিয়ে স্টেশনের চায়ের দোকানে এসে খাবার কিনলাম। দোকানি অবাঙালি, নাম গুন্টন। মিথ্যে বললাম, বাবা-মায়রে দ্যাশে কাইট্যা ফালাইসে। নিজের নাম বললাম ভোলানাথ। দয়াপরবশ হয়ে সেই অবাঙালি দোকানদার আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘কাপ-প্লেট ধুতে পারবি?’’ ঘাড় নাড়লাম। সিঙাড়া, চা, কচুরির সেই দোকানেই শুরু আমার কর্মজীবন।
চায়ের দোকান থেকে রামপুরহাট কোর্টের সামনে এক সস্তার হোটেলে। ‘চার নম্বরে ভাত-ডিম-তরকারি’ বলে তাড়াতাড়ি হাঁক দিতে হত। আমার খাওয়ার সময় জুটত বিকেল তিনটেয়। তখন খদ্দেরের চাপ থাকত না। ভাত-ডাল-তরকারি ও মাছ, মাংস, ডিমের মধ্যে যেটা থাকত সেটা পেতাম। অবশ্য রান্নার ঠাকুর অজয়দা আমাকে বেশির ভাগ সময় ডিম দিতেন না। কারণ ডিম গুনতির মধ্যে থাকত।
অতঃপর এক মুদির দোকানে। ভদ্রলোক বর্মার উদ্বাস্তু, নাম হৃদিমাধব গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁকে দেখতে দেখতে অনেক কিছু শিখলাম। কী করে ওজনে কম দিতে হয়, কোন তেলের সঙ্গে কোন তেল মিশিয়ে ভেজাল দিতে হয়। মালিকেরা তিন ভাই। যিনি ক্যাশে বসেন তিনি ক্যাশ থেকে টাকা সরান।
ইতিমধ্যে জে এল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। উনি মাঝেমধ্যে পড়াতেন আমায়। আর আমি পড়তাম খবরের কাগজ। খুঁটিয়ে দেখতাম, নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনে আমার নাম, ছবি আছে কি না। রেলের কন্ট্রাক্টরির একটা কাজও জুটে গেল। চলে গেলাম গঙ্গার ধারে সকরিগলি ঘাট। সেখানে রেললাইনে ক’জন মজুর কত ক্ষণ কাজ করে তার তদারকি করাই আমার কাজ। সকরিগলি ঘাট স্টেশন আর নেই, এখন তার নাম ফরাক্কা।
সে কাজও বেশি দিন ভাল লাগল না। বললাম, দাদার অসুখ। ছুটি নিয়ে ফিরে এলাম সালকিয়ায়। এক দিন রাস্তায় ঘুরছি, মেজদা এসে কান ধরে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেল। ফের মামাবাড়ি। এ বার ভর্তি হলাম হাওড়া বঙ্গবাসী স্কুলে। এক দিন সকালে প্রার্থনা চলছে। তাতে চোখ বুজে গান গাওয়ার কথা। চেঁচিয়ে বললাম, মদন চোখ বোজেনি! প্রার্থনা শেষ হওয়ার পরে মাস্টারমশাই এলেন। মদন চড় খেল। মাস্টারমশাই বললেন, ‘‘মদন চোখ বোজেনি, তুই জানলি কী করে? তার মানে তুইও চোখ বুজিসনি!’’ আমার ভাগ্যে বেতের বাড়ি জুটল। শিখলাম, নালিশ করা উচিত নয়।
বাংলাদেশের বাড়ি।
পড়তে ভাল লাগল না এ বারও। ভর্তি হলাম হাওড়া হোমস-এর সেলাই শেখার কোর্সে। মামিমা রোজ যাওয়া-আসার গাড়ি ভাড়া দিতেন। টেলারিং শিখতে গিয়ে এক দিন দেখলাম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ওখানে একটা পলিটেকনিক খুলেছেন। মাথার পোকাটা ফের চিড়বি়ড়িয়ে উঠল। শ্যামাপ্রসাদবাবুকে বললাম, আমি পলিটেকনিকে ভর্তি হতে চাই। উনি বললেন, ‘‘এখন যেটা করছ সেটা করো। তার পর অন্যটা শিখবে।’’ কয়েক মাস পরেই শ্যামাপ্রসাদবাবুকে দেখলাম অন্য ভাবে। মামিমা গঙ্গাসাগর যাবেন। নিয়ে যাওয়ার ভার আমার উপর। একটা হোগলার ছাউনিতে আমরা ছিলাম। দুপুরে খিচুড়ি-তরকারি খেয়ে বিকেলে একটা সভায় গিয়ে দেখি শ্যামাপ্রসাদবাবু তাঁর মা’কে নিয়ে এসেছেন, গঙ্গাসাগর মাহাত্ম্য নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। অসাধারণ স্মরণশক্তি। আমাকে দেখেই বললেন, ‘‘কি যোগেশ, ঠিকমতো কাজ শিখছ তো?’’
কাজ নিলাম পঞ্চু দর্জির দোকানে। এক দিন এক খদ্দের এলেন, বিয়ের পাঞ্জাবি বানাবেন। নির্দিষ্ট দিনে তিনি পাঞ্জাবি নিতে এসেছেন, পঞ্চুদা বেমালুম বলে দিল, ‘‘ইস্ত্রি হয়ে আসেনি।’’ এ দিকে পাঞ্জাবির কাপড়ই কাটা হয়নি তখনও! তার পরে এক দিন। ফের আর এক দিন। চতুর্থ দিন আসার পরে সদ্য-তৈরি পাঞ্জাবিটা ভদ্রলোকের গায়ে গলিয়ে, পঞ্চুদা পেনসিলের দাগ দিতে লাগল— এখানে চাপতে হবে, ওখানে খানিক সেলাই ছাড়াতে হবে। ভদ্রলোক সে দিনও ফিরে গেলেন। পর দিন পঞ্চুদা কিচ্ছু না করে, স্রেফ পাঞ্জাবিটা ইস্ত্রি করে, কাগজে মুড়ে ভদ্রলোকের হাতে দিল। তিনিও দেখি হাসিমুখে বলছেন, ‘‘এই তো, বেশ ভাল মাপ হয়েছে। একদম ফিট!’’ আমি হতবাক। বুঝলাম, এ ভাবেই ব্যবসা করতে হয়। লোক ঠকিয়ে। আর আমার দ্বারা তা হবে না।
ফের কাজ বদল। এ বার মোটর মেকানিক। দেখি, ইঞ্জিন খোলার সময়েই খালি আমাকে দোকানে পাঠায় মালিক। যাতে কিছুতেই শিখতে না পারি। সে কাজও ছেড়ে দিতে হল!
ছেড়ে দিতে হল মামার বাড়িও। দিদি বিজয়গড় কলোনিতে রিফিউজি প্লট দখল করেছিলেন। মাঝে মাঝে গিয়ে দিদির রেশন তুলে দিয়ে আসতে হত। সেখানেই মামাতো বৌদি এক দিন আমাকে চোর অপবাদ দিলেন। মামাবাড়ি ছেড়ে জনক রোডে চলে এলাম। তখন বয়স ষোলো। ব্যঙ্গকৌতুক করে কিছু নামডাক হয়েছিল। অনেকে অনুষ্ঠানে আমাকে নিয়ে যেতেন, কিন্তু সারা রাত বসে থেকেও সুযোগ পেতাম না। আলুর দম-লুচি খেয়েই ফিরে আসতে হত। কিন্তু দমে যেতাম না, পণ ছিল ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’।
তখন লেকে অনেকটা সময় কাটাই, কামানের ধারটায় বসে। রোজই দেখি জোড়ায় জোড়ায় বসে চারদিকে। কথা শুনতে পেতাম না কারও। শুধু আচার-আচরণ, অঙ্গভঙ্গিগুলো নজরে আসত। আস্তে আস্তে দেখি দিব্যি চিনতে পারছি, কারা ভাইবোন, কারা বিবাহিত দম্পতি, আর কারা অবিবাহিত!
এক দিন এক দিদির বাড়িতে কথা না বলে স্রেফ অঙ্গভঙ্গিতে দেখালাম, আয়নার সামনে মেয়েরা কেমন করে সাজে। তখনও জানি না, এটাকে কী বলে। নির্বাক কৌতুক হিসেবেই দেখিয়ে বেড়াচ্ছিলাম সবাইকে। সেই নির্বাক কৌতুকই হয়ে উঠল আমার প্যাশন। বালিতে এক অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠে বললাম, ‘‘ব্যঙ্গকৌতুক করার আগে আমি একটা নির্বাক কৌতুক দেখাচ্ছি।’’ সেখানে ভি বালসারাও ছিলেন। ওঁকে অনুরোধ করলাম, আমার সঙ্গে একটু বাজিয়ে দেবেন? উনি বললেন, ‘‘হাঁ বেটা, জরুর দেগা।’’ সেই অনুষ্ঠানে আমার মূকাভিনয় দেখে ভি বালসারা আমায় গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। মাঝে মাঝেই এই সব নির্বাক কৌতুক ভানুদাকে (বন্দ্যোপাধ্যায়) দেখাতাম। তখন ফরোয়ার্ড ব্লকের রাজনীতি করি। এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বাড়ার আন্দোলনে তিন দিন দমদম সেন্ট্রাল জেলেও কাটিয়েছি। কিন্তু ভানুদা সতর্ক করতেন, ‘‘পার্টির কাছ থেকে টাকা নিবি। তা না হলে তোকে কেউ মূল্য দেবে না।’’ লন্ডন থেকে তখন সবে ফিরেছেন এইচএমভি-র অরুণ বসাক। তিনি আমার নির্বাক কৌতুক দেখে বললেন, ‘‘এ কী করেছ! এ তো বিদেশে হয়! একে ফরাসিতে ‘মাইম’ বলে।’’ আরও বললেন, ‘‘যেহেতু মঞ্চে তুমি ছাড়া অন্য কেউ নেই, নির্বাক কথাটা এখানে প্রযোজ্য নয়।’’ আমি বললাম, ‘‘যদি মূকাভিনয় বলি?’’ উনি বললেন, ‘‘বাহ! এটাই ঠিক নাম।’’
আমার বাকি জীবনটা এই মূকাভিনয়ের হাত ধরেই কেটে যাচ্ছে।
অনুলিখন: পরমা দাশগুপ্ত