Uttam Kumar

মঞ্চাভিনেতা উত্তমকুমার

ছোটবেলায় স্কুলে ‘গয়াসুর’ দিয়ে শুরু। তার পর পাড়ার ‘ব্রজদুলাল’-এ কৃষ্ণের শৈশব। চাকরি করতে করতেও নির্দেশনা ও অভিনয় সমান তালে চালিয়েছিলেন উত্তমকুমার।

Advertisement

অভীক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২৩ ০৬:২৫
Share:

নাটকীয়: ‘শ্যামলী’-র অনিল চরিত্রের জন্য প্রস্তুতী।

চক্রবেড়িয়া স্কুলের অনুষ্ঠান। অভিনয় হবে ‘গয়াসুর’ নাটক। প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু ছোটবেলার গয়াসুর চরিত্রের জন‍্যে ছেলে পাওয়া যাচ্ছে না। অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা মাস্টারমশাই যখন খানিকটা হতাশ হয়েই ক্লাসে এসে বললেন, “তোমাদের মধ‍্যে এমন কি কেউ নেই, যে প্লে করতে পারে?”

Advertisement

তখন অরুণ নামে একটি বছর নয়েকের ছেলে দাঁড়িয়ে বলল যে, সে করবে। করলও। এবং তা বেশ নজর কাড়ার মতো। হেডমাস্টারমশাই তার পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, “ওয়ান্ডারফুল! চমৎকার অভিনয় করেছ তুমি।” অরুণের জেঠামশাইদের ক্লাবের নাম ছিল ‘সুহৃদ সমাজ’। সেখানে নিয়মিত যাত্রার মহড়া চলত। ছোট্ট অরুণ ঠায় দাঁড়িয়ে রিহার্সাল দেখত। সেখান থেকেই ক্রমশ অভিনয়ের নেশা। আর সহজাত প্রতিভা তো ছিলই। এই সবেরই মিলিত প্রকাশ ইস্কুলের নাটকে। ভবিষ‍্যতের ‘উত্তমকুমার’ হয়ে ওঠার শুরু এই ভাবেই। বাঙালি রুপোলি পর্দার এক ও অদ্বিতীয় ‘মহানায়ক’ যিনি, তিনি কিন্তু আজীবন মঞ্চের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলেন। ছবির চাপে তার সংখ্যা কম হলেও, কখনওই তিনি নাট‍্য-বিচ্ছিন্ন হননি। যার শুরু কৈশোর থেকেই।

ইস্কুলে তো অভিনয় চলছিল। এর পর এল পাড়ায় সুযোগ। খুব ইচ্ছে ছিল জেঠামশাইয়ের ক্লাবের হয়ে যাত্রা করার। ইচ্ছে পূরণ হল এক দিন। ‘ব্রজদুলাল’ নাটকে ছোট কৃষ্ণ সেজে সবাইকে মুগ্ধ করল অরুণ। ওই নাটকে অভিনয় করেছিলেন, তখনকার চিত্র ও মঞ্চ জগতের নামী অভিনেতা ফণী রায়। তিনি অরুণের জেঠামশাইকে বলেছিলেন, “তোমার ভাইপো বড় অভিনেতা হবে হে!”

Advertisement

‘আলিবাবা’-র বাবা ‘মুস্তাফা’-র ভূমীকায়

কী অব‍্যর্থ ভবিষ‍্যদ্বাণী!

ক্রমশ বড় হতে হতে এক দিকে যেমন অভিনয়ের ইচ্ছে প্রবল হতে লাগল, সঙ্গে চলল নাটক ও সিনেমা দেখা। পাড়ার ‘লুনার ক্লাব’-এর হয়ে একটার পর একটা থিয়েটারে অংশ নিতে লাগলেন। এর মধ্যে ছবিতে অভিনয়ের সুযোগও ঘটে গেছে। কিন্তু সেখানে চলছে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। পাশাপাশি, মঞ্চে তখন একের পর এক নাটকে নিজেকে তৈরি করে চলেছেন উত্তম। ‘কর্ণার্জুন’-এ শ্রীকৃষ্ণ, ‘সাজাহান’-এ দিলদার, ‘দুইপুরুষ’-এ সুশোভন ইত‍্যাদি। এ সব চরিত্রে তখন পেশাদারি মঞ্চ কাঁপিয়েছেন বিশ্বনাথ ভাদুড়ী, নরেশচন্দ্র মিত্র, ছবি বিশ্বাস, জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ডাকসাইটে অভিনেতারা। সেই সব মাথায় রেখে দুরুদুরু বুকে অভিনয় করতে হয়েছে উত্তমকে। কিন্তু প্রত‍্যেক ক্ষেত্রেই সফল। প্রশংসা পেয়েছেন দর্শকদের কাছ থেকে। আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল অনেকখানি।

উত্তমকুমার চাকরি করতেন পোর্ট কমিশনার্স-এ। সেখানে শরদিন্দু বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের হাসির নাটক ‘ডিটেকটিভ’-এ মুখ‍্য চরিত্রে দুর্দান্ত কমেডির অভিনয় করলেন। অফিস ইনস্টিটিউটের সেক্রেটারি মনোতোষবাবু প্রথমে এই চরিত্রে উত্তমকে নিতে চাননি। কিন্তু পরে তিনিই প্রদান করলেন স্বর্ণপদক।

শুরুর বেশ কয়েক বছরের সংগ্রাম-পথ পেরিয়ে যখন পর্দায় প্রতিষ্ঠা ঘটছে, তখন ১৯৫০ দশকের গোড়ার দিক। সেই সময় এল পেশাদারি মঞ্চের ডাক। জহর গঙ্গোপাধ্যায় নিয়ে গেলেন ‘স্টার’-এ। সেখানে নিরুপমা দেবীর গল্প অবলম্বনে দেবনারায়ণ গুপ্তের নাট‍্যরূপে ‘শ‍্যামলী’ নাটকে নায়ক অনিল-এর চরিত্রে ১৯৫৩-র ১৫ অক্টোবর থেকে একটানা ৪৮৪ রাত্রি অভিনয় করলেন উত্তম। পরিচালক ছিলেন শিশির মল্লিক ও যামিনী মিত্র। শিল্পী সমাবেশ ছিল তাক লাগানো— সরযূবালা দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, রবি রায়, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, অপর্ণা দেবী, শ‍্যাম লাহা, অনুপকুমার, ভানু বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় প্রমুখ। অসম্ভব জনপ্রিয় হয় নাটকটি। উত্তমের অভিনয় দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল। তখনকার এক বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকে অকুণ্ঠ সুখ‍্যাতি করা হয় তাঁর অভিনয়ের। এ প্রসঙ্গে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র মন্তব্য ছিল তাৎপর্যপূর্ণ— “অনিলের ভূমিকায় উত্তমকুমার পর্দার চেয়ে মঞ্চের অভিনয়েই বেশি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।” ইংল্যান্ডের খ‍্যাতনামা অভিনেতা-দম্পতি স‍্যর লুইস কেসন ও সাইবিল থর্নডাইক দেখেছিলেন নাটকটি। তাঁরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন উত্তমের অভিনয়ে।

সিনেমা-পত্রিকায় নাটকের বিজ্ঞাপন।

ছবির জগতে ব‍্যস্ততার কারণে, পেশাদারি মঞ্চ থেকে সরে আসতে বাধ‍্য হলেও, উত্তমকুমার যখনই পেরেছেন, নাটক করেছেন। যেমন অপেশাদার মঞ্চে তিনি ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে অভিনয়ে করতেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সত‍্য বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের মতো শিল্পীরা। সে কালে ‘অভিনেতৃ সংঘ’ থেকে বেরিয়ে গিয়ে উত্তমকুমারের উদ‍্যোগে বেশ কিছু শিল্পী তৈরি করেছিলেন ‘শিল্পী সংসদ’। এই সংস্থাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্যে নানা রকম উদ‍্যোগ করেছেন তিনি, যার মধ্যে নাট‍্য-প্রযোজনা অন‍্যতম। সংসদের অনুষ্ঠানে একের পর এক মঞ্চস্থ হয়েছে ‘পুনর্মিলন’, ‘নীলদর্পণ’, ‘সাজাহান’ ইত্যাদি। সব ক’টিতেই অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে থাকতেন উত্তমকুমার। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র সদনে হয়েছিল ‘অলীকবাবু’ নাটক। এতে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়-সহ একটি গানও (মনের আয়নায় দেখ কি তোমারে) গেয়েছিলেন তিনি। সে দিনই অভিনীত ‘অভিসার’ গীতিনাট‍্যে নায়কের ভূমিকায় ছিলেন উত্তমকুমার, এবং তিন নায়িকা ছিলেন বাসবী নন্দী, লিলি চক্রবর্তী ও জ‍্যোৎস্না বিশ্বাস। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ও শ‍্যামল মিত্রের সুরে তিনটি গান ছিল গীতিনাট‍্যটিতে। যার মধ‍্যে দু’টি গেয়েছিলেন শ‍্যামল মিত্র (‘কেন তুমি ফিরে এলে না’ ও ‘বাজে বাজে পায়েল বাজে’) এবং আর একটি ছিল উত্তম-কণ্ঠে (‘বলো না কী নামে ডাকব তোমায়’)। এ ছাড়া একটি রামপ্রসাদী গানও ব‍্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরের পয়লা তারিখে মঞ্চায়িত ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘আলিবাবা’ নাটকে ‘বাবা মুস্তাফা’-র চরিত্রে অতুলনীয় অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার। তা এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, নাটকটি আবারও মঞ্চস্থ করতে হয়েছিল ১১ সেপ্টেম্বর। ‘শিল্পী সংসদ’-এর প্রযোজনায় ও উত্তমকুমারের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের হাসির নাটক ‘সূক্ষ্ম বিচার’ মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৭৩-এর ১৪ মে, বিশ্বরূপায়। অভিনয় করেছিলেন বিকাশ রায় ও পরিচালক নিজে। নাটকের নির্বাচন দেখলেই বোঝা যায়, চিত্রজগতের ম‍্যাটিনি আইডল হয়েও, সুযোগ হলেই নাটকের সঙ্গে যুক্ত থেকে কী ভাবে নানা বৈচিত্রের পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন মহানায়ক।

১৯৬৮ সালে, যখন উত্তমকুমার মধ‍্যগগনে, সেই সময় এক দিন সকালবেলা তিনি দেবনারায়ণ গুপ্তকে ফোন করে পুনরায় পেশাদারি মঞ্চে অভিনয়ের ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “...ক’দিন ধরে ভেবে আমি মনস্থ করেছি, মঞ্চে অভিনয় করব। এমন একটা বই কি লিখতে পারেন না, যাতে প্রথম অঙ্কের শেষের দিক থেকে শেষ অঙ্ক পর্যন্ত আমার চার-পাঁচ বার অ্যাপিয়ারেন্স থাকে?” যে কোনও কারণেই হোক, তা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু, এখান থেকে একটা লক্ষণীয় দিক উঠে আসে। ওই ১৯৬৮-তেই একটি পত্রিকায় উত্তমকুমারের লেখা ‘আলোর পিপাসা’ নামে একটি ছোট নিবন্ধে যন্ত্রণামিশ্রিত তীব্র টানাপড়েনের প্রকাশ ঘটেছিল। যেখানে তিনি তাঁর চার পাশে থাকা ‘অন্ধকারের বৃত্ত’ থেকে বেরিয়ে ‘আলোর জগতে’ যেতে চাইছেন, “যেখানে কিছুই মেকি নয়, কিছুই কৃত্রিম নয়।” মনে রাখতে হবে, যখন তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখন এ রকম উপলব্ধির প্রকাশ ঘটছে তাঁর! তা হলে কি সেই আলোর জগতের সন্ধান তিনি নাট‍্যমঞ্চ থেকে পেতে চাইছিলেন তখন? আর তারই জন‍্যে ফোনে ওই ইচ্ছেপ্রকাশ?

কৃতজ্ঞতা: সঞ্জয় সেনগুপ্ত, ছবি সৌজন্য: হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর— উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement