সঙ্গীত পরিচালক কাজিসাহেব

‘গোরা’ ছবির গান নিয়ে বাধা এসেছিল, রবীন্দ্র হস্তক্ষেপে মিটে যায় সব। ‘গোরা’ ছবির গান নিয়ে বাধা এসেছিল, রবীন্দ্র হস্তক্ষেপে মিটে যায় সব।

Advertisement

অভীক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৯ ০০:০১
Share:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাস থেকে ছবি বানিয়েছিলেন নরেশচন্দ্র মিত্র। ‘দেবদত্ত ফিল্ম’-এর প্রযোজনায় তা মুক্তি পায় ১৯৩৮-এর ৩০ জুলাই। ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম। তাতে বাধা কম আসেনি।

Advertisement

ছবি মুক্তির আগে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল, তা দেখে বিশ্বভারতী মিউজ়িক বোর্ড আপত্তি তুললেন। তাঁদের বক্তব্য, কাজী নজরুল ইসলাম কি রবীন্দ্র-গানের মর্যাদা রাখতে পারবেন? কেন এ কাজ করার আগে তাঁদের অনুমতি নেওয়া হল না? মুশকিলে পড়লেন নির্মাতারা, কারণ ছবির কাজ তখন সম্পূর্ণ। শুধু মুক্তির অপেক্ষা। এখন তা আটকে গেলে ভীষণ সমস্যা। বিশ্বভারতীর পর্যবেক্ষকেরা ছবিতে সংযোজিত রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি শুনে তা ত্রুটিমুক্ত নয় বলে রায় দিলেন। পরিচালক ভেবেছিলেন, স্বয়ং নজরুল যেখানে সঙ্গীত পরিচালক, সেখানে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই কোনও আপত্তি করবেন না। তাই আর অনুমতি নেওয়ার কথা ভাবেননি। এখন?

‘গোরা’ ছবির প্রিন্ট আর একটা ছোট প্রজেক্টর সঙ্গে করে, গাড়ি নিয়ে নজরুল সোজা রবীন্দ্রনাথের কাছে শান্তিনিকেতনে হাজির। নজরুলকে দেখে তো কবি মহাখুশি। নজরুল ছবি সংক্রান্ত সমস্যার কথা খুলে বললেন কবিকে। বাঁধন সেনগুপ্ত ‘রবীন্দ্রনাথের চোখে নজরুল’ রচনায় লিখেছেন, সব শুনে কবি রীতিমতো বিস্মিত ও অসন্তুষ্ট হয়ে নজরুলকে বলেছিলেন, ‘‘কী কাণ্ড বলতো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান আর ওরা কোন আক্কেলে তার দোষ ধরেন? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশী বুঝবে! আমার গানের মর্যাদা ওরা বেশী দিতে পারবে?’’ কবির মন্তব্য শুনে নজরুল আশ্বস্ত হলেন। বললেন, তবু কবির লিখিত অনুমতি দরকার, নইলে ছবি মুক্তি পাবে না। তিনি ছবির প্রিন্ট ও প্রজেক্টর নিয়ে এসেছেন, রবীন্দ্রনাথ ছবি দেখে যা লেখার লিখে দিন। শুনে কবি বলেছিলেন, ‘‘ছবি দেখাতে চাও সকলকেই দেখাও, সবাই আনন্দ পাবে। আপাতত দাও কিসে সই করতে হবে।’’ আর কিসের বাধা!

Advertisement

‘গোরা’ মুক্তি পেল কলকাতার ‘চিত্রা’ (পরে ‘মিত্রা’) প্রেক্ষাগৃহে। ছবিতে অভিনয় করলেন জীবন গঙ্গোপাধ্যায়, রাণীবালা, প্রতিমা দাশগুপ্তা, রমলা দেবী, রাজলক্ষ্মী দেবী, মোহন ঘোষাল, নরেশ মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, রবি রায়, ললিত মিত্র, মনোরমা দেবী, বীণা, ইলা দাস, সুহাসিনী দেবী, বিনয় মুখোপাধ্যায় ও আরও অনেকে।

ছবিতে মোট পাঁচটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেছিলেন নজরুল। ‘সখী প্রতিদিন হায়’, ‘ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি’, ‘রোদনভরা এ বসন্ত’, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ এবং আংশিক ভাবে ‘মাতৃমন্দির পুণ্য অঙ্গন’। গানগুলি গেয়েছিলেন রাণীবালা ও প্রতিমা দাশগুপ্ত। এ ছাড়া সমবেত কণ্ঠে ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ ও বিভিন্ন সংস্কৃত স্তোত্র। ছবির একটি রোম্যান্টিক দৃশ্যে নিজের লেখা একটি গানও ব্যবহার করেছিলেন নজরুল। দৃশ্যটিতে তখন সবে ভোর হচ্ছে। নদীর বুকে চলন্ত স্টিমারের কেবিনে ঘুমিয়ে ‘ললিতা’(প্রতিমা দাশগুপ্তা)। বাইরে ডেকে চেয়ারে আধো ঘুমন্ত ‘বিনয়’ (মোহন ঘোষাল)। হঠাৎ ললিতার ঘুম ভেঙে যেতে তিনি এসে দাঁড়ালেন জানালায়। বাইরে এসে একটি চাদর টেনে দিলেন বিনয়ের গায়ে। নজরুল-রচিত গানটি ভেসে এল নেপথ্যে। রোম্যান্টিক আবহ তৈরি হল ভোরের পরিবেশে।

ঢিমে ত্রিতালে রাগাশ্রয়ী এই গানটি তৈরি করেছিলেন নজরুল। গেয়েছিলেন সেই সময়ের এক প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী ভক্তিময় দাশগুপ্ত। গানের কথাগুলো ছিল: ‘ঊষা এলো চুপি চুপি রাঙিয়া সলাজ অনুরাগে/ চাহে ভীরু নববধূ সম তরুণ অরুণ বুঝি জাগে।। শুকতারা যেন তার জলভরা আঁখি/ আনন্দে বেদনায় কাঁদে থাকি’ থাকি’/ সেবার লাগিয়া হাত দুটি/ মালার সম পড়ে লুটি/ কাহার পরশ-রস মাগে।।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement