রুবিক্স কিউব।
গোলকধাঁধা নয়, বলা যায় ঘনক ধাঁধা। আর সেই ঘনকের দুরন্ত জাদুতে মজে বিশ্বের আট থেকে আশি।
তাক লাগানো ধাঁধার সূত্রপাত অর্ধশতক আগে। ইউরোপ আমেরিকা হয়ে সে উন্মাদনার রেশ এসে পড়েছিল এশিয়ার নানা দেশেও। বয়স, পেশা নির্বিশেষে লোকজন যেন খেপে উঠল রাতারাতি। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হয়ে উঠল যে, অফিসযাত্রী ট্রেন বা বাস মিস করে বসে রয়েছে প্ল্যাটফর্ম বা বাসস্টপে। যাত্রী পেরিয়ে এসেছে তার নির্দিষ্ট স্টেশন। শ্রমিক সময়মতো পৌঁছয়নি কারখানায়। খেলোয়াড় ভুলে গেছে মাঠে নামতে। জগৎসংসার ভুলে সবাই নেশায় বুঁদ।
দেখা যেত, প্রত্যেকেই মগ্ন একটি রঙিন ঘনক আকারের খেলনা নিয়ে। সারা ক্ষণ তাতে ডাইনে-বাঁয়ে মোচড় দিয়ে চলেছে, আর কোনও দিকে হুঁশ নেই। যার নেশায় জাপান বা চিনের মতো নিয়মানুবর্তিতার দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে নিয়মহীন পরিস্থিতি। বার বার মোচড় দিয়েও সমাধান না করতে পেরে তারা বিরক্ত, অথচ থামার নাম নেই। আজও অটুট তার সম্মোহন।
অথচ নেহাতই খেলার ছলে রুবিক’স কিউবের আবিষ্কার। আবিষ্কারক এরনো রুবিক-এর নাম অনুসারে এর নামকরণ। রুবিক’স কিউব একটি ছয় তলযুক্ত রঙিন ঘনক, আর তার রঙিন অংশগুলো ডাইনে বাঁয়ে উপর-নীচে যথেচ্ছ ঘোরানো সম্ভব। এর ছ’টি তলের প্রত্যেকটি আলাদা রঙের। প্রতিটি তলে রয়েছে সেই রঙের ন’টি করে বর্গক্ষেত্র। কিন্তু মোচড় দিয়ে সেই রঙিন বর্গগুলি এলোমেলো করার পর, তা আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা বেশ কঠিন। এবং এটাই চ্যালেঞ্জ।
মার্টিন কুপার ও এরনো রুবিক— দু’জনেই প্রায় একই সময়ে দু’টি ভিন্ন ধরনের আবিষ্কারে পৃথিবী তোলপাড় করে দিয়েছিলেন। একটি নেহাতই খেলনা ধাঁধা, আর অপরটি বদলে দিল সারা পৃথিবীর যোগাযোগ মাধ্যমকে। এক জনের আবিষ্কার একটি ম্যাজিক কিউব, অন্য জন আবিষ্কার করলেন মোবাইল ফোন বা সেলফোন। মার্টিন কুপার সেলফোনের জনক, আর এরনো রুবিক রুবিক’স কিউবের।
দু’জনের কেউই হয়তো আবিষ্কারের সময় বুঝে উঠতে পারেননি, সেগুলি বিশ্ব জুড়ে এত জনপ্রিয়তা লাভ করবে এবং মানুষকে আটকে ফেলবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
রুবিক’স কিউবের জনক এরনো রুবিক ছিলেন এক জন হাঙ্গেরিয়ান স্থপতি। বুদাপেস্টের বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করেন। তার পর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করেন শিক্ষকতা। রুবিক’স কিউব আবিষ্কারের ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় সেখানে একটি বিশেষ বিষয়ের কোর্স ছিল। তা হল, বিভিন্ন ধরনের আকার ও ফর্ম নিয়ে পঠন-পাঠন। ঘনক এমন একটি আকার, যা স্থান ও অবস্থান (স্পেস ও পজ়িশন) বদলাতে পারে। এই বদলের ধরনগুলি দেখতে দেখতে হঠাৎ তিনি খেয়াল করেন যে, কোনও চতুষ্কোণ ঘনকের যদি বিভিন্ন অংশগুলি বদলানো হয়, তবে তা আগের অবস্থায় নিয়ে আসতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রায় অবিশ্বাস্য দীর্ঘ সময় নেয়।
ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি বোঝানোর মডেল তৈরি করতে গিয়ে তিনি বানিয়ে ফেললেন বিশ্বের সেরা জটিল কিউব। রুবিক’স কিউবের শুরু হয়েছিল কাঠের ব্লক দিয়ে। প্রথমে এটি ছিল টু বাই টু ব্লক, অর্থাৎ ঘনকের প্রতিটি তলে চারটি করে বর্গক্ষেত্র, যেগুলি ইচ্ছেমতো ঘোরানো সম্ভব। পরে সেটি আরও জটিল হয়ে আসে থ্রি বাই থ্রি ব্লক হিসেবে, যেখানে প্রতিটি পৃষ্ঠে ন’টি করে বর্গক্ষেত্র থাকে এবং স্বাভাবিক ভাবেই ধাঁধা আরও কঠিন হয়ে ওঠে।
১৯৭৪ সালের বসন্তে, মাত্র ২৯ বছর বয়সে রুবিক তৈরি করেন তার আশ্চর্য কিউব। এই বছরেই অর্ধশতক পূর্ণ করবে এই ধাঁধাটি। প্রথমে তৈরি করেছিলেন কাঠ এবং কাগজ দিয়ে। ছোট ছোট ঘনক জুড়ে এমন একটি বড় ঘনক তৈরি করার চেষ্টা করেন, যাতে এই ছোট ছোট ঘনককে যে দিকে খুশি ঘোরানো যেতে পারে। কিন্তু দু’-এক বার মোচড় দিতে তা ভেঙে পড়ে। আবার নতুন চেষ্টায় শেষে বানালেন কাঠের ঘনক।
তখনকার দিনে ইন্টারনেট বা ইউটিউব ছিল না, যেখানে সমাধানের সহজে পথ দেখা যায়। আবিষ্কর্তার নিজের আবিষ্কৃত কিউবের সমাধান করতে সময় লেগেছিল প্রায় এক মাস! ধাঁধার আবিষ্কর্তাই নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন সমাধান করতে। যদিও পরবর্তী কালে তিনি সমাধান করতেন কয়েক মিনিটে। বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অবশ্য ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা এখন চার থেকে সাত সেকেন্ডের মধ্যে সমাধান করে দেয়।
নিতান্তই খেলার ছলে আবিষ্কৃত ধাঁধা-কিউবটির জন্য রুবিক হাঙ্গেরির পেটেন্ট অফিসে আবেদন করেন, যাতে একটি ত্রিমাত্রিক লজিক্যাল খেলনা হিসেবে একে স্বত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালে হাঙ্গেরির এক খেলনা প্রস্তুতকারক সংস্থা এটির মাত্র পাঁচ হাজার কপি তৈরি করে বাজারে আনে। তখন নাম ছিল ‘রুবিক’স বুভোস কোকা’ বা রুবিকের ম্যাজিক কিউব। আবির্ভাবের পরের দু’বছরে তিন লক্ষ এই খেলনা বিক্রি হয়েছিল শুধু হাঙ্গেরিতে।
কমিউনিস্ট ঘেরাটোপে থাকা হাঙ্গেরি থেকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের সুযোগ ছিল কম। কারণ তখনও পর্যন্ত হাঙ্গেরি থেকে কিছু রফতানির সুযোগ ছিল না। এই পরিস্থিতিতে ‘আইডিয়াল টয়’ নামে একটি মার্কিন কোম্পানি রুবিকের কাছ থেকে কিউব-ধাঁধা বিদেশে বিক্রি করার অনুমতি পায় এবং তার পরেই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রুবিক’স কিউব। ১৯৮০ সালে নিউ ইয়র্কের ‘আইডিয়াল টয়’ কিউবের বিপণন ও উৎপাদনের দায়িত্ব নেয় এবং প্রথম বছরেই ২৩০ লক্ষ কিউব বিক্রি করে। বিশ্ব জুড়ে রুবিক’স কিউবের উন্মাদনার হদিস পাওয়া যায় এর বিক্রির সংখ্যাতেই।
ঠিক কী ভাবে ঘোরালে রুবিক’স কিউবের সমাধান হতে পারে, তার কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। আর নেই বলেই খেলাটি এত জনপ্রিয় ও জটিল। একটি সমীক্ষার মতে, পৃথিবীর যাঁরা এই ধাঁধাটি সমাধানের চেষ্টা করেন, তার মাত্র ৬ শতাংশ লোক এটি সমাধান করতে পারেন। আর ৯৪ শতাংশ লোক সমাধানের চেষ্টা করেও বিফল এবং বিরক্ত হন, কিন্তু এর নেশা ছাড়তে পারেন না।
যে মার্কিন কোম্পানি রুবিক’স কিউবের প্রচার ও বিপণনের দায়িত্ব নিয়েছিল, তারা এটি বাজারে আনার পরেই বুঝতে পারল যে, শুধু বিক্রি করলে হবে না। কিউব সমাধানের রাস্তা না দেখালে বাজার ধরা কঠিন। কারণ দু’-এক বার ব্যর্থ হয়ে মানুষ ‘সমাধান অসম্ভব’ ধরে নিয়ে মুখ ফেরাবে রুবিক’স কিউব থেকে। আবিষ্কর্তা ভিন্ন কিউবের সমাধান তখনও পর্যন্ত কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। খেলনার মেলায় অধ্যাপক রুবিকের কাজ ছিল তাঁর আবিষ্কৃত কিউবটির স্থান পরিবর্তন করে জটিল সমস্যা তৈরি করা এবং তা ফের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেটাকে পূর্বাবস্থায় নিয়ে এসে সমাধান দেখানো। মেলায় রুবিক যখন নিজের হাতে তাঁর কিউবের পরিবর্তন ও তার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার কৌশল দেখালেন, তা ছড়িয়ে পড়ল বিশ্বের সারা প্রান্তে। রুবিক’স কিউবের সমাধানও যে সম্ভব, তা জানতে পেরে বেড়ে উঠল নেশা।
রুবিক’স কিউব নির্মাতা সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবী জুড়ে তাদের প্রায় ৩৫ কোটি কিউব বিক্রি হয়েছে। তা ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থা চলতি মডেলকে নকল করে বহু লক্ষ কোটি বাজারে বিকিয়েছে, যার মধ্যে চিনা সংস্থার পরিসংখ্যান অজানা।
স্রেফ রয়্যালটির টাকায় রুবিক হতে পারতেন কোটিপতি। তা না করে জীবন কাটিয়ে দিলেন ২০০ ডলারের বেতনে। তিনি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন— তাঁর তৈরি পাজ়ল সমাধানে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। তাঁর আবিষ্কৃত ধাঁধার বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়তা ছাপ ফেলে সে সময়ের শিল্প, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপন-সহ বহু ক্ষেত্রে। ‘দ্য পারস্যুট অব হ্যাপিনেস’ কিংবা ‘ইন আ বেটার ওয়ার্ল্ড’-এর মতো সিনেমাতে গল্পের অংশ হিসেবে এসেছে রুবিক’স কিউবের কথা।
যা জটিল, যা আপাত-অসম্ভব, তার প্রতিই হয়তো মানুষের টান চিরন্তন। এই কথাটিই হয়তো রুবিক’স কিউবের বিপুল জনপ্রিয়তার রহস্য।