ছবি সুব্রত চৌধুরী।
উনিশ শতকের কলকাতা। তখনও ছিল বিবাহ-বহির্ভূত প্রেম। ঘরে-বাইরে নানা গোপন সম্পর্ক। কখনও স্বামীকে জোর করে বিষ খাওয়ানো, কখনও আবার স্ত্রীর আত্মহত্যা। বাবুরা বেশির ভাগ সময় বাগানবাড়িতে স্ফূর্তির ফোয়ারায়, বিবিরা শয্যায় একাকিনী। দাম্পত্যে সমান অধিকারের কথা সে দিন কল্পনাও করতে পারত না এই শহর।
সেন্স, ফ্রান্সের একটি ছোট্ট জনপদ। সেখানকার এক গৃহবধূ ক্লডিন, স্বামীর শারীরিক নিগ্রহের জ্বালায় এক দিন ঘর ছাড়ল। গিয়ে উঠল স্থানীয় সরাইখানার মালিক জঁ ব্যাস্টনের বাড়ি। খবর পেয়ে স্বামী টমাস সেখানে গিয়ে হাজির। তার পর বহু তোতাইপাতাই করে আর কিচ্ছুটি করবে না— এই ভাঁওতা দিয়ে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এল। দু’দিন পরেই আবার যে-কে-সেই। অত্যাচার চরমে পৌঁছলে ক্লডিন ফের বেরিয়ে পড়ল। এ বার গেল সেন্ট অ্যান্টনিজ় গেটের বাসিন্দা জনৈক কর্মকার, গ্রাফিকার্ট-এর বাড়ি। আবারও একই গল্প। টমাসের যথারীতি সেখানে পৌঁছে যাওয়া এবং ভুলিয়ে-ভালিয়ে স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসা। একই ভাবে ফেরার পরে সেই অত্যাচার, তবে এ বারে একেবারে মারধর করে ঘায়েল করে ফেলল স্ত্রীকে। পরিণতিতে ক্লডিন আবার ঘরছাড়া। এ বার ঠিকানা জনৈক চপিনের বাড়ি। দু’দিন পর টমাস ফের সেখানে গিয়ে হাজির। কিন্তু এ বার আর অনুরোধ-উপরোধ নয়, দস্তুরমতো লাঠ্যৌষধি। রীতিমতো মারতে মারতে বেয়াদব বৌকে এনে ঘরে তোলে টমাস।
এ বার কিন্তু ব্যাপার অত সহজে মিটল না। ক্লডিনের নতুন এই প্রেমিকটি সহজে হাল ছাড়ার পাত্র ছিল না। সে এসে চড়াও হয় টমাসের বাড়ি। প্রথম দিন সুবিধে হল না। দিন দুয়েক পর ফের সে হাজির দলবল নিয়ে। শুরু হয় ডুয়েল। মাঝে এসে পড়ে বেচারি ক্লডিন। উত্তেজিত টমাসের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে ক্লডিনের উপর। তাকে বলতে শোনা যায়, “শেষ অবধি কিনা একটা বেশ্যার জন্য মরব!” এই বলে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত ক্লডিনকে, এ বারে সে বেচারি একেবারে না ফেরার দেশেই চলে গেল।
ইতিহাসের দুনিয়ায় সুপ্রসিদ্ধ গল্পবলিয়ে লরেন্স স্টোন-এর ভক্ত নাটালি জেমন ডেভিসের লেখা ‘ফিকশন ইন দ্য আর্কাইভস/ পারডন টেলস অ্যান্ড দেয়ার টেলারস ইন সিক্সটিন সেঞ্চুরি ফ্রান্স’-এ পড়া এই কাহিনিকে কেউ নিছক ব্যভিচারী মহিলার গল্প হিসেবে দয়া করে পড়বেন না। বরং দেখুন, কাছের মানুষটির অবহেলা, অত্যাচারের শিকার হয়ে শান্তির আশায় ষোড়শ শতকে এক ফরাসি গৃহবধূর ঘর বদলের চেষ্টার কিস্সা হিসেবে। পরিণতি জেনেও শুধু একটু ভালবাসা, সম্মান আর নিরাপত্তার সন্ধানে সে বার বার ছুটে বেড়িয়েছে বেপরোয়া ভাবে। শাকিল বদায়ুনি, নৌশাদ আর লতা মঙ্গেশকর ত্রয়ীর অমর প্রোডাকশন— ‘জব পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’ মনে করিয়ে দেয়। সত্যিই ‘চোরি’ তো কিছু করেনি! একটু উষ্ণতার জন্য বেচারি মনই তো
দিয়ে ফেলেছিল।
অনাদর অত্যাচারের এই গল্প তো সব দেশে, সব কালে, সবার মধ্যেই ছিল। উনিশ শতকে লেখা ‘আপ্নার মুখ আপুনি দেখ’-তে ভোলানাথ মুখুজ্জে কী বলছেন? বলছেন, কত কত বাবু অসহ্য বিরহশয্যায় স্ত্রীকে ফেলে রেখে সমস্ত রাতের জন্য বেরিয়ে যান। আর বাড়িতে পরাধীন “চিরদুঃখিনী বনিতারা কেহ কেহ বা কড়িকাট গুনতে গুনতে কাট হচ্ছে কারও চোখের জলে বিছানা ভাসছে। বাবুদের এসব দিকে কোন দৃষ্টি নেই।” দৃষ্টি নেই বলেই তো গ্রামের পুকুরঘাটে বসা মেয়েদের পার্লামেন্টের সদস্যাদের মুখে লালবিহারী দে বসালেন এমন সংলাপ— অলঙ্কার তো স্বামীর ভালবাসার চিহ্ন নয়। স্বামী স্ত্রীর গা অলঙ্কারে ভর্তি করে দিলেও ভাল না বাসতেই পারে। কলকাতায় এমন অনেক লোক আছে যারা বৌয়ের সারা শরীর গয়না দিয়ে মুড়ে রাখে। কিন্তু তাতে কী? এই সব বাবু কালেভদ্রে বাড়িতে রাত কাটায়।
১৮৭০-এ লেখা ‘মাগ-সর্ব্বস্ব’ প্রহসনে এ কথাই তো চটুল করে বলা হয়েছিল, পাড়ার কিছু আহাম্মক নাকি সারা দিন ‘রাঁড়’ নিয়েই আমোদ করে, কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে ভাশুর-ভাদ্রবৌ সম্পর্ক। লিখছে ‘আরে ব্যাটারা তোরা রাঁড়ের বাড়িতে লোচ্চাম করতে যাস্ সমস্ত রাত কাটিয়ে আসিস তোদের মাগ্কে ঠান্ডা করে কে? তারাও তো লোচ্চা খুঁজে বেড়ায়?’ সমাজ তো সে কালে এই ‘লোচ্চা’ খোঁজা মেয়েমানুষদেরও মানতে পারেনি, ‘লোচ্চা’দেরও মানতে পারেনি। এ কালেও কি পেরেছে? কত বৌ তাই নিঃশব্দে নিজেদেরই শেষ করে দিয়েছিলেন।
হোগলকুঁড়ের রাজু নন্দীর ১৮ বছরের ধর্মপত্নী, স্বামীর ‘দুশ্চরিত্র জন্য জ্বলিতাঙ্গ’ হয়ে গলায় দড়ি দিয়ে নিজেকে শেষ করেন। ১৮৫৬ সালের ১৬ জুলাই ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখেছে, যে সমস্ত ‘বাবু’ ঘরের বৌ ফেলে ‘পরবধূ সম্ভোগে বিমোহিত’ হয় তাদের মতো ‘নির্দ্দয় হৃদয় পাপাত্মা এই জগতীপুরে’ আর দেখা যায় না। তাদের এই অপকীর্তির জন্যই ‘অবলাবালাগণ অসহ্য মন্মথজ্বালা সহ্যকরণে অক্ষম হইয়া কুলকলঙ্কিনী হয়, জারজ সন্তান প্রসব করে, বেশ্যা শ্রেণীতে মিলিত হয়, স্থান বিশেষে এবম্প্রকারে [আত্মহত্যা] হত হইয়া থাকে।’ কলকাতার বাইরেও তো কত ঘটনা ঘটত। স্বামীদের ভালবাসা না থাকায় কৃষ্ণনগরের কাছে এক গ্রামের ১৬ আর ১৭ বছরের দু’টি মেয়ে গলায় দড়ি দেয়। অথচ মেয়ে দুটি নাকি এতই সুন্দরী ছিল যে, দেখলে মনে হয় যেন ‘লক্ষ্মী স্বয়ং মূর্তি ধারণ পূর্বক ক্রীড়ার্থে ধরণীতলে অবতীর্ণ হইয়াছেন।’ তেমনটাই লেখা হয়েছিল ‘এডুকেশন গেজেট ও সাপ্তাহিক বার্ত্তাবহ’ কাগজে, তারিখটি ছিল ১৮৭২ সালের ৩ মে।
স্বামীর দূরে বাস বা অবহেলার কারণে নারী হৃদয়ের কষ্ট তো সে কালে কবিতার বিষয়বস্তুও হয়েছে। কেদারনাথ সেন এর ‘কান্তবিচ্ছেদ’-এর দু’টি লাইন বেশ মনকাড়া— ‘শীতের আগমনে যবে এই ধরাতল/ ভিন্নরূপ ভাব ধরি হইবে শীতল/ শুইতে হইবে যবে লেপ গায়ে দিয়া/ একাকিনী শয্যাপরি থাকিব পড়িয়া/ সে সময় না দেখিলে তোমার বদন/ রবে না রবে না কভু রবে না জীবন।’ খবরের কাগজে এমন সতর্কবাণীও থাকত, ‘বহুদিন একাকী বিদেশে থাকিলে পুরুষের শরীরে নানা দোষ স্পর্শ করে।’ আর ‘কামিনী’ বাড়িতে একা থাকলেও কুলে কলঙ্ক লাগার আশঙ্কা।
সবাই মুখ বুজে অনাদর সয়েছেন এমন নয়। ১৮৯০-এর ঘটনা। কুষ্টিয়ার চাপড়া নিবাসী ললিতমোহিনী যেমন। বাপ-মা মেয়ের সুখ চেয়ে জমিদার বাড়িতে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ির প্ররোচনায় স্বামীটি দ্বিতীয় বার বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। শুধু তা-ই নয়, ললিতকে পাগল বলে পর্যন্ত প্রচার করা হল। পরিণতিতে পিত্রালয়ে প্রত্যাবর্তন। সেখান থেকে স্বামীকে পাওয়ার জন্য লম্বা লম্বা চিঠি লেখা, লোক পাঠানো, এত সবের পর আদালতে নালিশ। অনেক টাকার ডিক্রি পেয়েও শান্তি হল না। মৃত্যুর আগে করে যাওয়া উইলের এক জায়গায় লেখা ছিল, যিনি তাঁর মৃত্যুর পর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ও তাঁর জীবনী সম্বন্ধে সর্বোৎকৃষ্ট গ্রন্থ লিখতে পারবেন, তিনি তাঁর সম্পত্তি থেকে ৩০০ টাকা পুরস্কার পাবেন।
নিজেকে শেষ করা বা আইনের দ্বারস্থ হওয়া, এর বাইরেও আর একটা পথ ছিল। মনের মানুষ খুঁজে নেওয়া। স্বামী বারবনিতা গৃহে যাতায়াতের সূত্রে যৌনরোগের শিকার হয়েছেন, স্ত্রী তার শয্যাসঙ্গিনী হতে চাননি। উল্টে ঘটিয়ে ফেললেন বিপ্লব, নিজের মামার মধ্যেই খুঁজে পেলেন ভরসার মানুষকে। উনিশ শতকের কলকাতা তোলপাড় করা ঘটনা। তার আগেও ছিল। নেহাত তখন ছাপাখানা ছিল না বলে জানা যায় না।
}প্রথম পাতার পর
বাবু ঈশ্বরচন্দ্র মিত্রের বিবাহিত কন্যা ক্ষেত্রমণি তার মাতুল উপেন্দ্রলাল বসুর প্রেমে পড়েন। মেয়েটি লেখাপড়া জানত। ব্যস! অমনি সব দোষ গিয়ে পড়ল স্ত্রীশিক্ষার ওপর। তিন দিন ধরে চলেছিল ব্যভিচারের মামলা। ১৮৭৮ সালের এই ঘটনায় ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ লিখেছিল, কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ে মামলার দিনগুলোয় দমবন্ধ অবস্থা হত। ‘সোমপ্রকাশ’-এ প্রকাশিত এই ঘটনার অনুবাদ সরকারি অনুবাদক এ ভাবেই করেছিলেন, ‘দ্য সারকামস্ট্যান্সেস অব দ্য কেস ইন্ডিকেট আ নিউ ফিচার ইন হিন্দু সোসাইটি।’ সুতানুটির হোগলকুড়িয়ার এই ঘটনা নিয়ে দস্তুরমতো দু-দু’খানা প্রহসন লেখা হয়েছিল, ‘মক্কেল মামা’ আর ‘মামা-ভাগ্নি নাটক’। এ গল্প তো পড়লাম সে দিন। আর কৈশোরে একটু মাতব্বর গোছের বন্ধুদের কাছে শোনা আর এক গল্প, ‘থাকতে ঘরে আপন স্বামী ভাগ্নে প্রেমে মজল মামী’ বাড়িতে আওড়াতে গিয়ে কেষ্টরাধিকার ভক্তিতে গদগদ পিতামহীর কাছে দু’-চার বার উত্তম-মধ্যম খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছি। আয়ান ঘোষকে আর এখানে টানলাম না।
স্বামীসঙ্গবঞ্চিতা বাঙালিনির অন্যত্র মন দিয়ে ফেলার গল্প কলকাতা পুলিশের প্রতিবেদনেই কি কম ছিল? বৌবাজারের সম্পৎ নামের সেই লোকটির কথা মনে পড়ে। স্ত্রীর উপর অকথ্য অত্যাচার করত। সম্পৎ-এর বন্ধু খিরাতি এসে তাকে ঘর ছাড়তে বললে মেয়েটি তা-ই করে। বৌ ফেরানোর জন্য তার সব ছলচাতুরি ব্যর্থ হয় এবং শ্রীঘরেও চালান করা হয় তাকে। কিন্তু যার হাত ধরে এই সব মেয়ে স্বামীর ঘর ছাড়ত, তারা সবাই নির্ভরযোগ্য থাকেনি। ১৮৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ বেরিয়েছিল, হাওড়ার একটি লোক ৩০০ টাকা দিয়ে একটি মেয়েকে বিয়ে করেন। তার পর বৌ ফেলে সম্ভবত অন্যত্র মজে যান। গিন্নি এমতাবস্থায় প্রেমিক জুটিয়ে ফেলেন। স্বামী আদালতের দ্বারস্থ হলে ওই ৩০০ টাকা মেয়েটিকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে বলা হয়, অনাদায়ে তাকে নিলামে চড়িয়ে টাকা আদায় করা হবে। এতে আপত্তি জানায়নি মেয়েটি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, যার ওপর ভরসা করে ঘর ছাড়া, তাকে কিন্তু আর দেখা গেল না। খবরের কাগজে লেখা হয় মেয়েটি ‘৩০০ টাকা দিতে অসমর্থ হওয়াতে নিরূপিত কালানুসারে নিলামে কোন মেতর কর্তৃক ক্রীতা হইয়াছে।’ কী অদ্ভুত!
প্রেমে মত্ত স্ত্রী স্বামী সংহারেও পিছপা হয়নি অনেক সময়। সোশ্যাল মিডিয়া তো ছিল না, খবরের কাগজের পাতা উল্টালেই এমন খবর তো কত চোখে পড়ত, ১৮ বছরের স্ত্রী ‘উপপতির পরামর্শে স্বকান্তের ভোজনের দ্রব্য সহিত গরল মিশ্রিত করিয়া তাহাকে ভক্ষণ করাইলে অভাগা পুরুষের প্রাণ ত্যাগ হয়।’ (সংবাদ প্রভাকর, ২৩ এপ্রিল ১৮৪৯)। হাইকোর্ট নথিতেও প্রচুর আছে। প্রেমিক লক্ষ্মীকান্তর সহযোগিতায় পান্তা ভাতের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে ঢাকার মুন্সীগঞ্জের কৃষ্ণমণি তার স্বামী হরিচরণ কাপালিকে হত্যা করেছিল। ঢাকার সেশন জজ কৃষ্ণমণিকে প্রাণদণ্ড দিলেও কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয় ১০ বছরের দ্বীপান্তরের আদেশ দেন।
স্থানীয় বা গ্রামসমাজে এই সব ঘটনা সে দিনও ব্যাপক আলোড়ন তুলত। সে সব নিয়ে মানুষজনের উদ্দীপনা ছিল নজরকাড়া। প্রণয়ঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলোর কথাই ধরা যাক। উনিশ শতকে নদিয়ার এই ঘটনাটি বিশেষ ভাবে সাড়া ফেলেছিল। ঘটনাস্থল, তৎকালীন পূর্ববঙ্গ রেলপথের আড়ংঘাটা স্টেশনের কাছে মামজোয়ান গ্রাম। সেখানে হারাধন রায় নামে এক রূপবান ব্রাহ্মণ যুবক মা-বাবা, স্ত্রী-পরিবার’সহ বাস করত। কর্মসূত্রে তাকে প্রায়ই বাইরে যেতে হওয়ায় পরিবারে যাতে সমস্যা না হয়, তাই সে বিহারীলাল বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তিকে গোমস্তা হিসেবে রাখে। বিহারী বয়সে যুবক, জাতিতে কৈবর্ত। সে সত্বর প্রেমে পড়ল হারাধনের যুবতী স্ত্রী মাতঙ্গিনীর। খবরের কাগজ লিখছে, বিশ্বাসের এই বিশ্বাসঘাতকতা দ্রুত সকলে জেনে যায়, হারাধনও। সুতরাং মাতঙ্গিনী প্রণয়ীর সঙ্গে ‘পরামর্শ করিয়া সুখের পথ হইতে কণ্টক দূর করিবার সংকল্প আঁটে। গুড ফ্রাইডের ছুটিতে প্রভু বাটী জাইলে একদিন রাত্রিতে বিশ্বাস মহাশয় গুপ্তভাবে তাহার বাটীতে প্রবেশ করিয়া তাহার গলায় ছুরি বসাইল। মাতঙ্গিনী পতিহত্যায় সহায়তা করিয়া নায়কের মন রক্ষা করে।’ (এডুকেশন গেজেট ও সাপ্তাহিক বার্ত্তাবহ, ২০ মে ১৮৮৭)।
দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘সেকালের স্মৃতি’-তেও আছে এই প্রসঙ্গ। লিখেছেন, ‘একদিন রাত্রিকালে মাতঙ্গিনী নিদ্রিত হারাধনের পদদ্বয় তাহার মৃণাল ভুজবন্ধনে আবদ্ধ করিলে, বেহারী সুশাণিত খড়্গ দ্বারা তাহার হতভাগ্য স্বামীর মুণ্ডচ্ছেদন করে। শুনিয়াছিলাম, মাতঙ্গিনী যখন হারাধনের পদদ্বয় উভয় হস্তে জড়াইয়া ধরিয়া তাহার আত্মরক্ষার পথ রুদ্ধ করিয়াছিল, সেই সময় তিনি হঠাৎ জাগিয়া প্রাণভয়ে তাহার পতিব্রতা পত্নীর দয়া প্রার্থনা করিয়াছিলেন, তাহাকে মুক্তিদান করিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন কিন্তু মাতঙ্গিনী তাহার কাতর প্রার্থনায় কর্ণপাত না করিয়া যথাসাধ্য চেষ্টায় তাহার উত্থানশক্তি রহিত করিয়াছিল। সেই অবস্থায় বেহারী খড়গাঘাতে তাহার মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে। মাতঙ্গিনী দ্বীপান্তরে নির্বাসিত হয়। বেহারীর ফাঁসি হয়।’
স্থানীয় সমাজে এই সব ঘটনার প্রতিক্রিয়ার কথা দীনেন্দ্রকুমারের মুখেই শোনা যাক, “কৃষ্ণনগর-স্টুডেন্টস কেস লইয়া নগরে যে বিপুল আন্দোলন আলোচনা আরম্ভ হইয়াছিল, সমাজের সকলস্তরে, এমন কি, ধনী ও দরিদ্রের অন্তঃপুরেও উৎসাহ ও উত্তেজনার আতিশয্য লক্ষিত হইতেছিল, তাহা প্রশমিত হইতে না হইতেই নদীয়ার সেশন আদালতে একটি খুনি মামলার বিচার আরম্ভ হইলে নগরের অধিবাসীরা সেই মামলার বিচার দেখিবার জন্য প্রত্যহ জজ-আদালত পূর্ণ করিতে লাগিল। আদালতের বাহিরের আঙিনায় প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বৃক্ষের সুদূর প্রসারিত শাখার ছায়ায় সমবেত হইয়া দূরদূরান্তের গ্রামবাসীরা সেই মামলার বিচার ফলের প্রতীক্ষা করিত। তাহাদিগকে দেখিয়া মনে হইত, সেখানে রথের মেলা বসে গিয়াছে!”
বলছেন, “আমরা সেশন আদালতে এই মামলার বিচারের সময় সেই শোণিতাপ্লুত খড়্গ এবং মাতঙ্গিনী ও বেহারীকে দেখিয়াছিলাম।’ সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের স্মৃতিতে থাকা এই সব ঘটনা, মুহূর্তে একটা সময়কে আমাদের সামনে তুলে ধরে। দীনেন্দ্রকুমার লিখছেন, সে সময়ে মাতঙ্গিনী আর বেহারীর অবৈধ প্রণয় ও হারাধনের হত্যাকাণ্ড অবলম্বনে কৃষ্ণনগর অঞ্চলে বহু গান রচিত হয়েছিল। নেড়া-নেড়িরা গোপীযন্ত্র ও ডুগি-মন্দিরা সহযোগে সেই গান গেয়ে নগর ও পল্লিবাসী গৃহস্থদের কাছে ভিক্ষে চাইতেন। একটি গানের কলি উল্লেখও করেছেন তিনি— ‘ভালো কীর্তি রাখল ব্রাহ্মণী,/ হারুবাবুর রমণী সেই মাতঙ্গিনী!’
গ্রামজীবনের এই ছবি শহরে পৌঁছত। ১৮৭৯-তে লেখা ‘এরা আবার সভ্য কিসে’ প্রহসনে পল্লিগ্রামের স্ত্রী-সমাজ সম্পর্কে বলা হচ্ছে ‘এদিকে মেয়েগুলো ভয়ানক ব্যভিচারিণী হয়ে উঠতেছে। ইহাদিগকে কিছুতেই দমন করা যায় না।’ আরও বলেছে, স্থানে স্থানে মেয়েরা কে কত জন ‘উপপতি কল্লে, কে কেমন নাগর ভুলানো ফাঁদ জানে, কার উপপতি কাকে কেমন ভালোবাসে’— এ ছাড়া কথা নেই।
পরপুরুষে মন মজে গেলে শত চেষ্টাতেও আর ছাড়ানো যেত না। সে প্রেম এতই শক্তিশালী। কত চেষ্টা হুমকি কাকুতি-মিনতিতেও চিঁড়ে ভেজেনি। শেষে তার মাশুলও দিতে হত অনেক সময়। ‘সোমপ্রকাশ’-এ (২৫ নভেম্বর ১৮৬৭) পড়া বিক্রমপুরের মুন্সীগঞ্জের সেই মেয়েটির যা হাল হয়েছিল আর কী! কোরহাটির মাল সম্প্রদায়ের একটি লোকের স্ত্রী অনেক দিন ধরে ব্যভিচারে লিপ্ত। স্বামী মাল তাকে বুঝিয়েও ব্যর্থ হন বার বার। তার প্রেমে কোনও খাদ ছিল না। ‘প্রীতির কোন প্রকার’ নাকি ‘বৈলক্ষণ্য হয় নাই’! মহিলা দু’-তিন বার তার উপপতির সঙ্গে প্রস্থান করেছিলেন। ‘হতভাগ্য’ মাল তাকে প্রবোধ দিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন, ‘সন্তোষার্থ’ দু’-তিন হাজার টাকার গয়নাও দেন। কিন্তু মহিলা ফিরতে চান না। এর পর এদের এক ছেলে মারা গেলে মাল শ্মশান থেকে ফিরে স্ত্রীর চরণে নত হয়ে তাকে বলেন, সে যদি এই ‘দুষ্ক্রিয়া হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া’ তার বাড়িতে বাস করে, তা হলে সে পুত্রশোক ভুলতে পারে। তাতেও কাজ হয়নি। মাল অবশ্য তার স্ত্রীকে হত্যা করেনি— ‘ক্রোধ সম্বরণ করিতে না পারিয়া ছুরিকাদ্বারা সেই কুলনাশিনী ব্যভিচারিণীর নাসিকাচ্ছেদন করে।’
তবে স্বামীর ঘরে সুখ না পেয়ে মেয়ের ব্যভিচার সে কালে মেয়ের বাপেও মানতে পারেনি। হাওড়ার এই ঘটনাটি যেমন। সম্ভবত ইছাপুর নবাবগঞ্জের গঙ্গারাম স্বর্ণকারের মেয়ে ১৬ বছরের যাদুমণি ব্যভিচার দোষে দূষিতা হয়। পীতাম্বর চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তি সেখানে বাড়ি ভাড়া করে থাকত। তাকেই ‘স্বীয় ব্যভিচার ব্রতে ব্রতী অর্থাৎ উপপতি করিয়া গোপনভাবে বৎসরাবধি স্বরাসে’ থেকে ‘স্বকার্য্য সাধন’ করছিল। কিন্তু প্রণয় প্রকাশ্যে এসে যায়। স্বামী তো বটেই, আত্মীয়স্বজন, মেয়ের বাবাও প্রবল বাধা দেন। এ সব দেখে মেয়েটি উপপতির সহযোগিতায় ‘স্বর্ণরৌপ্যের বহুবিধ অলঙ্কার ও বস্ত্রাদি সংগ্রহ করত আপন মাতুলানী সত্য নাম্নী কুলকামিনীকে’ সঙ্গে নিয়ে উপপতির বাড়ি রওনা দেন। কিন্তু ভিলেন তো বাবা স্বয়ং। তার পর কী হল?— ‘জিলা হাবড়ার অন্তঃপাতী থানা রাজাপুর এর অধীন সেহাখালা গ্রামের নিকটবর্তী রাজপথে আসিবার সময়ে উক্ত কামিনীর পিতা ওই স্থানে উপস্থিত হইয়া উহাদিগকে হস্তগত করিবার মানসে চৌকিদারের দ্বারা ধৃত করাইয়া সেহাখালার ফাঁড়িদ্বারের নিকট লইয়া যাওয়াতে দূরাত্ব যবন ফাঁড়িদ্বার ঐ দ্বিচারিণী নারিদ্বয়কে এক গৃহ মধ্যে আবদ্ধ করিয়া...’ উদ্ধৃতাংশে ‘দূরাত্ব’ সম্ভবত দুরাত্মা।
এর পর ফাঁড়িদ্বার এবং দারোগাও টাকা পয়সা সোনা রূপা খাওয়ার চেষ্টা করে। সফলও হয়। তবে শেষ অবধি আর পালানোটা হয়নি। (সংবাদ প্রভাকর, ১২ জুন ১৮৫৬)।
কিন্তু তাতে কী এল গেল? বঞ্চনা, অনাদর, অপ্রাপ্তি আর অবহেলা থাকলে মনের দেওয়া-নেওয়া তো চলবেই। টিটকিরি তো সর্বকালেই মানুষ দেয়, দেবে— ‘ছদ্মবেশী’-র সেই গানের মতো ‘কেয়া শরম কি বাত/ ভদ্দর ঘর কা লেড়কি ভাগে ডেরাইভার কা সাথ’ও হবে— প্রেম কি আর এত শ্রেণি, বর্ণ, জাত, কুলের ন্যায়শাস্ত্র মেনে চলে! ভালবাসার, ভরসার মানুষের সন্ধানে মেয়েরা বার বার ঘর পাল্টাতেও পিছপা হতেন না। আবার ঘর পাল্টেও সবাই শান্তি পাননি। পঞ্চানন মণ্ডলের ‘চিঠিপত্রে সমাজচিত্র’য় আছে লক্ষ্মী বেওয়ার কথা। স্বামীকে ছেড়ে প্রথম ঘর বাঁধে রামলোচন রায়ের সঙ্গে। ১৮২৪-এর ঘটনা। তাকেই লিখেছে, ‘তোমার সহিত আসনাই (প্রেম) করিয়া গিরস্থ হইতে তেআগ করিয়া আমি তোমার সঙ্গে ছিলাম... পর্দা পোসে (সম্ভ্রমেই) রাখিয়াছিলে... তথাপি অন্য আচরণ করিআ বেলডাঙায় কার্তিক চক্রবর্তীর অহিত আসনাই করিয়াছি...’ কিন্তু তাতেও শান্তি পাননি। তাই এ বার ‘বৈরাগ্য আশ্রম’ নিতে চান। দু’বারেও মনের মানুষ পেলেন না।
তবু আশায় বাঁচা, অপেক্ষায় থাকা। লালনের গানের মতো, মিলনের আশায় মনের মানুষকে খুঁজে বেড়ানো। তার ‘চরণদাসী’ না হতে পারলে তো জীবন বৃথা, কেবল গুমরে মরা। পড়ে থাকে শুধু আফসোস আর আফসোস।